কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
রাজামশাই যুদ্ধে যাবেন, সাগরপারে। রানি সুটকেসে যুদ্ধসাজ সাজিয়ে দিলেন, রাজামশাই ব্যাকপ্যাকে অস্ত্রশস্ত্র পুরে নিলেন, সারথি দরজায় রথ দাঁড় করিয়ে প্যাঁ প্যাঁ হর্ন বাজাল, রাজামশাই রানিকে তিনমাসের জন্য শেষবার প্রেমপূর্ণ আলিঙ্গন করলেন।
বলো রানি, কী চাও। সাগরপার থেকে কী আনব তোমার জন্য?
রানি ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখে রেখেছিলেন। রাজামশাই যে দেশে যাচ্ছেন সেখানে মাঠের পর মাঠ জুড়ে ভরে সাদা মেঘের মতো তুলো ফলে থাকে। সে মেঘ পেড়ে, ধুনে, চরকায় কেটে সুতো হয়। দেশের বুড়োবুড়িরা সেই পালকের মতো সুতো দিয়ে শাড়ি বুনে তাতে “অলওভার” সূচের কাজ করে। সূচ চালাতে চালাতে তাদের আঙুলের চামড়ায় গর্ত হয়ে গেছে; সূচ আর সূচ নেই, হাতের অংশ। আজীবন প্র্যাকটিসের পর জীবনের শেষাংশে পৌঁছে প্রায়ান্ধ বুড়োবুড়িরা যে শাড়ি বোনে তা স্বপ্নের মতো হালকা হয়।
রানি আদুরে গলায় বললেন, ওই শাড়ি আমার একখানা চাই।
রাজা রানির নাকে টোকা মেরে বললেন, তথাস্তু।
রথ যতক্ষণ না গলি পার হল বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়লেন রানি। রথ চোখের আড়াল হওয়া মাত্র রানির গলা থেকে গান ছিটকে বেরিয়ে এল। কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনেএএএ মনে।
এ গানের সঙ্গে জীবনে প্রথমবার পাড়ার ফাংশানে ন্যাড়া মাথায় রজনীগন্ধার মালা পেঁচিয়ে নেচেছিলেন রানি। সে নাচ অল্প অল্প এখনও স্মৃতিতে আছে। রানি ঘুরলেন এক পাক। অনভ্যস্ত, মোটা হয়ে পড়া শরীর টাল খেল। জুতোর বাক্সের কোণা ধরে সামলালেন রানি। চোখ চলে গেল বাক্সের ওপরের দেওয়ালে সূর্যপ্যাটার্ন আয়নার দিকে। চোখমুখ সুখে জ্বলজ্বল করছে। রানির গ্লানি হল। তাঁর তো এখন বিরহে আর্ত হওয়ার কথা। রানি মুখ বেদনাবিধুর করতে চাইলেন, যেমনটা হওয়া উচিত। যতবার চেষ্টা করলেন ততবার ঠোঁট ছেতরে মুখ হাসি হাসি হয়ে গেল।
ক্ষান্ত দিয়ে রানি রাজামশাইয়ের উনিশশো পঁচানব্বই স্কোয়্যার ফুটের থ্রি বিএইচকে জুড়ে ঘুরলেন, ফিরলেন, গলা ছেড়ে বেসুরে গাইলেন। ফ্রিজ খুলে দেখলেন দুপুরে কী খাবার আছে।
উচ্ছের চচ্চড়ি। কুমড়োর ঘ্যাঁট। জমে যাওয়া ঝোলে চিকেনের পিস।
রানির মন বিদ্রোহ করল। আজ কি ঘ্যাঁট খাওয়ার দিন? মনকে প্রশ্ন করলেন রানি, আজ কী খাওয়ার দিন? মন জবাব দিল, পোস্তবাটা দিয়ে ভাত। রানি তাক থেকে পোস্ত নামিয়ে বেশি করে বাটলেন, সর্ষের তেল আর কাঁচালঙ্কা ডললেন, তারপর অনেকখানি ভাত তা দিয়ে মেখে খেলেন।
অন্যদিন রানি খেয়ে উঠে টিভি দেখেন, আজ উবু হয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে খাটের নিচ থেকে বাক্স টেনে বার করলেন। বাক্সের মধ্যে তাঁর ন্যাড়া মাথায় ফুলজড়ানো নর্তকীজীবনের কিছু চিহ্ন লুকোনো আছে। কোণা ক্ষওয়া, পিচবোর্ডের ফিকেরং মলাটের ভেতরে প্রথম পাতায় একদা গোলাপি রঙের লেবেল। অঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য তৃতীয় শ্রেণীর কুমারী অমুককে পুরস্কৃত করা হইল। রানি অক্ষরগুলোর ওপর আঙুল বোলালেন। লেখা ফিকে হয়ে গেছে কিন্তু প্রাইজ পাওয়ার দিনটা এখনও ঝকঝকে। কী এঁকেছিলেন সে ছবিও স্পষ্ট মনে আছে। নীল নদী। বাদামী নৌকো। সবুজ জঙ্গল। পেখম মেলা বেগুনী ময়ূর। আকাশী রংপেন্সিল ঘষে ঘষে আঁকা মস্ত, অন্তহীন আকাশ।
ফ্ল্যাট কেনার সময় দালাল দুটো ফ্ল্যাট দেখিয়েছিল। তেরোতলার এই ফ্ল্যাটটা আর চারতলার একটা ফ্ল্যাট। এটার থেকে অনেক রিজনেবল। রানি আকাশ ভালোবাসেন বলে রাজামশাই তেরোতলারটাই নেওয়া স্থির করেছিলেন। কৃতজ্ঞতায় রানির চোখে জল এসেছিল।
