হিন্দু রাষ্ট্রের কুচকাওয়াজ

ভেঙ্কিটেশ রামাকৃষ্ণাণ

 

 

ভেঙ্কিটেশ রামাকৃষ্ণণ এই সময়ের একজন অগ্রগণ্য সাংবাদিক। ফ্রন্টলাইন পত্রিকার সিনিয়র অ্যাসোশিয়েট এডিটর। রাজনীতি ও সমাজনীতি বিষয়ে বিশেষ রুচি রাখেন। মূল নিবন্ধটি ফ্রন্টলাইন পত্রিকার ২১ জুলাই তারিখের মুদ্রিত সংখ্যায় প্রকাশিত। মূল নিবন্ধটি পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন।

 

 

“অ্যায়সা ভাষণবাজী কা কেয়া মতলব হ্যায়? উওহ তো হিন্দুস্তান কা শাহেনশাহ হি হ্যাঁয়। চাহে তো উওহ য়ে কতল রোক সকতে হ্যাঁয়, জ্যায়সে এক রাত মেঁ নোটবন্দী কিয়া থা। (“এত ভাষণে কাজ কী? উনি হিন্দুস্তানের রাজা। উনি চাইলেই এই খুনোখুনি বন্ধ করতে পারেন, যেমন এক রাতের নোটিশে নোটবন্দী করেছিলেন।”)

–জালালউদ্দীন, ষোলো বছরের জুনেইদ খানের বাবা। জুনেইদ খানকে দিল্লীর কাছে হরিয়ানার ফরিদাবাদের খান্ডাওলি গ্রামে ট্রেনের ভেতর গণপ্রহারে মেরে ফেলা হয়।

“শুধু ‘অসহিষ্ণুতা’ বলে একে আর ব্যাখ্যা করা যাবে না। এ এক অত্যাচারী শাসনের উত্থান আর প্রতিষ্ঠা যে ভারত থেকে সংখ্যালঘুদের হঠিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আর এস এস) ধারণার অনুসারী হয়ে হিন্দু রাষ্ট্রের স্থাপনা করতে চায়।”

–বিচারপতি রাজিন্দর সাচার, দিল্লী হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, ফ্রন্টলাইন পত্রিকাকে

কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির মৌন সম্মতিক্রমে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের বিরুদ্ধে ঘটতে থাকা সাম্প্রতিক গণপিটুনি এবং হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে দু’দিনের ব্যবধানে করা এই দুটি উক্তি আমাদের দেশের সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার অভিজ্ঞান বহন করে। ২৯-এ জুন তারিখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মহাত্মা গান্ধীর সবরমতী আশ্রমের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তাঁর অংশগ্রহণের সদ্ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বাড়াবাড়ি বিষয়ে-– বিশেষ করে “গো ভক্তির নামে হত্যা” প্রসঙ্গে– তাঁর “বেদনা ও ক্ষোভ”-এর কথা জানিয়েছিলেন। জালালউদ্দীনের কথাগুলো তার এক দিন পরের। জালালউদ্দীন– যাঁর কিশোর সন্তানকে উন্মত্ত কিছু লোক “গোরুখোর” বলে বিদ্রূপ করে, তার মুসলমানী টুপি মাটিতে ফেলে পা দিয়ে ডলে, আর কালক্রমে উপর্যুপরি ছুরির আঘাতে তাকে মেরে ফেলে-– প্রধানমন্ত্রীর এই ক্লেশ আর কোপের প্রকাশে যা দেখতে পেয়েছেন তা কেবল বস্তাপচা বাগাড়ম্বর। সোজা কথায় তাই তাঁর বক্তব্য, যেভাবে এক ধাক্কায় মোদী নোটবন্দী করেছিলেন, তেমনি উনি চাইলে এক কথায় গোরক্ষার নামে এইসব খুনের ঘটনাগুলোকে বন্ধ করতে পারেন। জালালউদ্দীনের হাহাকারের মধ্যেকার না-বলা কথাগুলো প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় জনতা পার্টি এবং আর এস এসের নেতৃত্বে সংঘ পরিবারকে নিয়ে গড়া তাঁর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে এইসব ঘটনার অপরাধীদের অশুভ আঁতাতের দিকেই আঙুল তোলে।

