![medha](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/11/medha.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
মেধা নম্রতা
লেখক সমাজ-রাজনীতি বিষয়ক প্রবন্ধকার
ফিনফিনে আগুনের উপর বসে আছে বাংলাদেশ। গুহ্যদেশ পুড়ে হাফ কাবাব। ভুরভুর গন্ধ ছুটছে চাদ্দিকে। পুরো পৃথিবী শঙ্কা আশঙ্কা আর উৎকণ্ঠায় নাক চেপে চেয়ে আছে। পুড়ছে অথচ উপায় নেই যে উঠে দাঁড়াবে!
গাঁটে গাঁটে ধর্ম-সারসদের ঠোক্করে রক্তপুঁজের পুরনো ঘা ঘিনঘিন করছে। ফতোয়াবাজির তাবিজ কবজে যেন এক ইচ্ছাপূরণের আনার গাছ গজিয়ে উঠছে বাংলাদেশের দিনাজপুর, কুমিল্লা, সিলেটসহ আরও অনেক জায়গায়। ক্রমশ সে গাছ ডালপালা ছড়িয়ে ছুঁয়ে বসেছে শাসনকেন্দ্রের হৃৎপিণ্ডকে। নতুন নতুন দাবি পেশ করে চলেছে তারা।
এতদিন চোখ রাঙিয়ে নারী মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্যকে পুরুষ বানিয়েছে, আদালত চত্বর থেকে রাতারাতি ন্যায়বিচারের নারী ভাস্কর্যকে সরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। এবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সরাতে দাবি তুলেছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু এখন কেবলই মোছলমান। খাঁটি মোছলমান। এর মধ্যে কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর ইরাক ইরানের বংশলতিকাও টেনে বের করার সফল চেষ্টা করেছে।
আচ্ছা ইরাক ইরানের মোছলমানরাই কি খাঁটি মোছলমান? তারাও কি কনভার্টেড মুসলিম নয় বাংলাদেশের মোছলমানদের মতন?
তবে এটা সত্য যে, বাঙালি মোছলমানদের বেশ আগে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছে। তা ওদের যদি খাঁটি মোছলমান মানি তাইলে ত পাকিস্তানিরাও বাঙালি মোছলমানদের চেয়ে খাঁটি মোছলমান! তাইলে একাত্তরে— হে হে হে হে! যাক গে কুচুটেপনায় চলে যাচ্ছিলাম। তাতে অনেক সত্য উদ্ঘাটিত হয়ে পড়বে। হয়ত দেখা যাবে আমরা পাঁচ কি ছয় পুরুষ আগেই ছিলাম বৌদ্ধ, হিন্দু অথবা জৈন।
আসল প্রসঙ্গে আসি।
নবিজি ছিলেন সৌন্দর্যের অনুরাগী। মরুপ্রান্তরের দগ্ধ বালুরাশির ভেতর খেজুরকাঁটার রুক্ষতার মাঝেও তিনি ফুল ভালোবাসতেন। মানূষের ক্ষুধা নিবারণের চাহিদাকে প্রথম স্থানে রেখে তিনি বলেছিলেন, ‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/ দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিও, হে অনুরাগী!’
অথচ কোনও মোছলমান নারী ফুল দিয়ে সাজলেই কটাক্ষ হেনে আসে, হিন্দুদের মত লাগছে।
কাবা শরিফের ৩৬০টি মূর্তি অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন নবিজি। অথচ একটি মাতৃমূর্তিকে তিনি ধ্বংস হতে দেননি। কবি শেখ সাদি, জালালুদ্দিন রুমির ভাস্কর্য রয়েছে তাদের মাজার শরিফের সামনে। কই সেখানকার মোছলমানরা তো সেগুলো ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দেয়নি বা দেওয়ার জন্যে দাবি তোলেনি!
কবে হল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের এমন ভরাডুবি? কবে ধর্মীয় সম্প্রীতির সোনার নাওখানি ডুবে গেল উগ্রধর্মের ভাবসাগরে! তবে কি ইসলাম ধর্মের শ্বাশত শান্তির ধার কমে এত ঠুনকো হয়ে গেছে যে সামান্য আঘাতেই ভেঙেচুরে ধ্বসে পড়বে বা মুছে যাবে?