রানি বই নিয়ে কিং সাইজ খাটে এলিয়ে পড়লেন। বাঁ বাহুতে মাথা রেখে ডান হাতে বই ধরে পড়তে শুরু করলেন। বাইরে জুনমাসের দুপুর গাঢ় হয়ে এল। রানির এসিতে দমবন্ধ লাগে, তিনি জানালা খুলে রেখেছিলেন। তপ্ত দুপুরের বাতাসের ঝিম রানিকে ঘিরে ধরল। রাজপুত্র চলেছেন টাস্ক পূরণে। তিনটি কঠিন টাস্ক। যা সফলভাবে সমাধা করে ফিরলে সিংহাসনে রাজপুত্রের অধিকার অবিসংবাদিত হবে। আপাতত রাজপুত্র চলেছেন ঘুমের পুরীর রাজকন্যার ঘুম ভাঙাতে। রাজ্যের সীমানায় ঢুকে রাজপুত্র দেখলেন কোথাও কোনও শব্দ নেই। গাছেরা পাতা নুইয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, ডালে ডালে নিশ্চুপ পাখিরা ডানা মুড়ে নিশ্চল, খেতে হালে জোতা বলদ কাত হয়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে, বলদের পেটে মাথা রেখে চাষি ঘুমিয়ে কাদা।
এত ঘুমের বর্ণনা পড়েই নাকি পোস্তবাটার মৌতাতে নাকি গ্রীষ্মের দুপুরের আমেজে— রানির চোখ লেগে গেল। স্বপ্নে রানি দেখলেন রাজপুত্র পা টিপে টিপে পালঙ্কে অচেতন রাজকন্যার দিকে এগোচ্ছেন। ধপধপে বালিশে কুচকুচে কেশ এলিয়ে কন্যে ঘুম যাচ্ছেন। এ কি মেয়ে না ছবি? রাজপুত্র মুহূর্তের জন্য কর্তব্যবিস্মৃত হয়েছিলেন, কন্যার শিয়রে রাখা সোনার কাঠি রুপোর কাঠিতে আলো ঠিকরে রাজপুত্রের চোখে পড়ে তাঁর ঘোর ভাঙাল। রাজপুত্র কাঠির দিকে হাত বাড়াতে যাবেন এমন সময়ে খোনা গলায় কেউ বলে উঠল, যত্তসব।
চটকা ভেঙে রানি ঠাহর করতে পারলেন না তিনি কোথায়। চারদিক অন্ধকার কেন? চেঁচিয়ে ওঠার আগে খেয়াল হল, বইয়ের অর্ধেক মলাট হাত থেকে খসে পড়ে চোখ ঢেকে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি বই সরিয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে যাবেন রানি, মুখ থেকে খানিকটা লালা ঝরে বইয়ের ওপর পড়ল। ছোটবেলা থেকেই রানির দাঁত উঁচু ছিল, হিতৈষীরা পইপই করে বাবামাকে বলেছিল এইবেলা ব্রেস পরিয়ে সোজা করে নিতে। রানিকে পরানো হয়েওছিল ব্রেস। রানি ছোটবেলায় দুষ্টু আর অবাধ্য ছিলেন; ব্রেস পরতে তাঁর অসহ্য লাগত। দেখ না দেখ খুলে রাখতেন। তারপর একদিন ব্রেস হারিয়ে গেল। দাঁত উঁচু রয়ে গেল। ফলত, এখন মুখ আপনা থেকে পুরো বন্ধ হয় না; ঘুমের সময় হাঁ হয়ে লালা গড়ায়। রানি নিজের লালাজনিত সমস্যা সম্পর্কে সচেতন এবং সতর্ক। সব জায়গায়, বিশেষ করে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সামনে রানি মরে গেলেও ঘুমোন না। এটা মোছেন, ওটা গোছান। লালাজনিত লজ্জা এড়ানো যায় আবার হাততালিও মেলে। কী কাজের মেয়ে! একমুহূর্ত বসতে পারে না।
নিজের বাড়িতে সে সব দুশ্চিন্তা করতে হয় না; ফলত, এইসব দুর্ঘটনা ঘটে।
রানি সুড়ুত করে লালার অবশিষ্টাংশ মুখের ভেতর টেনে নিলেন। একটা বিতিকিচ্ছিরি, কদাকার পাখি তাঁর খোলা জানালায় বসে আছে। আয়তন শালিখ পাখির মতো কিন্তু শালিখ নয়। কাক নয়, চড়ুই নয়, কোকিল, দোয়েল, ফিঙে, টিয়া তো নয়ই। এ পাখির পালকের রং কী বোঝার উপায় নেই কারণ পালক বেশি অবশিষ্ট নেই। কয়েকটা রংজ্বলা ধূসর পালক শরীরের এদিকওদিক সেঁটে আছে। সারা শরীরে, মাথায় ক্ষত; কয়েকটা পেকে ঘা হয়ে গেছে। বাঁ পা সিলের ওপর আলতো ছোঁয়ানো, যেন পুরো পেতে রাখলে ব্যথা করবে। ডানদিকের ডানা ভেঙে ঝুলছে। ড্যাবাড্যাবা জ্বলজ্বলে চোখ রানির দিকে সোজা তাকিয়ে আছে।
শব্দটা এর গলা থেকেই এসেছে।
মুখ আবার হাঁ হতে যাচ্ছিল, রানি সামলে নিলেন। হাত দিয়ে ঘষে মুখে লেগে থাকা লালার প্রমাণ মুছে নিলেন। ভাঙা ডানা তুলে পাখি নির্দেশ করল।
রানি ঠোঁটের ডানদিক ছুঁলেন। ভাঙা ডানা আরও একটু ডানদিকে সরতে বলল। ডানদিকে আঙুল সরিয়ে গালে লেগে থাকা লালার শেষবিন্দু মুছে নিলেন রানি।
এই গরমের মধ্যে বসে আছ কেন? এসি নেই নাকি?
