আনিসুজ্জামান – শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

শ্রীলা বসু

 


লেখক অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক এবং পুরাতত্ত্ব ও লোকশিল্প গবেষক

 

 

 

সম্প্রতি প্রয়াত হলেন বঙ্গবিদ্যাচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ— অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাঁর বয়স হয়েছিল, বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থও ছিলেন। তবু তাঁর প্রয়াণের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। বাংলাদেশে তো বটেই পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকেও তাঁর প্রয়াণের অভিঘাত স্পর্শ করেছে। করোনা কবলিত অন্তরীণের মধ্যে এ এক বিরাট দুঃসংবাদ।

বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহলে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পরিমাপ বোঝা, এ বাংলায় বসে প্রায় অসম্ভব। আসলে আনিসুজ্জামানের জীবন এত বেশি করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত যে ওদেশে তিনি শুধু একজন বুদ্ধিজীবী মাত্র নন, দেশের প্রতিবিম্ব। নিজে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না হয়েও বাংলাদেশের সংগঠনমূলক কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

সদ্য গড়ে ওঠা পূর্ব পাকিস্তানে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয় তখন, সেই ১৯৫২ সালে, আনিসুজ্জামানের বয়স পনেরো মাত্র। দেশভাগের পর তিনি কলকাতার পার্ক সার্কাস হাই স্কুলের পাট চুকিয়ে ভর্তি হয়েছেন প্রথমে খুলনা জেলা স্কুলে। তারপর ঢাকার প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন। আইএ পড়েন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। সে সময়ই তিনি যুক্ত হন তখনকার ঢাকার সম্ভবত একমাত্র অসাম্প্রদায়িক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান যুব লিগের সঙ্গে। ভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা আলোচনা করে যুব লিগ থেকে যে পুস্তিকা প্রকাশ করা হয় ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কী এবং কেন’— তার লেখক ছিলেন আনিসুজ্জামান। এ পুস্তিকায় তাঁর নাম ছিল না অবশ্য। ’৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক গতিবিধির সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৫৮ থেকে বাংলা একাডেমি বৃত্তি নিয়ে ’৬২তে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ’৬৪তে ফুল ব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইয়ং বেঙ্গল সম্পর্কে গবেষণা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে অস্থায়ী শিক্ষক পদে যোগ দেন। পরে ১৯৬৯এ স্থায়ীভাবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী বাংলাদেশের এক বৈপ্লবিক ঘটনা। আইয়ুব খান সরকারের আমলে এই উৎসব পালন ছিল রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। আনিসুজ্জামানের লেখাতেই আমরা পেয়েছি যে উচ্চ আদালতের বিচারপতি জনাব মুর্শদ কেমন আগ্রহের সঙ্গে শতবার্ষকী পালন করতে এগিয়ে এসেছেন, রাষ্ট্র তাঁকে আটকাতে পারেনি। এই সময়ই সরকারি কর্মী হওয়া সত্ত্বেও সনজীদা খাতুন রবীন্দ্রনাথের গান করেছেন। সনজীদা খাতুন লিখেছেন তিনি গান করেছেন মুখে রুমাল পুরে যাতে কণ্ঠস্বর চিনে নেওয়ায় তাঁকে রাষ্ট্রীয় কোপে না পড়তে হয়।

১৯৬৯এ পাকিস্তানি সৈনিকদের গণহত্যার প্রতিবাদে আনিসুজ্জামান চট্টগ্রামে আবাসিক এলাকা ত্যাগ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে কিছুদিন থেকে যান আগরতলা। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর বই ‘আমার একাত্তর’ এ সব ঘটনার দলিল। তারপর তিনি আসেন কলকাতা । কলকাতায় বাংলাদেশের শরণার্থী শিক্ষকদের নিয়ে যে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি তৈরি হয় তার সম্পাদক হন আনিসুজ্জামান। ইতিমধ্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন, বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করবার চেষ্টা করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। যদিও পরে সরে আসেন, শিক্ষা কমিশনের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭২ সালে ড. কামাল হোসেনের ডাকে বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা অংশ লেখার দায়িত্ব নেন। তখনও তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। শেষে খোদ বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে এবং আহ্বানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ২০০৩ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পরে এমিরেটাস ও জাতীয় অধ্যাপক।

