কোথায় প্রতিকার, কোথায় নিরাময়

কোথায় প্রতিকার, কোথায় নিরাময় -- মঞ্জিস রায়

মঞ্জিস রায়

 

কিছুদিন আগে একটি রাজনৈতিক দলের এক মাঝারি মাপের নেতা হোয়াটস্যাপে লিখে পাঠাল, আমাদের রাজনীতিতে এতদিন যা হয়েছে তা আর চলবে না। আমাদের দরকার Masculinity বা পৌরুষ, দরকার পেশীশক্তি। এই তো সেদিন বাজারে গেছি। মাংসের দোকানের সামনে মাঝবয়সি দুই ভদ্রলোক মাংস কিনবেন বলে দাঁড়িয়েছিলেন। দোকানদার যখন মুরগিটাকে খাঁচার থেকে বার করে কাটতে শুরু করল, সেই মুহূর্তেই এদের মধ্যে একজন খানিকটা দূরে সরে দাঁড়ালেন। বললেন যে মাংস কাটা শেষ হলে তিনি আবার এদিকে আসবেন। তাই দেখে তার সঙ্গী ভদ্রলোকটি বলে উঠলেন, কী হয়েছে এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে মাংস কাটা দেখতে। অনেক বয়স হয়েছে তোমার, মেয়েদের মত কোরো না তো! কোনও এক ক্লাসের সিবিএসই বোর্ডের হিন্দি পাঠ্যবইয়ের পাতা ওলটাতে দেখি লেখা আছে মেয়ে ভালোবেসে বিয়ে করলে পুরো পরিবারের মানসম্মান ধুলোয় মিশে যায় (পুরে খানদান কি নাক কট যাতি হ্যায়)। কোনও ক্ষেত্রে পুরুষেরা যদি ঘরের কাজ সামলান, রান্না করেন তো তাকে পরিহাসের পাত্র হতে হয়। আমার চেনাশোনা এক স্কুলশিক্ষক ঘরোয়া আড্ডাতেই বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ না একটু মেয়েলিই ছিলেন। হায় রে! না জানি এই শিক্ষক কী শিক্ষায় শিক্ষিত করেন ছাত্রছাত্রীদের।

