পারস্য উপসাগরের কবিতা

পারস্য উপসাগরের কবিতা | রূপায়ণ ঘোষ

রূপায়ণ ঘোষ 

 

আবদুল্লাহ রুদাকি: ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে তাজাকিস্তানের পাঞ্জাকেতে জন্ম। পারসিক ইতিহাসবিদদের মতানুসারে রুদাকি জন্মান্ধ ছিলেন, বর্তমানে তাঁর কয়েকজন জীবনীকার অবশ্য এ নিয়ে মতানৈক্য প্রকাশ করেছেন। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে তিনিই ধ্রুপদী পারসিক সাহিত্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর রচনাগুলির মধ্যে অধিকাংশই গজ়ল এবং রুবাই।

একালে ‘Adam of poets’ উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করা হয়েছে। ৯১৪-৯৪১ সময়কালে রুদাকি, পারস্যের সমানিদ্ শাসক দ্বিতীয় নাসেরের সভাকবি ছিলেন। জন্মভূমি পাঞ্জাকেতেই ৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ৮২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

এই পৃথিবী একটি স্বপ্নের মতো

এই পৃথিবী একটি স্বপ্নের মতো
এ দুনিয়া আদতে স্বপ্নের সংবদ্ধ আচরণ—
সে জেনেছে এ হৃদয় নিয়ত জাগ্রত
ক্রমশ যার অন্তর দীর্ঘ বিমুক্ত হয়
নিমেষে জেনেছে সে— এ চরাচর নিত্য উদারতায় সরিয়েছে নিঠুর তীব্রতা
এখানে সুখের ক্রম নিরন্তরতা সরিয়েছে দুঃখের গতিপথ
তবু কেন এত তৃপ্ত তুমি; যখন বিন্যাসহীন বিশ্ব উঠছে গড়ে
এখানে সমস্ত মুখ কী প্রসন্ন-সুন্দর!
অথচ কদর্য রীতিও আছে সুপ্ত—
এখানে প্রতিটি সত্তায় বিমোহিত প্রাণ
অথচ নীরবে এখানে পরিপ্লুত, মানুষের অবিনয় ঘ্রাণ…

 

নিয়তির দরজা

নিয়তির এই দুয়ারকে যেমন ভেবেছ তুমি
জেনো সে তোমার কাছে তেমনই।
এখানে এখন সুখ আছে, খুশি হও তাতে—
অথচ তুমি বিষণ্ণ কেন?

হারিয়েছ কোন চিন্তাতে?

তোমার জন্য যা প্রয়োজন, জেনো ভাগ্য সে খেলা জানে
এ কথা গ্রহণ করো— উজিরের সমৃদ্ধ উপায় তোমার তো নয়
নিয়তি জানে কতটুকু প্রাপ্য তোমার…
এ জীবনচক্র— দেখেছ কি অদ্ভুত মেতাচারী
কখনও তোমার মতো রচিত হয় না আর কেউ
তবু আশ্চর্য দ্যাখো; আরও একশত ভালো দ‍রজা খোলার আগে
ঈশ্বর তাঁর দুয়ার স্তব্ধ করে না কখনও…

 

শহিদের কাফেলা

আমাদের থেকে আরও এগিয়ে গেল শহিদের দৃপ্ত-করুণ কাফেলা
বিশ্বাস রাখো, চলে যেতে হবে আমাদেরও একদিন।
এ কাফেলায় গুণে নাও চোখেদের সারি
মেপে নাও সহস্র বোধের সুদীর্ঘ অধোগতি…
মৃত্যু এসে বেঁধে দিক পা—
তবু তার আগে মর্মবৃক্ষের কাছে,
সংগ্রহ করে আনো সমস্ত উর্বর ফসল!
মৃত্যু এখানে সুবৃহৎ হয়নি কখনও— তাই যা কিছু সংগ্রামশীল সঞ্চয়
জেনো এত সহজে তা হারাবার নয়…

***

 

হাফিজ় শিরাজী: ১৩১৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পারস্যের শিরাজ শহরে তাঁর জন্ম। হাফিজ় মূলত একজন সুফি কবি, তথাপি যে কোনও প্রকার অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের কট্টর সমালোচক ছিলেন তিনি। তাঁর গজ়লগুলিই সর্বাধিক বিখ্যাত। প্রেম, সুরা এবং ক্ষমতার উন্মত্ততার কথা হাফিজ়ের কবিতায় বারবার ফুটে উঠেছে। একপ্রকারভাবে তাঁর কবিতাকে বলা যায় শাসনের বিরোধাভাস— যা জীবনকে শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন পরমানন্দ চেতনার সন্ধান দেয়। ১৩৯০ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভূমি শিরাজ শহরেই ৭৫ বছর বয়সে তাঁর দেহাবসান হয়। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ— ‘দিওয়ান-এ-হাফিজ়’।

সুরা বন্দনা

চেয়ে দ্যাখো শুঁড়ি, রাত্রি শেষ হয়
মদে ভরে দাও শূন্য পেয়ালা
তুঙ্গে বয়ে যায় সময়ের ভেলা
তাড়াতাড়ি করো শুঁড়ি, নেশা শেষ হয়।

এই নশ্বর পৃথিবী আর কতদিন হায়
দয়া করো তার ধ্বংসের আগে
হে শুঁড়ি, আমাকে নীরবে সমাপ্ত করো
পুষ্প-রক্তিম সুরার আঘাতে!