বিচারপতি সাচারের ব্যথাহত মন্তব্যটি এল সেদিন, যেদিন ভারতের সতেরোটি শহরে হাজারে হাজারে মানুষ জড়ো হলেন গোহত্যার নামে খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে-– ‘নট ইন মাই নেম’ এই স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে। তিরানব্বই বছরের এই প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ছিলেন ২০০৫ সালে গঠিত একটি কমিটির প্রধান, যার কাজ ছিল আমাদের দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের হাল-হকিকত সম্বন্ধে একটি তথ্যনিষ্ঠ রিপোর্ট তৈরী করা। সাচার কমিটির রিপোর্টে মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অবস্থার কথা বিধৃত হল। রিপোর্টে এই অবস্থার থেকে বেরিয়ে একটি উন্নততর অবস্থার দিকে যাত্রা করবার দিকনির্দেশও দেওয়া হল।

‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বিচারপতি সাচার জানালেন, কেন্দ্রের সরকার এই রিপোর্টের অধিকাংশ সুপারিশের প্রতি নজর তো দেয়ইনি, উপরন্তু এমন একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে পুষ্ট করতে চাইছে যা কি না ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ন্যূনতম অধিকার আর সুবিধাগুলোকেও ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চায়।

‘নট ইন মাই নেম’ প্রতিবাদ আর জালালউদ্দীনের উপরোক্ত মন্তব্যের মধ্যবর্তী দিনে মোদী দেশবাসীকে জানালেন তাঁর “দেশে ঘটতে থাকা ঘটনার প্রেক্ষিতে বেদনা ও ক্ষোভ”-এর কথা। তবে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আন্তরিকতা ও সদুদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান জালালউদ্দীনের মন্তব্য হয়তো তাঁর একারই নয়। বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ অতীতে মোদীর অনুরূপ বিবৃতির সম্বন্ধে একই ধারণা পোষণ করেছেন। গুজরাটে প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ ভাষণের পরেই পুবের রাজ্য ঝাড়খণ্ডে একজন গো-ব্যবসায়ীকে গোরক্ষার নামে পাশবিকভাবে হত্যা করল দুষ্কৃতীরা। এর থেকেই বোঝা যায়, মোদী বা বিজেপিতে তাঁর সতীর্থেরা সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে হিংসা রুখতে কতটা তৎপর।

গো-ভক্তি হিংসা

বিগত তিন বছরে গো-রক্ষার নামে আক্রমণের ঘটনার নিন্দা প্রধানমন্ত্রী করেছেন মাত্র তিনবার। প্রতিবারই জনগণের বিরক্তি এতটাই বেড়েছিল যে সরকারী প্রচারকর্মীরা বুঝতে পেরেছিলেন-– এর পরেও চুপ থাকলে তার ফল মোদী ও সরকারের ভাবমূর্তির পক্ষে ক্ষতিকারক হবে। একইরকম উল্লেখযোগ্য বিষয় হল-– এই তিনবারের কোনও বারেই দুষ্কৃতীদের প্রতি নিন্দাজ্ঞাপন বা আক্রান্তের পরিবারের প্রতি শোকজ্ঞাপন কোনওটাই ছিল না। প্রথম নিন্দা বিহার বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের সময়ে, অক্টোবর ২০১৫-তে। এই নিন্দার আট দিন আগে, সেপ্টেম্বরের আঠাশ তারিখে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে খুন হলেন মোহম্মদ অখলাখ। গুণ্ডারা অখলাখের বাড়ি আক্রমণ করেছিল এই ভেবে যে, অখলাখ একটি গোরুকে মেরে তার মাংস ফ্রিজে রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নিন্দা, যেমন বলেছি, আক্রমণকারীদের উপর বর্ষিত হয়নি। তিনি বরং সমস্যার চারিধারে ঘুরে শেষকালে কি প্রকারে হিন্দু ও মুসলমান একসাথে এগিয়ে এসে গরীবীর বিরুদ্ধে লড়াই করবেন, এই পরামর্শ দিয়ে ফেলেন। সেই সময়ে এমন একটা ধারণা ছিল যে দাদরি এবং অন্যান্য ঘটনাগুলোর ফলে বিহার ক্রমে হিন্দুত্বের শক্তিগুলোর প্রতি বিরূপ হচ্ছে। মোদীর চেষ্টাটা ছিল ড্যামেজ কন্ট্রোলের।