আনিসুজ্জামানের দুটি আত্মজীবনী ‘কাল নিরবধি’ ও ‘বিপুলা পৃথিবী’-তে বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার এই সংগ্রামের  কথা বিস্তারে আছে। আনিসুজ্জামানের নিজস্ব প্রতিরোধের কথাও আছে। বইদুটি বাংলাদেশের ইতিহাসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আনিসুজ্জামান যে শুধু একজন অধ্যাপক বা বুদ্ধিজীবী নন, তিনি যে একজন যোদ্ধা— তার নিদর্শন এ সব বই।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের এই কর্মজীবন খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যতটা গুরুত্ব পেয়েছে এ বাংলায় ততটা নয়। আনিসুজ্জামানের স্কলার সত্তা বরং পশ্চিমবঙ্গকে আলোড়িত করেছে বেশি। তাঁর বইয়ের সংখ্যা চল্লিশের বেশি, সম্পাদিত গ্রন্থও প্রচুর। সে সব বিষয়ে বিস্তারে আলোচনা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে গবেষণার বিষয় হবে। সেই আলোচনার পরিসর এখানে নয়। তবে তাঁর গবেষণার কয়েকটি ক্ষেত্র দীর্ঘদিন আলোচিত হবে বলে মনে করি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিষয়ে তাঁর আলোচনা, মুসলমান সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ে তাঁর আলোচনা, নতুন তৈরি রাষ্ট্র নিয়ে তাঁর আলোচনা, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে ও নারী বিষয়ে তাঁর আলোচনা ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়ে তাঁর গবেষণার অভিমুখকে ভাগ করা যেতে পারে।

১৯৫৮ সালে এমএ পাশ করবার পর আনিসুজ্জামান বাংলা একাডেমির বৃত্তি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর গবেষণা বই আকারে যে নামে বিখ্যাত হয়েছে তার শিরোনাম ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৮৫৭-১৯১৮)’ । তবে গবেষণাটির প্রকৃত নাম ছিল ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা।’ গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই। এই বইয়ের চতুর্থ মুদ্রণের ভূমিকায় এবং ‘কাল নিরবধি’ বইয়ে আনিসুজ্জামান অকপটে বলেছেন যে দেশভাগের আগে তাঁর পরিবারের মানুষেরা পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন কিন্তু বঙ্গবিভাগের সিদ্ধান্তে তাঁরা ‍মুষড়ে পড়েন। আনিসুজ্জামানের বহু লেখায় বাঙালি মুসলমানের আত্মজিজ্ঞাসার কথা আছে। আপাতত আমরা পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশনা ‘কারিগর’ থেকে প্রকাশিত আনিসুজ্জামানের নির্বাচিত প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য’ বইটির ‘স্বরূপের সন্ধানে’ প্রবন্ধটির কথা বলি। এরকম আরও কিছু প্রবন্ধ ও আনিসুজ্জামানের গবেষণা সর্ন্দভটি মিলিয়ে পড়লে তাঁর আত্মজিজ্ঞাসার স্বরূপটি স্পষ্ট হবে।

মধ্যযুগের মুসলমান শাসন সর্ম্পকে মুসলমান সমাজে কিছুটা গর্ববোধ ছিল। কিন্তু উনিশ শতক, যে সময়টি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গৌরবের সময় তার হালহকিকত মুসলমান সমাজ পুরোটা অনুমোদন করতে পারেনি। উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে রচিত সাহিত্যে তাঁরা বাংলা সাহিত্যের নানান প্রবণতাগত অভাব ঘুচিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। যেমন আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহারের কমতিপূরণ বা মুসলমান জীবনের পরিচয় দেওয়া ইত্যাদি। এ সব ভাবনার সমাধান হবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে— এই কল্পিত রূপ অনেকটা বদলে গেল দেশভাগের পর। বাংলাদেশের দ্বিখণ্ডন পূর্ব পাকিস্তানের আত্মজিজ্ঞাসার প্রশ্নটি জটিল করে তুলল। ১৯৫২র ভাষা আন্দোলন নতুন করে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির সামগ্রিক রূপটি সম্পর্কে আস্থা তৈরি করতে চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্রের সমর্থন না থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের মধ্যে বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে জোরদার করে তোলবার চেষ্টা করা হয়েছিল। তারপর মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বহুবার বলা হয়েছে। আনিসুজ্জামানের অনেক লেখায় এ বিষয়ে বিরোধীদের কণ্ঠস্বরের কথা বলা হয়েছে। বিরোধী কণ্ঠ ছিল বলেই ১৯৭৫এ সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। বাংলাদেশের মুসলমানদের এই সাংস্কৃতিক সঙ্কটের ইতিবৃত্ত আনিসুজ্জামানের লেখায় বারবার এসেছে। তাঁর গবেষণার ভূমিকা পড়লে বোঝা যায় বাঙালি মুসলমানের অস্তিত্বের এই প্রশ্নটি তাঁকে ভাবিয়েছিল বলেই গবেষণার এই বিষয় নির্বাচন।

