খনিজ তেলের বিশ্ববাজার ও ‘লোকাল’ ক্রেতাদের বিপন্নতা

প্রবুদ্ধ ঘোষ

 


লেখক সাহিত্য-গবেষক, দাবাড়ু এবং প্রশিক্ষক

 

 

 

 

বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে। কিন্তু, ভারতে পেট্রোল-ডিজেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। লকডাউনের অব্যবহিত আগেই অর্থনৈতিক আলোচনায় উঠে আসছিল খনিজ তেলের দাম কমার প্রসঙ্গ। অথচ, লকডাউন ওঠার পর থেকেই পেট্রোল-ডিজেলের দাম বেড়ে চলেছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। গণতান্ত্রিক বহুদলীয় ব্যবস্থায় ‘মূল্যবৃদ্ধি হ্রাস’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েই কোনও শাসক নির্বাচনে জেতে অথচ ক্ষমতায় এসে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় আগের শাসককে ছাপিয়ে যায়। লকডাউন-চলাকালীন অর্থনৈতিক অবরোধে আয়সঙ্কোচ এবং লকডাউন-পরবর্তী সময়ে পেট্রোপণ্যের দামবৃদ্ধির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে হাঁসফাঁস অবস্থা নাগরিকদের। কিন্তু, কেন?

তৃতীয় দশার লকডাউনে ভারত সরকার রেকর্ড পরিমাণ এক্সাইজ ডিউটি চাপিয়ে দেয় তেলের ওপরে। প্রতি লিটার পেট্রোলে ১০ টাকা (৮টাকা সড়ক ও পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং ২টাকা অতিরিক্ত এক্সাইজ ডিউটি) এবং প্রতি লিটার ডিজেলে ১৩ টাকা (৮টাকা + ৫টাকা)। যদিও, রাজস্ব দপ্তরের দাবি ছিল, ভোক্তার ওপরে এই এক্সাইজ ডিউটি বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে না। কিন্তু, অর্থনীতির চাহিদা-যোগানের অঙ্ক এখানেও কার্যকরী। লকডাউনের পর্যায়গুলোতে পেট্রোল-ডিজেলের চাহিদা কমে গেছিল প্রবলভাবে। কোভিড-১৯ মহামারির জন্যে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী খনিজ তেলের ব্যবহার কমে যাওয়ায়, বিশ্বব্যাপী দামও হ্রাস পেয়েছিল অনেক। তবে, এর সঙ্গে খেয়াল রাখা দরকার খনিজ তেলের আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়গুলোও। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের অন্যতম বৃহত্তম তেল পরিশোধনাগারে ড্রোন হামলা হয়, বেশ কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে ক্ষতিপূরণে। ২০২০ সালের প্রথমে বিশ্বমহামারির সমান্তরালে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির চর্চার বিষয় ছিল সৌদি আরব ও রাশিয়ার সংঘাত। বিশ্বে দুটো কার্টেল[1] সবসময় আলোচনার কেন্দ্রে থাকে, খনিজ তেলের কার্টেল এবং ড্রাগ কার্টেল! টাকাপয়সার বখরা ও মুনাফা নিয়েই কার্টেল-অন্তর্ভুক্ত দেশ বা দলগুলোর মধ্যে সংঘাত খুনোখুনি চলে। ড্রাগ-কার্টেলের সংঘাত গ্যাং-ওয়র ও ব্যক্তিখুনে নিষ্পত্তি হয় আর, তেল-কার্টেলের সংঘাত গড়ায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের টানাপড়েন, যুদ্ধ অবধি। রিয়াধ-কেন্দ্রিক তেল-উৎপাদন বেশ কিছু আভ্যন্তরীণ ঝুটঝামেলার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পরে এবং আমেরিকার তেল-উৎপাদন সংস্থার ব্যবসাবৃদ্ধির ফলে সৌদি আরব প্রথমে রাশিয়া ও ‘ওপেক (তেল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশসমূহ)’-এর অন্য সদস্য দেশগুলিকে তেলের দাম সংশোধনের ব্যাপারে অনুরোধ করে। কিন্তু, মূলতঃ রাশিয়া তাতে রাজি না হওয়ায় সৌদি আরব ‘দাম-যুদ্ধ’ শুরু করে তেল-উৎপাদক দেশগুলোর বিরুদ্ধে। অর্থনীতির গেম থিওরির ‘পে-অফ নীতি’ মেনে দু’টি বড় দেশ/সংস্থা একে অপরকে বিপদে ফেলতে পণ্যের দাম কমিয়ে দেয়; যাতে, অপেক্ষাকৃত কম দামের পণ্য বাজারে বিক্রি বেশি হয়। আপাতদৃষ্টিতে এই দাম-যুদ্ধে ক্রেতা লাভবান হলেও, একই পণ্য বিক্রয়কারী ছোট সংস্থা/দেশ পুঁজির অভাবে বাজার থেকে ছিটকে যায়, পরে ছিটকে-যাওয়া বিক্রেতার শূন্যস্থান তথা মার্কেট-শেয়ার দখল করে ওই জায়গা নেয় বড় পুঁজির দেশগুলো এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে মুনাফার ভারসাম্য বজায় রাখতে বিক্রেতা দেশ/সংস্থাগুলো নিজেদের মুনাফা উশুল করে নেয়— তাতে বিপদে পড়ে ক্রেতা দেশগুলো। আর, এই দাম-যুদ্ধ আন্তর্জাতিক পণ্য বাজার এবং পারস্পরিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করে যুদ্ধের আবহে নিয়ে যায়। সৌদি আরব ও রাশিয়ার দাম-যুদ্ধে খনিজ তেলের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যায় চলতি বছরের মার্চ মাসে। আমেরিকার তেল-বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। এর সঙ্গে যোগ হয় মহামারি ও লকডাউনের অভিঘাত। আমেরিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিশেষজ্ঞ জেসন বর্ডফের কথায়, মার্চ-এপ্রিল মাসে আমেরিকার খনিজ তেল-উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে এবং ৪০ শতাংশ তেল কোম্পানি বাৎসরিক ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না; এমনকি, পেট্রোপণ্যের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ২ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারাতে পারেন বলেও তাঁর মত। ভারতে লকডাউনের সময়ে পেট্রোল-ডিজেলের চাহিদা অস্বাভাবিক হারে প্রায় ৫৫ শতাংশ কমে গেছিল। ভারতের পেট্রোপণ্য বাজারের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা ব্যাপক, কারণ, মালিকপক্ষের দাবি অনুযায়ী লকডাউনে চাহিদা কমে গেলেও অন্যান্য সব ব্যয় আগের মতোই বহন করতে হয়েছে তাদের; তার ওপরে সরকার থেকে চাপানো অতিরিক্ত শুল্ক ভোক্তার ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাপী করোনা-মহামারি এবং তেল-বাজারে খনিজ তেলের দামে আচমকা পতনে অর্থনীতি এক অভূতপূর্ব বাঁকের মুখে দাঁড়ায়। বিশেষজ্ঞদের আশা ছিল যে, খনিজ তেলের দামে অত্যাশ্চর্য পতনের ফলে ভারতের মতো প্রধান আমদানিকারক দেশের আমদানি-ব্যায় কয়েক হাজার কোটি টাকা কমবে এবং অর্থনীতির ‘ব্যালান্স-অব্‌-পেমেন্ট’ তথা রপ্তানি-আমদানি সামঞ্জস্যে ব্যায়ভার কমবে। খনিজ তেলের ব্যারেল-প্রতি দাম যখন সবচেয়ে কম, তখনই সবচেয়ে বেশি কর চাপানোর নজির গড়ল বিজেপি সরকার।

