কর্পোরেট ঋণ কি এদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের অনুঘটক?

সুশোভন ধর

 

মোদির নির্বাচন— অর্থনৈতিক বৃদ্ধির চাবিকাঠি

লন্ডনে অবস্থিত এক তথ্য সরবরাহকারী সংস্থা আইএইচএস মার্কিট-এর (IHS Markit) মতে, ভারত এই বছরে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। ছাপিয়ে যাবে তার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শাসক যুক্তরাজ্যকে, এবং ২০২৫-এর মধ্যে জাপানকে টপকে এশিয়া-প্যাসিফিকের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে মোদির পুনর্নির্বাচন শিল্পমহলে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে। সকলেই ভাবছেন যে এবার বোধহয় কিছু একটা হবে। তার বিজয় উদযাপন করতে ভারতীয় শেয়ার বাজারের সূচকগুলি, যেমন বিএসই সেনসেক্স, নিফটি, ইত্যাদি উচ্চতার শিখর ছুঁয়েছিল। আরও বেশি “শিল্প-বান্ধব” সরকারি নীতির আশায় বুক বেঁধেছিল এদেশের পুঁজিপতি ও তাদের সৈন্য-সামন্তরা। যদিও নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার অব্যহতি পরেই শেয়ার বাজার ঝিমিয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে কর্পোরেট সংস্থাগুলির জন্য বহুল কর ছাড়ের ঘোষণা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নিকরণ (পড়ুন ব্যক্তি পুঁজির হাতে জলের দামে তুলে দেওয়া), শ্রম-আইন সংশোধন, ইত্যাদি ঘোষণার ফলে বাজার একটু উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যদিও তা এখনও পর্যন্ত গড়িমসি করে চলছে। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন যে মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যা ছেড়ে ফাটকা পুঁজির বাজার নিয়ে এত মাতামাতি শুরু করলাম কেন? আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চাবিকাঠি কোনও কোনও বিশেষ মুহূর্ত ছাড়া সম্মিলিতভাবে পুঁজিপতিদের হাতে থাকে। অতএব আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে তারা কী ভাবছেন তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শেয়ার সহ ফাটকা পুঁজির বাজারের সঙ্গে বাস্তব উৎপাদনের (শিল্প, কৃষি, খনিজ, পরিষেবা, ইত্যাদি) চলন বলনের হুবহু মিল না থাকলেও এই দুইয়ের মাঝে কোনও চিনের প্রাচীর নেই। দ্বিতীয়ত এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শেয়ার বাজার হল পুঁজিপতিদের ভাবনা-চিন্তা, আশা-আকাঙ্খা, হর্ষ-বিষাদ… এই সবকিছুর অভিব্যক্তি ও সূচক। পুঁজিপতিরা তাদের পরিচালিত ব্যবস্থা সম্পর্কে কী ভাবছেন, কোন আশা-নিরাশার মাঝে দোল খাচ্ছেন তা বুঝতে শেয়ার বাজারের উত্থান পতন খুবই ইঙ্গিতবাহী। এছাড়াও বাস্তব অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও দিশা সম্পর্কে, আবছা হলেও, একটা ছবি উঠে আসে ফাটকা পুঁজির বাজারি গল্পে।

এবার মূল কথায় আবার ফেরা যাক। মোদির বিপুল বিজয় পুঁজিপতিদের মধ্যে অবশ্যই আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে। তারা আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন এই ভেবে যে মোদি সরকার গৃহীত নীতিসমূহের ফলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি গতি পাবে, শিল্পসংস্থাগুলির মুনাফা বৃদ্ধি পাবে, বাজার সচল হবে, ইত্যাদি। কিন্তু কোথাও একটা সন্দেহর বাতাবরণ থেকেই যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হল ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, কর্পোরেট সংস্থাগুলির ঋণের বোঝা বৃদ্ধি, তাদের মুনাফা হ্রাস পাওয়া এবং বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা যা কখনও কখনও মন্দা বা এমনকি সঙ্কটের রূপ ধারণ করছে। এবং এই প্রত্যেকটি বিষয় একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

