হম দেখেঙ্গে

জয়া মিত্র

 




কবি ও প্রাবন্ধিক, সমাজ এবং পরিবেশ আন্দোলনকর্মী

 

 

 

 

লোভীর নিষ্ঠুর লোভ, বঞ্চিতের
নিত্য চিত্তক্ষোভ
জাতি অভিমান, মানবের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার
বহু অসম্মান, বিধাতার বক্ষ আজি বিদিরিয়া
ঝটিকার রুদ্ধ রোষে জলেস্থলে বেড়ায় ফিরিয়া

ঝড়ের খেয়া, বলাকা

সত্যি জল এসে যাচ্ছে চোখে!

এমন হতাশার অন্ধকারের মধ্যে শেষ হতে যাচ্ছিল বছরটা, এই ২০২০ সাল, যে, ইতিহাসের সবচেয়ে আশাবাদী ছাত্রছাত্রীরও মুখ থেকে, বুক থেকে, বারে বারে অস্ফুটেও উঠছিল স্বর— ‘আর নেওয়া যাচ্ছে না’। আমাদের জানাচেনা পৃথিবীকে যেন কী একটা দুঃস্বপ্নের প্যাকেটে ভরে গুঁজে রাখা হচ্ছিল অসুখের আতঙ্কের ভেতর। অথচ অসুস্থতা ছিল তার বাইরে। ‘ধরিত্রী’, ‘সৌন্দর্য’, ‘শান্ত সচ্ছলতা’, ‘ফসল’, ‘কৃষিসভ্যতা’— এসব শব্দ অতি দ্রুত মুচ্ছে যাচ্ছিল আমাদের চারপাশ থেকে। দেখা যাচ্ছিল সর্বগ্রাসী ভাইরাসের প্রকৃত আগ্রাসী চেহারা। আমাদের পায়ের তলার মাটি, আমাদের মাথার ওপরের আকাশ, ঘন বনাঞ্চল, ঢলোঢলো সব নদী, সবই যেন কেমন মিলিয়ে যাচ্ছিল, কেবল কানে আসছিল— অধিকারহীনতার সংবাদ। নিজেদের গ্রাম নেই, ভিটে নেই, প্রয়োজনীয় শিক্ষা নেই কোনও লোকের যা দিয়ে সে সুস্থ জীবন কাটাতে পারবে, জীবিকা জোগাড় করা প্রায় অসাধ্য এই বিচিত্রতম পেশা আর কারুকুশলতার দেশে, নিজেদের ভিটেজমিতে বাস করার, সন্তানসন্ততি নিয়ে মানমর্যাদায় বেঁচে থাকার অধিকার— কোনও কিছুরই কোনও সদর্থক উত্তর থাকছিল না। অসামান্য প্রাকৃতিক সম্পদে সজ্জিত একশো তিরিশ কোটি মানুষের এই বিরাট দেশ যেন দুর্নীতি আর দূষণের একটা সংকীর্ণ গর্তের মধ্যে পড়ে কিলবিল করছে— এ থেকে তার আর পরিত্রাণ নেই কোনও— এরকম একটা ছবি আমাদের সামনে, তরুণদেরও সামনে, দুলছিল কালির পর্দার মতো। শেষ পর্যন্ত কোথাও সহ্যের শেষ হল।

একটা চূড়ান্ত অন্যায়ের সামনে পৌঁছে সেই পর্দা ছিঁড়ে ফেললেন এই ভারতের প্রধান জনগোষ্ঠী— অন্নদাতা কৃষকরা। যতদূর সেই খবর পৌঁছল, অনেক মানুষ জেগে উঠছে এক নতুন বিশ্বাসে। শ্রমিকদের অধিকার, প্রকৃতির আত্মরক্ষার অধিকার, দেশের নির্বাচকমণ্ডলীর এক বিরাট অংশের প্রাকৃতিক সুরক্ষা ও জীবনধারনের অধিকার— একের পর এক দ্রুত অপহৃত হচ্ছিল যখন অসুখের ভয়ে, মানুষের ঘরের বাইরে আসা নিষেধ। প্রাণ গেলেও রাস্তায় নামা বারণ, একত্র হওয়া চলবে না। দেশের চলতে থাকা গাড়ি যেন কোনও আনাড়ি চালকের হাতে পড়ে দুরন্ত বেগে পাতালের দিকে ধেয়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত কোনওরকমে কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই পতনে একটা প্রতিবন্ধক দিলেন। অভাবনীয় রকমের জোর আপত্তি উঠল কৃষি আইন নিয়ে।

