কবিতাবিহীন জীবন

কবিতাবিহীন জীবন -- পেটার হান্‌ট্‌কে | অনুবাদ: মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

পেটার হান্‌ট্‌কে

 

২০১৯-এ সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার পেলেন পেটার হান্‌ট্‌কে। যদিও তাঁর এই পুরস্কারপ্রাপ্তি নতুন করে একটি পুরনো বিতর্ককে সামনে তুলে এনেছে। পেটার হান্‌ট্‌কে একসময় খোলাখুলিভাবে যুগোস্লাভিয়া ও সার্বিয়ার যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারী মিলোসেভিচ সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থেকেছিলেন। পেটার বলেছিলেন নব্বইয়ের দশকে বল্কান যুদ্ধের সময় সারাজেভোর মুসলিমদের নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বই তাদের হত্যার জন্য দায়ী, সার্বদের এতে কোনও হাত নেই। পেটারের এই রাজনৈতিক মত সেইসময় রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক মহলে আলোড়ন তুলেছিল। সুইডিশ নোবেল কমিটির পেটারকে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা আবার এই পুরনো বিতর্ক সামনে নিয়ে এনেছে। নোবেল পুরস্কারের যোগ্যতামান নির্ণয়ে লেখকের সাহিত্য প্রতিভার বিচারের পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক মতকেও একইরকম গুরুত্ব দেওয়া উচিত কিনা, সেই প্রাচীন প্রশ্নটি আরেকবার তুলে এনেছে। সলমন রুশদি-সহ একগুচ্ছ বিশিষ্ট সাহিত্যিক নোবেল কমিটির এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছেন।

কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রনির্মাতা পেটার-এর জন্ম অস্ট্রিয়ার গ্রিটেন-এ, ১৯৪২-এ। তিনি আইন নিয়ে পড়াশুনো করলেও তাঁর গভীর অনুরাগ ভিটগেনস্টাইনের ভাষাতত্ত্বে। ১৯৬৬ সালে বেরোয় তাঁর প্রথম উপন্যাস, সেই বছরই ফ্রাঙ্কফুর্ট-এ প্রথম অভিনীত হয় তাঁর নাটক 'দর্শকদের চটিয়ে দেওয়া'। 'স্বয়ং-সোপর্দ' আর 'কাসপার' তাঁর আরও দুটি চমকপ্রদ নাটক। ষাটের দশকের মধ্যভাগে তাঁর নাটকের প্রভাব বা অভিঘাত ইউরোপে সেইরকম হয়েছিল, পঞ্চাশের দশকে ঠিক যেমন প্রভাব বিস্তার করেছিল সামুয়েল বেকেটের নাটক। হান্‌ট্‌কের প্রথম কবিতার বই 'অন্তর্জগতের বহির্জগতের অন্তর্জগৎ' (১৯৬৯), এবং পাঁচ বছর পর বেরোয় দ্বিতীয় কবিতার বই 'অর্থহীনতা আর সুখ' (১৯৭৪)। এই নতুন কবিতার বইটিতে হান্‌ট্‌কে আরও প্রত্যক্ষ অথচ সূক্ষ্মভাবে তাঁর বক্তব্যকে উপস্থিত করার উপায় আবিষ্কার করেছেন— এবং তেমনি নাটকীয়ভাবে। তিনটি দীর্ঘ ও পরস্পর-সংলগ্ন কবিতায় তিনি অর্থহীনতা ও সুখের প্রসঙ্গকে ক্রমগভীর স্তরান্বয়ে সাজিয়ে হাজির করেছেন এবং বিশদ করেছেন। রচনার ভঙ্গি সাঙ্গীতিক, তিনটি জটিল ও বহুস্বরঘাতিক আন্দোলন। প্রথমটি অন্তরঙ্গ ও মমত্বময়, দ্বিতীয়টিতে সন্ধিক্ষণ, তৃতীয়টি যুগপৎ বেদনায় অস্থির ও প্রচণ্ডভাবে হাস্যকর— অথচ সেইসঙ্গে আধুনিক বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কারিগরি বিদ্যার অমোঘ অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত সমাজে একটি বিচ্ছিন্ন মানুষের বেঁচে থাকার মানে খোঁজার, মাথা-কোটার চেষ্টায় আর্ত, উন্মাদক ও স্পর্শাতুর।

আলোচ্য বইটির প্রথম কবিতাটি পাঠকের জন্য পুনঃপ্রকাশ করল চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, নভেম্বর ২০১৮ সংখ্যার স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে। পেটার হান্‌ট্‌কের বইটি যখন অনুবাদ করেছিলেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অ্যাকাডেমিয়ার বাইরের সাধারণ বাঙালি পাঠক সম্ভবত পেটারের নামও শোনেননি। 'অর্থহীনতা আর সুখ' বইটি ২০১০ সালের বইমেলায় পুনঃপ্রকাশ করেছিল কবিয়াল। বর্তমান কবিতাটি কবিয়াল-এর সম্পাদক মিতুল দত্তের সহযোগিতা ও অনুমতিক্রমে প্রাপ্ত ও প্রকাশিত হল।

 

আ.-র জন্য, ভবিষ্যতের উদ্দেশে

এই হেমন্তকাল কেটে গেলো প্রায় আমাকে বাদ দিয়েই
আর আমার জীবন দাঁড়িয়ে রইলো অনড় ঠিক সেই সময়কার মতো
যখন আমার এতই মনখারাপ ছিলো যে
আমি টাইপ-করা শিখতে চেয়েছিলুম
আর সন্ধেগুলো অপেক্ষা ক’রে কাটিয়েছিলুম জানলাবিহীন ছোটো ঘরে
শেখানো শুরু হবার জন্য
নিঅনটিউবগুলো গর্জন ক’রে উঠছিলো
আর ঘণ্টার শেষে
প্লাস্টিকের ঢাকাগুলো আবার টেনে দেওয়া হচ্ছিলো টাইপরাইটারগুলোর ওপর
আমি আসতুম আর যেতুম আর
নিজের সম্বন্ধে কিছুই ব’লে উঠতে পারতুম না
নিজেকে আমি এতটাই সিরিয়াসভাবে নিতুম যে আমি তা লক্ষও করেছিলুম
কোনও মরিয়া হতাশা ছিলো না আমার ছিলো নিছকই অসন্তোষ
নিজের সম্বন্ধে কোনও অনুভূতিই ছিলো না আমার কোনও অনুভূতি
ছিলো না অন্য কোনও কিছুরই জন্য
আমি হেঁটে বেড়াতুম আর দাঁড়িয়ে পড়তুম উদ্দেশ্যহীন
মাঝে-মাঝে পালটে ফেলতুম চলার গতি আর দিক
একটা রোজনামচা রাখতে চেয়েছিলুম আমি
যার সর্বস্ব ছিলো মাত্র একটাই বাক্য
‘আমি বরং পছন্দ করবো নিজেকে কোনও ছাতার গায়ে ছুঁড়ে ফেলতে’
আর এমনকি তাকেও আমি লুকিয়ে রেখেছিলুম দ্রুতলিখনের সংকেতচিহ্নে
চার সপ্তাহ ধ’রে রোদ ঝলসাচ্ছে
আর আমি ঠায় ব’সে আছি বারান্দায়
আর যা-কিছু আমার মনে খেলে যায়
আর যা-কিছু আমার চোখে পড়ে
তাদের সবাইকে উদ্দেশ ক’রে আমি শুধু ব’লে উঠেছি ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ’

দিনগুলো হ’য়ে উঠেছিলো একেবারে মফঃস্বলের মতো
আর বন্ধুরা যারা সাধারণত কাজে-কর্মে ব্যস্ত থাকতো
আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতো আর আমার সঙ্গে বসতো এসে
বারান্দায়
‘কাজের জায়গা আমরা কেবলই ভুলে যাই
জীবনের কথা’
তারা বলতো
কিন্তু মফঃস্বলের কোনও ভদ্রলোকের ভূমিকায় অভিনয় করা
আমার পক্ষে মোটেই সম্ভব হ’তো না
আর বেড়িয়ে-টেড়িয়ে তারা ফিরে যেতো
তাদের কাজে-কর্মে আরও তৃপ্ত