 

কর্পোরেট ঋণ

১৯৯৭-এর পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সঙ্কট বা ২০০৮-এর ইউরোপ-আমেরিকা সহ উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির সঙ্কটের সঙ্গে, এত আগে থেকে, আমাদের অবস্থার তুলনা করতে চাইলে একটু তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে, কিন্তু সামগ্রিক অবস্থা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। ২০১৭ সালে ক্রেডিট সুইস সংস্থার একটি রিপোর্ট ভারতের কর্পোরেট ঋণ নিয়ে সিঁদুরে মেঘের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দেখা যায় যে বহু কর্পোরেট সংস্থা ঋণের সুদ দেওয়ার মতো মুনাফা অর্জন করতে পারছে না। এদের সংখ্যা নেহাতই কম নয় এবং মোট কর্পোরেট ঋণের চল্লিশ শতাংশ এদের হাতে। প্রসঙ্গত বোঝা দরকার যে কর্পোরেট ঋণ পরিশোধ এমনভাবে বিন্যস্ত হয় যার দ্বারা ঋণের আসল ও সুদ ধারাবাহিক কিস্তির মাধ্যমে ঋণদাতা ফেরত পায়। এই কিস্তিগুলিকে বলা হয় অ্যানুইটি পেমেন্ট। এই অ্যানুইটিগুলি এমনভাবে গঠিত হয় যাতে ঋণদাতা প্রথম দিকে তার সুদ বেশি বেশি তুলে নেয়। পরের কিস্তিগুলিতে মূলধন পরিশোধ করা হয়। এই কারণেই ৪০% সংখ্যাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ এক বিপুল সংখ্যক বাণিজ্যিক সংস্থা তলিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত এদের অনেকেই সুদ ফেরত দেওয়ার অবস্থাতেই আটকে থাকবে। ফলত যে অর্থ তারা পরিশোধ করতে পারছেন না তা ব্যাঙ্কের খাতায় অনাদায়ী ঋণ (এনপিএ) হিসাবে পড়ে থাকবে এবং শেষ পর্যন্ত এই লোকসানের ভার ব্যাঙ্কগুলিকে বইতে হবে। ক্রেডিট সুইস রিপোর্ট অনুসারে ৩৭৮ হাজার কোটি টাকার[i] মোট ঋণের দুই-তৃতীয়াংশ এমন সব কোম্পানির হাতে ছিল যারা তার আগের ১২টি ত্রৈমাসিক সুদের ১১টি দিতে পারেনি। মোট ঋণের তিরিশ শতাংশ সেই সব সংস্থার হাতে আছে যারা আর্থিক লোকসান করেছে।

বস্তুত বিগত ৬০ বছরের তথ্য দেখলে বোঝা যায় যে কর্পোরেট ঋণ মোট জাতীয় আয়ের শতকরা হিসাবে বাড়ছে। এবং ২০০২-২০০৩ থেকে এই বৃদ্ধি অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে বাড়ছে।

Table 1: ভারতের কর্পোরেট ঋণবৃদ্ধি

ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট-এর মতে: ব্যাঙ্ক নয়, এমন আর্থিক সংস্থাগুলির (নন-ব্যাঙ্কিং ফাইনান্সিয়াল কর্পোরেশন বা এনবিএফসি) বন্ড ও ধার সহ মোট ঋণ গত এক দশকে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ৩৭ ট্রিলিয়ন থেকে ২০১৭র মাঝামাঝি ৬৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে যা মোট বৈশ্বিক আয়ের ৯২ শতাংশ। সরকারি ঋণ নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হলেও বেসরকারি ঋণের বৃদ্ধি তার কাছাকাছি। অতীতের নিয়ম ভেঙে এই মুহূর্তে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কর্পোরেট ঋণ ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে চিনে। মোট জাতীয় আয়ের অনুপাতে কর্পোরেট ঋণের পরিমাণ চিনে সর্বাধিক।

