বনস্পতির ছায়ায়

হাবিবা মুস্তাফা

 


লেখক চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

 

 

 

 

আনিস স্যারের সঙ্গে দেখা হওয়ার অনেক আগেই তাঁর সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি তাঁর পাণ্ডিত্যের ব্যাপ্তি, মেধা ও মননশীলতায়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে স্যারের সম্পৃক্ততার কথাও অজানা ছিল না।

প্রথম তাঁকে দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমএ ক্লাসের মৌখিক পরীক্ষা নিতে এসেছিলেন বহিরাগত পরীক্ষক হিসেবে। তিনি আসছেন শুনেই হৃৎকম্প শুরু হয়েছিল আমার। অত বড় পণ্ডিত, না জানি কত কঠিন প্রশ্ন করবেন! কিন্তু তেমন অঘটন অবশ্য ঘটেনি, সহজ প্রশ্নই করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত ভালোভাবেই উতরে গিয়েছিলাম। প্রথম দেখায় সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো ফ্রেমের চশমা পরা মানুষটিকে একটু গম্ভীরই মনে হয়েছিল। তবে এই মানুষটিই যে ভবিষ্যতে একদিন আমার কাছে এত সহজমানুষ হয়ে উঠবেন, আমাদের পরিবারের এত আপনজন, এত কাছের মানুষে পরিণত হবেন, সে কথা কি তখন ভাবতে পেরেছিলাম?

১৯৭৮ সালে বৈবাহিক সূত্রে আমি চট্টগ্রামে চলে আসি। ১৯৭৯ সালে আমার স্বামী গোলাম মুস্তাফা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার পর স্যার ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুযোগ ঘটে। স্যারের বাসায় অবশ্য যাই বিয়ের কিছুদিন পর ১৯৭৮ সালের মাঝামাঝি কোনও এক দিন। হেনা স্যার (ডঃ আবু হেনা মুস্তফা কামাল) তাঁর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বাসায় একদিন দুপুরে আমাদের দাওয়াত করেছিলেন। ওইদিনই বিকেলে আনিস স্যার তাঁর ক্যাম্পাসের বাসায় হেনা স্যারের পরিবার ও আমাদের চায়ের দাওয়াত দেন। সেখানে ভাবী, স্যার ও অন্য সবাই মিলে বেশ জমাটি আড্ডা হয়। সব শেষে বসে গানের আসর। হেনা স্যারের ছেলে বিদ্যুৎ (সুজিত মুস্তফা) ও আমি কয়েকটি গান গাই। আমি গেয়েছিলাম ‘সই ভালো করে বিনোদ বেণী’ ও ‘সখি বাঁধলো বাঁধলো ঝুলনিয়া’— এই দুটি গান। স্যার গান শুনতে খুব ভালোবাসতেন, শুনতেনও গভীর মনযোগ দিয়ে। গানের কথা বলার পেছনে কারণ এই যে, দুটো গানের অন্তরাতেই জরিন ফিতা শব্দবন্ধের উল্লেখ ছিল। স্যার সেটা খেয়াল করেছিলেন। গান শেষ হবার পর স্যার বললেন, দ্যাখো দুটো গানেই কিন্তু একই কথা আছে, একটায় জড়ায়ে দে জরিন ফিতা, আর একটায় মেঘ বেণীতে বেঁধে বিজলি জরিন ফিতা। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, কারণ খুব মনোযোগী শ্রোতা না হলে গানের কথা এভাবে মনে রাখা সম্ভব নয়। এর পরেও অনেকবার স্যারকে গান শোনানোর সৌভাগ্য হয়েছে। গান শোনাতে গেলেই সে দিনের কথা মনে হত। গান সম্পর্কে স্যারের মতামত খুব মূল্যবান ছিল আমার কাছে।