সময়টা ছিলো নিসর্গের
আর শুধু যে কুঁড়েরাই তার ভক্ত হ’য়ে পড়েছিলো তা নয়
ব্যাবসাদাররা যারা বড্ড জড়িয়ে থাকে
পণ্য আর টাকাকড়ির হাতবদলে
খেদের কথা বলতো
এই রকম ‘এমন-একটা দিনেও কিনা ব্যাবসা করতে হবে’
আর আমি তাদের বিশ্বাস করতুম
(তারা নিজেরা যতটা-না করতো তার চেয়ে ঢের বেশি)
কিন্তু যখন এক ভাড়াটে-গাড়ির চালকের হৃদয়টা
আমার সামনে ঝ’রে পড়লো ডাঙার দৃশ্যের রংবদলের মধ্যে
আমি মেজাজ দেখিয়ে বললুম
যে কোনও ভাড়াগাড়ি এনে পৌঁছে দেবার সময়টুকুর জন্য
টাকা চাওয়া বেআইনি

আমি দিনটার মধ্যেই থাকতুম দিনটার বাইরেও থাকতুম
কোনওকিছুর প্রতিই আমার নজর ছিলো না
অন্য-কারো চাকরিবাকরি ব্যাবসাকেও আমি ঈর্ষা করিনি
আলস্যবশতও নয়
ঔদাসীন্যবশতও নয়
বরং আমার নিস্ক্রিয়তা তার তুলনায়
তখনও আমার কাছে অর্থময় ব’লে বোধ হচ্ছিলো
আমার সেই নিস্তেজ আলস্যে
নিজেকে আমি অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ব’লে বোধ করেছিলুম
তা যে কোনও সাহায্য করেছিলো তা নয়
কারণ আমি যদিও আমার অবস্থাকে একটা কিছুর লক্ষণ ব’লে ভাবছিলুম
আমিই ছিলুম একমাত্র যার কোনও মানে ছিলো আমার কাছে
এটা আর এই-যে নিজেই জানি না যে আমি ঠিক কী চাই
আর এই-যে সারাদিন ধ’রে আমি কেবলই দুঃখী বোধ করি এই জন্য–
বেশির ভাগ সময়েই আমি তাকিয়ে থাকতুম মেঝের দিকে
আমার মগজটা শুধু সেই একই পুরোনো ভাবনাগুলো খেলিয়ে যেতে থাকতো
‘বাসেল এস.বি.বি.’ আমি পড়েছিলুম বোর্ডে লেখা আছে
সেনট্রাল রেলওয়ে স্টেশনে
‘হাগো বাসেলের গায়ে’ তক্ষুণি আমি ভেবেছিলুম আর
এসকালেটরে চেপে উঠে গিয়েছিলুম ডাকঘরে
এক পাও না-হেঁটে

উষ্ণ একটা দিন
একটা কনকনে-ঠান্ডা রাত
‘রোজই আমার ছেলেমেয়েরা শিশুবিতান থেকে নতুন-নতুন গান নিয়ে আসে’.
বললেন এক প্রতিবেশী
‘এখনও কিনা আজ আমার হাতে অনেক কাজ প’ড়ে  আছে’
বললেন আরেকজন
‘যতই আমি ভাবি ততই হাওয়া হ’য়ে ওঠে সাইবেরিয়ার
যা আমার মাথার মধ্য দিয়ে ব’য়ে যায়’
আমি পড়েছিলুম জেমস হ্যাডলি চেজ-এ
খবরকাগজগুলোয় সবকিছুই দাঁড়িয়েছিল শাদার ওপরে কালো
আর সব ব্যাপারকেই একেবারে গোড়া থেকে বোধ হচ্ছিলো
কোনও ধারণার মতো
কেবল সাহিত্যসংস্কৃতির পত্রিকাগুলোই শুধু
তখনও দাবি করছিলো প্রত্যয়গত প্রচেষ্টা
কিন্তু সংস্কৃতিবাদীদের প্রত্যয়গত প্রচেষ্টাগুলো
শুধু-তো ছিলো নিছকই পরদার নৃত্য
অন্য-সব নৃত্য পরদার সামনে
উপন্যাস হবে ‘রগরগে’ আর কবিতা ‘চটপটে’
টাকা নিয়ে যারা লড়ে সেই ভাড়াটেরা পথ হারিয়ে এসে পড়েছে
ভাষার মধ্যে আর দখল ক’রে বসেছে
সব ক-টা শব্দ
তারা পরস্পরকে ঘুষ দেয় চোখ রাঙায় আর কাজে খাটায়
প্রত্যয়গুলোকে
সংকেতবাক্য হিসেবে ব্যবহার ক’রে
আর আমি ক্রমশই আরও বেশি ভাষাহারা হ’য়ে উঠছিলাম

