ভালাবাবুর উপাখ্যান

নিরুপম চক্রবর্তী

 




যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি, লেখক তাদের একজন।

 

 

 

 

ভালাবাবু ভালো লোক। সে এক অঞ্চল যাকে শত্তুরেরা উলটো প্রদেশ বলে ক্ষ্যাপায়, সেখানে আছে এক হতশ্রী শহর, কর্ণপুরা না কি যেন তার ভুলে যাওয়া প্রাচীন নাম; আর তার দেহাতের বাসিন্দা ভালাবাবু যাদব। যদুকুলের সুপ্রাচীন পেশা সে ধরে রেখেছে। ভালাবাবু আমাকে দুধ দিয়ে যায় নিয়মিত। আমার সঙ্গে গল্প করে।

‘পুরব সে হওয়া আনেসে দুধ আচ্ছি রহতি হ্যায়, লেকিন পচ্ছিম সে হওয়া আনে সে দুধ সরক যাতি!’ তার জ্ঞানের বিস্তার আমাকে হতবাক করে। বলেই সে জানতে  চায় ‘আপকি কাস্ট কেয়া হ্যায় সাব?’ সবিনয়ে বলি ‘আমার কাস্ট নেই ভালাবাবু!’ খানিকটা বিস্মিত হয়ে সে দুধের পাত্র উঠিয়ে নিয়ে একটু আনমনা হয়ে প্রস্থান করে। পরের দিন তাকে আবার দেখি আমি। আকর্ণ বিস্তৃত হাসি। ‘সাব আপ হামসে বহুত মজাক উড়াতে হ্যায়! তিয়ারী সাব বাতা দিয়া আপ ব্রাহ্মণ হ্যায়, সমাজকি বহুতই সম্মানিৎ ব্যক্তি হ্যায়, লেকিন কাল ম্যায় শোচা আপ মুসলিম কাস্ট কি হোঙ্গে! এক আজিব দাড়ি ভি বানাকে রাখি হ্যায় না!’ ভালাবাবুর দেবদ্বিজে ভক্তি অপরিমেয়, মুসলিম কাস্টের প্রতি তার বিদ্বেষ নেই, খানিকটা অস্বস্তি আছে যেহেতু এই কাস্ট তার অজানা। সে আবার বলতে থাকে: ‘তিয়ারী সাব ইয়ে ভি বাতায়া আপ বাহার সে আয়ে হ্যায়, বহুতই পড়িলিখি আদমি হ্যায় আপ, ইয়ে লোক তো আপকো কাফি তনখা দেতে হোঙ্গে!’ এ অঞ্চলে প্রথম পরিচয়ে উপার্জনের কথাটা না জিজ্ঞাসা করাটা অভদ্রতা! সবিনয়ে জানালাম যে সবাইকে যা দ্যায় আমাকেও তাই দ্যায় এখানে। ভালাবাবুকে ভয়ানক চিন্তান্বিত দ্যাখায়। অবশেষে খানিকটা আমতা আমতা করে বলে ‘লেকিন সাব, ইতনা পয়সা তো ম্যায় মেরা ভহিস কে পিছে লাগা দেতে!’ আমার প্রতি এই অভাবনীয় অবিচার এরপর তাকে বাকরুদ্ধ করে!

এটা ঠিকই ভালাবাবুর মহিষেরা সৌভাগ্যবতী। তাদের মালিকের তালিমারা ফতুয়ার পকেটে আমার সম্বৎসরের খোরাকি অবহেলাভরে গুঁজে রাখা থাকে। তাতে হাত লাগবে কোন জেব কতরেইয়া কোই মাই কি লাল? দেহাতের মানুষ বন্দুক রাখে সঙ্গে, ওই সব ব্যাংক ট্যাংক বিলকুল ফালতু চিজ, ইমানদারেরা নগদে কামায় নগদে খরচা করে।

ভালাবাবুর অভিজ্ঞতার পরিধি সুদূরবিস্তৃত। ‘সাব হাম জব ছোটে থে, কভিকভি ঘাস কাটনে কে লিয়ে আ যাতে ইধার আপকি কালেজ মে। ইস্তরফ বহোত সারে গোরে লোক রহা করতে থে। উও লোক ছোটে ছোটে পাতলুন পহেনকে গাড়ি চালা কর ঘুমতে থে দিনভর। কেয়া জমানা থা সাব, উও লোক চলে গয়ে, অভি ইধারকা হালত দেখিয়ে! পতা নেহি অভি ইসি কালেজ মে বাচ্চ কা ক্যায়সা শিচ্ছা মিলতে হোঙ্গে!’ শিক্ষাব্যবস্থার অধুনান্তন অধোগতিতে তাকে বিমর্ষ দ্যাখায়।

