তাই বলে কমরেড বলবে!– বিনায়ক সেন থেকে বিট্টু সোনোয়াল আর বিচারব্যবস্থা

পারভেজ খান

 

ভেলোর মেডিকেল কলেজ থেকে স্বর্ণপদক পাওয়া ডাক্তার, চাইলেই কাটাতে পারতেন বিলাসবহুল জীবন। কিন্তু সবার ইচ্ছে তো আর সমান নয়- অনেকে বলবে নিজে সুখে থাকতে চাওনা চেয়োনা, বাকিদের কেন জড়াও!যাই হোক সে জীবন তিনি উপেক্ষা করবেন যখন আর আটকায় কে!স্ত্রী কে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন ছত্তিসগড়ের আধিবাসী অধ্যুষিত জঙ্গল অঞ্চলে।তাদের চিকিৎসা করার জন্য।অধীবাসীদের কাছে হয়ে উঠলেন দেবতা!হাসপাতাল খোলা, কৃষিকাজ শেখানোও চলল। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন, জাতিসংঘের বাহবাও জুটল।আবার সেই তিনিই গ্রেপ্তার হলেন মাওবাদীদের সাহায্য করার অপরাধে।রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ।জঙ্গল এর অধিকার কার? জঙ্গল বেচে খনি হবে।উন্নয়ন।সাফ করতে হবে তা। মাওবাদী ধ্বংসের নামে রাষ্ট্রীয় অত্যাচার জঙ্গলে। তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে জুটলো জেল।সে তুমি যতই স্বর্ণপদক পাও।রাষ্ট্রীয় কাজের নিন্দে করো এমন সাহস?বিচার ব্যবস্থার নামে প্রহসন চলল অনেক বছর। লোকটার নাম বিনায়ক সেন।মানবাধিকার কর্মী।দীর্ঘদিন পর তার জামিন দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্ট বলে-“We are a democratic country. He may be a sympathiser. That does not make him guilty of sedition.” আরও বলেন- “if Mahatma Gandhi’s autobiography is found in somebody’s place, is he a Gandhian? No case of sedition is made out on the basis of materials in possession unless you show that he was actively helping or harbouring them (Maoists).”[১] কারণ ছত্তিসগড় এর নিন্ম আদালত তাকে যাবজ্জীবন এর সাজা শুনিয়েছিল কিছু বই পাওয়া যাওয়ার ভিত্তিতে।

হঠাৎ করে এসব কথা টানতে হল কেন?করোনা পর্ব না আসলে দেশে এখনো যা নিয়ে চর্চা হতো বা যে জিনিস টি সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হতে থাকতো তা অবশ্যই সিএএ এবং এন আর সি। করোনার থাবা সেই আন্দোলনেও পড়েছে স্বাভাবিক ভাবেই।সিএএ বিল আসার পর উত্তাল হয় দেশ এবং অবশ্যই আসাম ও। আন্দোলন ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়।ইউ এ পি এ আইনে ‘কিষাণ মুক্তি সংগ্রাম স্মৃতি’র নেতা অখিল গোগই কে তার দুই সহযোগীর সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বর মাসে।আর এক সহযোগী বিট্টু সোনওয়াল গ্রেপ্তার হন এ বছরের শুরুতে৷ এন আই এ(National Investigation Agency) তদন্তভার নেয়৷ তারপর তারা চার্জশিট পেশ করেছে ২৯ শে মে আর সেটিই সবচেয়ে মজার ও আশ্চর্যের। দাবী করা হয়েছে বিট্টু সোনওয়ান মাওবাদী, কিসের ভিত্তি তে? সোনওয়াল ‘কমরেড ‘, ‘লাল সেলাম’ এই কথা গুলো ব্যবহার করেছেন তার বন্ধুদের, ফেসবুকে লেনিনের(গত ২২শে এপ্রিল যার জন্মের ১৫০ বছর হল) ছবি দিয়ে লিখেছেন-“The Capitalists will sell us the rope with which we will hang them”[3]।”An introduction to socialism”, “Communist Manifesto” বই গুলো ও বাজেয়াপ্ত করেছে এন আই এ।যদিও বইগুলো খোলা বাজারেই বিক্রি হয়।নিষিদ্ধ নয়।এগুলো কে হাস্যকর বলব ছাড়া আর কি!কমরেড লিখলে জেল হতে পারে, লেনিনের ছবি দিলেও।একটা কাল্পনিক দৃশ্য, ধরুন কোনো কুখ্যাত অপরাধীর বাড়ি গিয়ে দেখলেন সে মাদার টেরেজা বা বিবেকানন্দের জীবনী রাখা।কি প্রমাণ হবে সে বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রানিত। অপরাধ মাফ!