সময় যত এগিয়েছে, স্যার ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে এই পরিচয় ধীরে ধীরে গাঢ় হয়েছে। চট্টগ্রামে আমাদের বাসা ছিল চট্টগ্রাম শহর থেকে দূরে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শহরে যেতে হলে আমাদের বাসার সামনে দিয়েই যেতে হত। কোনও অনুষ্ঠান থাকলে স্যার যাবার সময় আমাদের গাড়িতে তুলে নিতেন আবার ফেরার পথে নামিয়ে দিয়ে যেতেন। এরপর দীর্ঘ সময় গড়িয়ে গেছে। ১৯৮৫ সালে স্যার ঢাকা চলে গেলেন কিস্তু সম্পর্কের সূত্র ছিন্ন হয়নি। আমাদের প্রায়ই ঢাকা যওয়া হত, যতবার গিয়েছি (বিদেশে না থাকলে) তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাড়িতে বা বাইরে একবার সবাই মিলে খাওয়া তো হয়েছেই। কতবার ভাবীর অসাধারণ রান্না পরখ করার সুযোগ পেয়েছি। স্যারের প্রসঙ্গে ভাবীর কথা না বললেই নয়, ভাবী চাকুরি আর ঘর-সংসার সব এক হাতে সামলেছেন, সংসার সন্তান সামলানোর ভার প্রায় পুরোটাই নিজের হাতে তুলে নেওয়াতে স্যার কর্মক্ষেত্রে নিজেকে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। স্যারের ছেলেমেয়েরাও খুব শান্ত ভদ্র। ভাবী বলতেন, কোনও কিছুর জন্যই তারা কখনও বায়না করে না।

নানা কাজে স্যারকে প্রায়ই ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসতে হত। যতবার এসেছেন, আমাদের সঙ্গে দেখা না করে কখনও যাননি। মাঝে-মধ্যে সকালের ট্রেনে পৌঁছে আমাদের বাসায় উঠেছেন, কাজকর্ম সেরে রাতের ট্রেনে ফিরে গেছেন ঢাকায়। তিনি স্বল্পাহারী কিন্তু রুচিশীল। গুণের বিচারে যাই হোক না কেন, দর্শনধারী না হলে সে ‘ডিস’ সাধারণত তিনি চেখে দেখতেন না। আমি তেমন রন্ধনপটিয়সী নই, তবু তাঁর পছন্দের খাবারটা করার চেষ্টা করতাম। তাঁর জন্য কিছু করতে পারলে আমি খুবই আনন্দিত হতাম। কখনও তাঁর ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছি, স্যান্ডেলটা  প্যাক করতে দিতে চাইতেন না, কিন্তু আমার এই কাজটি করার আগ্রহ দেখে তিনি আর বাধা দিতে পারতেন না। মুস্তাফার সঙ্গে প্রায় সময় গুরুগম্ভীর কঠিন কঠিন বিষয়ে কথা বললেও আমার সঙ্গে তিনি মিশতেন খুব সহজভাবে। আমার দুই ছেলে বিশেষ করে ছোটটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুসুলভ। তার সঙ্গে নানারকম খুনসুটি চলত। যখনই আসতেন সে জিজ্ঞেস করত, আজকেও কি তুমি আমাদের বাসায় খাবে? তারপর স্যার কী খাবেন আর কোথায় শোবেন তা নিয়ে গবেষণায় লেগে যেত। স্যার কী পরিমাণ খেলে তার নিজের ভাগে কম পড়বে না আর কীভাবে শুলে সহজেই সকলের স্থান সঙ্কুলান হবে সে বিষয়ে পরামর্শ দান করত। স্যারও কম যান না, খাবার টেবিলে বসে এক টুকরো মাংস তুলে সকৌতুকে জিজ্ঞেস করতেন “শুভ,এটার ওপর তোমার কোনও দাবী নেই তো? আমি নিতে পারি? শুভ অবশ্য সবসময়ই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাত। আমার ছেলেরা এখন আর ছোটটি নেই। তবু তাদের প্রতি তাঁর স্নেহ বাৎসল্য আগের মতোই প্রবহমান। একবার স্যার ভাবী সহ আমার ননদের বিয়েতে এসেছিলেন। পথে দেরি হওয়তে রাত এগারোটায় চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন। অনুষ্ঠানে এক ঘণ্টা থেকে রাত বারোটায় আবার ঢাকার পথে রওনা হয়েছিলেন। এতে স্যারের ভ্রমণের কষ্ট হয়েছিল, তবু তিনি পরোয়া করেননি। আমাদের পরিবারের সব অনুষ্ঠানেই তার উপস্থিতি ছিল অবধারিত। শুধু আমাদের ছেলেরাই নয়, আমাদের উপরও তাঁর মমতা শতধারায় বর্ষিত হয়েছে। পরম স্নেহময় অভিভাবকের মতো আমাদের দুঃখে-বিপদে সবার আগে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, আনন্দ-আয়োজনে শরিক হয়েছেন। আমরাও সঙ্কটে বিপদে তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি, দুঃসময়ে তাঁর পরামর্শ আমাদের পথ দেখিয়েছে।

