সৌমিত্র দস্তিদার
লেখক তথ্যচিত্র-নির্মাতা ও প্রাবন্ধিক।
অবশেষে জামিন পেলেন শিলচরের অধ্যাপক, প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী সৌরদীপ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীল শ্রীযুক্ত মহামহিম নরেন্দ্রভাই মোদিকে ‘গণহত্যার নায়ক’ বলার ‘অপরাধে’ তাঁকে সঙ্ঘ পরিবারের ফতোয়া মেনে শিলচরের পুলিশ কয়েকদিন আগে অ্যারেস্ট করেছিল। অপরাধ এতই ‘গুরুতর’ যে নিরীহ সঙ্ঘীরা সৌরদীপের বাড়িতে অবধি ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ হামলা চালাতে বাধ্য হয়। আর কে না জানে গুজরাত থেকেই মহামহিমের পছন্দের শ্লোগান হচ্ছে, ‘ইয়ে গর্ব কি বাত হ্যায়/ পুলিশ হামারা সাথ হ্যায়’। তাই ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ বলতে বলতেই বিজেপি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও তাদের নানা নামের ভাইবেরাদরেরা সর্বত্রই, জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটি, আলিগড়, উত্তর পূর্ব, দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকায়, উত্তরপ্রদেশের অসংখ্য মহল্লায় সুযোগ পেলেই নিছক দেশের স্বার্থে পুলিশকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে, ট্যাঁকে গুঁজে একতরফা হামলা চালাচ্ছে। মন্ত্রী ছোট বড় সিকি আধুলি নেতারা প্রকাশ্যে একটি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে হুমকি দিচ্ছেন কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর হয় না। হলেও কোনও শাস্তি হবার প্রশ্নই ওঠে না। কেউ প্রশ্ন তুললেই তাকে বিচারপতি মাননীয় মুরলিধরের মতো রাতারাতি হিন্দি সিনেমার অদৃশ্য গডফাদারের অঙ্গুলি হেলনে বদলি হতে হয়। কখনও কখনও আবার মামলা চলাকালীন আচমকাই গাড়ির ধাক্কায় কোনও না কোনও বিচারপতিকে ‘দুর্ঘটনা’য় মারাও যেতে হয়।
স্বাধীনতার আগে অন্তত উনিশশো সাঁইত্রিশ অবধি যে কোনও দাঙ্গার কারণ বিশ্লেষণ করলে এটা পরিষ্কার ছিল যে ধর্ম নয়, প্রায় সবকটি দাঙ্গা-হাঙ্গামার পিছনে ছিল জমিদার ও রায়তদের মধ্যে তীব্র সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য। তখন ভারতীয় উপমহাদেশ পুরোপুরি কৃষিপ্রধান, আয়ের মূল উৎস কৃষিনির্ভর। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমি পুরোটাই প্রায় কেন্দ্রীভূত ছিল হিন্দু উচ্চবর্গের হাতে। আর প্রজাদের বড় অংশ মুসলিম ও নিম্নবর্গের হিন্দু। হিন্দু জমিদারের বিপুল অত্যাচার সইতে না পেরে গরীব কৃষক প্রতিবাদ করলেই তাকে কোনও না কোনওভাবে ধর্মীয় রং লাগানো ছিল হিন্দু জমিদারদের দস্তুর। দেশভাগের দশ বছর আগে, যখন সর্বজনীন ভোটাধিকার চালু হল তখন মুসলিম জনতার এক বড় অংশ মুসলিম লিগের নেতৃত্বে নিজেদের স্বাধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার হবার পর থেকে নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক মৌরসিপাট্টার ভাগবাঁটোয়ারার দ্বন্দ্বে খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক রং লেগে গেল।