এভাবেই পুরুষ হতে শেখায়, পুরুষ নির্মাণ করে আমাদের সমাজ, আমাদের রাজনীতি, আমাদের পরিবার। কতকাল ধরে কে জানে। আর পুরুষের নির্মাণে শুধু পুরুষ নয়, কখনও মহিলারাও পিতৃতন্ত্রের মুখ হয়ে ওঠেন। পিথাগোরাস বলেছেন, “শৃঙ্খলা, আলো আর পুরুষের নির্মাণ করেছে একটি ভালো নীতি, আর বিশৃঙ্খলা, অন্ধকার আর নারীর সৃষ্টির পেছনে আছে একটি খারাপ নীতি (“There is a good principle— which has created order, light and man, and a bad principle which has created chaos, darkness and woman”, said Pythagoras) [সৌজন্য: দ্য সেকেন্ড সেক্স: সিমোন দ্য ব্যোভেয়ার]। পিথাগোরাসের সময়ও এভাবেই নির্ধারিত হয়েছে পুরুষ বা নারীর সংজ্ঞা। রাজস্থানের একটি পাবলিক স্কুলের এক বন্ধুর মেসেজে দেখেছি যে সংস্কৃতের অসংস্কৃত শিক্ষক ক্লাস সেভেনে পড়াতে পড়াতে বলেছে যে মাতৃগর্ভ হল রৌরব নরক। যে ইতিহাসের শিক্ষক ক্লাসে রানি লক্ষ্মীবাই, জোয়ান অব আর্ক, বেগম রোকেয়া ইত্যাদি পড়ান, সেই তিনিই আবার কন্যাভ্রূণ হত্যা করিয়েছেন। প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা আমরা বিষয়গুলো দেখেও দেখি না কিংবা এড়িয়ে যাই। আর কেউ যদি প্রতিবাদ করেন তো তিনি পরিহাসের পাত্র হন। আমরা যখন এই মানুষদের মেনে নিই, সহ্য করি, সেই মুহূর্তেই আমরাও নিজের অজান্তেই পিতৃতন্ত্রের শরিক হয়ে যাই। আমাদের সমাজ, আমাদের রাজনীতি নারীকেও নির্মাণ করে। আমরা তখনই প্রতিবাদ করি, যখন ঘটনাটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। ২০১৯-এর হেমন্তের পড়ন্ত বেলায় ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়ে গেল আমাদের সমস্ত দেশ, সমাজ, চেতনাকে। মানুষের স্বাভাবিক ক্ষোভ ফুটে উঠল সংবাদমাধ্যমে, সমাজমাধ্যমগুলিতে। অনেক মানুষই অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সরব হলেন, কিছু লোক বললেন সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথা। স্বাভাবিকভাবেই বিচারপ্রক্রিয়ার বিলম্ব এবং ফাঁকফোকর নিয়েও কথা উঠেছে। ফেসবুক, হোয়াটস্যাপে মানুষ কখনও গরমে, কখনও নরমে নিজের নিজের মত প্রকাশ করছিলেন। ফেসবুকে এমন অনেককে চিনি যারা মেয়েদের নিয়ে অত্যন্ত নিম্নমানের জোক শেয়ার করেন, মেয়েদের কাজকে হেয় করার চেষ্টা করেন, সেই তাদেরও দেখলাম বুক বাজিয়ে অনেক বৈপ্লবিক কথা বলতে। আমরা কি ভাবের ঘরে চুরি করছি না? ছোট ছেলেটিকে তার জেঠু বলেন, তোর মা কি সব জানে? মায়ের সব কথা একদম শুনবি না। বাবা মৃদু হেসে প্রশ্রয় দেন। তাদের মতো করে তাদের ‘বংশধর’কে তারা তৈরি করতে চান, যেখানে মা অপ্রাসঙ্গিক। কলকাতা শহরেই একজন মহিলাকে চিনি, বছর কুড়ি আগে তার বিয়ের পরের ঘটনা। তার জা তাকে বলেছিল, বাড়ির দোতলায় সালোয়ার কামিজ পরে থাকতে পারো, কিন্তু একতলায় তোমায় সবসময়েই শাড়ি পরতে হবে। তার জীবনসঙ্গী এগুলোকে প্রশ্রয় দেন। তার মানে আমরা প্রতিবাদ করি না। বছর দশেক আগে কলকাতা-সন্নিহিত অঞ্চলে শুনেছি, যে ছেলেমেয়ে দুটি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করতে চলেছিল তাদের মধ্যে মেয়েটি ছেলেটির চেয়ে বছর চারেকের বড়। তাই নিয়ে তাদের কর্মক্ষেত্র, তাদের পাড়াপ্রতিবেশী ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ তাদের পক্ষে ছিলেন। কোনও এক ‘শিক্ষিত’ ও ‘প্রগতিশীল’ পরিবারে দেখেছি যে একজন ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে ‘মানসিক অসুস্থতা’র কারণে ঘরে আটকে রাখেন। ভদ্রমহিলা একজন স্কুলশিক্ষিকা। আশেপাশের প্রায় কোনও মানুষই এর প্রতিবাদ করেন না বা ‘অন্যের পারিবারিক বিষয়ে’ মাথা ঘামাতে চান না। অর্থাৎ নীরব থাকতেই আমরা অভ্যস্ত। নিম্নবিত্ত মহিলারা যারা বাজারে সবজি নিয়ে বসেন বা মাছ বিক্রি করেন, পুরুষ খদ্দেররা অনেক সময়ই তাদের সঙ্গে অশ্লীল ব্যবহার করেন। ধমক দিয়ে কথা বলেন। আমরা বেশিরভাগই পাশ কাটিয়ে যাই। যে নারী সারা দিন ঘুরে ঘুরে লোকের বাড়ির কাজ করে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে মাতাল পুরুষটির হাতে নিগৃহীত হয়, তার হয়ে বলার কেউ নেই। আমরা উটকো ঝামেলায় জড়াই না। তাহলে প্রথমত আমরা নারীকেও আমাদের মতো করে নির্মাণ করি। আর দ্বিতীয়ত আমরা রাজনৈতিকভাবে সঠিক থেকে প্রতিবাদ করার উপায় খুঁজি। আমরা ধর্ষণ ও খুন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। মনে করি না আমাদের সব প্রশ্রয়, আমাদের সব প্রতিবাদহীনতা এসবের পটভূমি তৈরি করে রেখেছিল। সম্প্রতি হায়দ্রাবাদ ও উন্নাওয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই বলেন যে মেয়েদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপরাধকে নিয়ে অযথা রাজনীতি করা উচিত নয়। আমার মনে হয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই বিষয়টাকে দেখা উচিত। আমাদের সংসদ আলো করা, মঞ্চ কাঁপানো, বাগ্মী নেতারা বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে মহিলাদের নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করেছে। আমাদের রাজনীতি কখনও অত্যাচারিতা মেয়েটির জন্ম, জাত, ধর্ম, পেশা, পোশাক এসব বিষয়ে কথা বলে অত্যাচারকে অনুমোদন করেছে। কোনও কোনও নেতা অত্যাচারিতা মেয়েটিকেও অপরাধীর সঙ্গে সমানভাবে দায়ী করেছে। কোনও দল এই জঘন্য অপরাধীদের স্বপক্ষে মিছিল বের করেছে, কখনও বা মালা দিয়েছে। কিছু রাজনৈতিক দল অভিযুক্তদের ভোটে লড়বার টিকিট দিয়েছে। এতে কি এই বার্তা পৌঁছয় না যে অপরাধ করলেও রাজনীতির ছত্রছায়ায় থাকলে পার পাওয়া যায়।