২০১০ সালে সরকারি চাকুরি থেকে আমার অবসর গ্রহণের পর সময় যখন গুরুভার হয়ে চেপে বসেছে, তখনই তাঁর সঙ্গে একটা কাজে সম্পৃক্ত হবার সুযোগ এল। কলকাতার শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেডের কর্ণধার দেবজ্যোতি দত্ত স্বাধীনতা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী বাংলাদেশের লেখকদের লেখা নিয়ে ছোটদের জন্য দুটি সঙ্কলন করার কথা ভাবেন, এর একটি হবে শিশুতোষ অন্যটি কিশোরদের জন্য। তিনি স্যারকে এই সঙ্কলন দুটি করার অনুরোধ করেন। স্যার এত ব্যস্ত, এই কাজ করার সময় কোথায়? তখন স্যার আমাকে এই কাজটিতে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেন। আমি বরাবরই শিশুসাহিত্যানুরাগী, তাই তাঁর এই প্রস্তাব অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করি।

বলা বাহুল্য চট্টগ্রামের চাইতে ঢাকায় বইপত্র যোগাড় করা অপেক্ষাকৃত সহজ, তাছাড়া লাইব্রেরিতে কাজ করবার  সুযোগসুবিধা বেশি, তাই এই কাজটির জন্য বহুবার আমাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম করতে হয়েছে। ভ্রমণের কষ্ট ছিল কিন্তু স্যারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে সে কষ্টকে কষ্ট বলেই মনে হয়নি। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পারা আমার জীবনের এক দুর্লভ ও আনন্দময় অভিজ্ঞতা। আমি ঢাকায় বিভিন্ন লাইব্রেরিতে বসে কাজ করতাম। সকালবেলাতেই বেরিয়ে পড়তাম সারা দিনের জন্য, বইপত্র ঘাঁটতে আমার ভালই লাগত, কোনও কষ্ট বলেই মনে হত না। কাজ করতে আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা স্যার বরাবরই সে খোঁজখবর রাখতেন। বিভিন্ন লাইব্রেরিতে নিয়ে গিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন যাতে কাজ করতে আমার কোনও অসুবিধা না হয়।

গল্প, কবিতা বাছাইপর্ব শেষ হতেই বেশ কিছুদিন লাগল। এর পর স্যারের সঙ্গে কাজ করার পালা। এই সময় তাঁকে কাছ থেকে দেখার ও তাঁর সাহচর্য লাভের সুযোগ পাই। তাঁর কাজের ধরন যে কারও জন্যই অনুসরণযোগ্য। আমার বাছাইকৃত গল্প-কবিতার বিষয়, বাক্যগঠন, ছন্দ, সব দিকেই ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কোথাও ছন্দের এক মাত্রা হেরফের হলে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলতেন। একবার একটা ছড়ায় সেতার বাজিয়ে গলা সাধবার প্রসঙ্গ ছিল, তিনি বললেন, এ কবিতা চলবে না, সেতার বাজিয়ে কেউ গলা সাধে নাকি? স্যার যেহেতু পুরো কবিতাটি তখনও পড়েননি, তাই আমি বললাম যে কবিতাটি এমন এক লোক সম্পর্কে লেখা যার সব কাজই উদ্ভট, সুতরাং সেতার বাজিয়ে তার পক্ষে গান গাওয়া খুবই সম্ভব। কবিতাটি অবশ্য শেষ পর্যন্ত বাদ পড়েছিল, বিষয়ের কারণে নয়, ছন্দের দুর্বলতার জন্য। গল্প-কবিতা নির্বাচনে ক্ষেত্রে আমার মতামতকেও তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। তাঁর এত কাজের মধ্যেও আমার সঙ্গে বসে প্রুফ দেখেছেন। কাজ শুরু করার সময় প্রথমেই তিনি কতক্ষণ কাজ করবেন এবং কয় ঘণ্টা সময় লাগবে তা ঠিক করে নিতেন। সেই নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই প্রায় আমাদের কাজ শেষ হত। এমনই ছিল তাঁর সময়ের হিসাব। কাজের পুরো সময়টা ছিল ঠাসবুনোট। এক নাগাড়ে কাজ করে আমি ক্লান্ত হলেও, তাঁর মধ্যে ক্লান্তির কোনও লক্ষণ দেখা যেত না। প্রুফ দেখা শেষ হলে হয়তো সভা-সমিতি বা অন্য কোনও কাজে তাঁকে ছুটতে হত, সেখানে যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে তাও তিনি হিসাব কষেই রাখতেন। নির্দিষ্ট সময়ে তিনি তাঁর কাজের জায়গায় উপস্থিত হতেন, কখনও এর ব্যত্যয় ঘটত না। তিনি নিজে সময়ানুবর্তী, তাই চাইতেন অন্যরাও সময়মত কাজ করুক। নির্ধারিত সময়ে কেউ উপস্থিত না হলে তিনি তা খুব অপছন্দ করতেন। সেটা অবশ্য মুখে বলতেন না। কাজ দিয়েই বুঝিয়ে দিতেন।