এক পায়ে লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকে এল কুচ্ছিত পাখি।
রানির তখনও বাক্যস্ফূর্তি ঘটেনি, তিনি জানালা বন্ধ করে এসি চালালেন। পাখি ঘাড় বেঁকিয়ে এসির দিকে তাকিয়ে বলল, ক টনের?
এক।
এক টনের এসিতে ভালো কাজ দেয় না। খাটের ওপর বিছানার ওপর রাখা বালিশে শরীরের ভর ছেড়ে দিল পাখি।
ওপরের ফ্ল্যাটে মজুমদারেরা আড়াই টনের লাগিয়েছে। ঘর পুরোওও বরওওফ হয়ে থাকে।
একটু জল খাওয়াবে প্লিজ? রানি খেয়াল করলেন পাখির চোখেমুখে গলায় পরিষ্কার ভাবপ্রকাশ ঘটে। মজুমদারদের এসির খবর দেওয়ার সময়কার সর্দারির ভাবটা কেটে গিয়ে এখন একটা নকল বিনয়ের ভাব জায়গা নিয়েছে। রানি গেলেন জল আনতে। পাখি চেঁচিয়ে বলল, একটু ফ্রিজের জল মিশিয়ে দিও।
রানি গ্লাসে জল ভরতে ভরতে ভাবলেন ঘটনাটা কি সত্যি সত্যি ঘটছে? একটা বদখত পাখি তাঁর ঘরে ঢুকে এসে প্রতিবেশীর এসির গল্প তাঁকে শোনাচ্ছে? এ কি বাস্তব? নাকি রানি এখনও ঘুরছেন রূপকথার দুনিয়ায়? কিন্তু এই যে তিনি তাঁর মডিউলার কিচেনে, মার্বেলের শীতল মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, আধুনিকতম জল পরিশোধনীয় যন্ত্র থেকে মৃদু ঝর্নার আওয়াজ তুলে জল ঝরছে, এ তো রূপকথা নয়, ঘোর বাস্তব। ঘরে ফিরে আসতে আসতে রানির মনে হল এক্ষুনি তাঁর ঘুম ভেঙে যাবে আর তিনি আবিষ্কার করবেন কথাবলা পাখিটাখি কোথাও নেই। আজ দিনটা উচ্ছেরই, পোস্তবাটার নয়।
দরজায় দাঁড়িয়ে রানি দেখলেন কোলবালিশের ওপর পাখি চিত হয়ে শুয়ে। ঠ্যাং দুটো আকাশে তোলা, ঠোঁট হাঁ, চোখ বন্ধ। রানির বুক ধড়াস করে উঠল। দৌড়ে গিয়ে গ্লাস থেকে দু ফোঁটা জল ছিটোতেই পাখি ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ঠোঁট ডুবিয়ে অনেকখানি জল একবারে খেয়ে নিয়ে বলল, তুমি যে তৃষ্ণার্তকে জল দিয়ে, তাও আবার যে সে তৃষ্ণার্তের নয়, আমার, তেষ্টা মেটালে এইজন্য আমি তোমার উপকার করব ঠিক করেছি। এবার থেকে তোমার বাড়িতেই থাকব। অসুবিধে হবে, মানিয়েগুছিয়ে নেব।
থাকবে মানে? রানির চোখ কপালে উঠল। আমার বর পশুপাখিতে ভয় পায়।
তুমিও পাও নাকি?