এই রিপোর্টে আরও বলা আছে: চিনে এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে কোম্পানিগুলি অত্যাধিক বন্ড ছাড়ছে। চিনের নন-ফাইনান্সিয়াল কর্পোরেট বন্ড ২০০৭এ ছিল ৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০১৭এ বেড়ে দাঁড়ায় ২ ট্রিলিয়ন। এই মুহূর্তে চিন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্ডের বাজার। চিনের বাইরে ব্রাজিল, চিলি, মেক্সিকো এবং রাশিয়ায় বন্ড ছাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে।

চারিদিকে চিনের কর্পোরেট ঋণ যত হৈচৈ হয়েছে ভারত নিয়ে ততটা সোরগোল হয়নি। এর কারণ অবশ্য চিনে জাতীয় আয়ের অনুপাতে এই ঋণ ১৪৭ শতাংশ। এদেশের কর্পোরেট ঋণের বহর হয়তো লুক্সেমবার্গ, হংকং, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সুইডেন, চিন, ফ্রান্স, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড বা অন্যান্য দেশের মতো নয় যেখানে এই ঋণ মোট জাতীয় আয়ের ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে তবে ভারতে কর্পোরেট ঋণ বৃদ্ধির হার স্বস্তিজনক নয়। এছাড়া মার্কিন দেশের ৯ বিলিয়ন ডলার ঋণও একটি সম্ভাব্য বিপদ যদি সুদের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনীতি দুর্বল হয়। যদিও ওয়াল স্ট্রিট বন্ড বিশেষজ্ঞরা আমাদের বিশ্বাস করাতে চান যে এই সমস্যাটি আগামী এক বছরে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু আর্থিক সূচকগুলি খুব একটা আশ্বাস দেয় না। সিকিউরিটিজ ইন্ডাস্ট্রি এবং ফিনান্সিয়াল মার্কেটস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, ২০০৭এ অর্থনৈতিক মন্দা শুরুর সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট কর্পোরেট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪.৯ ট্রিলিয়ন ডলার যা ২০১৮ সালের মাঝামাঝি ৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯.১  ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকদের একটি অংশ এটিকে টাইম বোম্বের সঙ্গে তুলনা করছেন।

ভারতে কর্পোরেট ঋণ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে উপরোক্ত দেশগুলির মতো বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। অনাদায়ী ঋণের ৪০ শতাংশ আছে ধাতু, বিদ্যুৎ এবং টেলিযোগাযোগ শিল্পে। এটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক কারণ এই তিনটি ক্ষেত্রের ওপর যেহেতু অন্যান্য ক্ষেত্র নির্ভরশীল সেই কারণে এর প্রভাব অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। একই রিপোর্ট অনুযায়ী: এমনকি আজকের স্বল্প সুদের হারেও ব্রাজিল, চিন এবং ভারতে ২০-২৫ শতাংশ কর্পোরেট বন্ড ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।

Table 2 : কর্পোরেট ঋণ সমস্যা

একবার জেট এয়ারওয়েজের দিকে তাকানো যাক যা বিগত দিনগুলিতে ভারতের অন্যতম প্রধান বিমান সংস্থা ছিল। ভারতের বিমান শিল্পের বাজারে তাদের দখল ছিল সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও তারা বহু আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বিমান চালাত। আবু ধাবির এতিহাদ বিমান সংস্থা জেটের ২৪ শতাংশ শেয়ার কিনেছিল। এতদসত্ত্বেও ঋণ সমস্যায় জর্জরিত এই বিমান সংস্থাটি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে। ২০১৮র শেষে তাদের মোট ঋণ ছিল ৭৩০ কোটি টাকা এবং তারা ঋণশোধের কিস্তি দিতে পারেনি। এছাড়াও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বাকি ছিল এবং বিমান মালিকদের ভাড়া দিতে পারছিল না এই সংস্থা।

