দ্য ফার ফিল্ড

স্বাতী ভট্টাচার্য

 

এ যেন প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি। মাধুরী বিজয় প্রথম উপন্যাসটি লিখেই জিতে নিয়েছেন জেসিবি প্রাইজ়। পুরস্কারের অর্থমূল্য ভারতে সর্বোচ্চ— পঁচিশ লক্ষ টাকা। প্রতিযোগিতাও ছিল জব্বর, তামিলনাড়ুর বিখ্যাত লেখক পেরুমল মুরুগানের দু-দুটো উপন্যাস মনোনীত হয়েছিল, ছিলেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী, হাঁসদা সৌভেন্দ্রশেখরের মতো হেভিওয়েট লেখকরাও। অতএব মাধুরী যে শক্তিশালী লেখক, আর ‘দ্য ফার ফিল্ড’ একটি উৎকৃষ্ট বই, সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তারপরেও কিছু কথা বলার থাকে। স্যালুট করতে হয় মাধুরীর সাহসকে। কাশ্মির সমস্যার মতো বহুমাত্রিক, বহু-দ্বন্দ্ব-দীর্ণ একটা বিষয়কে বেছে নিয়েছেন, আর লিখেওছেন কারওকে রেয়াত না করে। কাশ্মির সম্পর্কে বাকি ভারতের প্রেজুডিস যে কত গভীর, কাশ্মিরের মানুষদের সঙ্কট না বুঝেই তার ‘সমাধান’ বাতলে দেওয়ার স্পর্ধা যে কাশ্মিরীদের জীবনে কী বিপর্যয় ডেকে আনছে, এক অর্থে তা-ই এই উপন্যাসের প্রতিপাদ্য। দ্বিতীয় মোদি সরকারকে নিয়ে একটি নিবন্ধে সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি লিখেছেন, ‘‘ভারতের অন্যান্য জায়গায় অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস উৎপাদন করা হয়েছে যে যেহেতু অনেক কাশ্মিরী পাকিস্তানে ট্রেনিং-পাওয়া জঙ্গি, তাই সে রাজ্যের সব বাসিন্দাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। কাশ্মিরীদের প্রতি সহমর্মী মানুষ পাওয়াই খুব কঠিন।’’

ঠিক এই সত্য পরিস্ফুট মাধুরীর বইতে। সেখানে দক্ষিণ ভারতের এক সফল, সচ্ছল ব্যবসায়ী এক কাশ্মিরী কাপড়-বিক্রেতাকে বলেন, ‘‘আমরা তোমাদের কাজ দিয়েছি, রাস্তা, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল দিয়েছি। আমাদের ট্যাক্সের টাকায় হাজার হাজার কাশ্মিরী ছেলেমেয়ে শিক্ষা পাচ্ছে। বিনিময়ে একটু কৃতজ্ঞতা আশা করা খুব বেশি কিছু নয় নিশ্চয়ই, কিন্তু তার বদলে তোমার ওই সব লোকগুলো বাড়ি উড়িয়ে দিচ্ছে, পাকিস্তানের স্লোগান দিচ্ছে, ভারতের পতাকা পোড়াচ্ছে, কী কী না করছে।’’ উত্তরে কাশ্মিরী লোকটি শান্তভাবে জানাল, ‘‘আপনার মতো আরও অনেকে মনে করে, মানুষ যা পায় তাই নিয়ে তাদের খুশি থাকা উচিত, যদি তারা না চেয়ে থাকে, তা হলেও। আর এ কথাটাও আপনাকে বলব, যত দিন আপনার মতো লোকেরা এমন বিশ্বাস করবেন, ততদিন যাদের আপনি ‘ওই সব লোক’ বলছেন, কাশ্মিরের সেই মানুষগুলো চলে যাবে না। না জনাব, তাদের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। আপনাদের মুখের দিকে চেয়ে আশা করব, তেমন দিন যেন না আসে, কারণ তখন আপনাদের মাথাব্যথার কারণ সত্যিই দেখা দেবে।’’