“গো-ভক্তি” হিংসার দ্বিতীয়বারের নিন্দা হল যখন বিজেপি দল, বিভিন্ন রাজ্যে তাদের সরকার এবং কিছু সহযোগীর রাজনৈতিক ভাবমূর্তি কিছুটা চিড় খায়। জুলাই ২০১৬-তে গুজরাটের উনায় গোহত্যার দায়ে চারজন দলিতবর্গের মানুষকে মারধর করা হয়। এই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, এবং ভারত ও ভারতের বাইরের থেকেও ধিক্কারের আওয়াজ উঠতে থাকে। মোদীর এই ঘটনার নিন্দা অবশ্য আরেকটু বেশী সোজাসাপটা আর নির্দিষ্ট। উনি বলেন-– “কিছু মানুষ, আমি দেখেছি, সারা রাত অসামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে থাকেন, আর দিনের বেলা গোরক্ষকের পোষাক পরেন” উনি এ-ও বলেন, উনি জানেন যে এইসব গোরক্ষকদের শতকরা সত্তর থেকে আশি ভাগ আসলে অপরাধী। উনি আইনরক্ষকদের উপদেশ দেন এইসব অপরাধীদের নাম আইনের খাতায় নথিভুক্ত করার জন্য।

জুন ২৯-এ, অর্থাৎ তৃতীয় নিন্দার দিন, মোদী আরও সুর চড়িয়ে বলেন-– “দেশের চতুর্দিকে যা ঘটছে তাতে আমি ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। এই দেশ যেখানে কোনওদিন একটি পিঁপড়েকেও মারা হয়নি। এই দেশ যেখানে পথের কুকুরকে মানুষ খাবার দেয়। এই দেশে মানুষ সমুদ্রে মাছকে খেতে দেয়। বাপুর মতন একজন মানুষ এই দেশে অহিংসার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এ কী দশা আমাদের? এই কী আমার দেশ? বাপুর দেশ? এ কোথায় চলেছি আমরা?”

এই আবেগান্বিত বক্তব্যের জবাবে অখিলেশ যাদব, উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও সমাজবাদী পার্টির সভাপতি ফ্রন্টলাইনকে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আবেগ প্রচুর, কিন্তু এই ঘটনাগুলো আসলে মোদী সরকারের শাসনের লজ্জা। “উনি বিগত তিন বছর ধরে এই দেশ চালাচ্ছেন, আর বলছেন ‘আচ্ছে দিন’ আসছে। আর এখন নিজেই বলছেন এ কী দশা আমাদের? ঘটনাগুলো এমন দুঃখজনক না হলে একে একটা রাজনৈতিক রসিকতা বলা যেতে পারত। এই ধরণের ঘটনা দেশকে দুর্বল করে দেবে।” অখিলেশ জানতে চান এক বছর আগের (উনার ঘটনার পর) অপরাধী সনাক্তকরণের কী হল। “স্বাভাবিকভাবেই কিছু হয়নি। এটা একটা নিষ্ঠুর চমক ছাড়া আর কিছুই নয়। এর ফলে লাভবান হচ্ছে এই তথাকথিত গোরক্ষকের দল আর হিন্দুত্ববাদীরা, আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। মনে রাখবেন, এই বিজেপি নেতৃত্ব, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ধরে নিয়েই বলছি, এই হিন্দুত্ববাদীদেরই অংশবিশেষ।”

সবরমতীতে মোদীর বক্তৃতার দিনে ঝাড়খণ্ডের রামগড়ের গিড্ডিতে গোরু ব্যবসায়ী আলিমুদ্দীন আনসারিকে পিটিয়ে মারার ঘটনা, আর তার পরের ফাইল করা কেসগুলো অখিলেশের মন্তব্যকেই পুষ্ট করে। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস খুনের ঘটনার নিন্দা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তারপর কেস ফাইল হবার পর দেখা গেল বিষয়টাতে অনেক রকমের মোচড় রয়েছে। প্রাথমিকভাবে কেসটা করা হল “অন্তত দশ জন যারা রাঁচির কাছে আনসারির ভ্যান আটকে দেয় এবং তাকে আক্রমণ করে”-– এই বলে। কিন্তু সমান্তরালভাবে তলে তলে “নিষিদ্ধ গোমাংস” পরিবহণ ও বিক্রয়ে আনসারি ও তাঁর পরিবারবর্গের ভূমিকা-– এই মর্মেও একখানা কেস লাগু হল। আনসারির উপর আক্রমণের কারণ ব্যক্তিবিদ্বেষ বা ব্যবসায়িক অসূয়া-– দ্বিতীয় কেসে এইভাবে এই ধরণের সিদ্ধান্তে আসার একটা সূত্র ছেড়ে রাখা হল। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের কথায়-– “এই দুই কেসের কোনটা কেমন গতিতে এগোবে, সে তো জানা কথা

ফ্রন্টলাইনের সঙ্গে রামগড় থেকে ফোনে কথা বললেন সেখানকার মসজিদ কমিটির সম্পাদক মুস্তফা আনসারি। জানালেন, গোরক্ষার নামে হেনস্থা রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর এর পিছনে রাজনৈতিক মদতও স্পষ্ট।

