লকডাউন এবং আশা-দিদিদের কথা

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত

 


লেখক গবেষক ও নারী-আন্দোলনের কর্মী

 

 

 

 

মিটিং শেষ হওয়ার পর বিডিও অফিসের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। সামনেই জাতীয় সড়ক। এখনও রাস্তার দুপাশে বেশ কিছু গাছ আছে। বৃষ্টি শুরু হল হঠাৎ। দ্রুত ছাতা খুলে এক দল সপ্রতিভ মহিলা রাস্তা পার হয়ে ওপারে বাস স্টপে গিয়ে দাঁড়ালেন। বেগুনী শাড়ি-ব্লাউজে দলটি উজ্জ্বল। পেছনে বড় বড় পুরনো গাছ। দৃশ্যটা এপার থেকে বেশ পিকচার-পোস্টকার্ড টাইপ।

আশা কর্মী অর্থাৎ সরকারিভাবে নিযুক্ত স্বাস্থ্যকর্মী মেয়ে এঁরা— বেগুনী ইউনিফর্ম পরে কাজ থেকে ফিরছেন। এঁদের দেখে মনে হতে পারে যে শাড়ির রঙে ঔজ্জ্বল্য এনে আমরা বেশ এগিয়েছি প্রচলিত কিছু ধারণা ভেঙে। কথাটা বলছি এজন্য যে আমাদের চোখ অনেক কাল অভ্যস্ত ধবধবে সাদা শাড়ি পড়া নার্স-দিদি অথবা সরু লাল-পাড় কিম্বা নীল-পাড় সাদা শাড়িতে বিভিন্ন হাসপাতাল/স্বাস্থ্যকেন্দ্র/সেবা সদনের সেবিকাদের দেখে। সাদা শাড়িতে, পবিত্রতা ও শুচিতার মোড়কে আমরা বহুদিন মুড়ে রাখতে চেয়েছি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত মেয়েদের যাতে তারা মা-বোনের স্নেহমমতায় রোগী আগলায়, ধৈর্যশীলতায় চিড় ধরা অথবা কোনও নৈতিক স্খলন যাতে তাদের না ঘটে। দিনকাল পাল্টেছে। এখন সালোয়ার-কামিজ পরে বহু নার্সিংহোমে অথবা বাড়িতে মেয়েরা সেবিকার কাজ করতে যান। জেলায় জেলায় বেগুনী শাড়িতে ‘আশা’দের (সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী), হলুদ শাড়িতে সেকেন্ড এএনএম (অকজিলিয়ারি নার্স অ্যান্ড মিডওয়াইফ) ও গোলাপী শাড়িতে ফার্স্ট এএনএম মেয়েদের দেখতে পাওয়া যায়। এঁরাই সরকারিভাবে সারা দেশের মা ও শিশুর রোগ প্রতিরোধ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বে আছেন।

ইদানিং করোনা-কালে এঁদের মধ্যে ‘আশা’ কর্মীদের কথা মাঝেমধ্যে কাগজে পড়েছি আমরা, রাত্রিদিন দরজায় দরজায় ঘুরে নিজেদের প্রাণ হাতে করে সংক্রমণ প্রতিরোধের কাজ করছেন বলে। আমাদের রাজ্যে লকডাউনের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করবার জন্য তাঁরা মাসে হাজার টাকা করে বখশিস পেয়েছেন। অতি সম্প্রতি আমাদের মুখ্যমন্ত্রী আশা কর্মীদের মাসিক মাইনেও হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় এটা যথেষ্ট ভালো, জানি।

ওহ, ভেরি স্যরি। আশা কর্মীদের মাইনে বেড়েছে এটা তো বলা যাবে না, কারণ এই দিদিরা তো দেশের কোথাওই মাইনে পান না। ‘ন্যাশানাল রুরাল হেলথ মিশন’-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী তাঁরা তো ‘হনারারি ভলান্টিয়ার’— মাইনে-করা কর্মী নন। তাই তাঁদের ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক ছুটি বা ন্যূনতম মজুরিটজুরির প্রশ্নই ওঠে না।