কাউকে ভালোবাসা জরুরি ছিলো আমার
কিন্তু যখন আমি সব খুঁটিনাটিসমেত ব্যাপারটা কল্পনা ক’রে নিলাম
আমি কী-রকম দ’মে গেলুম
‘মান ওনে আইগেনশাফটেন’[1]-এ আমি এই বাক্যটায় এসে পৌঁছোলাম
‘উলরিখ মানুষকে পরীক্ষা ক’রে দেখলো’
(‘মানুষ’ মুজিলও বুঝিয়েছিলেন
অতিশয় অবজ্ঞার সঙ্গে)
যখন গা-গুলিয়ে-ওঠা আমাকে বাকিটুকু পড়া থেকে থামালো
হয়তো আমার দশা যে ভালোর দিকে চলেছে
এটা তারই লক্ষণ

মাঝে-মাঝে আমার বাচ্চাটার কথা মনে প’ড়ে যেতো
আর আমি তার কাছে যেতুম
কেবল এইটেই দেখাতে যে আমি এখনও ওখানে আছি
আমার যেহেতু অপরাধবোধ ছিলো এতই প্রবল
আমি তার সঙ্গে খুব স্পষ্ট ক’রে কথা বলতুম
একবার আমি তাকে জড়িয়েও ধরেছিলুম
যখন সে ‘কিন্তু’ শব্দটা
ব্যবহার করেছিলো একটা মস্ত বাক্যের মধ্যে
তারপর আমি তাকে খুব বকলুম
কারণ তার হেঁচকি শুরু হয়ে গিয়েছিলো

গ্রীষ্মকালে সেই সময়টায়
যখনও ঘাস ছিলো নিবিড় আর লম্বা
রংবেরঙের খেলনা পড়েছিলো তার ওপর ছড়ানো
আর কে যেন বলেছিলো
‘ওটা প’ড়ে আছে ঘাসের মধ্যে কোনও শিশুর স্বপ্নের মতো’
(ওটা লেখার আগে
আমাকে মনে-মনে খুব একচোট হেসে নিতে হয়েছিলো
কিন্তু এটা তো তথ্যের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যায়- এবং কোনও প্রত্যয়গত প্রচেষ্টা ছাড়াই)

‘আমি প্রায় সময়েই সুখী থাকতুম’
বলেছিলেন এক রূপসী বর্ষীয়সী মহিলা
যিনি ফরাশের ওপর ব’সে
তাঁর ব্লাউজের তলার কাঁধে হাত বোলাতে ভালোবাসতেন
প্রায়ই কতবার?

আমার বোন এসেছিলো অস্ট্রিয়া থেকে
আর এসেই সব ঝাড়পোঁছ করতে
আর চাইলো গৃহস্থালিতে কোনও শৃঙখলা আনতে
মেজাজ খারাপ ক’রে আমি দেখতুম
কেমন ক’রে সে আমার চায়ের পেয়ালা কানায় কানায় ভ’রে দেয়
তারপরেই আমার মনে প’ড়ে গিয়েছিলো গরিবরা সবাই
তাদের অতিথিদের আপ্যায়ন করতে গিয়ে তা-ই করে
আর আমার এত কষ্ট হয়েছিলো যে নিজেকেই আমার অচেনা ঠেকছিলো
(ঠিক তারপরেই আমার মনে পড়েছিলো
কীভাবে আমি একবার রাগী চোখে তাকিয়েছিলুম আমার মায়ের দিকে
যখন একটা বীটলস[2] রেকর্ডের গানের তালে-তালে
আস্তে আস্তে তাঁর মাথা নেড়েছিলেন তিনি)

পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় আমি ছিলুম না
অন্যদের সঙ্গে শুরু করেছিলুম এক শিশুবিতান
দরখাস্ত পাঠিয়েছিলুম সদস্যপদের জন্য
একটা ক্লাবে
কিন্তু সে-সব ছিলো আমার ঢুলুনির মধ্যে নিছকই কতগুলো ভূষণ
যেমনভাবে কোনও বাচ্চা তার গু মাখে মেঝের ওপর

কিছু-কিছু লোকের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছি আমি
গোড়ার দিকে আমরা পরস্পরের কাছে
কেবলই আউড়ে যেতুম সে-সব কথা যা আগেই বলা হ’য়ে গেছে
পরস্পরের স্মৃতি ঝালিয়ে নেয়ার জন্যে
আমি কথা বলতুম এমনভাবে যেন আমি সবসময় প্রমাণ করতে চাচ্ছিলুম যে আমি
কোনও শ্রোতার কাছে মোটেই ক্ষতিকর নই

আমার ঘাড়ে আড় ধ’রে গেলো
আর যখন মনে হ’লো যথেষ্ট হয়েছে আর নয়
আমি কিন্তু ফিরে যাইনি
বরং শুধু একটু এপাশ-ওপাশ তাকিয়েছি
‘নাও শোনো ঐ কথা’ বেন[3]
‘লুক হোমওয়ার্ড এনজেল’-এ বলেছিলো
ফাঁকা কুঠুরিটাকে লক্ষ্য ক’রে
হুবহু তার মতোই ছিলো ব্যাপারটা
আর এইসব বোধহীন হৃদয়হীন কিচিরমিচির
আমাকে এতটাই ভড়কে দিয়েছিলো
যে আমি পরে আর একটা বইও পড়তে পারিনি

এই একঘেয়ে-ঝলমলে হৈমন্তী জগতে
লেখাটাকেও আমার মনে হ’তো অর্থহীন
সবকিছুই আমাকে এতটাই চেপে ধরেছিলো
যে এমনকি অমূলকল্পনার উপহারটাও আমি হারিয়ে বসেছিলুম
নিসর্গের এই বাহির-জমকালো মহিমার সামনে
আর-কোনও কল্পনার বালাই-ই কোথাও ছিলো না
আর রোজকার এইসব প্রভাবের যোগফলের একঘেয়েমির মধ্যে
বিশেষ-কিছুই আমাকে নাড়া দেয়নি
‘না আমার কোনওই কামনা নেই’ আমি বলেছিলুম
আর তাই আমি বাচ্চাদের ইচ্ছেগুলোকেও বুঝতে পারিনি
অন্ধের মতো আমি মদের গেলাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতুম বিকেলগুলোয়
ভবিষ্যতে কী হবে আমাকে তা ভাবার অধিকার দেয়া হয়নি
ভাবনাগুলো সব শুকিয়ে কুঁচকে যেতো মুহূর্তেই
এমনই অনুভূতিহীন ছিলো তারা
আর প্রায় কোনও ঘণ্টাই কাটেনি যাকে আমি শুনিনি
‘তবু পিপাসায় গলা শুকিয়ে মরার চেয়ে ভালো’
আমি ভেবেছিলুম একবার