রানি চুপ করলেন। তিনি পান না। তাঁর বরং পশুপাখির প্রতি আহ্লাদই আছে। তাও আবার যত খুঁতো, দাগী, রুগী পশুপাখি। বাপের বাড়ির পাড়ার যত চোখ কাকে-খোবলানো বেড়ালবাচ্চা, খোঁড়া গরু, বাচ্চা বিয়োতে বিয়োতে পেট পার্মানেন্টলি ঝুলে যাওয়া কুকুর— সব নন-ফোটোজেনিক, ভালোবাসার অযোগ্য জানোয়ারের নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল রানির।
সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই কদাকার পাখি রানিকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আদর্শ। কিন্তু রানি সে কথা ভাঙলেন না। তাঁর ভালোবাসার পোষ্যরা কেউ এই পাখির মতো দুর্বিনীত আর বিশ্বপাকা ছিল না। কথায় কথায় ঠোক্কর দিত না।
পাখি মুখ ব্যাজার করে বলল, ঠিক আছে, তাহলে মাঝে মাঝে আসব। উপদেশটুপদেশ দেব। সেগুলো যদি মেনে চলো তা হলে পরিস্থতির উন্নতি হলেও হতে পারে।
রানি বলতে পারতেন, অবনতি তো কিছু ঘটেনি, কিন্তু বললেন না। পাখির সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা তাঁর কম্ম নয়।
সেই থেকে পাখি আসত। খবর না দিয়ে দুমদাম এসে হাজির হত। তবে রানি পাখির আসাযাওয়া একেবারে আন্দাজ করতে পারতেন না তেমন নয়। যে সব দিনে ঘুম থেকে উঠে রানির মনে হত আজ দিনটা অন্যরকম, যে সব দিনগুলোয় রানির ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি ভেসে আসত, যে জীবনটা এই তেরোতলার জানালা থেকে দেখা পৃথিবীটার মতো সত্যি কিন্তু দূরের, যে জীবনে কিছু নিয়েই ভাবনা ছিল না, ফ্রকের বেল্ট ফরফরিয়ে উড়ে যাওয়া জীবন, যে সব দিনে রানির আনন্দ, দুঃখ সব একই সঙ্গে হত, হাসিকান্না সব একই সঙ্গে পেত, সেই সব দিনে রানি নিশ্চিত জানতেন, আজ পাখি আসবে।
একদিন পাখি বলল, তুমি আমাকে হেই হুই হ্যাট ম্যাট করে ডাকো কেন বলো দেখি? আমার একটা নাম আছে তো, নাকি নামের জায়গির তোমরা দুপেয়েরাই নিয়ে রেখেছ?
রানির লজ্জা হল। সত্যি, এমন তালেবর পাখির নাম না থাকাই আশ্চর্যের। রানি বললেন, কী নাম তোমার, শুনি।
হিরেমন।
রানি হাঁ করলেন। হিরেমন?
হিরেমন জানো না? প্রিয় বইয়ের লিস্টে এর ঝুলি তার ঝুলির মলাটের ছবি সেঁটে খুব যে দেখি লাইক বাগাও, হিরেমন জানো না?
আহা, জানব না কেন। কিন্তু সে হিরেমনের তো… আড়চোখে পাখির দিকে তাকিয়ে রানি চুপ করলেন।
পাখি রোঁয়া ফুলিয়ে বলল, শুনি শুনি, থামলে কেন?
হিরেমনের তো সোনার পালক, রুপোর ঝুঁটি, মুক্তোর চোখ, হিরের ঠোঁট…
পাখি, থুড়ি, হিরেমন ভাঙা ডানা তুলে রানিকে চুপ করিয়ে বলল, ব্যস ব্যস থামো। এইবার বলবে সে রাজারানির মন ভোলাতে গানও গায়, রাজকন্যার চুলও বাঁধে, রাজপুত্রের কেরিয়ারের ভবিষ্যদ্বাণীও করে। বইতেও লিখেছে আর তুমিও বিশ্বাস করেছ। যত্তসব।
একদিন হিরেমন এল হাঁপাতে হাঁপাতে। কোথা থেকে ঠোক্করমোক্কর খেয়ে। রানি তুলোয় স্যাভলন ভিজিয়ে ক্ষত পরিষ্কার করতে করতে বললেন, কী করে হল?
ব্যাটল স্কারস।
ব্যাটলে তুমিও কিছু দিলে নাকি সবাই তোমাকেই ধরে মারল? নির্ঘাত কাউকে উপদেশ দিতে গেছিলে?
স্যাভলনের জ্বালায় শিউরোতে শিউরোতে হিরেমন বলল, আরে ভুল দেখলে ধরিয়ে না দিয়ে পারি না বলেই তো…
পেট ভরে খাবার জল খেয়ে হিরেমন এসির হাওয়ায় নরম বালিশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। রানি পাশে শুয়ে চুপটি করে হিরেমনকে দেখলেন। জেগে থাকলে যার অত দাপট, অত ক্যাটর ক্যাটর কথা, ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে আহত ছোট পাখিটির মতো দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে নরম শরীর কেঁপে উঠছে, সম্ভবত ব্যাটলের দুঃস্বপ্নে।
রানি আঙুল ছোঁয়ালেন হিরেমনের গায়ে। ফিসফিস করে ষাট ষাট বলতে আলতো বুলিয়ে দিলেন। ধীরে ধীরে হিরেমনের শরীর স্থির, শ্বাস গভীর হয়ে এল।
কদিন পর রাজামশাইয়ের আবার সাগরপারের ডাক এল। রাজামশাইয়ের এই ঘনঘন বিদেশযাত্রায় রানি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সত্যি বলতে, ঘটকালি সংস্থার বিজ্ঞাপনে রাজামশাইয়ের সিভিতে তাঁর ভিজিট করা দেশ/শহরের লিস্টি দেখেই রানির মন খানিকটা গলে গিয়েছিল। বিদেশের ঝাঁ চকচকে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ছবি, বরফের ওপর লাফিয়ে ছবি, উষ্ণ পুলে শরীর ভেজানো ছবি (যদিও ওই মাংসল উন্মুক্ত শরীর দেখে রানির সামান্য গা গুলিয়েছিল এবং রানি তাড়াতাড়ি পরবর্তী ছবিতে অগ্রসর হয়েছিলেন), অ্যামিউজমেন্ট পার্কে মানুষপ্রমাণ মিকি মাউস জড়ানো ছবি, এয়ারপোর্টের পর এয়ারপোর্টে ভি দেখানো সেলফির সুনামি— রানির মন ভুলিয়েছিল।
ছবিতে ব্যাপারটা যেমন রূপকথার মতো দেখায়, সামনে থেকে তেমন দেখায় না।
হিরেমন ঠাকুরের থালা থেকে নকুলদানা ঠুকরে খেতে খেতে বলল, এই তো এল সেদিন। আবার যাবে? কদিনের জন্য?