ইংরেজ আমলে মুসলমান সমাজে যে সব ভাবগত আন্দোলন হয়েছিল আনিসুজ্জামান তাদের মূল্য স্বীকার করেও তাঁর গবেষণার গোড়ায় একথা বলতে ‍দ্বিধা করেন না যে “বাঙালী মুসলমানের সঙ্গে আধুনিক জীবন ও জগতের বিচ্ছেদ ঘটাবার জন্য এদের দায়িত্ব যথেষ্ট।’’ ওয়াহাবি ফারায়েজি আন্দোলনের মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল আদি ইসলামে ফেরা। পাকিস্তানে আন্দোলনের সময় ‍দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যাখ্যাতারা পুথি সাহিত্য বা মুসলমানি বাংলা রচনাকে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যিক উৎস বলেছিলেন। আনিসুজ্জামানের গবেষণায় সেই তত্ত্বকে যাচাই করবার একটা চেষ্টাও আছে।

আনিসুজ্জামানের গবেষণার প্রধান বৈশিষ্ট্য সামঞ্জস্যবোধ। তিনি ইসলামি সাহিত্যের নিষ্ঠাবান পাঠক। তাঁর পিএইচডি গবেষণা শুধু নয় বহু প্রবন্ধে ইসলামি সাহিত্য পাঠের নিবিড় পরিচয় পাওয়া যায়। এক সময় ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বাঙালি নারী: সমাজে ও সাহিত্যে’-তে মুসলমান মেয়েদের অনেক লেখার ব্যবহার আছে যা চূড়ান্তভাবে উপেক্ষিত। তবু তাঁর লেখার ভঙ্গি ধর্মনিরপেক্ষ। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে মীর মুশাররফ হোসেনের শেষের দিকের লেখা যেখানেই তাঁর মনে হয়েছে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার পরিচয় আছে, তিনি সমালোচনা করতে ছাড়েননি। এই নিরপেক্ষ অবজেকটিভিটি পরবর্তী গবেষকদের উদ্বুদ্ধ করবে আশাকরি।

বাংলা সাহিত্যে ইতিহাসের যুগবিভাজন নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন আনিসুজ্জামান তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসা’ প্রবন্ধে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ক্ষেত্রে আদি মধ্য আধুনিক যুগের যে ভাগ এখন মানা হয় তা প্রধানত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মত, এ মত সমর্থন করেছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, আহমদ শরীফ প্রমুখ। রাহুল সাংকৃত্যায়ন ও শশিভূষণ দাশগুপ্তের সংগ্রহ দেখলে বোঝা যায় চর্যাগীতি অন্তত চোদ্দ শতক পর্যন্ত রচিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে আদিপর্বর সীমারেখা অন্তত চোদ্দ শতক অবধি টানতে আগ্রহী আনিসুজ্জামান। আবার বাংলা সাহিত্যে গদ্যের আবির্ভাব, ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যের আবির্ভাব এবং সাহিত্যে ব্যক্তিসত্তার জাগরণ— যেগুলিকে পাশ্চাত্য প্রভাবজাত প্রবণতা বলে মনে করে উনিশ শতক থেকে সাহিত্যের ইতিহাসের আধুনিক যুগ বলা হয়, সে প্রবণতাগুলি যে উনিশ শতক পূর্ববর্তী তা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। বাংলা গদ্য নিয়ে তাঁর স্বতন্ত্র গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন যে ষোড়শ শতক থেকে বাংলা গদ্যের প্রায় ধারাবাহিক নিদর্শন পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে আধুনিক যুগের সূচনা কবে থেকে নির্ধারিত হবে সে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

