আশ্চর্য বাঁশি

শ্রীজাতা গুপ্ত

 



লেখক গবেষক। কবি ও গদ্যকার।

 

 

নির্জন রাস্তাঘাট দেখে আমার দীপ্তি নাভাল-ফারুখ শেখ-এর প্রেমের মত মনে হয়। ঝকঝকে পিচ-রাস্তায় পিন-হোল ক্যামেরা এফেক্ট-এ গোল গোল আলো মাখা কৃষ্ণচূড়া বা জ্যাকার‍্যান্ডার সারি। কী অভূতপূর্ব প্রিভিলেজড-জন্ম নিয়ে বেগুনি বিছানায় গড়াগড়ি খাই। ওয়ার্ক ফ্রম হোমের বিলাসিতার শেষে রয়েছে মাস মাইনে। মাঝখানে দ্বিপ্রাহরিক ঘুম। বাছাই করা গ্রীষ্মের হালকা রঙের পর্দা ছেঁকে যে ভ্যানিলা আলো আমার শয্যাসঙ্গী, তার গায়ে আভেন-ফ্রেশ কেকের সুগন্ধ।

শুয়ে ভাবি, কী অস্থির পরিস্থিতি এই পৃথিবীর, কিছুতেই মন বসাতে পারছি না কোনও কাজে। যাঁরা দিন-আনি-দিন-খাই তাঁদের চলছে কীভাবে? এইসব দোষী বিবেক মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ে আমাদের আলোকপাপ্ত কথোপকথনে। অমুক দেশ এত বড়লোক, তারাও কেন সামলে উঠতে পারছে না এই ধাক্কা? তমুকদের কী কী করা উচিৎ ছিল? আমাদের কি অন্য কোনও ইকোনমিক মডেল ফলো করা দরকার? সুষ্ঠুভাবে লকডাউন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কি আমাদের দেশে সম্ভব? এইসব আলোচনা গড়াতে গড়াতে নিগূঢ় প্রেমালাপের দিকে দ্রুতধাবমান হয়। সারা শরীরে মনে সেই আশ্চর্য শিহরণ। আরও, আরও অনেক ভাবতে ইচ্ছা করে। আরামকেদারায় দুলে দুলে নতুন থিওরি দিয়ে জগৎটাকে এক নিমেষে আগের চেয়েও স্বাভাবিকতর করে ফেলতে ইচ্ছা করে। আর এইসব আলোচনার চূড়ান্ত মুহূর্তে দুজনেরই একসঙ্গে মনে পড়ে, থিওরি টাঙিয়ে ভাবনাচিন্তার জাল বিস্তার করা, সেও এক মহার্ঘ্য প্রিভিলেজ বৈকি।

এই যে থেকে থেকে মনে পড়ছে, আজ কার ঘরে চাল বাড়ন্ত, কাল কার কাছে দুদিনের বাজার সামগ্রী কিনে রাখার সামর্থ্য নেই, এইসব কথা বুঝি কেবল আজকেই মনে পড়ার ছিল? কেন মনে পড়েনি, দুর্গাপুজোয় পাঁচটার জায়গায় ছটা শাড়ী কেনার সময়ে? কেন মনে পড়ে না রোজ রাতে শেষপাতে তিরিশ টাকা দামের মিষ্টি না হলে খাওয়াটা ঠিক যুতসই হল না বলার সময়ে? কেন? কেন? কেন? আঙুল তোলেনি কেন দৈনন্দিন পদক্ষেপে পূর্বপ্রজন্ম, এই ক্রমবর্ধমান বিভাজনের দিকে? সেই অপরূপ রিফট ভ্যালির এপার থেকে আমরা দেখি ওপারের ঐতিহাসিক ভুল। ক্ষয়ক্ষতি কারুকাজ। ওপার থেকে দেখা যায় রক্তমাখা সূর্যাস্ত। ঠিক যেন দেশি গ্র‍্যান্ড ক্যানিয়ন। কোনও প্রযুক্তিবিদ্যাতেই আজ দুইয়ের মধ্যে সেতুনির্মাণ অসম্ভব।