বারো সপ্তাহ।
রানি স্পষ্ট দেখলেন, হিরেমনের ড্যাবা ড্যাবা চোখের ওপর দুটি অদৃশ্য ভুরুর বাঁ দিকেরটা বেঁকে ওপরে উঠে আছে।
তোমাকে একবার সঙ্গে নিয়ে গেলে পারে তো। ভালো লাগে? একা একা থাকতে?
এই প্রশ্নগুলো সবই রানির মনে উঠেছে। নিজের মগজকে চুপ করাতেই রানি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আহা আমি গিয়ে করব কী। সংসার দেখার জন্যও তো একজন দরকার। আমার কষ্ট হয় না। রোজ ফোন করে কথা বলে। খেয়াল রাখে। প্রতিবার যাওয়ার আগে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আমার কী চাই। আমি যা-ই চাই, সব এনে দেয়।
রানি প্রমাণ দেখালেন। এই যে কফিপট, এটা ইটালি থেকে আনা। আগের সপ্তাহের বিয়েবাড়িতে যে অথেনটিক জামদানিটা পরে গিয়েছিলাম, সেটা ঢাকা শহরের অথেনটিক তাঁতিদের অথেনটিক আঙুলে বোনা। আর ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে ঘরে যে সিংহের হাঁ-মুখ মুখোশ টাঙানো, সেটা আফ্রিকার আদিবাসী মানুষদের নিজে হাতে বানানো।
সে তুমি সস্তা জিনিস চাও বলে আনে। শাড়ি, কফিপট, সিংহের মুণ্ডু। এগুলো একটা চাওয়ার মতো জিনিস হল? ছোঃ।
রানি রেগে গেলেন। জিনিসগুলো মোটেই সস্তা না। তাছাড়া আমি আরও যদি দামি জিনিস চাই তাও এনে দেবে।
চ্যালেঞ্জ?
রানির কান গরম হয়ে গিয়েছিল। রানি বলে বসলেন, চ্যালেঞ্জ।
ঠিক আছে, তা হলে এবার যাওয়ার আগে একটা জিনিস চেয়ে দেখো, যদি দেয়। হিরেমন বলল।
ফস করে চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করে রানির একটু একটু ভয় করতে লাগল। হিরেমন যা বদমাইশ, হয়তো বলল, সোনার ঘোড়ার রুপোর ডিম এনে দিতে বল। কিংবা জলের তলার মৎস্যকন্যার ল্যাজের পালক। কিংবা গ্রিক রাক্ষুসি মেডুসার মাথা থেকে একখানা সাপ।
রানি বললেন, এক মিনিট এক মিনিট। যেটা আনতে বলবে সেটা বাজারে টাকা দিয়ে কিনতে পাওয়া যায় তো?
হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ। বাজারেও যেতে হবে না, পয়সা দিয়ে কিনতেও হবে না। সে জিনিস তোমার বাড়িতেই আছে।
*****
রওনা দেওয়ার আগের রাতে, আগামী দীর্ঘ বিরহের কথা মাথায় রেখে, রাজারানি ঘনিষ্ঠ হলেন। আলাপ গৎ ঝালা সেরে রাজামশাই চিৎপাত হলেন। রানি রাজামশাইয়ের বুকে মাথা রেখে হৃদপিণ্ডের ধকধক শুনতে লাগলেন। রানির কণ্ঠ আলিঙ্গন করে রাজার আঙুল রানির নরম পিঠে আঁকিবুঁকি কাটতে লাগল। মধুঝরা গলায় রাজা বললেন, বলো রানি, কী চাই এবার? কী আনব তোমার জন্য সাগরপার থেকে?
যেমন যেমন ঠিক করে রেখেছিলেন তেমন তেমন রানি বললেন, কী আবার চাই, সব তো আছে আমার।
আহা, তাও বলো। ওখানে শুনেছি ভালো গরম কোট পাওয়া যায়। পাহাড়ের ওপরের ঘন জঙ্গলে ফাঁদ পেতে ব্যাধেরা পাখি ধরে, তারপর তাদের পালক ছিঁড়ে ছিঁড়ে…
রানি তাড়াতাড়ি বললেন, না না ও সব চাই না।
তবে?