“If you tremble with indignation at every injustice, then you are a comrade of mine.” – চে গেভারার এই কথা হয়ত কমরেড কথার মানে বুঝিয়ে দিতে পারে। তবু যদি উৎপত্তিগত মানে খুঁজতে হয় তাহলে বলতে হয় এটি এসেছে ফরাসি শব্দ ‘কমারাডা’ বা ‘ক্যামারাডা’ থেকে যার অর্থ একই ঘরের বন্ধু (উইকিপিডিয়া)। ফরাসি বিপ্লবের সময় শব্দটি জনপ্রিয় হয় ও পরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সময় সতীর্থ দের কমরেড বলে ডাকা হতে থাকে।যার অর্থ বন্ধু, বা সাথী বা সহযোদ্ধা।এখন কাউকে কমরেড বলে ডাকলে যদি গরাদ যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে-এ দেশের কপালে দুঃখ আছে।

এদেশের বিচারের রায় হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিমকোর্ট যেতে যেতে পালটে যায়।বিচারপতি দের সাংবাদিক ডেকে বলতে হয় ” integrity of court was in under threat “, যুক্তি নয় অধিকাংশ বা সঙ্গে সংখ্যগুরুর বিশ্বাসের ভিত্তিতে রায় দেওয়া হয় আর তারপর সোজা রাজ্যসভার দরজা হা করে খুলে যায়!প্রভাবশালীদের প্রভাবে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়া এখন এতটাই দূর্লভ, যে তা অর্জন করতে পারলে পেপারে ছবি টবি বেরোয়া।মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেলে মার্ডার কেসের আসামি ও ডিটারজেন্ট এ ধোয়া ধবধবে সাদা।আইন শৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য ব্যবস্থা নিতে বললে তড়িঘড়ি বিচারক ট্রান্সফার।

এত শত ভেবে হবে টা কি?ব্রিটিশ দের দেওয়া সিডিশন আইন ব্রিটেনে বন্ধ হয়ে গেল আর আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে তা চালিয়ে যাচ্ছি।নইলে যো হুকুম করবে কি করে!ভাবছেন কি আর হবে? শব্দ বলা নিষেধ? বেশ বলব না। ওই ক’টা বই পড়লে পুলিশ ধরবে? পড়বো না। আজাদী স্লোগান দেওয়া নাকি নাকি রাষ্ট্রদ্রোহিতা, আমরা স্বাধীন তাই অধিকারের কথা বলা অপরাধ। আস্তে আস্তে শ্রম আইন কঠিন হচ্ছে। শ্রমিকের অধিকার খর্ব হচ্ছে। আপনি তাদের বলার স্বাধীনতা বা আজাদীর কথা বলবেন? আপনি রাষ্ট্রের শত্রু। আপনি তাদের কমরেড বলে সম্বোধন করবেন? আপনি রাষ্ট্রের শত্রু।অতএব চুপ করে থাকুন।কিন্তু থাকতে থাকতে কখন আপনার উপরেও কোপ পড়বে বুঝতেই পারবেন না।তখন বলার জন্য কেউ থাকবে না।এই যেমন এখন আছেন।


তথ্যসূত্র:

  1. https://www.thehindu.com/news/national/Binayak-Sen-gets-bail-in-Supreme-Court/article14685491.ece
  2. https://www.outlookindia.com/website/story/india-news-writing-lal-salam-and-comrade-on-facebook-can-now-land-you-behind-bars-in-assam/354137
  3. https://thewire.in/rights/assam-bittu-sonowal-akhil-gogoi-nia-lenin-comrade

Be the first to comment

আপনার মতামত...