এর আগে ২০১২ সালে কিংফিশার এয়ারলাইন্স থেমে যায়। তারাও ব্যাঙ্কের কিস্তি,  শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন, বিমান ভাড়া, বিমান বন্দরের বিভিন্ন চার্জ ও ফি দিতে পারেনি। ভারতের বিমান শিল্পে আগামী দিনে কী ঘটতে চলেছে এই দুই বিমান সংস্থার গল্প থেকে তার একটি ছবি ফুটে ওঠে।

 

ক্রমবর্ধমান অনাদায়ী ঋণ

ব্যাঙ্ক শিল্পের এই সঙ্কট পুরোটাই জেনে বুঝে তৈরি করা। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে বাধ্য করা হয়েছিল বিভিন্ন বড় বড় “উন্নয়ন প্রকল্প” এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ঢালাও ঋণ দিতে। এর ফলে প্রায় এগারো হাজার কোটি টাকার ওপর অনাদায়ী ঋণ জন্ম নিয়েছে। ২০১৫ থেকে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ এমনভাবে বেড়েছে যে আজ তা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলির অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি শুরু করেছে। অনাদায়ী ঋণের ৮২ শতাংশ কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে এবং এই বিপুল পরিমাণ একদিনে তৈরি হয়নি।

Table 3. ২০১৫-২০১৭ — কর্পোরেট ঋণ বৃদ্ধির হার

ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেডিট রেটিং সংস্থা কেয়ার রেটিংস-এর মতে সর্বোচ্চ অনাদায়ী ঋণের তালিকায় ভারত পঞ্চম স্থানে আছে। গ্রিস, ইতালি, পর্তুগাল এবং আয়ারল্যান্ডের পরেই এদেশের স্থান। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে পারে এবং ভারত হয়ত খুব শীঘ্রই আয়ারল্যান্ডকে ছাড়িয়ে যাবে। ১১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অবস্থা খুবই খারাপ এবং অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে এগুলি গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত হতে পারে।

Table 4. সর্বোচ্চ অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ

দেশ বছর অনুপাত
গ্রিস ২০১৭ ৩৬.৩৭
ইতালি ২০১৭ ১৬.৩৫
পর্তুগাল ২০১৭ ১৫.৫২
আয়ারল্যান্ড ২০১৭ ১১.৮৫
ভারত ২০১৭ ৯.৮৫
রাশিয়া ২০১৭ ৯.৭২
রোমানিয়া ২০১৭ ৮.৩২
সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ২০১৭ ৬.৭০
হাঙ্গারি ২০১৭ ৫.৩৬
স্পেন ২০১৭ ৫.২৮

 

 

এই অনাদায়ী ঋণের কৃষ্ণগহ্বর শেষ পর্যন্ত দেশের গোটা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকেই গিলে ফেলবে কিনা সে নিয়ে বহু সমালোচকই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এক অনিবার্য ধ্বসের কথা কেউই অস্বীকার করতে পারছেন না। বহ ব্যাঙ্কই ঋণ দেওয়ার মতো আর্থিক স্বচ্ছল অবস্থায় নেই, ফলে দেশের ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্র ঋণের স্বল্পযোগানের সমস্যায় জর্জরিত।  ২০১৬-১৭র হিসেব অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির দেয় ঋণের পরিমাণ ছিল দেশের মোট ঋণের ৬৯%।