রানি বললেন, আ রুম অফ ওয়ান’স, থুড়ি, মাই ওন।
রাজার আঙুল থেমে গেল, ঘাড় ঘুরে গেল। গলা শুনে রানি টের পেলেন, রাজার ভুরু কুঁচকে গেছে।
তোমার নিজস্ব ঘর? গোটা বাড়িটাই তো তোমার নিজস্ব।
রাজারানির তেরোতলার ফ্ল্যাট তিন ঘরের। সাউথ ফেসিং, অ্যাটাচ বাথরুমওয়ালা মাস্টার বেডরুম। মাঝারি ঘরটা রাজামশাইয়ের ডেন। ওই ঘরে রাজা কাজের চাপ বাড়লে কাজ করেন। রাজামশাইয়ের বন্ধুবান্ধবরা এলে বসা হয়। তাঁর তিল তিল করে ডাউনলোড করা সিনেমার সিডির বাসা, রাজামশাই বলেন লাইব্রেরি, ওই ঘরেই। তিননম্বর ঘর ফাঁকা থাকে, আত্মীয়স্বজন এলে থাকতে দেওয়া হয়।
রানি বলতে পারতেন, তোমার মতো একটা ডেন আমার চাই, কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
রানি বললেন, ওই যে ছোট ঘরটা ফাঁকা আছে…
গেস্ট রুম? বাচ্চাকাচ্চা হলে যেটা নার্সারি হবে?
যতদিন না হচ্ছে ততদিন ভাবছি ওটা আমি ব্যবহার করি। একটা ছোট টেবিল আর চেয়ার যদি রাখা যায়… মোড়ের মাথায় ছুতোরের দোকানে বললে সস্তায় বানিয়ে দেবে।
টেবিলচেয়ারে তুমি করবে কী?
রানি চুপ করে রইলেন। তিনি নিজেও জানেন না কী করবেন। কিন্তু হিরেমন বলেছে আগে তো আসুক, তারপর দেখা যাবে কী করা যায়।
রাজামশাইয়ের রথ ভোঁ ভোঁ হর্ন দিতে দিতে গলি পেরিয়ে গেল। পরের কদিন রানি বাড়তি ঘরখানা নিজের জন্য তৈরি করতে লাগলেন। রাজকন্যা রাজপুত্রের জন্য বাঁচিয়ে রাখা ঘর নিজের ব্যবহারের জন্য গাপ করতে রানির মারাত্মক অপরাধবোধ হতে লাগল। বাড়তি জিনিস বাঙ্কে তোলা আর ড্রয়ারেপোরা হয়ে যাওয়ার পর খালি ঘর দেখে হিরেমন বলল, দিব্যি। খালি দেওয়ালের রংটা বড় ফ্যাটফ্যাটে।
রানি বললেন, ওরে বাবা, চেয়ারটেবিলে অনেক খরচ হচ্ছে, এর ওপর আবার ঘরে রং করানো যাবে না।
ওপরের মজুমদারদের ফ্ল্যাট রং হচ্ছে। ওদের একজনকে ডেকে বলে দাও না, সস্তায় দু পোঁচ বুলিয়ে দেবে। একটা তো মোটে ঘর।
রানি উৎসাহিত হলেন। বলব এই দুটো দেওয়াল নীল আর ওই দুটো দেওয়াল গোলাপি রং করে দিতে। তাহলে যা-ই হোক না কেন…
হিরেমন ঝাঁঝিয়ে উঠল। কবে কী হবে উনি এখন থেকে তাদের কথা ভেবে মরছেন। আগে হয় কি না দেখো, তোমার তো আবার কী সব পিসিওডি ফিসিওডি… তোমার নিজের কী রং পছন্দ সেটা বলো দেখি।
রানি মিনমিন করে বললেন, হলুদ।
তাহলে হলুদ রং-ই করাও। বাচ্চা হলে ওর ওপর নীল গোলাপি যা ইচ্ছে রং বুলিয়ে নিও। যত্তসব।
মজুমদারদের মজদুরদের মধ্যে ছিল একটা অল্পবয়স্ক ছেলে, বাবরি চুল, সারা গায়ে রংবেরং-এর ছোপ। সর্দার রংওয়ালা তাকে খালি পুরনো রং ঘষে তুলতে আর প্রাইমারের পোঁচ মারতে কাজে লাগায়। বেনারসির কল্কা, কুলো, ঘটি, আদিবাসী মুখ, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, মুষ্টিবদ্ধ হাতের মোটিফ ইত্যাদি ইন্টারেস্টিং কাজে হাত ছোঁয়াতে দেয় না, নিজে আঁকে। ছেলেটা রানিকে দেখে নরম মাটি বুঝে ভারি উৎসাহ পেয়ে বলল, আপনি চিন্তা করবেন না দিদি, থুড়ি, ম্যাম। আমি ঘর রং করে ডিজাইন এঁকে দিয়ে যাব। নো এক্সট্রা চার্জ।
সে মন দিয়ে রানির ঘরে কটকটে হলুদ রং করে তাতে সবুজ রঙের ট্যারাব্যাঁকা মেঘ এঁকে দিয়ে চলে গেল।
পরদিন সকালে ভ্যানরিকশা চড়ে চেয়ারটেবিল এসে গেল। রানির অনুরোধমতো ঘরের জানালার সামনে চেয়ারটেবিল বসিয়ে, টাকা গুনে ভ্যানওয়ালা চলে যাওয়ার পর রানি হলুদসবুজ ঘরে ঢুকে আস্তে করে দরজা দিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। গোটা ব্যাপারটা তাঁর ভারি বোকা বোকা ঠেকতে লাগল।