টিভির নিউজ চ্যানেলগুলিতে প্রাইম টাইম ডিবেটে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্ররা উগ্র ও অশ্লীলভাবে একে অপরকে আক্রমণ করে। অন্যের মত শোনার ধৈর্য এই বক্তাদের নেই। আমাদের তরুণ তরুণীদের কাছে কী বার্তা পৌঁছচ্ছে? আমরা কি আমাদের তরুণ তরুণীদের অসহিষ্ণু এবং আগ্রাসী মনোভাবসম্পন্ন করে গড়ে তুলছি না? অথচ এই সব নিয়ে প্রতিবাদ করার সময় আমরা অনেকেই রাজনৈতিকভাবে সঠিক থাকার চেষ্টা করি। বা আদৌ প্রতিবাদ করি না। আমরা চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায় থাকি।

আমার চেনা এক তরুণী বলেছিল যে তার ‘স্বামী’ তার প্রতি খুব যত্নবান। তাকে কোথাও একা ছাড়ে না। সব সময় আগলে আগলে রাখে। বহু চেষ্টা করেও বোঝাতে পারিনি যে এটা ‘শিভালরি’ এবং ‘অধিকারবোধ’, এটা কোনও যত্ন বা ভালোবাসা নয়। রাষ্ট্রের উচিত মহিলাদের নাগরিক হিসেবে যথেষ্ট নিরাপত্তা দেওয়া। স্বাধীনতার বিনিময়ে কোনও সুরক্ষা তাদের প্রয়োজন নেই। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বলিউডের সিনেমায় প্রায় সাদাকালো জমানা থেকেই পেশীবহুল পৌরুষ এবং রক্ষা করার নামে নারীকে বেঁধে রাখাকে বড় করে দেখানো হয়েছে। আর আজকের দুনিয়ায় তো আমাদের জীবন অনেক বেশি ফিল্মি। রোজ নতুন নতুন চমক। সেভাবেই হায়দ্রাবাদ ঘটনার পরে চলে এল রাষ্ট্রের আরেক চমক ‘এনকাউন্টার’। পুলিশ ভোরবেলা চার অভিযুক্তকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলল। এ নিয়ে আবার সমাজমাধ্যম-রাজনীতি ইত্যাদি দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। কেউ পুলিশকে বাহবা দিয়ে বলছেন যে যা হয়েছে বেশ হয়েছে, এ সব জঘন্য অপরাধীর এই শাস্তিই প্রাপ্য। যেন এই চারজনকে মেরে ফেললেই রাতারাতি সবাই পালটে যাবে। আবার কেউ যুক্তি দিচ্ছেন যে বিনা বিচারে ‘এনকাউন্টার’ কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ তারা এখনও অভিযুক্ত, অপরাধী নয়। আর বিচারকের ভূমিকা নেওয়ার অধিকার পুলিশের নেই। অপরাধের বিরুদ্ধে অপরাধ কোনও পথ দেখাতে পারে না। আইনের সাহায্য নিয়ে হোক বা আইনকে তোয়াক্কা না করেই হোক, হত্যা তো হত্যাই। এদের কেউ বলেছেন যদি নিরপরাধ মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয় আর প্রকৃত অপরাধী পার পেয়ে যায় তো সেটা আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে। এভাবেই নানা যুক্তি ও পালটা যুক্তিতে সমাজমাধ্যম তোলপাড় হল।

প্রশ্ন হল, যারা পুলিশের এই ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, যারা অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি করছেন, তারা সবাই কি আক্রান্ত মহিলাদের বিষয়ে যথেষ্ট সংবেদনশীল? যখন রাস্তার মোড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলাকে সবাই ঢিল ছুড়ে উত্যক্ত করে, তখন এরাই পাশ কাটিয়ে যায় কিংবা মজা দেখে, যখন ক্লাবের ছেলেরা কোনও মেয়েকে একা পেয়ে বিরক্ত করে, তখন এরা নিরাপদ দূরত্বে থাকাই শ্রেয় মনে করে। কিছুদিন বাদেই সব ‘ঠিক’ হয়ে যায়। হ্যাঁ তাই। আবার বিয়েবাড়ি, জন্মদিন, পুজো, পার্বণ, বেড়ানো, খাওয়া…। পাতলা হয় সমস্ত মিছিল। এরপর পাড়ায়, শহরে, রাজ্যে, দেশে আরও কত ঘটনা ঘটে যায়, তা নিয়ে ভাবার মতো বিন্দুমাত্র ফুরসত কি আছে আমাদের? অপরাধীদের গুলি করে মেরে ফেললে বা ফাঁসি দিলেই কি সবার মানসিকতায় বদল ঘটে? এই ঘটনা কি বন্ধ হয়ে যায়? যখন প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও আদিবাসী মেয়ের সঙ্গে এই অপরাধ হয় তখন হয়ত ‘সবকিছু স্বাভাবিক’ থাকে। রাজনৈতিক পেশীশক্তি সম্পন্ন লোকেরা যখন কোনও মেয়ের ওপর নারকীয় অত্যাচার করে তখন আমরা ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ থাকি কিংবা সঠিক সময়ের অপেক্ষা করি। আসলে এটাই আমাদের সমাজ, এই হল আমাদের রাজনীতি। এ সমাজ মেয়েদের পোশাক নিয়ে, রাত্রিবেলা বেরোনোর সময় নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এখানে বোসো না, ওখানে ঘুরো না, ওভাবে কথা বলতে নেই— এভাবেই চলে নারীর নির্মাণ। মেয়েদের তো যথেষ্ট শিক্ষা দেওয়া হল, এবার একটু ছেলেদের শিক্ষা দেওয়া হোক। গৃহশ্রমকে মর্যাদা দিতে শেখানো হোক, পথচলতি মহিলাকে সহনাগরিক হিসেবে ভাবতে শেখানো হোক, বাড়ির ছেলেটিকেও ঘরের কাজ শেখানো হোক। মেয়েদের মন, মেয়েদের মনন, মেয়েদের মেধা, মেয়েদের যোগ্যতা যেন হারিয়ে না যায়। ‘স্ত্রীর পত্রে’ মৃণাল লিখেছিলেন—