পূর্বসূরিদের দোষারোপ করতে করতে, নিজের প্রিভিলেজের উপর নিজের কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকার দুঃখ করতে করতে, বর্তমানে আশেপাশের নির্বোধ মানুষদের উদ্দেশ্যে খানদানি গালিগালাজ করতে করতে আমি আরেকবার দুপুরের দিকে ফিরে শুই। ইনবক্সের দিকে ঘুরে দাঁড়াই। বন্ধুর কাছে আবদার জানাই, বাজনা শোনাও। একখানি স্পন্টেনিয়াস বাজনা এক্ষুণি শোনাও। নইলে আর কোনওকিছুই স্বাভাবিক হবে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঠো সুরে আচ্ছন্ন হই। নেশার মত। বোরিয়াল ফরেস্টের অভ্যন্তরীণ সুর। অথবা সোনাঝুরির বন। যত এগোই, মনে হয়, সুর ছুটেছে তার চেয়েও দ্রুত। দূরের থেকে দূরে। ক্লান্ত পা আর চলে না যখন, মাটিতেই বসে থাকি, সুর শুনি, পিঠ ঠেকে যায় আর কারও পিঠে। ঘুরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করি না। এইবার চিনেছি সুর। যে বাঁশি দিয়েছিলাম ‘এক আশ্চর্য রাখাল ছেলেকে’, এ তারই খেলা। আমি তাকে ভালো করেই চিনি। এক বছর, লক্ষ বছর, অনন্তকাল পিঠোপিঠি বসে থাকি আমরা। শিরদাঁড়ার সঙ্গে জুড়ে যায় শিরদাঁড়া। হাড়ের মধ্যে মধ্যে পলি জমে। বালি, আর বরফ। দুর্মূল্য রত্নভাণ্ডার। আমরা এখন নির্মীয়মাণ পাথর। আমি আর রাখাল ছেলের বাঁশি। পাথরের বুকে সুর জমে আছে ঢের। পাথরের ভিতর একদল মানুষ। তাদের ধরে জরিমানা ভরছে পুলিশ। সময়ের নিয়ম লঙ্ঘন করে তারা পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? জানে না? এই সময় গৃহবন্দি থাকার? সেই মানুষগুলো আপ্রাণ চেষ্টা করছে। পাথর ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলতে চাইছে, আমাদের গৃহ নেই। আমরা পথেঘাটে জন্মেছি, পথেই পড়ে থাকি। এই আমাদের গৃহবন্দিদশা। এইখানেই গৃহ। দেশের নাম: ফ্রান্স। ঘরে ঘরে মানুষ মহামারির প্রকোপে চলচ্ছক্তিহীন, তবু হাসপাতাল অবধি পৌঁছতে পারছে না। ভয়ে। ঘরের বাইরে সংক্রমণের তীব্রতায় তাদের আরও বিপদ হবে। বিনা ইন্সিওরেন্সে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য তাদের কই? দেশের নাম: উত্তর অ্যামেরিকা। আর, পাথরের অন্যদিকে হুড়মুড় করে গড়িয়ে নামছে মৃতদেহের ঢল। শহরের রাজপথে বাঁধভাঙা অচেনা নদীর মতন। দেশের নাম: একুয়াডর। আরও কত দেশ, আরও কত গ্রাম, আরও কত মৃত্যুকে নিপুণ হাতে জীবাশ্মে পরিণত করেছে আমার রাখাল ছেলের বাঁশি। বড় পাথর থেকে অজৈবিক প্রজনন পদ্ধতিতে সৃষ্টি হবে ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত প্রস্তর-সন্ততি। সংখ্যায় তারা শতকোটি। মিছিলে মিছিলে পার করে আসবে ২০০-৩০০-৫০০ কিলোমিটার পথ। ঘরে ফেরার পথ। ঘর। সে দেশের নাম: ভারতবর্ষ।

ছাদে কাপড়জামা শুকোতে দেখলে খানিকটা নিশ্চিন্ত হই। খাঁখাঁ রোদ্দুরে নিজের খেয়ালে উড়ে বেড়ায় আটপৌরে শাড়ি। চেককাটা গামছা। বিসদৃশ অন্তর্বাস। ভেনেশিয়ান সিটিস্কেপের মত দেখায়। নিস্তব্ধতা দেখলে প্রথমে মনে হবে নির্বাক ছবির দৃশ্য। সে ভুল ভেঙে হঠাৎ সিনে ঢুকে পড়বে অদৃশ্য সমুদ্রের শোঁশোঁ আওয়াজ। সেভাবেই এইসব ছাদের সিনে ঢুকে পড়ে আবহমান দিনলিপির সাক্ষর। প্রাণের সঞ্চার। যেভাবে টবের মাটিতে লুকোনো বীজের থেকে অবিচল বেড়ে ওঠে চারাগাছ। সূর্যমুখী হয়ে ওঠার প্রত্যাশায়। পৃথিবী রসাতলে গেলেও আমাদের ধোপদুরস্ত জামাকাপড়ের চাহিদা মেটে না। দিনশেষে কটকটে শুকনো রোদের ধুলোমাখা গন্ধময় জামাকাপড় ভাঁজ করে আমরা আলমারির নির্দিষ্ট তাকে তুলি। আলনায় টাঙিয়ে রাখি এক একটি ব্যর্থ দিন। কারাগারের দেয়ালে নখের আঁচড়ে গুনে রাখা এক একটি দিন।