তিনঘন্টার লোকসভা অধিবেশনে একের পর এক উনিশটা আইনের খসড়া পাস হয়ে যায়। বড্ড তাড়াহুড়ো ছিল। করোনার সময়, এখন সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে বেশি। যে রোগের মৃত্যুহার নগণ্য, তার জন্য দেশের আপামর কর্তৃপক্ষ এত ব্যস্ত যে, যেসব রোগে সত্তরভাগ পরিবার ভুগছে বলে প্রমাণিত, সেই অর্ধাহার-অপুষ্টির চিকিৎসায় মনোযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। তারই মধ্যে আবার দেশের উন্নয়নও হতে হবে খুব তাড়াতাড়ি, যাতে পুঁজি বিনিয়োগকারীদের কোনওরকম অসুবিধে না হয়। সুতরাং হাততোলা ভোটে তিন-তিনটে কৃষি অর্ডিন্যান্স পাস হয়ে রাজ্যসভায় চলে যায়। কয়েক সপ্তাহ আগেই পাস হয়েছে শ্রমিকদের অধিকার (হরণ) আইন। তার আগে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভালমন্দ নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করার নিদান দেওয়া হল। সমগ্র বিশ্ব যখন আর্তভাবে প্রার্থনা করছে মাটির জন্য আরও কিছু সবুজ চাদর, যাকে রাচেল কারসন বলছেন ‘আর্থ্‌স গ্রিনম্যান্টল’, দেশের সরকার তখন একশো একানব্বইটি ঘনতম জঙ্গল এলাকায় গাছ কাটবার অনুমতি দিয়েছেন। উষ্ণায়ন নিয়ে ক্লাস ফাইভের ছাত্রছাত্রীরাও প্রশ্নোত্তর পড়ে ফেলছে, তখন এ দেশে কেন্দ্রীয় সরকার একানব্বইটি নতুন খনি বেসরকারি সংস্থাদের নিলাম ডাকার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। এতদিন পর্যন্ত পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে এমন প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে, দায়সারাভাবে হলেও, একটি ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ রিপোর্ট তৈরি করতে হত এবং স্থানীয় লোকেদের নিয়ে একটি ‘জনশুনানি’ করতে হত। প্রকৃতির সেই মৌখিক সুরক্ষাব্যবস্থাও তুলে দেওয়া হল নির্লজ্জভাবে। যুক্তি হিসাবে বলা হল— যাঁরা এখানে বড় পুঁজি বিনিয়োগ করবেন, বা হয়তো করতে পারেন, তাঁদের পথ যেন যথাসাধ্য নিষ্কণ্টক হয়। আইনের কোনও অসুবিধা যেন না হয় আমার দেশের সম্পদ যথেচ্ছ লুঠ করতে। যেন সেইসব বিনিয়োগকারীরা নিজেদের স্বার্থে ব্যবসা করতে আসছেন না, আমাদের ওপর করুণা করা ছাড়া তাঁদের আর কোনও উদ্দেশ্যই নেই।

এই সবকিছু চলছিল নির্বাধে। গণতান্ত্রিক দেশে যে বিরোধীপক্ষ নামে সংস্থান থাকে দেশের প্রকৃতি ও মানুষদের সুরক্ষার জন্য, গণতন্ত্রের কাঠামো কার্যকর রাখার জন্য— তার কোনও চিহ্নও দেখা যাচ্ছিল না।

শেষ পর্যন্ত বাধা পেল ‘উন্নয়ন’-এর আগ্রাসী রথের চাকা। এই কৃষিসভ্যতার দেশে কৃষির প্রবল সঙ্কট আশঙ্কায় চরম স্বাধীনতা-বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জাগল।