***

 

ভারতে মোট যত খনিজ তেল ব্যবহার হয়, তার ৮৩ শতাংশ আমদানি করা হয় এবং মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৪৫ শতাংশ আমদানি করা হয়। সৌদি আরব এবং ইরাক থেকে সর্বাধিক তেল ও রান্নার গ্যাস আমদানি হয়। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল-আমদানিকারী দেশ ভারত। ২০১৮-১৯ আর্থিক বর্ষে ৮৭ বিলিয়ন ডলার ভারত সরকার খরচ করেছে তেল আমদানিতে। কয়লার পরে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। এছাড়াও, বিভিন্ন শিল্পে ও পরিবহণে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার এর। ২০০৭-এর বিশ্বব্যাপী তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে যেরকম পেট্রোপণ্যের বিক্রি ধাক্কা খেয়েছিল, প্রায় ততটাই ধাক্কা খেয়েছে আড়াই মাসের লকডাউনে। ২০১৯-এর মে মাসের তুলনায় ভোগ্যপণ্য হিসেবে পেট্রোপণ্যের মোট ব্যবহারের তফাত ২০২০-র মে মাসে— ৪০ শতাংশ। এপ্রিল ও মার্চের শেষ সপ্তাহের পর যা ভোক্তাহার, তার থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ মে মাসে বাড়লেও, চাহিদা-ভোগে এখনও যে পরিমাণ ঘাটতি তা সমতায় ফিরতে ২০২০ সাল ফুরিয়ে যাবে। লকডাউন ওঠার প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই রান্নার গ্যাস ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বিক্রি বেড়েছে ১২.৮০ শতাংশ, ন্যাপথার বিক্রি বেড়েছে ৩৪.০৬ শতাংশ। অন্যদিকে, লকডাউন-পর্যায়ে কাজ হারানোর হার বেড়েছে, খনি, নির্মাণশিল্প ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রায় ৫৫ শতাংশ সঙ্কোচন হয়েছে গতবছরের এই ক মাসের তুলনায়। মোট জিএসটি আদায় ৪১ শতাংশ কম হয়েছে গতবছরের থেকে। একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচারের ঢক্কানিনাদ অন্যদিকে করোনার কারণে ক্রমবর্ধমান আতঙ্ক। বাস্তবায়িত না-হওয়া একাধিক অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত ক্রেতাদের আয় ও সঞ্চয় হ্রাস পেয়েছে। এরই সঙ্গে যোগ হয়েছে পেট্রোপণ্যের ক্রমবর্ধমান দাম। শাসকের যুক্তি, লকডাউনের সময়ে চাহিদার যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার উপায় করবৃদ্ধি, এই মূল্যবৃদ্ধি নাকি প্রয়োজনীয় অর্থনীতিকে ফের চাঙ্গা করতে।