আমাদের সঙ্কলনের সব কাজ শেষ হয়ে এলে লেখকদের নামের তালিকা প্রস্তুত করা শুরু করতে হল। বইপত্র ঘেঁটে, টেলিফোন করে, নানাভাবে লেখক পরিচিতি জোগাড় করেছিলাম। সেগুলো ক্রমানুসারে সাজিয়ে তালিকা করতে গিয়ে তাঁর আর এক পরিচয় পেলাম। কোন লেখক নামের বানান কীভাবে লেখেন, কে নামের শুরুতে মোহাম্মদ লেখেন, কে লেখেন মুহাম্মদ বা মুহম্মদ, কে পুরোটা না লিখে মোঃ বসান, কে প্রচলিত নামের বানানে উ-র জায়গায় ঊ লেখেন, কে নামের দুই শব্দের মাঝখানে হাইফেন টানেন, এসব ছিল তাঁর নখদর্পণে। কোনও ভুল থাকলে এক ঝলক তাকালেই তা তাঁর চোখে পড়ে যেত। শুধু তাই নয় আনেক আগে করা কোনও পরিবর্তন বা পরিমার্জন নির্ভুলভাবে তাঁর মনে থাকত। তাঁর স্মরণশক্তি ঈর্ষা করার মত।

সব কাজেই তিনি নিখুঁত পরিপাটি। রাত জেগে নিজেই তাঁর সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখক পরিচিতি লিখলেন। একবারে লেখা শেষ হল না, নানা ব্যস্ততায় সময় দিতে পরছিলেন না। রাত জেগে লিখতে ওঁর কষ্টই হচ্ছিল। আমি ওঁর মত করে লিখতে পারব না জেনেও দায়িত্ব নিতে চাইলাম। উনি বললেন সবটা একজনের হাতে লেখা হলেই ভালো, একরকম হবে। শেষদিন রাত তিনটে পর্যন্ত জেগে কাজটা শেষ করলেন। আসলে লেখক পরিচিতির কাজটা উনি নিজেই করতে চেয়েছিলেন, কারও উপর ভার দিয়ে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। সে কথা বললে যদি আমি আহত হই, তাই হয়তো একটু ঘুরিয়ে বলেছিলেন।

শিশুদের জন্য সঙ্কলনটি (সাদা মেঘের ভেলা) প্রথমে প্রকাশিত হল। সঙ্কলনটির পেছনের ফ্লাপ-এ স্যার ও আমার ছবি সহ পরিচিতি দেয়া হল। স্যার বললেন তোমার জন্য সাত আর আমার দশ লাইন নিলাম, বয়সের বিবেচনায় তিন লাইন বেশি  নিয়েছি, আশাকরি তুমি কিছু মনে করবে না। শুধু বয়স কেন, অনেক কিছুর বিবেচনায় তিনি পুরো ফ্ল্যাপই নিতে পারতেন। আমার কাছে এ কৈফিয়ৎ দেবার কোনও প্রয়োজন ছিল না, তবু দিলেন, কারণ সৌজন্য আর ভদ্রতাবোধ তাঁর মজ্জাগত। কখনও কারও মনে আঘাত দিয়ে কথা বলা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তাঁকে কখনও কেউ রাগ করতে দেখেছে বলে মনে হয় না। কোনও কিছু অপছন্দ হলে চুপ করে থাকেন, কখনও প্রকাশ করেন না। সারাদিন সভা-সমিতি-সেমিনার করছেন, হয়তো শরীরটা আর বইছে না, কিন্তু মুখ ফুটে সেকথা কখনও বলবেন না। এতে মাঝে মাঝে তাঁর বেশ কষ্টই হয়, সেটাও হাসি মুখে সয়ে যান।