রোজ রাতেই আমি টি-ভি চালিয়ে দেয়া স্থগিত রাখতুম
সরক্ত রাজনীতিবাজেরা লুকিয়ে রেখেছিলো তাদের রক্ততৃষা
ভোটের অভিযানের সময় এক অঃনিশেষ ভয়াবহ মৃদুহাসির আড়ালে
অবিশ্বাসীদের কাছে যাকে মনে হবার কথা ছিলো মঠসন্ন্যাসীর প্রসন্নতা
(তিনি আসলে তাদের কাছে এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন হাতের চেটোয় বসা চড়ুইদের সঙ্গে কথা বলছেন)
আর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা
আর গায়ক-গায়িকারা
আর ক্যামেরার ছবিগুলো খেলাতো
দর্শকদের জন্য
আবেগ-অনুভূতির বেহেস্তকে
যেখানে মানবতার প্রতিচ্ছবি ছিলো এত বিকিকিনির যোগ্য
আর হৃদয়স্পন্দন এত বাতিল ক’রে দেবার যোগ্য
আর সহানুভূতির অভিব্যক্তিগুলো ছিল এমনই পুতুলসাজানো
যে আমি হাগতে যাবার তাড়া অনুভব করছিলুম

খবরকাগজগুলোয় আমি পড়েছিলুম যে একজন ধনী
অভিজাত ব্যাঙ্কারের স্ত্রী নাকি বলেছেন
‘এই সরকারের অধীনে ধনীরা আরও-ধনী হ’য়ে উঠছে
আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না বটে
তবে আমার স্বামী এতে রাগে অগ্নিশর্মা হ’য়ে উঠেছিলেন’
এটা আমাকে দারুণ প্রফুল্ল ক’রে তুলেছিলো উদ্ভটভাবে

একবার এক তরুণী বসেছিলো আমার সামনে
এত সুন্দর
আর আমি ভেবেছিলুম
‘আমাকে তার খুব কাছে যেতে হবে
যাতে তার রূপ নিজেকে খুলে দেখাতে পারে’
কিন্তু সে শুকিয়ে কুঁচকে গেলো
যখন আমি তার কাছে গেলুম

যখন আমি ঝকঝকে দিনের আলোয় সমভূমি থেকে উত্তরে শহরের দিকে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলুম
মিট্‌টেলগেবির্‌গে-র কাছে নীল আকাশ এমনই কালো হ’য়ে গিয়েছিলো
যেন তার পরেই আছে রাত্রির সীমান্ত
একটা ঝড়ঝঞ্ঝার ভাব ছিলো সেখানে কোনও ঝোড়ো মেঘ ছাড়াই
ঝকঝকে দিনের আলোয় তা চোখ ঢেকে দিয়েছিলো
আর সার-সার করাতের ধাতব চীৎকার আমাকে কোনও দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো
শহরতলির ছেলেমেয়েরা রাস্তায় রোলারস্কেট করছিলো
‘তোর মা কোথায় রে?’ শুনলুম চাকাপায়ে গড়িয়ে যেতে-যেতে একজন চেঁচিয়ে বললো
‘মা গেছেন সুপারমারকেটে’
আর আমার জীবনযাপনের ধ্রুববাক্যের মতো শুনিয়েছিলো সেটা
আর আমি ক্ষণিকের জন্য উৎফুল্ল হ’য়ে উঠেছিলুম
টেলিফোনের বুথে গিয়ে আমি পুরোনো পরিচিতদের ফোন করলুম
যে-বান্ধবীদের কথা আমি জিগেস করেছিলুম তারা কেউই অনেকদিন হ’লো এখানে আর নেই
ঠিক তখন যেন ক্রমেই বেশি লোকে একা-একা জীবন কাটাচ্ছিলো
আমি ফরাশ থেকে কিছু গুঁড়ো কুড়িয়ে নিলুম
বাইরে বারান্দায় গ্রীষ্মকালে বাগানে জল দেবার নলটা প’ড়ে আছে তখনও
একটা আকুয়াভিটের গেলাশ হঠাৎ আমার হাত লেগে উলটে গেলো
ঠাণ্ডা আকুয়াভিট চুঁইয়ে পড়লো
টেবিলের ধারে ফুলে উঠলো
টপটপ নীচে না ঝ’রেই
মাছিগুলো ঢিপঢিপ ম’রে গেলো সবখানে অনিচ্ছাসত্ত্বেও
আমি তাদের তুলে-তুলে ময়লার ঝুড়িতে ফেললুম
যখন জলের কল খুললুম
আমি সবসময়েই ধরতে পারি ক্লোরাইনের অবদান
যা নাকি প্রতি দশ মিনিট অন্তর যোগ করা হয়
আর সূর্যাস্তের সময়
যখন আমি ডাকবাক্সের দিকে হেঁটে গেলুম
অ্যাসফল্টে আমার চোখ এতটাই ধাঁধিয়ে গেলো যে
আমাকে হাত তুলে চোখ ঢাকতে হ’লো
যাতে আমার দিকে এগিয়ে-আসা কালো-কালো মূর্তিগুলোকে আমি সম্ভাষণ জানাতে পারি
অবশেষে তারপর সন্ধেবেলায়
কোনাকুনি-উলটোদিকের তিনকোনা ছাতওলা বাড়িটায়
EDEKA নামটি ঝলশে উঠলো
সান্ত্বনার মতো হলদে
আর আমি বেরোলুম বাজার করতে
দোকানটা এতই উজ্জ্বল আর চুপচাপ
ম্যানেজার রসিদ গুনছে
ফ্রিজারগুলো গুনগুন করছে প্রিয়ম্বাদী
আর এই তথ্য যে যে-চাইভগুলো আমি কিনেছিলুম
তা একটা রাবারব্যান্ড দিয়ে গোছা করা ছিলো
বস্তুত আমাকে এতটাই নাড়া দিলো যে চোখ ফেটে জল বেরুবে বুঝি
অনেক পরে রাতে
যখন আমি নিজের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে ব’সে আছি আমার নিঃশব্দ ঘরে
মেঝের ওপর গিটারটা হঠাৎ বেজে উঠলো
একটা মাছি
তার ওপর বুকে হেঁটে গেছে
তারপর রাতে
আমি ঘুমিয়ে পড়লুম পাশে বাগানের পাতা ছাঁটার কাঁচি
ছিলো এক পূর্ণচাঁদ
আর বাচ্চাটা ছটপট করছিলো কাঁপা-কাঁপা হাতে
ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলো তার বিছানায়
যখন আমি চোখ বুজি তখন কেবল একটা একটা ক’রেই তাদের আমি আবার খুলতে পারি
হ্যাঁ এককালে আমিও জানতুম কেমন ক’রে আমার বাঁচা উচিত
কিন্তু এখন সবই বেমালুম ভুলে-যাওয়া গেছে
এখন এমনকি কোনও পাদকেও আমার আর
কোনও শারীরিক ক্রিয়া ব’লে মনে হয় না