আমার একটা জিনিস তোমাদের ঘরকন্নার বাইরে ছিল, সেটা কেউ তোমরা জান নি। আমি লুকিয়ে কবিতা লিখতুম। সে ছাইপাঁশ যাই হোক-না, সেখানে তোমাদের অন্দরমহলের পাঁচিল ওঠে নি। সেইখানে আমার মুক্তি; সেইখানে আমি আমি। আমার মধ্যে যা-কিছু তোমাদের মেজবউকে ছাড়িয়ে রয়েছে, সে তোমরা পছন্দ কর নি, চিনতেও পার নি; আমি যে কবি সে এই পনেরো বছরেও তোমাদের কাছে ধরা পড়ে নি।

এনকাউন্টারের পরে আমার খুব চেনা কলকাতাবাসী এক তরুণ তার কাছের দুয়েকজনকে একটা মেসেজ করেছিল—

প্রতি বছর পঁচিশে ডিসেম্বর এলে অনেক প্রশ্ন আসে আমার মনে। ভয় করে, চিন্তা হয়।

সেটা ছিল বছর পাঁচেক আগের কথা। ২৫শে ডিসেম্বর। সেদিন বেশ ভালো শীত পড়েছিল। সন্ধের পর একটু বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। ফেরার পথে কেক নিয়ে আসার কথা। শীতের শহর তখন ছুটির মেজাজে। বড় রাস্তার ওপারের গলিতে একটা ছোট অনুষ্ঠানও চোখে পড়ল।

বেশ হাঁটছিলাম নিজের মনে। হঠাৎ একজন প্রৌঢ় আমার পেছনে অনেকটা এসে আমাকে ডেকে কথা বলতে চাইল। আমি তার পরিচয় জানতে চাওয়ায় বলল, তোমার মায়ের সঙ্গে আমার কিছুদিন আগেই বাজারে কথা হয়েছিল। তুমি হয়ত আমাকে তেমন চিনবে না। আমি অবশ্য অনেকবার তোমাকে বাজারে, বাসস্টপে, ব্যাঙ্কে দেখেছি। আমার কিছু মাথায় ঢুকছিল না। কী করেই বা এই লোকটা আমার মাকে এত ভালো করে চিনল? আমি তো এর বিষয়ে কিছুই জানি না। একথা সেকথার পর লোকটা বলল, আমার নাম ধীরেশ মুখার্জি, আমি সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। তোমার অনেক শিক্ষককেও আমি খুব ভালো মতো চিনি। তুমি আমার বাড়িতে একটু এসো, সেখানে তোমার সঙ্গে আরও অনেক কথা হবে।

আমি বললাম, আজ না হয় থাক। পরে একদিন হবে। লোকটা বলল, আজকেই আমি ফাঁকা আছি। পরে কোন দিন কোন কাজ পড়ে যায়। এরপর একটু এগিয়ে গিয়ে একটা নির্মীয়মান বহুতলে নিয়ে গিয়ে বলল, এটা হল গিয়ে আমাদের নতুন বাড়ি। সামনের বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমরা এখানে চলে আসব। এইখানে তো এখন কেউ নেই। তাই ভালো করে কথা বলা যাবে।

লোকটার সঙ্গে বাড়ির দোতলায় গিয়ে দেখলাম যে কোনও আলো নেই। এদিক ওদিক বাড়ি তৈরির সরঞ্জাম পড়ে রয়েছে। আমি ভাবলাম, মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে নিই। মা চিন্তা করবে। লোকটাকে বললামও এই কথা। তারপর আমি মাকে ফোন করে হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার থেকে ফোনটা রীতিমত কেড়ে নিয়ে সে নিজেই মায়ের সাথে কথা বলতে শুরু করল, বৌদি ও আমার এখানেই আছে। আপনি চিন্তা করবেন না। ওর সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগছে।