মেয়েরা মায়ের জাত— সংসারে সেবার কাজটা তো তাদেরই মানায়! বাড়িতে বাচ্চা-বুড়ো কেউ অসুস্থ হলে বিছানার পাশে দিনের পর দিন তাদের অক্লান্ত সেবিকা-রূপটিই তো আমরা বেশিরভাগ পরিবারে দেখে এসেছি। এ তো তাদের রক্তেই আছে, তারা ভালোবেসে করে! এখানে আবার শ্রমের মূল্যটুল্য ধরবার কথা আসছে কোথা থেকে? আমরা কি বাড়ির মধ্যে যাঁরা পরিবারের সদস্যদের সেবাযত্ন করেন, যাঁদের অনেকেই বাইরে বেরিয়ে রোজগার করতে পারতেন, তাঁদের কখনও একটা ন্যূনতম অর্থমূল্য দেওয়ার কথা ভেবেছি? আমাদের কাছে ‘কেয়ার ইকোনমি’ নিয়ে তথ্য-পরিসংখ্যান রয়েছে খুবই কম; ‘কেয়ার ইকোনমি’-র পরিকাঠামো ও নীতি নিয়ে রাষ্ট্র ভেবেছে কতটুকু? সেবামূলক শ্রমের দৌলতে পরিবারগুলো যেভাবে সাশ্রয় করে, রাষ্ট্র ও নীতিপ্রণেতারাও সে পথেই হাঁটছেন। মেয়েদের ‘স্বেচ্ছাসেবার’ ধারাটা নিজের সংসারের বাইরে সমাজের মধ্যে বইয়ে দিতে পারার জন্যেই তো ‘হনারারি ভলান্টিয়ার’ নিয়োগ। আর কে না জানে শ্রমিক-স্বার্থ রক্ষায় গঠিত ট্রেড ইউনিয়নগুলো মেয়েদের গৃহশ্রম ও সেবামূলক শ্রমকে দৃশ্যমান করা নিয়ে খুব কমই লড়েছে আমাদের দেশে।

মেয়েরা মাধ্যমিক পাশ হলেই অনারারি ভলান্টিয়ার-রূপী ‘আশা’ কর্মী হওয়ার সুযোগের জন্য আবেদন করতে পারেন। বয়স অবশ্য ৩০-এর ওপর হলেই ভালো। তবে অবিবাহিত হলে চলবে না কিন্তু! শুধুমাত্র বিবাহিত, বিধবা এবং বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলারাই বিবেচিত হবেন এই কাজের জন্য। কেন বলুন তো? কোনও পুরুষ কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কখনও শুনেছেন তিনি বিবাহিত, বিপত্নীক না বিবাহবিচ্ছিন্ন সেটা বিচার্য? আসলে মেয়েদের ব্যাপারটা তো আলাদা। অবিবাহিতারা তো বিয়ের পর অন্য গ্রাম/জেলা/প্রদেশে চলে যেতে পারে স্বামীর ঘর করতে। তাই তারা শুরু থেকেই বাতিল। আচ্ছা ধরুন কোনও বিধবা আশাকর্মী যদি পুনর্বিবাহ করতে চান এবং তাঁর হবু স্বামী যদি অন্য ব্লক বা জেলার বাসিন্দা হন, তাহলে কি তাঁর বদলি চাওয়ার অধিকার থাকবে? অথবা কোনও বিবাহিত আশাকর্মী যদি অত্যাচারী স্বামীর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পাশের গ্রামে/জেলায় থিতু হতে চান, তাহলে কি তিনি কাজটা রাখতে পারবেন? না! ভারতের কোথাওই না। সংশ্লিষ্ট এলাকার/গ্রাম পঞ্চায়েতের স্থায়ী বাসিন্দা না হলে তিনি কাজটা পাবেন না। ব্যস!