***

 

পেট্রোপণ্যের দাম বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকম। কারণ, সর্বশেষ ক্রেতা যে দামে পেট্রোপণ্য কেনে, তার মধ্যে বিভিন্ন কর অন্তর্ভুক্ত থাকে— কেন্দ্রীয় সরকারের কর, রাজ্য সরকারের কর এবং ডিলারের কমিশন। আমরা ভোক্তারা খনিজ তেল ব্যবহার করি না, ব্যবহার করি পেট্রোপণ্য, যা পরিশোধনের বহু স্তর পেরিয়ে আসে। সাধারণত, ডিজেলের থেকে পেট্রোল বেশি পরিশোধিত বলে, পেট্রোলের দাম ডিজেলের চেয়ে বেশি থাকে। ডিজেলের ব্যবহার তাই দৈনন্দিন ক্ষেত্রে বেশি আর, সরকারও ডিজেলের ওপরে পেট্রোলের তুলনায় কম কর চাপায়। লকডাউন চলাকালীন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার সঙ্গে চাহিদার ঘাটতিও বিবেচ্য। আর, এখানেই আসে সরকারের ভূমিকা। অর্থনীতির যান্ত্রিক হিসাবকিতাব পেরিয়ে শাসকের ভূমিকা। অথচ, এই সময়েই এক্সাইজ ডিউটি বাড়িয়ে দিল শাসক, আপাতউদ্দেশ্য ক্রমনিম্নমান জিডিপি-কে চাগিয়ে তোলা। আর, পেট্রোপণ্যের এক্সাইজ ডিউটির ‘ক্ষতি’ পোষাবার জন্যে বিক্রেতা তা আদায় করে ক্রেতাদের থেকে। পেট্রোপণ্যের ওপরে অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দিয়ে রাজস্ব ঘাটতি মেটানো কেন্দ্র সরকারের সবচেয়ে সহজ পন্থা। সাম্প্রতিক পেট্রোপণ্যের দামবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেক অর্থনীতিবিদ্‌ ও ভারতীয় অয়েল কর্পোরেশন লিমিটেডের দাবি, ব্যবসায়ীরা নিজেরা এই ‘এক্সাইজ ডিউটি বৃদ্ধি’-র দায় নিয়েছে, ভোক্তাদের ওপরে চাপিয়ে দেয়নি। কিন্তু, তাত্ত্বিক জটিলতায় তাঁরা বোধহয় এটা ভুলে যাচ্ছেন যে, পেট্রোপণ্য-ব্যাবসায়ীরা ‘ব্যবসা’ করছেন, যে কোনও মূল্যে ক্ষতি উশুল করাই তাঁদের উদ্দেশ্য আর, লকডাউনের সময় ভোক্তাদের ওপরে অতিরিক্ত করের বোঝা ঠেলে দিয়ে তাঁরা লাভ করতে পারতেন না কিছুই। তাই, লকডাউন খোলার জন্যে অপেক্ষা ছিল। খেয়াল করলে দেখা যাবে, জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথমে লকডাউন খোলার সময় থেকেই পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে, সরকারের ১.৬ লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব-বাড়ানোর ফন্দি ব্যবসায়ীরা পরোক্ষে চাপিয়ে দিয়েছে ভোক্তাদেরই ওপরে, প্রতি দু-তিনদিন অন্তর একটু একটু করে বেড়েছে দাম। এমনকি, অভূতপূর্ব উপায়ে পেট্রোলের দামকে ছাপিয়ে গেছে ডিজেলের দাম! পেট্রোপণ্য, যা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মধ্যে পড়ে, তার দাম বাড়লে বহু ক্ষেত্র একের পর এক প্রভাবিত হবে। লকডাউনের পর্যায়ে দীর্ঘ আড়াই মাস জন-পরিবহন স্তব্ধ থেকেছে, এমনকি লকডাউন ওঠার পরেও যাত্রী-পরিবহনে বেশ কিছু সরকারি শর্ত আরোপিত হয়েছে; জন-পরিবহনমাধ্যমের মালিকেরা নিশ্চয়ই নিজেদের ব্যবসায়িক ক্ষতি চাইবে না, ফলে ভাড়াবৃদ্ধির মাশুল গুনতে হবে আমাদেরই। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যা শহরান্তরে বা রাজ্যান্তরে আমদানি-রপ্তানি হয়, তার দামও এর পরোক্ষ প্রভাবে বৃদ্ধি পাবে। মূল্যবৃদ্ধি যদি অনিয়ন্ত্রিত হারে বাড়ে, তার জেরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হস্তক্ষেপ করতে পারে সুদের হারে। সেক্ষেত্রে, মূল্যবৃদ্ধি দিয়ে চাহিদার ঘাটতি সামলানোর তত্ত্ব কাজ করবে কি না, জানা নেই। ভারতের অর্থনৈতিক মসৃণতা বিগত কয়েক মাসে বিপন্ন হয়েছে, পেট্রোপণ্যের ওপর সরকারের এই অতিরিক্ত কর চাপানোয় তা থেকে মুক্তির উপায় নেই।