২০১৩ সালে স্যার ও মুস্তাফা ভারতের মুর্শিদাবাদে একটা সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আমিও ঐতিহাসিক স্থান দেখার লোভ সংবরণ করতে না পেরে তাঁদের সঙ্গে জুটে পড়লাম। প্রথম দিন বহরমপুর ঘুরে দেখা হল। কাশিমবাজার কুঠি, ইমামবাড়া, জগৎশেঠের বাড়ি কিছুই বাদ গেল না। ছাত্রজীবনে পড়া এই সময়ের ইতিহাসটা বিস্মৃত হইনি তাই সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। স্যার সারাটা দিন সমান তালে আমাদের সঙ্গে হাঁটলেন। আগ্রহ নিয়ে সব দেখলেন, আলস্য শব্দটি যেন তাঁর অভিধানেই নেই। তাঁকে দেখলে মনে হত তাঁর আসল বয়সের অর্ধেক বযসী তিনি। কী করে সারাটা দিন এত কাজ করে যান তা দেখে বিস্ময় মানি। তাঁর কর্মক্ষমতা অসীম, প্রাণশক্তিও অফুরন্ত।

পরের দিন বহরমপুরের বাকি দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে বেশ কিছু দূরে খোসবাগে সিরাজউদ্দৌলার কবর দেখতে যাবার কথা। পথটা তেমন সুগম নয় শুনেও নিরস্ত হলেন না। নৌকায় উঠাবার সময় নদীর ঢালু পাড় বেয়ে বেশ কসরত করে নিচে নামতে হল। ছোট নৌকা, চারধারে বাঁশের খুঁটির উপর ছোট একটা ছাউনি দিয়ে রোদ-বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর ব্যবস্থা। পা ঝুলিয়ে বসার উপায় নেই। স্যারের বসতে বেশ আসুবিধে হচ্ছিল, বারবার পার্শ্ব পরিবর্তন করছিলেন। কিন্তু সেটা বলে কাউকে বিব্রত করতে চাননি। বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে নৌকা তীরে ভিড়ল। নৌকা থেকে নেমে বাকি পথটা যেতে হবে ভ্যানগাড়িতে। সবাই পা তুলে বাবু হয়ে গাড়িতে বসল। আমি আর স্যার বসলাম বাইরে পা ঝুলিয়ে। গাড়ি ঝাঁকুনি দিয়ে চলা শুরু করতেই আমিই প্রায় পড়ে যাই আর কি! আমি না পড়লেও আমার পা থেকে এক পাটি স্যান্ডেল খুলে পড়ে গেল। আমি স্যান্ডেল সামলে এবার পা তুলে বসলাম, স্যার আগের মতই পা ঝুালিয়ে বসে রইলেন। এবড়োখেবড়ো পথে গাড়িটা বেশ ভালোই ঝাঁকুনি দিচ্ছিল। আমি আতঙ্কিত হয়ে চেয়ে রইলাম, ঝাঁকুনির চোটে স্যারের পা থেকে স্যান্ডেলটা না খুলে পড়ে যায়। স্যার বললেন, সে ভয় নেই কারণ ওটা ফিতে লাগানো, অর্থাৎ কিনা ‘স্যান্ডেল সু’। খোসবাগে পৌঁছে নবাব সিরাজউদ্দৌলা, লুৎফা, তাঁদের কন্যা এঁদের সবার কবর দর্শনের পর পথের ক্লান্তি যেন মুহূর্তেই উবে গেল। ঘুরে ফিরে চারিদিক ভালো করে দেখা হল। স্যার বললেন, পথের কষ্টের কথা ভেবে এখানে না এলে সারাজীবন আফসোস রয়ে যেত। সত্যিই তাই, তবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাবের নিতান্তই অবহেলায় পড়ে থাকা কবরের জীর্ণ দশা দেখে সবারই মন খারাপ হয়ে গেল।