দিল্লি গণহত্যায় কতজনের মৃত্যু হয়েছে বা কতজন আহত তা নিয়ে চাপানউতোর চলতেই থাকবে। সঠিক সংখ্যা হয়তো কোনওদিনই জানা যাবে না। যেমন জানা যায়নি ভাগলপুর, নেলি, গুজরাত, মুজফফর নগরে ঠিক কতজন মানুষ ধর্মীয় সন্ত্রাসে খুন হয়েছেন। প্রত্যেক দাঙ্গা বা গণহত্যার পিছনে কোনও না কোনও কারণ থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রভাব-প্রতিপত্তি ধ্বংস করে নিজেদের বাজার সম্প্রসারণ করতে চায় বলেই ইচ্ছে করে দাঙ্গা লাগায়। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বিজেপির এই মেরুকরণের রাজনীতি করা ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। সংখ্যার জোরে সংসদ দখলের পর থেকে বিজেপি নিশ্চিন্ত ছিল একটুআধটু তর্জন-গর্জন বাদ দিলে বিরোধী পক্ষের ক্ষমতা নেই তার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতিকে আটকাবার।
আপাতভাবে এবারের দিল্লি গণহত্যার ধরন দেখলে মনে হবে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি করে চলেছে, যেভাবে নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে এ তারই এক বর্ধিত সম্প্রসারণ। কিন্তু জেএনইউ-এর ছাত্রদের ওপর সঙ্ঘী সমর্থকদের হামলা, জামিয়া মিলিয়ায় পুলিশের ঘৃণ্য আক্রমণ, খোদ সংসদে দাঁড়িয়ে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এনআরসি বা ক্যা নিয়ে মুসলিম বিদ্বেষ বা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘পোশাক’ মন্তব্যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সামান্য হলেও পিছু হটতে বাধ্য হয় বিজেপি সরকার। মুখে না বললেও শাহিনবাগ থেকে পার্কসার্কাস দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মূলত সাধারণ মহিলাদের মাথা উঁচু করে লড়াই কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে এদেশের শাসকদের। দিল্লির গরীব মানুষের বাস জাফরাবাদ ও অন্যত্র পুলিশ গুন্ডা নিয়ে গেরুয়া বাহিনীর বর্বর হামলা একধরনের ভয় থেকেই। সংসদীয় রাজনীতিতে জেতা যত সহজ, রাস্তার গণআন্দোলনের মোকাবিলা যে ততটা সোজা নয়,তা আরএসএস-এর রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি অন্য অনেকের চেয়েই ভালো বোঝে। বিজেপি জানে যে ফিয়ার সাইকি বা ভয়ের আবহ তৈরি করে আমজনতাকে সে দমিয়ে রাখতে চায়, তা একবার কেটে গেলে বা মানুষের মনের ভয় একবার কেটে গেলে তার কাগুজে বাঘের চেহারা বেআব্রু তো হবেই, তার লৌহকঠিন ভাবমূর্তিও মুখ থুবড়ে পড়বে।
পাশাপাশি একটু আগে যা বলছিলাম যে দাঙ্গার পিছনে থাকে অর্থনৈতিক স্বার্থ। মনে রাখবেন এবার যেখানে যেখানে হামলা হয়েছে অধিকাংশই গরীব মানুষের বাস। পুরনো মহল্লা। অভিজাত ঝা-চকচকে দিল্লির সঙ্গে এই ঝুগ্গিবস্তির কোনও মিল নেই। পুলিশ, রাজনীতিক, জমি-মাফিয়া, প্রোমোটার চক্র জানে এই মহল্লা থেকে গরীব উচ্ছেদ একবার করা গেলেই তথাকথিত উন্নয়নের বিজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি মুনাফা ও দলের ফান্ডের শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব। এই অর্থনীতি-রাজনীতির সাঁড়াশি আক্রমণের বলি হতে হয়েছে অসংখ্য নিরীহ নির্দোষ সাধারণ মানুষকে। অবশ্য শুধু এবার কেন, সব কালেই পৃথিবীর সর্বত্রই তো দাঙ্গার আগুনে সর্বস্বান্ত হন গরীব মানুষই। এবারও ঠিক তাই হল। এই হিংসার আগুন শাসককে কতখানি ক্ষমতাবান করল নাকি দেশের সাধারণ মানুষকে শাসকের বিরুদ্ধে চোয়াল শক্ত করে লড়বার প্রতিজ্ঞায় দীক্ষিত করল, আগামী দিনে সেটাই দেখার।

লেখক তথ্যচিত্র-নির্মাতা ও প্রাবন্ধিক।