প্রতিশ্রুতির ফাটা কাঁসর না বাজিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ছিল জনগণের দুর্ভোগ কম করা। ভারতের অর্থনীতির হাল করোনা-মহামারির বহু আগে থেকেই নিরাশাজনক। আর, আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও ভারতের অবস্থান স্থিতিশীল নয়, একের পর এক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ফলাফল সামনে আসছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের তৃতীয় খনিজ তেল আমদানিকারী ভারতরাষ্ট্র পারত আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দামহ্রাসের সুযোগ নিয়ে নাগরিকদের স্বস্তি দিতে। যখনই ভারতের বাজারে পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ে, শাসকের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয় যে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। কিন্তু, সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের ব্যর্থতাই সামনে আসে। “লোকালই আমাদের চাহিদার সঙ্কটে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, লোকালকে জীবনমন্ত্র বানাতে হবে”— এই সমস্ত বাক্য অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে, যখন সেই ‘লোকাল’-এর ওপরেই সবথেকে বেশি অর্থনৈতিক শোষণ নেমে আসে। আর, ‘লোকাল’ যদি চাহিদার সঙ্কট সমাধান করতে পেরেই থাকে, তাহলে কেন সরকারকে এতগুণ অতিরিক্ত কর চাপিয়ে নাগরিকদের থেকে রাজস্ব আদায় করতে হয়? বিগত মাসগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যেকটি জনস্বার্থবিরোধী নীতি অর্থনীতিকে আরও বেকায়দায় ফেলেছে। শ্রমজীবী-বিরোধী আইন ও নীতিসমূহে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারিকরণের মধ্যে সমস্ত সামঞ্জস্য হারিয়ে ফেলছে সরকার, যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে জনজীবন আরও বিপর্যস্ত হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারি রুখতে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে বরং আতঙ্ক আরও বেশি তৈরি হতে দিয়েছে, যাতে বিপন্নতার সুযোগ নিয়ে স্বৈরাচারী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। সাম্প্রতিক পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আদৌ ভারতের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করতে পারে কি না, তা সময় বলবে। কিন্তু, আপাতত দেশের বৃহত্তম শোষিতশ্রেণিকে আয় ও সঞ্চয়ের অনিশ্চয়তায় আরও বহু মাস কাটাতে হবে।


[1] একাধিক সংস্থা বা দেশ, যারা উৎপাদন ও ব্যবসায়িক স্বার্থে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়। এরা একত্রে উৎপাদনের পরিমাণ ও বিক্রয়মূল্য ঠিক করে। অলিগোপলি বাজার হলেও, কার্টলের সিদ্ধান্তে এরা ক্রমশ মনোপলি বাজারের বিক্রেতার মতোই আচরণ করে; এদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-মসৃণ সম্পর্ক ও চোরাযুদ্ধ থাকে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...