স্থায়ী ঠিকানায় নিজের সংসারের হাঁড়ি ঠেলে, জল এনে, বাচ্চাদের দেখাশোনা ও বুড়োবুড়িদের যত্ন করবার পর, হাতে যেটুকু উদ্বৃত্ত সময় থাকে, সেটুকু সমাজসেবার কাজে লাগাতে চাইলেই মিলবে বেগুনী ইউনিফর্ম, সম্মান দক্ষিণা, নানাবিধ ইন্সেনটিভ ও ‘সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মী’ হিসেবে গণ্য হওয়ার মর্যাদা! প্রতি হাজার জন গ্রামবাসী পিছু একজন আশাকর্মী থাকেন যাঁদের কাজের মধ্যে পড়ে প্রাথমিকভাবে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের খবর রাখা, তাদের নিয়মিত চেক-আপ করানো, আয়রন-ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট দেওয়া, সময়সূচি ধরে ভ্যাকসিন দেওয়ানো, প্রসবের আগে ও পরে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করা ইত্যাদি। কাজের মূল অভিমুখ মার্তৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা।

আশাকর্মী হিসেবে বহাল হলে মাস গেলে তিন-চার হাজার টাকার সাম্মানিক, তাছাড়া প্রচুর বাড়তি রোজগারের সুযোগ। কোনও প্রসূতিকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রসব করালে ইন্সেনটিভ, ঠিক ঠিক সময়ে একটি শিশুর টিকাকরণ চক্র পূর্ণ হলে ইন্সেনটিভ। আরও আছে। সব মিলিয়ে মাস গেলে হাজার সাতেক টাকা হয়েই যায়!

লকডাউনের ফলে অবশ্য গত কয়েক মাস ইন্সেনটিভের দফারফা! সরকারি হাসপাতালে লকডাউনের প্রথম তিন মাস প্রসব হয়েছে হাতে গোনা। ডাক্তারবাবুরা কোভিড কেস সামলাতে ব্যস্ত। হাসপাতালে সংক্রমণের ভয়ও রয়েছে। তাই ধারদেনা করে প্রাইভেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গর্ভবতী মায়েদের। টিকাকরণের কাজও অনেকদিন বন্ধ ছিল। মা ও শিশুকে যে সমস্ত ভ্যাক্সিন এবং ওষুধ দেওয়া প্রয়োজন, লকডাউনের মধ্যে তার সাপ্লাই ছিল না দীর্ঘদিন। এতে যে শুধু মা ও শিশু স্বাস্থ্যের অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে তাই-ই নয়, আশাকর্মীদের মানসিক হতাশা ও আর্থিক ক্ষতির দিকটাও ভেবে দেখার মতো। চোখের সামনে দেখছেন কাজ-হারানো খেতে-না-পাওয়া পরিবারগুলো গর্ভবতী মেয়েদের/নতুন মায়েদের কোনও পুষ্টির যোগান দিতে পারছে না। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলো মাসে একবার খোলায় শিশুরা রোজ একবেলার পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত। অথচ আশাকর্মীদের নিজেদের সামাজিক ও আর্থিক ক্ষমতা এত সীমিত যে এঁরা কোনওভাবে সাহায্য করতে না পেরে অসহায় বোধ করছেন।

লকডাউনের সময় এঁদের অসহায়তা ও বিপন্নতার আর একটা দিক হল অসুরক্ষিত অবস্থায় সম্পূর্ণ নতুন বেশ কিছু গুরুদায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হওয়া। কোভিড-১৯ সম্পর্কে এলাকায় সচেতনতা বাড়ানো, কনট্যাক্ট ট্রেসিং করা, ঘরে ফেরা অভিবাসী শ্রমিকদের ও তাঁদের পরিবারকে কোয়ারেন্টাইন বিধি বুঝিয়ে দেওয়া ও তাঁদের ওপর নজর রাখা, যে সব গ্রামবাসী সুস্থ হয়ে উঠছেন তাঁদের ফিটনেস সার্টিফিকেট পেতে সাহায্য করা— আরও কত কী!