এ প্রশ্ন এ মুহূর্তে করা নিশ্চয় অন্যায় হবে না।
বিভিন্ন দেশে ঘটমান কাণ্ডগুলো দেখলে মনে হয়, ইসলাম ধর্ম যেন ভীষণ দুর্বল, বিপন্ন এবং দুস্প্রাপ্য কিছু হয়ে যাচ্ছে। যেন দ্রুতই মোছলমানরা মুছে যাবে এ পৃথিবীর কোল থেকে। তবে কি এ ধারণার বশবর্তী হয়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠেছে ইসলামিক মতাদর্শপুষ্ট অসংখ্য জঙ্গিগোষ্ঠী?
নইলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুসারীর ধর্মের এমন কী এসে যায় কে কী বলল কী করল তাতে?
ইসলাম ত প্রথমেই গ্রহণীয় হয়েছে মানুষের কাছে শান্তির ধর্ম হিসেবে। তাছাড়া ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে বড় শক্তি বা গুণ কিম্বা সাফল্যের চাবিকাঠিই তো হচ্ছে এর সাম্যতা। ধনী গরীব, কালো ফরসা, বেঁটে লম্বা, দেশি বিদেশি যে কোনও মুসলিমই তো পরস্পর পরস্পরের সমান অধিকারী। একজন রিক্সাওয়ালাও যদি ইমামতি করার যোগ্যতা রাখে তো কোটি কোটি টাকার মালিক তার ইমামতিকে শ্রদ্ধা করে তার পেছনে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহকে স্মরণ করে নামাজ আদায় করতে পারবে। আপত্তি, অনুযোগ, নালিশ ফরিয়াদ, আঁতাত, আক্রমণ কোনও কিছুই করার নিয়ম নেই। করলেও টিঁকবে না। গরীব বলে আত্মীয়তা, আহার বিহারে কোনও ধর্মীয় বিধিনিষেধও নেই। বরং সাহায্য করার কথা বলা আছে।
হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বেঁচে থাকতে কণ্টকযন্ত্রণা পেয়েছিলেন। মক্কা নগরীতে মুহাম্মাদের পরিচিত এক বুড়ি প্রতিদিন তার আসাযাওয়ার পথে খেজুরগাছের কাঁটা গোপনে গেঁথে রাখত। সেই কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে নবিজির পা অনেকবার রক্তাক্ত হয়েছে। তিনি যন্ত্রণা পেতেন। বুড়ি ষড়যন্ত্রের খুশিতে ভাবত, এবার নিশ্চয় মুহাম্মাদ ইসলাম প্রচার থেকে সরে আসবে। কিম্বা ক্ষিপ্ত হয়ে বুড়ির উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। তাতে প্রমাণ হয়ে যাবে ইসলাম শান্তির ধর্ম নয়। ইসলামে ধৈর্য্য, সহ্য, পরমতসহিষ্ণুতা নেই। মুহাম্মাদ যা বলে তার সব কিছু মিথ্যে।
নবিজি কিন্তু বুড়ির পাতা ষড়যন্ত্রে পা দেননি। এমনকি তিনি তার কোনও সাহাবি বা সঙ্গীকে বুড়ির উপর প্রতিশোধ নিতে দেননি। বরং একদিন পথে কাঁটা না পেয়ে খুঁজে বের করেন সেই বুড়িকে। অসুস্থ মরণাপন্ন নিষ্ঠুর বুড়ির সেবা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। তাতে মুহাম্মাদ যত উদার হয়ে উঠলেন ঠিক সেভাবে ইসলাম ধর্মের মহিমাও ছড়িয়ে পড়েছিল দূরদূরান্তে।
কিন্তু তিনি যদি ক্ষেপে যেতেন বা বুড়িকে তার কাজের জন্যে কোনও শাস্তি দিতেন, তাহলে কি ইসলাম সম্পর্কে এমন ভালো কথা কেউ জানতে পারত?
দু-একটা ব্যঙ্গচিত্র, নবিজি সম্পর্কে হাজার কটূক্তি, পবিত্র কুরআনকে অসম্মান করায় কি ইসলাম মুছে যাবে এ পৃথিবী থেকে? একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ইসলামকে খুনির ধর্ম বানানো ঠিক হচ্ছে? কেন পৃথিবীর অন্য ধর্মের মানুষ আজ ভয় পাচ্ছে মোছলমানদের? কেন অন্য ধর্মের প্রতিবেশীরা আতঙ্কে থাকছে একটি মোছলমান প্রতিবেশীর পাশে থাকতে?