একবার রাজশাহীতে একটি কবিতা উৎসবে তাঁর সঙ্গে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। ঢাকা থেকে অনেক কবিই গিয়েছিলেন। আমিও গেলাম। রাজশাহী আমার নানার বাড়ি, সেখানে বেড়ানোর লোভও ছিল। কবিতার অনুষ্ঠানের পর সবাই মিলে খুব খাওয়াদাওয়া আর আড্ডা হল। ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত পেরিয়ে যাবার পর স্যারের শখ হল পদ্মায় নৌকাভ্রমণ করবেন। আমি সাঁতার জানি না, যদি পানিতে পড়ে যাই, মৃত্যু অবধারিত। তাই রাজি হচ্ছিলাম না, সে কথা স্যার কানেই তুললেন না। তিনি সদলবলে নদীর তীরে চললেন। কিন্তু অত রাতে কোথায় নৌকা আর কোথায় মাঝি! শেষ পর্যন্ত একটা নৌকা পাওয়া গেল, কিন্তু মাঝি কোথায়? মাঝি তো ঘুমিয়ে কাদা, ঘুমন্ত মাঝিকে ঘুম থেকে টেনে তোলা হল। স্যার, মুস্তাফা, আমাদের বন্ধু মারুফ (কবি মারুফুল ইসলাম), মারুফের ভগ্নিপতি লুৎফুর রহমান এবং আরও কয়েকজন নৌকায় উঠলেন। মেঘাবৃত চাঁদের আলোয় রাতটি মায়াবী হয়ে উঠেছিল। নদীর পানিতে ছোট ছোট ঢেউয়ে আলো-ছায়ার খেলা এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি করেছিল। লুৎফুর ভালোই গাইতে পারেন, উনি গলা ছেড়ে গান ধরলেন, আমিও তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলালাম। মজার ব্যাপার হল, স্যারও এক ফাঁকে আমাদের সঙ্গে একটু গুনগুন করে উঠলেন। আমি তাঁকে আর কোনও দিন সুর ভাঁজতে শুনিনি। এই মায়াময় পরিবেশের ছোঁয়া হয়তো তাঁর মনেও লেগেছিল। তবে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল আমার জন্য। স্যার এক সময় আমাকে হাত পাততে বললেন। আমি হাত পাতলে তিনি তাঁর হাতের মুঠি থেকে যেন কোনও মহার্ঘ্য বস্তু দিচ্ছেন এমনভাবে আমার হাতে ঢেলে দিলেন একটু পানি, আর মুখে বললেন, এই নাও পদ্মার পানি। আমার চোখ ভিজে উঠেছিল। অভিভূত আমি নদীর পানিতে হাত ডুবিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তাঁর শিল্পীসুলভ স্নিগ্ধ-কোমল মনের পরিচয় পেয়েছিলাম সেদিন।

কত বড় বড় বিদ্বান, পণ্ডিত মানুষ আছেন এ দেশে। কিন্তু স্বভাব মাধুর্যে তাঁর মত সকলের হৃদয় জয় করতে পেরেছেন কজন? কত জন তাঁর সহৃদয় সাহচর্য পেয়েছে, তাঁর ভালোবাসায় প্রীত হয়েছে। তাঁর নৈকট্য লাভের কোনও যোগ্যতাই আমার নেই। তবু আমার মত নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষকে তিনি এত স্নেহ-মমতা-প্রশ্রয় দিয়েছেন তা আমি ভাগ্য বলে মানি। ২০১৮ সালে প্রকাশিত তার লেখা একটি বই– ‘বিদ্যাসাগর ও অন্যেরা’ তিনি আমাকে ও মুস্তাফাকে উৎসর্গ করেন। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া এই ভালোবাসার নিদর্শন আমাদের জীবনে পরম প্রাপ্তি। আমাদের জীবনে তিনি যেন ছিলেন সেই বনস্পতি, যিনি স্নেহ-মমতা ভালোবাসার ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন চারিদিকে, আমরা তাঁর ছায়ায় নিশ্চিন্তে ছিলাম। কিন্তু ভালোবাসা আর মমতায় জড়িয়ে রাখা সেই ছায়াটি আর রইল না। হঠাৎ এক শূ্ন্যতা সব দিক ভরে দিল। আমাদের মাথার উপর থেকে ছায়াটি সরে গেল।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...