আমি যতজন আশাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছি তাঁদের কারও মধ্যে কিন্তু কোনওরকম অনীহা, কোনও দ্বিধা দেখিনি এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করায়। বরং তাঁরা মাথা পেতে নিয়েছেন এই কাজ। কিন্তু তাঁদের সুরক্ষা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই, তাঁদের নিয়মিত মাস্ক ও স্যানিটাইজার সরবরাহ করার কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি, পঞ্চায়েত বা জেলাস্তরে আশাকর্মীদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার জন্য কোনও সক্রিয়তা নেই, বাস বন্ধ/ট্রেন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা যখন দূরে গিয়ে রিপোর্ট দিয়েছেন/নিয়েছেন তখন তাঁদের যানবাহনের ব্যবস্থা নিয়েও কেউ ভাবেননি। নিজেদের পয়সায় তাঁরা মাস্ক-স্যানিটাইজার কিনেছেন প্রাণের দায়ে। এই অবজ্ঞা তাঁদের বুকে গিয়ে বেজেছে।

সিঁড়ির সবচেয়ে নিচু ধাপে আছেন বলেন এমনিতেই প্রাপ্য সম্মানটুকু তাঁরা পান না বেশিরভাগ সময়। হাসপাতালের ডাক্তাররা ও নার্সরা প্রায়ই খারাপ ব্যবহার করেন। অথচ তাঁরা নাকি ‘হনারারি ভলান্টিয়ার’— সাম্মানিক কর্মী! সম্মানদক্ষিণার সঙ্গে মাস গেলে শ-খানেক টাকা ফোন রিচার্জ করানোর জন্য পান। প্রত্যন্ত এলাকায় পায়ে হেঁটে অথবা সাইকেলে জলকাদা ভেঙে কাজ করতে যাওয়ার সময় শাড়ি ছেড়ে বেগুনী সালওয়ার-কামিজ পড়বার অনুমতি পান না তাঁরা বেশিরভাগ জায়গায়। স্বাস্থ্য প্রশাসকদের ও নীতিপ্রণেতাদের কাজের শেষ আছে নাকি! কতগুলো মাধ্যমিক পাশ গরিব মেয়ে মাস গেলে একটা দক্ষিণা আর ইন্সেনটিভ পাচ্ছে— এই না কত! তাছাড়া মেয়েদের বাথরুম, মেয়েদের পোশাকের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আমাদের জননীতি কবেই বা লিঙ্গ-সচেতনতা দেখিয়েছে। পুরুষদের সুবিধা আর স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবেই তো সবটা পরিকল্পিত। জেন্ডার অডিটের প্রশ্নই নেই।

আর সেই সঙ্গে নেই মেয়েদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনার অভ্যেস। আমাদের সমাজে মেয়েরা নিয়ম-নির্দেশ বুঝিয়ে দেবে আর পুরুষরা সেগুলো মন দিয়ে শুনে মেনে চলবে, এটা হওয়া যে কত কঠিন আর একবার প্রমাণ করে দিল লকডাউন। আশাকর্মীরা সকলেই মেয়ে আর ঘরে ফেরা অভিবাসী শ্রমিকরা অধিকাংশই পুরুষ। আমাদের রাজ্যের এক প্রাক্তন স্বাস্থ্যসচিবের মুখে জেনেছি অভিবাসী শ্রমিকদের ক্যোয়ারেন্টাইন বিধি বুঝিয়ে নিয়ম মানাতে গলদঘর্ম হতে হয়েছে আশা-দিদিদের! এই কাজটা যদি পুরুষ সামাজিক স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে জেলায় জেলায় করানো যেত, তাহলে মেয়েদের বোঝাটা একটু হাল্কা হত আর অভিবাসী শ্রমিকরাও অনেকে সহজে মানতেন পুরুষ জনস্বাস্থ্যকর্মীদের কথা। কিন্তু হায়, আশাকর্মীদের লেভেলে পুরুষ ‘হনারারি ভলান্টিয়ার’ কই? শত বঞ্চনা সত্ত্বেও তাঁদের শ্রমের মূল্য নিশ্চিত আর একটু বেশি।

তবে ভাগ্যিস লকডাউন ছিল। তাই তো আশা-দিদিরা দৃশ্যমান হিয়ে উঠলেন আর আমরা তাঁদের মুখ থেকে তাঁদের কাজের কথা, জীবনের কথা শুনে দু-পাতা লেখার সুযোগ পেলাম। নইলে কে আর মাথা ঘামায়, বলুন?

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4873 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...