এই প্রসঙ্গে বিজেপির অন্যান্য নেতাদের– যাঁদের মধ্যে আছেন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টার ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং– কথাও বিবেচ্য। এঁদের সকলের বক্তব্যেরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল-– গোরক্ষকেরা যা করেছে তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। ভারতে থাকতে হলে গোমাংস ভক্ষণ বন্ধ করতেই হবে। আরও দেখবার বিষয়-– জামিয়ত-উলামা-ই-হিন্দ এই বছরে সাম্প্রদায়িক অসদ্ভাব বেড়ে ওঠা এবং তার ফলে সংখ্যালঘুদের দৈনিক জীবনের বর্ধমান সমস্যার প্রেক্ষিতে দেশে ঈদ মিলানের বার্ষিক অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন। এই সমস্ত কিছুর যোগফল এক উৎপীড়ক হিন্দু রাষ্ট্রের শাসন, যেমন বলেছেন বিচারপতি সাচার।

গো-ভক্ষকদের প্রকাশ্য ফাঁসি

গোয়াতে জুন ১৪ থেকে ১৮ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত “হিন্দু রাষ্ট্র” কনক্লেভের থেকে উদ্ঘোষিত মন্তব্যগুলিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ২০২৩ সালের মধ্যেই হিন্দু রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এবং গোমাংস ভক্ষণকারী ও “সেক্যুলার”দের প্রকাশ্যে ফাঁসিতে লটকাতে হবে। বলা হয়, হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি ও সনাতন সংস্থা আয়োজিত এই কনক্লেভে শতাধিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন অংশ নেয়। নরেন্দ্র দাভোলকর, গোভিন্দ পানসারে ও এম এম কালবুর্গি হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত সকলেই সনাতন সংস্থার সদস্য। এই কনক্লেভ থেকে গবাদি পশু হত্যার ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবী তোলা হয়। আরও দাবী তোলা হয়-– গোরুকে জাতীয় পশু হিসাবে ঘোষণা করতে হবে, সমস্ত রকমের ধর্মান্তরকরণকে নিষিদ্ধ করতে হবে, এবং অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরী করতে হবে। হিন্দুত্ব-বর্তনীর উদীয়মান নক্ষত্র সাধ্বী সরস্বতী, যার কথা শুনলে বাবরিকাণ্ডের সময়ের সাধ্বী ঋতাম্ভরার কথা মনে পড়ে, গোভক্ষকের প্রকাশ্য ফাঁসির দাবী তুললেন। আরও বললেন– “গোমাতার যে অনিষ্ট করে, সে দেশের অনিষ্ট করে, এবং সে দেশের শত্রু। যে সমস্ত রাজনীতিবিদেরা গোমাংস ভক্ষণকে সমর্থন করেন এবং তাঁরা যারা একে স্টেটাস সিম্বল হিসাবে দেখেন, রাষ্ট্রের উচিত তাঁদের প্রকাশ্যে হত্যা করা। গোরক্ষা আমাদের কর্তব্য। নরহত্যার শাস্তি গোহত্যাকারীরও প্রাপ্য হওয়া উচিত

আর এস এস ও বিজেপি-সহ সংঘ পরিবার অবশ্য এই কনক্লেভ আর তদ্ভূত ঘোষণার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে, তবু বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একাংশ এবং অন্যান্য আরও হিন্দুত্ববাদী সমিতি এতে আশার আলো দেখেছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সংস্থা রাম জন্মভূমি ন্যাসের (রামমন্দির গঠনের দায়িত্ব নেওয়া ট্রাস্ট) সভাপতি মহান্ত নৃত্যগোপাল দাস ফ্রন্টলাইন পত্রিকাকে জানালেন-– ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্ররূপে ঘোষণা করে দেওয়াটা খুবই উচিত কাজ হবে, যদিও এখনই দেশ দুই মহাপুরুষ মোদী ও যোগী আদিত্যনাথের হাত ধরে ওই পথেই এগিয়ে চলেছে। দাস আরও বললেন-– “মার্গদর্শক মহাপুরুষ” বিনায়ক দামোদর সাভারকর ও এম এস গোলওয়ালকরের স্বপ্নের হিন্দু রাষ্ট্র গঠিত হবে ভৌগোলিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সত্তার ভিত্তিতে, যেখানে একজন অধিবাসীর জীবন কেমন হবে তা স্থির করবে জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা এবং খাদ্যাভাসসহ সামগ্রিক জীবনযাত্রার ধরণ। “হিন্দু রাষ্ট্রের এই নিয়ম মেনে যিনি থাকতে চাইবেন থাকবেন। তাঁদের ধর্ম যাই হোক, বা আরাধ্য ঈশ্বর যেই হোন। এই নিয়ম যিনি মানবেন না দেশে তাঁর জায়গা হবে না। দেশের চারদিকে যা দেখছেন তা এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিশোধনের সূত্রপাত” দাস আরও বললেন-– দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা জাতীয়তাবাদী শক্তির হাতে থাকা এই প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম উপাদান।