রাজনৈতিক নেতা, আমলা, আর পুঁজিপতি— এই ত্র্যহস্পর্শে গোটা দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দশ বছরে ব্যাঙ্কগুলি মোট ৭,০০,০০০ কোটি (১০১ বিলিয়ন ডলার) টাকার ঋণ মকুব করেছে, আর ডিসেম্বর ২০১৮র হিসেব অনুযায়ী তার আগের নয় মাস সময়ে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ১,৫৬,৭০২ কোটি টাকা। গত দশ বছরের এই ঋণ মকুবের একটা বড় অংশ (প্রায় চার-পঞ্চমাংশ) ঘটেছে ২০১৪তে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর গত পাঁচ বছর সময়ে। কর্পোরেট ক্ষেত্রর প্রতি ব্যাঙ্কের এই বিচিত্র উদারতার খেসারত দিতে জনগণের তহবিলের টাকা দিয়ে ব্যাঙ্কের মূলধনে পুনর্বিনিয়োগ করা হচ্ছে, অর্থাৎ কর্পোরেট ব্যাঙ্কগুলিকে লুটে নেবে আর তারপর সেই দুর্বল ব্যাঙ্ককে বাঁচিয়ে তুলবে সাধারণ ভারতীয় নাগরিক! এই বিষয়টি আসলে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের এক ঘৃণ্য উদাহরণ ছাড়া আর কিছুই না, যেখানে রাজনৈতিক নেতা, সরকারি আমলার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে একদল পুঁজিপতি হাসতে হাসতে মোটা টাকা লাভ করে ফেলেন। পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের ১.৭৭ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক কেলেঙ্কারি যা সম্ভবত ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতারণা, এই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমেরই আর এক আদর্শ উদাহরণ।

অনেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারিকরণকে সব আর্থিক অসুখের একমাত্র বিশল্যকরণী হিসেবে মনে করলেও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিও কিন্তু সমস্যামুক্ত নয়। আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক, অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক বা ইয়েস ব্যাংকের মত অতিপরিচিত বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিতেও অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ কিছু কম নয়। সাম্প্রতিক অতীতে আমরা ব্যাঙ্কগুলির বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্তাকে অনাড়ম্বরে এইসব ব্যাঙ্কগুলি থেকে বিদায় নিতে দেখেছি।

 

নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (NBFC) দেউলিয়া অবস্থা

শুধু ব্যাঙ্ক নয়, আর্থিক ক্ষতির এই রোগের ছোঁয়াচ নন-ব্যাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও লেগেছে। অথচ, এই প্রতিষ্ঠানগুলি গত পাঁচ বছরে প্রায় ২৫-৩০% ফুলে ফেঁপে যথেষ্ট শক্তিশালী আর্থিক সত্তা হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। এই মুহূর্তে NBFC-গুলির সুখের দিন সম্ভবত শেষ আর তার পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে ব্যাঙ্কের ওপর। কারণ ব্যাঙ্কগুলি NBFC-র সাফল্যের ওপর বাজি ধরে প্রচুর টাকা ধার দিয়েছিল তাদের। এই মুহূর্তে তাদের প্রচুর টাকা এই সংস্থাগুলির হাতে আটকে রয়েছে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস (IL&FS)-এর গণেশ উল্টে যাওয়ার ফলে গোটা আর্থিক ব্যবস্থা কেপে উঠেছে। আরেকটি গৃহঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ৯৬০ কোটি টাকা খেলাপ করেছে বলে জানা গেছে। এই ধরণের ঋণ শোধের বিলম্ব হলে মূল্যায়ন রীতি অনুযায়ী সম্পত্তির মূল্য কমে যাওয়া উচিত। গত কয়েক মাসে মোটা অঙ্কের ঋণের বোঝা থাকায় বিভিন্ন রেটিং এজেন্সিগুলির কাছে দেওয়ান হাউজিং ফিনান্স কর্পোরেশন লিমিটেড (DHFL)-এর রেটিং-এর ধারা নিম্নমুখী। এদিকে, ইয়েস ব্যাঙ্ক ও চারটি সরকারি ব্যাঙ্কের DHFL-কে দেয় ঋণের পরিমাণ প্রচুর। এর ফলে গৃহ, স্থাবর সম্পত্তি, গাড়ি, ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানকারী এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সংস্থাগুলির কপাল পুড়বে। এবং ভারতীয় আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নিঃসন্দেহে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। এই কঠিন পরিস্থিতিতেই গত বৎসরের শেষে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে প্রায় ১৫০০টি NBFC-র লাইসেন্স বাতিল করার কথা ভাবতে সরকার বাধ্য হয়েছিল।