পাড়ার ছাত্রবন্ধু থেকে একটা ড্রয়িং খাতা আর চব্বিশটা রং পেনসিলওয়ালা একটা প্যাস্টেলের বাক্স কিনে আনলেন রানি। জানালা খুলে দিয়ে চেয়ারটেবিলে বসে ছবি আঁকলেন। দুপুর কখন বিকেল হল, বিকেল কখন সন্ধে, অনেক বছর পর এই প্রথম রানি টেরই পেলেন না। পরদিন হিরেমন এল। জলটল খেয়ে হাঁফটাফ ছেড়ে কোলবালিশের গর্তে আরাম করে বসে বলল, কই, নিজের ঘরে নিজের চেয়ারটেবিলে বসে কী করলে দেখাও।
রানি লজ্জা লজ্জা মুখে ড্রয়িং খাতা নিয়ে এলেন। তাঁর নিজস্ব ঘরের জানালা দিয়ে নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটবাড়ির পিলার আর লোহার শিকে ফালাফালা আকাশ দেখা যায়; সেই আকাশের ছবি এঁকেছেন তিনি।
হিরেমন বলল, তোফা। এবার এটার ছবি তুলে ফেসবুকে ছাপিয়ে দাও।
রানি হিরেমনের থাবার তলা থেকে খাতা ছিনিয়ে নিতে নিতে বললেন, পাগল নাকি? লোক হাসবে।
হিরেমন বলল, আহা, সে হল ভাড়া করে প্রদর্শনীতে টাঙালে লোক হাসত। ফেসবুকের পক্ষে এই ছবিই যথেষ্ট হয়েছে।
সময়ের চাকা ঘুরল। রাজামশাইয়ের আবার সাগরপাড়ির ডাক এল। আগের রাতে মিলনান্তে রাজা আবার জানতে চাইলেন, এবার রানির কী চাই।
রানি বললেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।
ঠান্ডা গলায় রাজা প্রশ্ন করলেন রানির হাতখরচা কম পড়ছে নাকি। রানি বললেন, না না, তুমি যা দাও তা তো আমি খরচই করে উঠতে পারি না। কিন্তু আমি নিজে চাকরি করতে চাই। বাড়িতে বসে বসে…
রাজা বললেন, আমি তো ভেবেছিলাম তোমার চাকরিবাকরির ইচ্ছে নেই।
রানি স্বীকার করলেন, চাকরি করার ইচ্ছে তাঁর সত্যিই ছিল না। রাজার চোখের মণি হয়ে, দাসদাসী খাটিয়ে, সোনার পালঙ্কে শুয়ে, রুপোর থালায় ভাত খেয়ে জীবন কাটানোই তাঁর অ্যাসপিরেশন ছিল, কিন্তু ইদানীং রানির ইচ্ছেগুলো কেমন ঘণ্ট পাকিয়ে গেছে।
বিনা এক্সপেরিয়েন্সে কে তোমাকে চাকরি দেবে? দেখি দিবাকরকে বলে, ওর কনসার্নে যদি কোনও ভ্যাকেন্সি থাকে। শখ হয়েছে, মিটিয়ে নাও।
রানি বললেন, ইয়ে মানে, আমি অলরেডি একটা চাকরির দরখাস্ত করে রেখেছি। ডাকও এসে গেছে।
রাজা বললেন, ওহ্।
রানির চাকরিটা হয়ে গেল। এখন সকালবেলা রানি রান্নাবান্না হুড়মুড়িয়ে সেরে রাজার সঙ্গেই বসে খান, একটাদুটো পদ কম রান্না হয়। রাজামশাইয়ের সঙ্গে নিজের টিফিনও গোছান। খাবারে নুনচিনি কম বেশি হয়। রানির রুটে জ্যাম থাকলে রাজা রানির আগে বাড়ি ফিরে আসেন। নিজেই নিজের চা বানিয়ে খান।
একদিন জ্যাম ঠেলে ঘামতে ঘামতে বাড়ি ফিরে রানি দেখলেন রাজা দরজার দিকে মুখ করে বসে আছেন। হাতে চায়ের কাপটাপ কিচ্ছু নেই।
উই নিড টু টক।
রানি উল্টোদিকের চেয়ারে বসলে রাজামশাই বক্তব্য শুরু করলেন।
দেখো বস্, আমি যখন বউ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম আমার প্রেফারেন্স পষ্ট লিখেছিলাম। আমি যখন বাইরে থাকব, ঘরে বউ আমার শিকড় হবে। আমি সংসারসমুদ্রে দাঁড় বাইব, বউ সংসারের হাল ধরবে। কমপ্লিট প্যাকেজ। বাহির অ্যান্ড ঘর। পুরুষ অ্যান্ড প্রকৃতি। ইন অ্যান্ড ইয়্যাং। বউয়ের প্রাইভেট ঘরে নক করে ঢোকার আর অফিস থেকে বাড়ি ফিরে নিজের চা নিজে বানিয়ে খাওয়ার শখ থাকলে আমি অন্যরকম বউ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিতাম। তাই তো? বুঝতে পারছ আমি কী বলছি?