‘সত্যি আমি ভারি খারাপ আছি
জানি যে এইভাবে কারু থেমে-যাওয়া মোটেই উচিত নয়
কিন্তু আর-কোনও বিকল্পই নেই’
–প্রত্যয়গুলোর স্পীডি গন্‌জালেস—
আমি থামতে চেয়েছিলুম
এমনকি লিখতে শুরু করার আগেই
তারপরেই আত্মপ্রকাশের
ধৃষ্টতায়
যা আগেই ভেবে ঠিক করা হয়েছিলো হ’য়ে উঠলো আরও-ভয়ানক
শব্দের পর শব্দে
আর বস্তুত একটা ঝাঁকুনিতেই
আমি আবার জেনে গেলুম আমি কী চেয়েছিলুম
আর আবার জগতের জন্য উৎসুক বোধ করলুম আমি
(ছেলেবেলায় যখন জগতের জন্য অনুভূতি আমাকে জিতে নিয়েছিলো
আমি শুধু একটা কামনাই বোধ করেছিলুম কিছু লেখা
এখন জগতের জন্য এক কবিত্বময় আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে সচরাচর
ঠিক যখন আমি কিছু লিখে ফেলি)
‘আবার কিছু অনুভব করছি আমি’ আমি ভাবলুম
কিন্তু এটা তো নিছকই মনের একটা হড়কানি
আর ভাবলুম ‘আবার পড়ছি ধপ্‌ আমি’