ভালাবাবুকে আমি সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পাই না। সত্যিই দেশের হালত খুবই খারাপ। একদিন সে ছুটতে ছুটতে আসে ‘সাব ইধার কোই সর্দারজি আ রহা হ্যায়, উসিনেই রাজু গান্ধী কো মার ডালা!’ হতভম্ব আমি তাকে বোঝাই যে যিনি আসছেন তিনি এ দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, রাজু গান্ধীর নিজের দলের লোক, তিনি তাঁকে মারতে যাবেন কোন দুঃখে! ভালাবাবুর অসীম বিশ্বাস আমার জ্ঞানভাণ্ডারের অপরিমেয়তায়। ‘তব লাগতে হ্যায় ইয়ে সর্দারজি রাজু গান্ধী সে ভি বড়া আদমি! ম্যায় উৎনি লিখি পড়ি নহি হুঁ সাব, ম্যায় শোচতা থা রাজু গান্ধী হি সবসে বড়া, সবকে উপর।’ তার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের জন্য সে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নেয়।

ইতিহাস একটু একটু করে বদলাতে থাকে। জনগণ কখনও আমাদের ছাত্র কখনও শিক্ষক। ভালাবাবু একদিন এসে বলে ‘ইয়ে নয়া নেতা খসখস সিং যাদব কোই কামকি নহি হ্যায়’। বললাম, কেন তিনি তো তোমারই মতো যাদব, তুমিই তো বলেছ তোমরা কিষণজির বংশধর। উত্তরে জানলাম যে যাদব কুল আদতে কয়েকটি উপযাদব কুলে বিভক্ত। ভালাবাবুর উপ-কূল আর খসখস বাবুর উপ-কূল এক নয়, তিনি শুধু তাঁর নিজের যাদব উপগোষ্ঠীর কল্যাণসাধন করে চলেছেন। ভালাবাবুকে বিষণ্ণ দ্যাখায়। ‘সবহি জাত কি নসিব আপনা আপনা!’ ভালাবাবু বলতেই থাকে ‘উনসে ভি আজিব হ্যায় ওহি ছায়াবতী বহেনজি, স্টাইল মারকে সিরফ ঘুমতি হ্যায় ইধার উধার। মেরে মালুম হ্যায় সাব, জব উও ইধার আয়ি থি, শালে পুলিশআলো নে আপকি গাড়ি সড়কসে উঠাকে জঙ্গল মে ফেক দিয়া থা। মেরে কো বহোত দুখ হুয়া শুনকে সাব।’ ভালাবাবুর চক্ষু কর্ণের বিস্তার সুদূরপ্রসারী, নতুবা এই ঘটনাটি তার গোচরে থাকার কথা নয়। চমকানো শীতল স্বরে ভালাবাবু বলে ‘অভি সে মেরে লিয়ে সিরফ কমল কে ফুল!’

তার পরে বইতে থাকে এলোমেলো হাওয়া, দুধ কেটে যায়, বদলে যেতে থাকে মুখশ্রীগুলো। বদলে যেতে থাকে কণ্ঠস্বর। এই প্রদেশ লব কুশের। পাঠ করা হত তুলসীদাসী সুন্দরকাণ্ড, বিরাজ করতেন কমল নয়ন আলে রাম। মানুষজন গাইত: কষ্ট হরণ তেরি নাম রাম হো, কমল নয়ন আলে রাম, জয় সিয়া রাম কো। তার পরিবর্তে জাগতে থাকে এক উন্মাদ কোলাহল: রাম লালা কো লায়েঙ্গে, মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে। একদিন উন্মত্তের মতো ছুটে যেতে দেখি করসেবক ভালাবাবুকে। অনতিদূরে কাবরি মসজিদ বলে একটা সাত পুরনো নির্মাণ আজ ভেঙে পড়বে। তার নিচে একটা আট পুরনো রাম মন্দির আছে নাকি। আমার কেন যেন মনে হয় তারও নিচে আছে শূদ্র শম্বুকের হাড়।