সংঘ পরিবারের অযোধ্যা এবং লক্ষ্ণৌয়ের বহু সক্রিয় কর্মীর বক্তব্য, গোয়া হিন্দু কনক্লেভের হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনার বছর হিসাবে ২০২৩-কে বেছে নেওয়া এবং মোদীর ২০২২ সালকে ‘নতুন ভারত’ তৈরীর বছর হিসাবে ঘোষণা করা নিছক সমাপতন নয়। বরং, এই দুই ঘোষণা একসঙ্গে দেখাটাই বাঞ্ছনীয়।

২০২২ সাল সাভারকরের হিন্দুত্ব–হিন্দুরাষ্ট্র থিসিসের শতবার্ষিকীর বছর। সুতরাং, এই দুটি বছর আলোচনায় উঠে আসা, বিশেষত উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয়ের পর, একেবারে অকারণ নয়।

প্রায় তেইশ বছর আগে, ১৯৯৪ সালে, তার এক বছর আগেই উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির অপ্রাত্যাশিত পরাজয় হয়েছে-– নৃত্যগোপাল দাসের এক প্রাক্তন সহযোগী মহন্ত রামচন্দ্র পরমহংস এই লেখককে বলেছিলেন-– হিন্দুকর্তৃত্বের এই প্রকল্পের কাজ সংঘ পরিবারের কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, যে যত সময়ই লাগুক, এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবেই-– সমস্ত সাফল্য-বিফলতা স্বত্বেও। “আমাদের কাছে চূড়ান্ত লক্ষ্য পরিষ্কার। সে লক্ষ্যে পৌঁছনোর মূল রাস্তা হিন্দুবিশ্বের একটা রাজনৈতিক পরিচয় তৈরী করা। এই সংগ্রামের প্রতীক হিসাবে রাম জন্মভূমি বা রাম মন্দিরের মতো অনেক কিছুই আসবে। দলিত আর অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনজাতির মানুষদের (ওবিসি) জাতিসত্তার দাবীর কারণে আমাদের হোঁচট খেতে হয়েছে। এই সমস্ত পিছুহঠা, আর সাফল্য, এইসব শিরোধার্য করে আমরা চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি

এ কথা স্পষ্ট, যে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর একটা অংশ মনে করে যে তারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে এই লক্ষ্যের অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, কারণ ওবিসি শ্রেণীভুক্ত মানুষদের মধ্যে কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী এই হিন্দুত্ব-অ্যাজেন্ডার আড়ালে চলে এসেছে।

কিছু ওবিসি গোষ্ঠীর সদস্যেরা গোরক্ষার নামে আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এমন ঘটনার সংখ্যা খুব কম নয়।

এমতাবস্থায় বাপুর নামে বিলাপ বা সবরমতীর বক্তৃতা বাহুল্য নয় কি? অ্যামেরিকাতে, মোদী প্রধানমন্ত্রী হবার পর বহুবার যে দেশে গেছেন, বিল অফ রাইটস-– যা কি না সরকার পরিচালনার মৌলিক পথনির্দেশক নীতির সংকলন-– সরকার আর দেশবাসীর মধ্যেকার এমন এক বন্দোবস্তের কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে, যার মূল লক্ষ্য সকলের জন্য সুখসমৃদ্ধি নিশ্চিত করা।

হিন্দুরাষ্ট্রের প্রবক্তারা, এবং তাঁরা যারা মনে করেন সেই লক্ষ্যের কাছাকাছি এসেছেন-– এঁরা কেউই দেশবাসীর সামগ্রিক সুখসমৃদ্ধি নিয়ে ভাবিত নন। গণপিটুনির ঘটনাগুলো, আর সংখ্যালঘুদের ওপর উৎপীড়ক সামাজিক অবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রচালনার গণতান্ত্রিক নিয়মনীতির এই আতঙ্কজনক ও বিপজ্জনক লঙ্ঘন।

 

ফ্রন্টলাইন পত্রিকার অনুমতি নিয়ে এই লেখা প্রকাশ করা হল। বক্তব্যের দায় লেখকের। আমাদের পত্রিকার নয়।

ছবিঋণ:– ইন্টারনেট

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...