গত কয়েক দিনে
প্রকৃতি গান হ’য়ে উঠেছে
তার সৌন্দর্য হ’য়ে উঠেছে মানুষী
আর তার মহিমা এত নিবিড় অন্তরঙ্গ
খুশিতে পা ছপছপিয়ে চললুম আমি ঝরা পাতার মধ্য দিয়ে
একটা গন্ধামাখানো পুড্‌লের পেছন পেছন হাঁটলুম
ঝোপঝাড় ন’ড়ে উঠলো
যেন কোনও কৌশলী অভিযানে বেরিয়েছে সৈন্যরা
আত্মগোপন ক’রে আছে তাদের পেছনে তাদেরই মতো সেজে
গাঢ়-বাদামী দেবদারুরা দাঁড়িয়ে আছে জন্তুর মতো শরীরী
জানলার সামনে
আর এক জায়গায় ভয়ধরানো ভূদৃশ্যটির মাঝখানে
বার্চপাতাগুলো ঝকঝক ক’রে উঠলো এত উজ্জ্বল
যেন কোনও কষ্টের চীৎকার
‘উঃ!’ আমি ভাবলুম
আরও-দূরে ধোঁয়া ভেসে যাচ্ছে বাড়িঘরের আড়ালে
আর সামনের টি-ভি অ্যানটেনাগুলো হ’য়ে উঠেছে স্মৃতিস্তম্ভ
রোজ তুমি দেখতে পাও পাতার ফাঁক দিয়ে আরও বেশি ডালপালা
শেষবার ঘাস কাটার পর কোথাও-কোথাও এখন আবার ঘাসের ডগা গজিয়ে উঠেছে
এত অন্তরঙ্গভাবে ঝলমল করছে
যে আমি পৃথিবীর অবসান আসন্ন ভেবে আঁৎকে উঠলুম
এমনকি বাড়িঘরের সদরও
মৃদু-মৃদু হেসে উঠলো আমার মানুষী প্রতিবিম্বের মধ্যে
‘এত কষ্ট লাগে এতে!’ শুনলুম এক মহিলা আকাশে জেটবিমানের ধোঁয়ার পুচ্ছ দেখে বলছেন
সন্ধের দিকে অন্য বাড়িগুলোর রান্নাঘর থেকে খাবারের গন্ধ এলো
আর বাচ্চাটি সবসময়েই একবারে-দ্বিতীয়-দফা কিছু চাইবার মতো খিদেয় কাতর হ’য়ে পড়ে
‘এর মধ্যেই ওখানে ছায়ার মধ্যে ঠাণ্ডা প’ড়ে গেছে’
আমি সত্যি লিখেই চললুম
বললে দীর্ঘচাপাপড়া সবকিছু
আর তারপর আক্ষরিকভাবেই ভাবলুম
‘তো এখন তাহ’লে জীবন কেটে যাবে’
রাস্তার বাতির বদল দেখে আঁৎকে উঠে
অতিথি মজুরনিটি
ডোরাকাটা জেব্রার ওপর দিয়ে ত্রস্ত ছুটলো
দোকানের মেয়েরা তাদের পেছন উঁচিয়ে আছে
পাৎলা ব্লাউজে
হাতে হাত ধ’রে ছুট লাগালো রাস্তা পেরুতে
একটা ফোনবুথের তুহিন কাচের আড়ালে
কোনও মা তার বাচ্চার গালে চড় কষালেন
লেখার জন্য কী গর্বই না ছিলো আমার!

 


[1] রোবের্ট মুজিল-এর বৃহৎ উপন্যাস ‘নির্গুণ মানুষেরা’; ইংরেজি তর্জমার নাম ‘মেন উইদাউট কোয়ালিটিজ’।

[2] বীটলসরা, অর্থাৎ জন লেনন, পল ম্যাকার্টনি, জর্জ হ্যারিসন আর রিঙ্গো স্টার, প্রথম নাম করেছিলো আলেমান ভাষায় গান গেয়ে, প্যাঁচপেঁচে সেন্টিমেন্টাল সব গান, জার্মানিতে।

[3] মার্কিন লেখক টমাস উলফের উপন্যাস, তীর্থঙ্কর চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘দি আর্টিস্ট অ্যান্ড দি সিটি’, (১৯৭৮, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়) বইতে যে-সম্বন্ধে আলোচনা আছে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...