আই লাভ মোহাম্মাদ বা নবিজিকে ভালোবাসি বলে ফেসবুক ভেসে যাচ্ছে। নবিজির জন্যে জান দিতে প্রস্তুত হাজার হাজার মোছলমান। অথচ নবিজির মত ক্ষমাশীল সরল সহজ জীবনযাপন গ্রহণ করতে কতজন মোছলমান মনেপ্রাণে প্রস্তুত আছে? কতজন মোছলমান আছেন যারা নবিজির মত নারীদের সম্মান রেখে কথা বলে? কতজন মোছলমান জাকাত দিয়ে গরীবদের সাহায্য করে? মাদ্রাসার দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের থাকা খাওয়া পড়াশুনার জন্যে কতজন মোছলমান সাহায্য করে? কতজন মোছলমান শিক্ষকরূপী সেই সব হুজুরদের বয়কট করে যারা মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের ধর্ষণ করে, মেরেও ফেলে?
ইসলামে জাকাত নামে চমৎকার একটি নিয়ম রয়েছে। অনেকটা কর দেওয়ার মত। প্রতি মুসলমানকে তাদের অর্জিত সম্পদ অর্থাৎ জমি, অর্থ, চাকরি, ব্যবসা, সোনারূপা থেকে নির্দিষ্ট অর্থ গরীবদের জাকাত দিতে হবে। এমনকি গরীব অমুসলিমকেও দান হিসেবে দেওয়া যাবে।
এরকম একটি ভালো গুণ সম্পন্ন ধর্মের অনুসারীরা কেন এত বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলছে সারা পৃথিবী ব্যেপে? কেন নারীকে মর্যাদা দেওয়া সত্ত্বেও তাদের অবরুদ্ধ করে রাখার প্রচেষ্টা গ্রহণ করছে মোল্লা মুসুল্লিরা?
বিশ্বের প্রতিটি ধর্ম এসেছে মানুষের জন্যে। মানুষের হাতেই ধর্মের বিস্তার। তাতে উগ্রতা মিশে গেলে ধর্ম তার মাহাত্ম্য হারিয়ে ফেলে কেবল অনুশাসনে পরিণত হয়। প্রতিটি ধর্মের ভালো দিক নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। কোনও ধর্মকে উগ্রভাবে সমালোচনা বা ব্যঙ্গ করাও ঠিক নয়। হজরত মুহাম্মাদ একাধিক বিয়ে করেছেন তাতে আমাদের কী? কোথাও কি লেখা আছে প্রতিটি মোছলমান পুরুষকেও একাধিক বিয়ে করতে হবে? কৃষ্ণ রাধাসহ শতাধিক গোপিনী্র সঙ্গে অভিসার করেছেন। তাই বলে কি প্রতিটি হিন্দু পুরুষকে এমন করতে হবে? শত বছর আগে একজন ব্রাহ্মণ পুরুষ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করত। এখন কি সে সময় আছে?
তোর ধর্ম খারাপ, আমার ধর্ম ভালো— এসব তর্কে না গিয়ে প্রতিটি ধর্মের ভালো দিক নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তাতে ধর্মের অবমাননা যেমন হবে না, তেমনি উন্মুক্ত হয়ে উঠবে প্রতিটি ধর্মের ভালো দিকগুলো।
মনে রাখতে হবে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মকে এত দুর্বল হতে দেওয়া মুহাম্মাদের উম্মতদের শোভা পায় না। আমরা কেউ কি নবিজিকে দেখেছি? অথচ নিজের ধর্মের উপর ঈমান শক্ত আর নির্ভেজাল হলে অন্যে কী বলছে, কী করছে তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে। সেভাবেই বরং ইসলাম ধর্ম কিছুটা শান্তির ধর্ম হয়ে উঠবে আশা করি।
লেখাটা ভালো হয়েছে । জোটে যদি মোটে এইটি পয়সা ….. উক্তিটি একজন লেখকের ,সৈয়দ মুজতবা আলী কোনো লেখায় ব্যবহার করেছিলেন । এটি ঠিক করে দিলে ভালো হবে ।