এই সংলাপে উপকার, কৃতজ্ঞতা, প্রতিদানের বয়ান রাষ্ট্রের প্রসঙ্গে আসে, কিন্তু তার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট রয়েছে দুই পুরুষের ব্যক্তিগত সন্দেহ আর বিদ্বেষ। বেঙ্গালুরুর এক সম্পন্ন গৃহস্থালি, যেখানে ডিনারে আমন্ত্রিত হয়েছেন অতিথিরা, সেখানে আপাত-সৌজন্যের পিছনে গৃহস্বামী আর তার গৃহে আশ্রিত এক দরিদ্র কাশ্মিরীর এই সঙ্ঘাত এক অসামান্য টেনশন তৈরি করে। তার সঙ্গে যোগ হয় কাহিনির প্রবক্তা মেয়েটির উৎকণ্ঠা। সে নিশ্চিত, আজ রাতে তার মা ঘর ছাড়বে কাপড়-বিক্রেতা বশির আহমেদের সঙ্গে। এই মায়ের চরিত্রটি গোটা কাহিনি জুড়ে অতিকায় হয়ে উপস্থিত। মেয়ে তাকে বলে ‘বিদ্যুৎজিহ্ব’। ভারতীয় সমাজ-সংসারের প্রচলিত যে সব বিনয়-বশ্যতার মাখন ‘সিস্টেম’কে চালু রাখে, তার কোনওটারই ধার ধারেন না মহিলা। স্বামীর অফিস পার্টিতে এক ম্যানেজার যখন তাঁর বুকের দিকে দৃষ্টি রেখে বলেন, ‘আপনার শাড়িটা ভারী সুন্দর,’ তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দেন, ‘কনফারেন্স রুমটা তো ফাঁকাই আছে, চলুন তা হলে।’ মেয়ে বাড়ির বাইরে মাংস খেয়ে এসেছে শুনে নিরামিশাষী মা তার দিকে নিজের বাহু বাড়িয়ে দেন। ‘খিদে রয়ে গিয়েছে নাকি, লিটল বিস্ট?’ মায়ের এই খরশান ব্যক্তিত্ব তাঁর কন্যাকে একই সঙ্গে বিপর্যস্ত আর পুলকিত করে। কিশোরী মনের উৎকণ্ঠা আর উৎফুল্লতার দোদুল্যমানতার ফাঁকে পাঠকের কাছে ধরা পড়ে, কাশ্মিরের মতো জটিল একটা বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে মাধুরী প্রায় তেমনই বহুমাত্রিক এক বিষয় বেছে নিয়েছেন— ঘনিষ্ঠজনের মানসিক অসুস্থতা। ‘বাইপোলার’ কথাটা উল্লিখিত হয়নি কোথাও, যদিও লক্ষণগুলি স্পষ্ট। মানসিক অসুখ, চিকিৎসার কথা আসে কাহিনির শেষ লগ্নে, কিন্তু সে তথ্য এক মুহূর্তও মায়ের গুরুত্বকে খর্ব করে না।