মা কিছু কথা বলার আগেই আমার ফোনটা কেটে দিয়ে লোকটা আসল চেহারা প্রকাশ করল। ও আমাকে সারা শরীরে মুখ লাগাতে বাধ্য করেছে। আমার ঘেন্না করছিল, আমার দম আটকে আসছিল। তারপর যখন ও আমার প্রাইভেট পার্টসে হাত দিতে গেল, তখন কোনও এক অজানা শক্তিতে লোকটার হাত ছাড়িয়ে সোজা দৌড় দিলাম বাড়ির দিকে। রাস্তায় দেখি যে আমার মা আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে। ডিসেম্বরের শীতেও দরদর করে ঘামছি। বাড়িতে এসে তিন-চারবার বমি করেছি। কোনও খাবার আমার গলা দিয়ে নামেনি। ঘণ্টাখানেকের বেশি রাতে ঘুমোতেও পারিনি।

এরপর মা মাসিরা লোকটাকে অনেক খোঁজার চেষ্টা করেছে। বাবা কিছু করেনি। দু একজন লোক এদিক ওদিক সন্ধান করেছে, কিন্তু তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। মা আমাকে ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারবাবু বললেন লোকটা পেডোফেলিক।

বিষয়টি অমীমাংসিত রইল। আজও আমি বাসস্টপে, বাজারে, পাড়ায় লোকটাকে খুঁজি।

এভাবেই কত কিশোর প্রতিদিন অত্যাচারিত হয়। কে তার খোঁজ রাখে?

পিংকি ভিরানি তাঁর বিটার চকোলেট বইতে বলেছেন–

“প্রত্যেক শিশুই নিরাপত্তাহীন, নির্ভরশীল আর সরল, সে ছেলেই হোক বা মেয়ে। সুতরাং যখন যৌন হেনস্থা হয়, তার শারীরিক, মানসিক এবং আবেগেপ্রবণ দিকটিকেও বিপর্যস্ত এবং অগ্রাহ্য করা হয়।” (Every child is vulnerable, dependent, innocent and needy, be it a boy or a girl. And so when it is sexually abused there is almost simultaneously the violation of its physical, mental and emotional state.)। এসব ঘটনার কথা খবরের কাগজে দেখেও সমাজমাধ্যমে আমাদের টাইমলাইন নিরুত্তাপ থাকে। আদিবাসী মেয়েটিকে যখন অকথ্য অত্যাচার করা হয়, সেনাবাহিনীর কিছু লোকেরা যখন মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে, কোনও পুলিশ যখন মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে আমরা ক্ষমতার সঙ্গে আপস করি।

রিকশচালক, বাস কন্ডাক্টার, সুইপার, বাস ড্রাইভার কিংবা যে কোনও নিম্নবিত্ত বা তথাকথিত ‘নিম্নবর্ণের’ মানুষের প্রতি আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের অবজ্ঞা, আমাদের অশালীন আচরণ ছোটদের কাছে কি বার্তা দেয়? ছোটরা শেখে ক্ষমতার দম্ভ দেখানোটা আগের প্রজন্মের কাছে অনুমোদিত। স্কুলে অটিস্টিক ছাত্র/ ছাত্রী যখন সহপাঠী এবং শিক্ষকের অমানবিকতার ফলে রেগুলার কোর্সে পড়াশুনা করতে পারে না, তখন তার সমস্যার সঙ্গে আমরা অনেকেই একাত্মবোধ করি না কিংবা বিষয়টাকে এড়িয়ে যাই।

এই সামাজিক অসুখের মূল কারণকে এড়িয়ে গিয়ে তাৎক্ষণিক দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য অসুখটাকে বাড়িয়ে তোলে। হিংসার বিরুদ্ধে হিংসা, হত্যার বিরুদ্ধে হত্যা আদৌ কি আমাদের কোনও পথ দেখায়?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...