মধুভাণ্ডের পুবদিকে দ্যাখো
পবিত্র রূপে ধরা দেয় সুরা;
সেখানেই যদি তুমি চাও স্বর্গীয় সুখ
উড়িয়ে দাও নিদ্রহীন রাত, ছড়িয়ে দাও প্রবল মদিরা…

মহাশূন্যেও পাব মাটি এইটুকু
আকাশ গড়ে দেবে পাত্রের সমারোহ
তবু আমাদের পার্থিব ঘট
এসো, অফুরান মদিরায় ভরো।

কখনও করিনি পূজা, হইনি সংযমী
নেই অনুতাপ তাতে, নেই বেয়াদবি
শোনো, ভীত নই আমি
সুরার পাত্র হাতে স্বাগতম্ বলো শুঁড়ি…

মদের পেয়ালা ছোঁয়া কী ভীষণ ভালো
হাফিজ়, সে কথা মনে রেখো—
ঘুরিয়ে দাও যা আছে— শপথের দুরূহ মুখ
যেদিকে রয়েছে ওই বিমোহ দ্রব্য।

 

মৃত্যুর মুহূর্ত আগে

কোনখানে আছে তোমার আসঙ্গ মিলনের ডাক?
ভেঙে যেতে হবে সমস্ত বন্ধন-শোক,
এ শরীর ছেড়ে যেতে আর ক্ষণকাল
মুক্ত বিহঙ্গ আমি, ছুঁয়ে যাই সে মহাশূন্যলোক।

যদি প্রেম স্বীকার করো সমর্থ চোখে
যদি মেনে নাও ক্রীতদাস বলে আমাকে
তবে দেশ ও কালের নিয়ম উড়িয়ে
এ নগর ত্যাগ করে যাব অনায়াসে…

সুরা ও সুরকার সহ তুমি
এসে বসো আমার কবরের কাছে
বিশ্বাস রাখো তারই সুগন্ধে আমি
এসে যাব নৃত্যময় উচ্ছ্বাসে।

বিমুক্ত ছন্দে এই গতিবিভঙ্গে, প্রিয়া
চেয়ে থাকো অমৃতমুখে নির্নিমেষ আমাতে;
হাতের রেখা ধুয়ে ফেলি পিপাসার জলে
যেতে হবে বহুদূর— এ যাপন পৃথিবী ছেড়ে!

বৃদ্ধ তবুও, একটি বিপুল রাত্রি—
উন্মুখ করো হৃদয় তোমার
দ্যাখো নিদ্রা ভেঙে অমলিন ভোরে
জীবনের প্রবেশপথে আলোকিত নবযৌবন দুয়ার।

মৃত্যুর দিন শুধু সামান্যকাল
যদি চকিতে পান করি দৃষ্টি তোমার
হাফিজ়ের মতো এ প্রাণ, এ বিশ্বলোক—
ভেঙে উড়ে যাবে পাখি— বন্দি খাঁচার…

***

 

সঈব তবরিজ়ী: মির্জা মহম্মদ আলি সঈব আজ়রবাইজানি তবরিজ়ী-র জন্ম ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে ইরানের তবরিজ় নগরে। তাঁর কবিতায় পারস্য দেশের স্তুতি বা বন্দনা সর্বাধিক চর্চিত বিষয়। আধুনিক গবেষকরা যাকে ‘Persian panegyric poetry’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবরিজ়ী ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন। পরে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে দীর্ঘ কয়েক বছর মুঘল রাজদরবারে অবস্থান করেন। তিনি কাশ্মির ও কাবুলেও কয়েক বছর অতিবাহিত করেন এবং ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দেশে ফেরেন। ইরানের ইসফাহান নগরে ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৮৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

১.

যদিও আমরা কোনও এক তৃপ্ত কাহিনির জন্য ঘুমিয়েছিলাম
কিন্তু আমাদের সেই ঘুম ভেঙে গেল সুললিত গল্পের কারণে…
প্রতিটি ঘুমের ভিতর স্বচ্ছ আয়না আছে—
যাকে আলোকিত করে চাঁদ, সূর্য— আরও কতশত নক্ষত্রমালা
অতঃপর,
দ্যাখো একসাথে মিশে যায় আলো ও ঘুমের কাহিনিরেখা…

 

২.

এই তরুণ শরতের চেয়ে, পুরনো ইচ্ছেরা আরও বেশি সতেজ হোক
এখানে প্রতিটি গাছের পাতায় বিবিধ রং আসে
দ্যাখো, তাঁর ভালোবাসা এসে
আমাকে দূরে নিয়ে গেছে ধর্মের থেকে—
তবু সূর্য যখন প্রকাশিত হয়
নক্ষত্রের আড়ালও তো তৈরি করে কথা বলবার সুযোগ।

যখন আমরা দেখা করি একে অপরের সাথে
জানো পরিস্কার নয় এও,
দেখা হবে কিনা আবার আমাদের
দেখা হবে কিনা জলে ভাসমান কাঠের মতো…

 

৩.

ফুলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা থেকে
গান গাওয়া পাখিটির নাম জানি—
কিন্তু তা না হয় যদি,
তবে কী এসেছে ফিরে একগুচ্ছ পালকের ভরে?
যাবতীয় জটিল সমস্যা থেকে সুদীর্ঘ নিঃশ্বাসে
তুমি শূন্য করতে পারো হৃদয় তোমার
জেনো, একটি সংবাদবাহকের আগমন
শত পত্রের জন্য যথেষ্ট মনে হয়…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

আপনার মতামত...