রানি বললেন, পারছি গো। সত্যিই পারছি।
রাজা বললেন, বুঝেছ যখন তখন এইসব দিল্লাগি বন্ধ কর। লেটস অ্যাডমিট, যে পয়সা রোজগার করছ ওটা না করলেও কিছু না।
রাজার গলা নরম হল। চেয়ারের কিনারে এগিয়ে বসে হাত বাড়িয়ে তিনি রানির হাত ধরলেন। আমি বুঝি, তুমি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস একা থাকতে থাকতে বোর হয়ে যাও। লেটস ট্রাই ফর বেবিস, বেবস। এইসব চাকরি চাকরি খেলা কাটাও দেখি।
রানির বুকের ভেতর একটা পাখি ডানা ঝাপটাল। তিনি বললেন, আমি বরং বিয়ে বিয়ে খেলাটাই কাটাই, বুঝলে।
*****
রানির জবাব শুনে রাজা যা বললেন তা ছাপার অক্ষরে লেখার যোগ্য নয়। বাকি যারা শুনল তাদের কেউ বলল, ঠিক সময়ে রাজপুত্র রাজকন্যে না হলে এই হয়। কেউ বলল, আরে ধুর, দেখ গে অন্য কোনও চক্কর ।
চাকরিতে রানির দুয়েকজন বন্ধু হয়েছিল; লেডিজ হোস্টেল খুঁজে দিল। কয়েকটা বছর পেরিয়ে, খানদুয়েক চাকরি বদলে, হোস্টেল ছেড়ে রানি ভাড়াবাড়িতে উঠে এলেন। ওয়ান রুম, ওয়ান কিচেন, ওয়ান বাথরুম। সে বাথরুমের কল থেকে সারা রাত টপ টপ জলের ফোঁটা রানিকে ঘুম পাড়ায়। সে ঘরের চুনকাম করা খরখরে দেওয়ালে আয়না আর ক্যালেন্ডারের পাশে একটাই ছবি ঝোলে। রানির আঁকা। আকাশী আকাশ জুড়ে একটা রংচটা, ডানাভাঙা, হতকুচ্ছিত পাখি উড়ছে।
*****
ব্যস, আমার গল্প ফুরোল, নটেগাছটি মুড়োল। কেন রে নটে মুড়োলি? তাও আবার অসময়ে? গল্পের শেষে চরিত্ররা কে কেমন রইল না বলেকয়েই?
রাজামশাই কেমন রইলেন বলতে পারি না। কারণ এটা তাঁর গল্প নয়। যেহেতু এটা হিরেমনের গল্পও নয়, সে কেমন রইল না রইল তার খবর রাখা আমার দায়িত্ব নয়। তবে আমার ধারণা সে সুখেই আছে, কারণ হিরেমনকে খারাপ রাখা কারও কর্ম না।
গল্পটা রানির। জানা দরকার রানি কেমন রইলেন।
রানি, তাঁকে আর রানি বলা চলে না, তিনি এখন আগাপাশতলা কেরানি, সুখে রইলেন কি? মনে হয় না। প্রতি পদে গুনে গুনে টাকার হিসেব। বসের খোঁটা। সহকর্মীদের পলিটিক্স। ফেসবুকের ‘বসে আঁকি’ গ্রুপে নিজের আঁকা ছবি পোস্ট করে কখনও ‘কেয়া বাত,’ কখনও ‘চেষ্টায় কী না হয়,’ কখনও ‘অমুকের থেকে ঝাড়া’ প্রতিক্রিয়া।
যার প্রতিক্রিয়া যাই হোক না কেন, একজন আছে যে এসে কোনও কথা না বলে রানির প্রতিটি ছবির নিচে একটি করে লাইক দিয়ে যায়। সে প্রোফাইলের নাম হিরেমন, তার ডিপিতে একটি রূপকথার পাখির ছবি। সে পাখির সোনার পালক, রুপোর ঝুঁটি, মুক্তোর চোখ, হিরের ঠোঁট।
আজকাল পথ চলতে চলতে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকান রানি। যদি কোনও বদমেজাজি, কুচ্ছিত পাখি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়, উড়তে উড়তে যদি ভাঙা ডানা নেড়ে ‘হাই’ বলে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে পাখির ভাবনা অজান্তেই রানির মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। রানি অবাক হয়ে আকাশ দেখতে থাকেন। কী বিশাল, কী অন্তহীন।
থ্যাংক ইউ, শুভময়।
প্রতিবারের মত এবারেও ভালো লাগা জানালাম। চমৎকার পরিবেশনা ।
থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী। আমারও আপনার প্রশংসা পেয়ে মন ভালো হল প্রতিবারের মতোই।