চারদিক থমথেমে। চারদিক হিংস্র। ভালাবাবু কিন্তু আমাকে ভোলেনি। একদিন আসে। বলে ‘মন্দিরকে লিয়ে এক ইটা খরিদিয়ে সাব, এক এক ইটা সিরফ পাঁচ রুপিয়া!’ বলি: আমি এই ইট কিনতে পারব না ভালাবাবু। অসম্ভব বিস্মিত সে, বলে ‘সাব আপকে পাশ পাঁচ রুপিয়া ভি নহি হ্যায় কেয়া?’ একটু ভাবে তারপরে বলে ‘সাব, আপ কেয়া রামচন্দ্রজী কো ভি নহি মানতে?’ আমি তাকে বোঝাতে থাকি যে যে তিনি আমার মহাকাব্যের নায়ক, তাঁর গাথা আমার উত্তরাধিকার, আমার পরিচিত রামের সঙ্গে তার রামকে আমি মিলিয়ে উঠতে পারছি না। ভালাবাবু মন দিয়ে শোনে। বলে ‘হাম ঠিকসে সমঝা নহি সাব, ইয়ে বহতই পড়িলিখি বাত। লেকিন এক চিজ ম্যায় সমঝ লিয়া সাব, রামচন্দ্রজী আপকে দিল মে সুরছছিত রহেনগে।’

এরপর একটা দীর্ঘ জাম্প কাট। আমার আর ভালাবাবুর মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে, কেটে গেছে প্রায় এক কুড়ি বছর। যেন একটা স্বপ্ন দৃশ্যে দেখি এক উন্মাদ নৃপতি হা হা করে হাসছেন আর বলছেন: টাকা মাটি মাটি টাকা আর ইমানদার নগদের কারবারি ভালাবাবু মাথা ঠুকছে ওইসব বেওকুফ ব্যাংকগুলোর দরজায় দরজায়। পরবর্তী দৃশ্য। তবুও তার বিশ্বাস অটুট, চুনাও মে ফিরসে কমলকে ফুল: গৈরিকধারী এক মহাপুরুষ আজ রাজদণ্ড হাতে অবতীর্ণ।

এইসব এলোমেলো স্বপ্নে দৃশ্যপট বদলে যায় বহত তুরন্ত। গ্রাম ও শহরগুলো জ্বলে ওঠে, কোই এক কানুন কে বাজে সে চারদিকে একরাশ বিপর্যস্ত মানুষ। এটা স্বপ্ন না চলচ্চিত্র? আমি আর ভালাবাবু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেখি: একটা বিশাল পর্দা জুড়ে এক গৈরিকধারীর প্রস্তরকঠিন মুখ, হাতের বন্দুকে লক্ষ্য স্থির। ট্রিগারে চাপ পড়ে।

এ বড় সুখের সময় নয়, কে যেন বলেছিল, মনে করতে পারি না স্বপ্নের ঘোরে। মুখ ঢেকে কারা যেন তাণ্ডব চালায় অতিদূরের কোনও এক বিদ্যায়তনে। আমি স্বপ্নে দেখি, ভালাবাবু দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো কালেজে যেখানে সে শৈশবে একদিন ঘাস কাটতে কাটতে পৌঁছে গিয়েছিল। ‘সাব কোই প্রদেশ মে, এক দুসরী কালেজ মে বাচ্চেলোগ কো গুন্ডে নে পিটায়া বহত। ইধারকে কাফি বিদ্যার্থী অউর শিছছক নে বোল রহা হ্যায় ইয়ে কাম সহি নহি হুয়া, লেকিন কোই কোই বোলা মেরেকো, আচ্ছা কিয়া হ্যায় উধার, কিসিকো জানসে মারনা চাহিয়ে থা উস দিন। ম্যায় সিধে সাধে ভোলেভালা আদমি হুঁ সাব, বাচ্চেলোগ পর এইসি হাথ উঠানা হাম বরদাস্ত নহি কর পায়েঙ্গে!’

তার কথা বিশ্বাস করতে আমার দ্বিধা হয় না।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4861 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

6 Comments

  1. পৃথিবীতে ভালাবাবুদের সংখ্যা বড় বেশি, আর তাদের নিংড়ে নেওয়ার লোকেদের সংখ্যা কম হলেও তারা ভারি শক্তিশালি। আমার দেশের এই অবস্থা দেখে বড় দুঃখ হয়। টেকনোলজির জোরেই নাকি আজ ভারত এগোচ্ছে, আর সেই টেকনোলজির জোরেই আজ ভালাবাবুর ঈশ্বররা ক্ষমতায়। জানি না আর কত দুঃখ জমা আছে কপালে।

  2. “আমার কেন যেন মনে হয় তারও নিচে আছে শূদ্র শম্বুকের হাড়।” দুর্দান্ত লেখা ।

  3. এটি কি নিবন্ধ? ছোটগল্পের মত পড়তে লাগল। শাণিত অথচ কী মানবিক!

  4. দুর্দান্ত লেখা। আপনার গদ্য যথেষ্ট শক্তিশালী। অসম্ভব ভালো লাগলো।

আপনার মতামত...