ছাদের কাপড়জামা দেখে চিনে নিই প্রতিবেশীদের ফ্যামিলি স্ট্রাকচার। কোন বাড়িতে কজন মহিলা পুরুষ শিশু। তাদের কী কী রং পছন্দের। জানলার বাইরে থেকে ভেসে আসে ফোড়নের ঘ্রাণ। চায়ের চিনির হিসেব। ঝগড়া আর ভালোবাসার শব্দ। সকাল সকাল রাস্তা পেরিয়ে যায় সবজিইইইইইইইই, মাছ-চাই-মাআআআআছ? নিকোনো উঠোনে অস্থায়ী ফলমূল তরিতরকারির দোকান পাকাপাকি বন্দোবস্ত করতে উদ্যত। মুদিখানার দোকান আমাদের সব পেয়েছির দেশ। এ ঘর ও ঘর থেকে চলে কিঞ্চিৎ দরাদরি। কাল কিন্তু অবশ্যই নিয়ে এসো সজিনার ডাঁটা। সকালে যে কটা কুচো চিংড়ি নিলাম, আর তুমি আজকেই লাউ আনলে না? কী করি? বাটি চচ্চড়ি করে ফেলুন বৌদি, দেখুন কেমন ফনফনে কুমড়ো! নেবেন। ধীরে ধীরে পাড়া থেকে বেরোনোর প্রয়োজন কমে আসে আমাদের। সুপারমার্কেটের প্লাস্টিকে মোড়া ঝিঙে-আলু-টমেটো খামোখা মনে হয়। এই যে হাতের কাছেই ছোটখাটো চাষি পরিবার ছিল, মাছ-চাষি ছিল, তাদের সরঞ্জামেই আরামে দিন কেটে যায়, এ আমরা টের পাই মনে মনে। সন্ধ্যায় ছাদে হাঁটতে গিয়ে নাকে আসে ডিম-টোস্টের লোভনীয় সুবাস। উলটো ছাদে কিশোরী পা ছড়িয়ে বসে জামবাটি থেকে মুড়িমাখা খায়। আমাদের আর রোজ সন্ধ্যায় পিৎজা বা ফ্রায়েড চিকেনের জন্য শপিং মলের দিকে যাওয়া নেই। এইসব জমানো সময়ে আমরা আজকাল রেডিওতে শুনি অনুরোধের আসর। বিছানায় শুয়েশুয়ে দেখি ফিরে এসেছে চড়াই, দোয়েল, ফিঙে, কাঠঠোকরা। হাড়িচাঁচাঁ। ফিরে আসেনি। এখানেই ছিল।

এখানেই আমাদেরও ফেরবার পালা। প্রকৃতির কাছে। এত প্লাস্টিক জমিয়েছি দু হাতে, ঘরে ঘরে বসিয়েছি সামর্থ্যের আস্ফালন: এয়ার কন্ডিশানার। দূর দেশ থেকে বয়ে আনা নাম না জানা তরকারি খেয়ে জাহির করেছি নিজেদের ঝাঁ চকচকে সানন্দা-লাইফস্টাইল। তার যাতায়াতের পিছনে জ্বালানি পুড়ল কত? তাকে পাড়ার ছোটবাজার অবধি তরতাজা নিয়ে আসতে বিদ্যুৎ ব্যয় হয়েছে কতখানি? ভেবেছি? বদলে, দায়িত্ব নিয়ে গলিয়ে ফেলেছি মেরু হিমবাহ। এক টুকরো বরফের উপর আঁকড়ে বসে থাকা ভাসমান পোলার বেয়ারের ছবি শেয়ার করেছি। গরমে হাঁসফাঁস করে উঠলেই বলেছি, ওই তো গ্লোবাল ওয়ার্মিং। দার্জিলিঙে বরফ পড়ার খবর শুনে বলেছি, কী? কোথায়? তোমাদের গ্লোবাল ওয়ার্মিং? এইসব দুর্বিষহ পল্লবগ্রাহিতা থেকে, এ-আমির আবরণ থেকে স্লো-মোশনে রিভার্স গিয়ারে ফিরে আসা প্রয়োজন। আরও একটু এম্প্যাথির দিকে। আরও একটু পর্যবেক্ষণের দিকে। ব্যাঙ্কে তো যাওয়া যাচ্ছে না আজকাল। গাছপালাপশুপাখি পারিপার্শ্বিক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুঁজি চিনে নেওয়ার এই তো সুযোগ। এর চেয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়কারী জীবনবীমা আজ অবধি কোনও কোম্পানি আপনার কাছে পৌঁছিয়ে দিতে পারল?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4821 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...