যাঁরা মনোরোগ নিয়ে আন্দোলন করেন, তাঁরা জানেন যে এটাও কম বৈপ্লবিক নয়। মানসিক অসুখ, বিশেষত মেয়েদের মানসিক অসুখ, প্রায় সব সময়ই মানুষকে প্রান্তিকতায় ঠেলে দেওয়ার একটি উপায় হয়ে ওঠে পরিবার আর সমাজের কাছে। এই কাহিনিতে মনোরোগী মা সমাজ-সংসারে ‘মিসফিট’, কিন্তু তার স্পষ্টবাদিতা, তার সংশয়হীন আত্মপ্রত্যয়, তার ভালবাসার প্রচণ্ডতা তাকে রাখে কাহিনির একেবারে কেন্দ্রে। এমন মায়ের আত্মহত্যা একুশ বছরের মেয়ের অস্তিত্বের একেবারে শিকড়ে টান দেয়। বন্ধুত্বহীন, উদ্দেশ্যহীন তিনটে বছর কাটিয়ে সে পাড়ি দেয় কাশ্মিরে। বশিরকে খুঁজে বার করে মায়ের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছে দেবে, এই তার সঙ্কল্প। শুধু মনে আছে বশিরের শ্বশুরবাড়ির শহরের নাম। আর কিছুই সে জানে না। লোকে ভাবে, অগণিত নিখোঁজ কাশ্মিরীদের যারা খুঁজে বেড়াচ্ছে, শালিনী হয়তো তাদেরই একজন। তার স্থান হয় এমন এক পরিবারে, যাদের স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। এই যন্ত্রণা, এই সন্দেহদগ্ধ সমাজ দেখার কোনও মানসিক প্রস্তুতিই ছিল না বেঙ্গালুরুর তরুণীর। প্রতি মুহূর্তে সে অনুভব করে নিজের দূরত্ব, আবার ধীরে ধীরে সবার সঙ্গে এক সম্পর্কও গড়ে ওঠে তার। যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষদের মধ্যে যেমন হয়।

শেষ অবধি বশিরের গ্রামে যায় শালিনী, সত্যিই বশিরকে খুঁজে পায় সে। আর সেখানেই খুব কাছাকাছি আসে সন্ত্রাসবাদী আর সেনা-দর্পী রাষ্ট্রের মাঝে পড়ে যাওয়া মানুষদের ছিন্নভিন্ন জীবনের সঙ্গে। বশিরের ছেলে জ়ায়েদ সেনার কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয় না। ‘নাম কী’ বললেও চুপ করে থাকে। যেন মার খেতেই চায়। যারা কাশ্মিরের মানুষকে মর্যাদা দেয় না, তার প্রশ্নের উত্তর দিলে অমর্যাদা স্বীকার করা হয়। চুপ করে মার খাওয়া যে আত্মসম্মান রক্ষার উপায় হতে পারে, তা উপলব্ধি করে শালিনী। তরুণী মেয়েটি দেখে, বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সামনে এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে ‘সবাই গ্রামের বাসিন্দা’ এই পরিচিতি তৈরির মরিয়া চেষ্টা। বহু বছরের সেই চেষ্টা ধূলিসাৎ হল কত সহজে। নিজেকে দিয়ে আবিষ্কার করে, অন্যায়-প্রসূত ঝাঁঝালো আবেগ কত সহজে হার মানে অভ্যস্ত আরামের কাছে, শূন্য আশ্বাসের কাছে। শালিনীর অনভিজ্ঞতা, তার কৌতূহল মারাত্মক ক্ষতি করে তার আশ্রয় দেওয়া মানুষদের।

মাধুরীর কাহিনি ত্রুটিমুক্ত নয়। কাহিনির গতি বজায় রাখতে সব কিছুই চলে অবিশ্বাস্য গতিতে। বাস্তবে অত শীঘ্র মানুষ নিজেকে উন্মুক্ত করে না অপরিচিতের কাছে, বিশেষ করে কাশ্মিরের মতো শঙ্কিত সমাজে। অভ্যাগতকে ‘ম্যানিপুলেট’ করা, অর্থাৎ ভুল বোঝানোর একটা পালাও চলতে থাকে। সময়ের ফ্রেমটা ছোট করার তাগিদে মাধুরীর গল্প কিছুটা নাটকীয় হয়ে গিয়েছে। তবে তার মূলে একটা সততা রয়েছে, যা সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। বইটা ধরলে শেষ না করে পারা যায় না, এমনই লেখার গুণ। এই বান্দা মেট্রো রেলে বইটা পড়তে পড়তে চাঁদনি চক মিস করে চলে গিয়েছিল গিরিশ পার্ক। আর কী বলার থাকে?

The Far Field
by Madhuri Vijay,
Grove Press,
448 Pp, Rs. 599/-.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...