ভারতে অনাদায়ী ঋণের এক-চতুর্থাংশ আসে ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা পাঁচমিশেলি ছায়া ব্যাঙ্কগুলির (Shadow Bank) থেকে। যেহেতু তারা আমানত নিতে পারে না তাই পুঁজি যোগাড় করতে তারা ঋণের ওপর নির্ভরশীল। এগুলি অর্ধ-নিয়ন্ত্রিত এবং কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন রিয়েল এস্টেট শিল্পে এরা ধার দিয়ে থাকে। চিনের প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই ছায়া ব্যাঙ্কিং শিল্পের ওপরেই কড়া নিয়ন্ত্রণের ফলে বহু ব্যাঙ্ক ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

 

অযৌক্তিক উদ্দীপনা

একুশ শতকের শুরুর দশকের মাঝামাঝি যে অযৌক্তিক উদ্দীপনা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল, ভারতও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ভারতবর্ষে উচ্চহারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি দেখা গেছিল। প্রচুর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ব্যাঙ্ক ঋণের সহায়তায় আগ্রাসী সম্প্রসারণের উন্মাদনায় মেতেছিল। দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের গ্রাফ তখন ঊর্ধ্বমুখী। ব্যাঙ্ক ঋণের ওপর ভিত্তি করে বহু ব্যবসায়িক উদ্যোগ চটজলদি সম্প্রসারণ করতে থাকে। এমনকি ভারতের অন্যতম বিখ্যাত কর্পোরেট হাউস সেই যুগের হাওয়ায় ভেসে গেছিল। টাটা স্টিল কর্তৃক ১৩.১ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে কোরাস স্টিল ক্রয় ছিল এই টাকা ওড়ানোর প্রতিযোগিতার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। বিনিয়োগকারীদের উত্সাহ বাণিজ্যিক সম্পদের মূল্য এমন জায়গায় নিয়ে যায় যা কোম্পানিগুলির লাভ-ক্ষতির হিসাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। বলা বাহুল্য, এই ক্রয়— ১০ বছর আগের অন্য অনেক কিছুর মতোই— একটি বিপর্যয় হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে।

সংস্থাগুলির আর্থিক সমস্যা ব্যাঙ্কগুলির জন্য আরও বড় বিপদের অশনি সঙ্কেত বহন করছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ঋণ প্রদানকারীদের আইনি সুরক্ষা বলতে কিছুই ছিল না। রাজনৈতিক যোগসাজশ আছে এমন ব্যবসায়ীদের থেকে ঋণ আদায় ব্যাঙ্কের পক্ষে কার্যত অসম্ভব ছিল। এই সব রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীরা ঋণ শোধ না করলে ব্যঙ্কের একমাত্র করণীয় ছিল ঋণ মকুব। এভাবে ব্যবসায়ীরা নিশ্চিন্তে ঋণের বোঝা সাধারণ করদাতাদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজস্ব পুঁজি বাড়িয়ে নিত। লাভ হলে তার, ক্ষতি হলে সাধারণ মানুষের। এখনও তারা লাভের ব্যক্তিকরণ এবং ক্ষতির সামাজিকীকরণের অধিকার ধরে রাখতে চায়। কিন্তু তার জন্য বাকিদের মূল্য চোকাতে হয়।

যদিও ভারতীয় অর্থনীতি এখনও পূর্ণ সঙ্কটের সম্মুখীন হয়নি কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্কট দেখা দিলে তা সহজেই আমাদের গ্রাস করবে।

এই ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট ঋণ— যা ব্যাঙ্ক ও NBFCগুলিকে গ্রাস করেছে— আসন্ন সঙ্কটে একটি প্রধান উপাদান হিসাবে কাজ করবে।


[i]  ৫৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বিনিময় মূল্য ১ মার্কিন ডলার = ৭১.৩৩ টাকা)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. করোনার দোহাই ও শ্রমিক শোষণ – Collective for Economic Justice

আপনার মতামত...