আর কী অপূর্ব সেই জেগে ওঠা। নারীপুরুষ, ধর্ম, জাতপাত— সব উড়ে গেল গভীর বিপদের সামনে একাত্মতায়। তরুণী থেকে বৃদ্ধ-ছাত্র থেকে প্রকাণ্ড জমিমালিক, এসে বসেছেন পথের পরে, পথ জুড়ে। ধুলোয় বসা, ধুলোয় খাওয়া। সেই অন্ন যা তাঁরা উৎপাদন করেন কঠিন পরিশ্রম আর অসামান্য বুদ্ধি ও কুশলতায়, ভাগ করে দিচ্ছেন উদ্যতলাঠি পুলিশদেরও পাতে। একের পর এক রাজনৈতিক পার্টির নোংরামি, নীতিহীনতা, লোভ দেখে-দেখে, ছোট থেকে বড় পর্যন্ত ক্ষমতাশালীদের সীমাহীন লালসা আর অকারণ নিষ্ঠুরতা দেখে-দেখে ছোটদের ভাববার ক্ষমতাও লোপ পাচ্ছে বলে ভয় হত।

মিথ্যে ভয়। ওই চাষিসমাবেশের পাশে জড়ো হচ্ছেন দেশের যুবসমাজ। দেশের যাঁরা ভবিষ্যৎ। উচ্চাশার অলীক লোভ দেখিয়ে যে যুবসমাজকে সমাজ থেকে বিযুক্ত, সঙ্কীর্ণ আত্মকেন্দ্রিকতায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল গত কয়েক দশক ধরে। সেই যুবশক্তিরই এক বড় অংশ সারা দেশ থেকে সাড়া দিচ্ছেন। আগুনের মতো দ্রুত বাড়ল তাঁদের সংখ্যা। অভিনব তাঁদের যোগদানের ধরন। আগেকার মতো সবাই মিলে আন্দোলনের জায়গায় গিয়ে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলেন না তাঁরা, বরং আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিলেন দূর দূরান্তের ঘরে ঘরে। ব্যক্তিগত যোগদান বাড়িয়ে তুললেন।

এত দ্রুত সংগঠিত হল সাতই ডিসেম্বরের দেশব্যাপী ব্যক্তিগত অনশন পালনের কর্মসূচি! পরিবর্তন ঘটল চেতনায়। কেউ পাহারা দেবে না, কেউ হিসেব কি প্রমাণ চাইবে না যে, তুমি অনশন করলে কি না। ফলে অনশন হয়ে উঠল যেন উৎসব। নদীর স্রোতের মতো সাড়া আসতে থাকল— এক দুই দশ… দল বেঁধে, হাতে লেখা পোস্টারের অপূর্ব সৌন্দর্য নিয়ে ছবি পাঠাল যারা ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। হয়ে উঠল পরস্পরের ব্যক্তিগত বন্ধু। সাথী। কত পুরনো সব আন্দোলনের, আত্মদানের, প্রতিবাদের গান নতুন করে ডানা মেলে দিল আজকের নবীনদের গলায়, আর বইতে শুরু করল ইতিহাসের নদী। যে নৈতিকতা অবলুপ্ত হয়েছে রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে, তাকেই ফিরিয়ে আনল এই তরুণতরুণীরা। বড়রা কতজন সাগ্রহে এসে যোগ দিলেন। অনশন শেষ হয়েছে, যদিও এখনও আসছে দেরি করে পাঠানো ছবি আর খবর। আন্দোলন কিন্তু এই শুরু হল। কোনও নাম ঘোষণা করা নেতৃত্ব নেই, বড় কিংবা সামান্যের উঁচুনিচু চেয়ার নেই।

তিন বছর আগে মার্কিন সরকারের নাকের নীচে বসে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছিল যে দুর্নীতিবিরোধী ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন, পৃথিবীর কোণে-কোণে নিত্য উঠছে সেরকম তরঙ্গের দোলা— কখনও ইংল্যান্ডে, কখনও সুইডেনে কখনও আরও কোনওখানে। আমাদের চোখের সামনে কি জন্ম নিচ্ছে তারই এক নতুন অধ্যায়? লোভ, ভয় আর দুর্নীতিতে দম বন্ধ হয়ে আসা এই দেশের খাটিয়ে সাধারণ মানুষজন প্রতীক্ষায় ব্যাকুল, যোগ দেবেন বলে।

এতবার এতরকম অবস্থার মধ্যে অনশন প্রতিবাদে অংশ নিয়েছি, কিন্তু আজ দুহাজার কুড়ি সালের এই সাত ডিসেম্বরের মতো অপূর্ব আনন্দের বোধ হয়নি কখনও। ঠিক আনন্দ বললেও বোঝাতে পারছি না, ‘জোশ’ বললেই ঠিক হবে বোধহয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...