বাংলা সাহিত্যের অনেকগুলি ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় ঢাকা বাংলা একাডেমি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রকাশ করতে শুরু করে। এ যাবৎ এই সিরিজের দুটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে প্রথম দিকে রামগতি ন্যায়রত্ন প্রমুখের সাহিত্যের ইতিহাস বাদ দিয়ে বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ধরা হয় দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’। দীনেশচন্দ্র নিজে বিখ্যাত বৈষ্ণব পদসঙ্কলন ‘গৌরপদতরঙ্গিনী’র সম্পাদক জগদ্বন্ধু ভদ্রর ছাত্র। চণ্ডীদাসের কবিতা পড়ে বৈষ্ণবতায় ভাসতে ভাসতে তিনি সাহিত্যের ইতিহাস লেখা কথা ভেবেছিলেন। তাঁর বইয়ে ধর্মীয় নিরপেক্ষতা আশা করা বোধহয় যায় না। সুকুমার সেন মুসলমান রচিত সাহিত্যকে অর্ন্তভুক্ত করেছেন পরে। এ নিয়ে স্বতন্ত্র বইও লিখেছেন। কলকাতার গবেষকরা মোটামুটি সেই ধারা অনুসরণ করেছেন, ইসলামি সাহিত্যকে ক্রমশ আলোচনায় জায়গা দিয়েছেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ শরীফ যখন বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য লেখেন তখন এই ক্ষোভ তাঁর যায় না যে ‘‘আজো মধ্যযুগের কিংবা আধুনিক কালের বাঙলাসাহিত্যের একটিও পূর্ণাবয়ব ইতিহাস প্রণীত হয়নি। তার কারণ কোলকাতাস্থ ইতিহাসকারগণ মুসলিমরচিত সাহিত্য সম্বন্ধে তেমন জিজ্ঞাসু নন (২ খণ্ডের ভূমিকা)’’। এই ক্ষোভ মোচন করতে গিয়েই হয়তো আহমদ শরীফের সাহিত্যের ইতিহাসে ইসলামি সাহিত্যের প্রতি পক্ষপাত একটু বেশি।

তাই প্রয়োজন ছিল একটি নিরপেক্ষ সাহিত্যের ইতিহাসগ্রন্থের পরিকল্পনার। সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করেছে আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সাহিত্যের ইতিহাস। প্রথমত এই বই কোনও কোষগ্রন্থের মতো সমবেত প্রচেষ্টায় লেখা, একক প্রচেষ্টায় নয়। দ্বিতীয়ত দ্বিতীয় খণ্ডের সূচনায় আনিসুজ্জামান বলেই দিয়েছেন যে যুগ বিভাজন বিষয়ে তাঁর পূর্বতন জিজ্ঞাসার কারণে তিনি মধ্যযুগ শব্দটি যথাসম্ভব পরিহার করেছেন। তৃতীয়ত এই গ্রন্থপরিকল্পনায় ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতের দিকে জোর দেওয়া হয়েছে বেশি। বিশেষ করে প্রথম খণ্ডে। ইতিহাস ও সাহিত্যের এই পরিপূরক পাঠ অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। চতুর্থত এ বইয়ের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র। দীনেশচন্দ্র বা আহমদ শরীফের প্রবণতার মধ্য যে-সামঞ্জস্যবোধের অভাব, তা রয়েছে আনিসুজ্জামানের গ্রন্থে। যোগ্য ব্যক্তিরা এই বইয়ের অধ্যায় রচনা করেছেন। এমন একটি বইয়ের বড় প্রয়োজন ছিল বঙ্গবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে। আশাকরি আনিসুজ্জামানের অবর্তমানেও তাঁর পরিকল্পনামাফিক পাঁচ খণ্ডে বইটির কাজ শেষ হবে।

আনিসুজ্জামান আজীবন বাঙালি হিসেবে কাজ করে গেছেন। তাঁর এক শিক্ষক অজিতকুমার গুহর কথা তিনি বারবার লিখেছেন। তিনি কোনও অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িকতার কাছে সমর্পণ করেননি। সাম্প্রদায়িকতার মতো ব্যাধি রোধ করা তিনি নিজের দায় বলে মনে করতেন। এই কর্তব্যবোধ আনিসুজ্জামানের মধ্যে ছিল। তাঁর কর্মজীবন এবং গবেষক-অধ্যাপক জীবন তাই বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ সামগ্রিক পরিচয়কে তুলে ধরবার এক অন্যরকম প্রয়াস।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...