আমার মুখে এ সব কথা মানায় না

শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 




কবি ও প্রাবন্ধিক, স্পেনীয় ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক

 

 

 

 

আমার ছাত্র লাভজিৎ সিং খালসা ছবি তোলে, উত্তর প্রদেশের ছোট শহর মোরাদাবাদ থেকে সে এসেছিল দিল্লিতে, ভাগ্যসন্ধানেই বলা উচিত। কারণ, সে বড় শহরের মধ্যে দিয়ে দেখতে চেয়েছিল দুনিয়া। যেমনটা বা অনেকেই চায়। এখানেই সে আবিষ্কার করে নিজের আলোকচিত্রীর পরিচয়। ফেসবুকে গত কয়েকদিন ধরেই দেখছি তার তোলা নানারকমের ছবি, মূলত দিল্লি-হরিয়ানার সিঙ্গু বর্ডারের। রাজ্যের সীমানাকে যে এভাবে বর্ডার বলা যায়, ভাবলেই কেমন লাগে! এখন কিন্তু সে অঞ্চলের চেহারা কোনও আন্তর্জাতিক সীমান্তের চেয়ে কিছু কম নিয়ন্ত্রক নয়। আমি লাভজিতের চোখ দিয়ে দেখি কৃষক-বিদ্রোহের চেহারা। দেখি তাঁদের রান্নাঘর। তাঁদের রোজকার প্রার্থনা ও বেঁচে থাকার দলিল। লাভজিতের ক্যামেরা হয়ে উঠেছে আমার দেখা সবচেয়ে বড় দলিল এই সময়ের। সে নিজেও রান্না করছে। এসেছে তার দাদা, বৌদি, বোন। সবাই একযোগে নেমেছে কাজে। দেখি তার পরিবার কীভাবে প্রার্থনা ও খাবারের আয়োজন করছে। আমি জানি, সে কোনও অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে নয়। কিন্তু তার এই মিশে যাওয়া দেখি— এক গণহত্যার প্রস্তুতি নেওয়া উগ্র বাজারবাদী সরকার নামক রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে কীভাবে সাধারণ মানুষ জোট বাঁধছেন। আমি তারই ক্যামেরায় দেখছি নানা ধর্মের মানুষের সমাবেশ যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। দেখছি মেয়েদের অবস্থান ও এগিয়ে আসা।

দেখছি, আর বারবার অস্থির হয়ে উঠছি। কেন রাস্তায় নামছি না তার কোনও স্পষ্ট উত্তর আমার কাছে নেই, কিন্তু এভাবে ঘরে বসে থাকা আরও অসহ্য। আমার বাড়ি থেকে সামান্য কয়েক কিলোমিটার দূরে কৃষক-বিক্ষোভের এক ছোট কেন্দ্র। নয়ডা-দিল্লি চিল্লা বর্ডার। যাকে লকডাউনের আগে অবধি কখনওই মনে হয়নি সে কোনও সীমান্ত, যেখানে নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে। গত ২৫ মার্চ থেকে বুঝেছি তার দাপট, কাঁটাতার না-থাকলেও রাজ্য বর্ডার পেরোতেও ‘পাসপোর্ট’ লাগে। আর এখন আরও একদফা স্পষ্ট হচ্ছে। দিল্লি নামক ছদ্ম-রাজ্যকে তথা দেশের রাজধানীতে দেশেরই একদল নাগরিককে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে কাজ করছে নাগরিকের প্রকারভেদ। এই সেই মুহূর্ত যখন আমাদের প্রত্যেকের মনে হওয়া উচিত সেই সীমান্তে গিয়ে দাঁড়ানোর কথা, অথচ আমরা পাশ কাটিয়ে কী অনায়াসে অন্য অঞ্চল দিয়ে ঘুরপথে দিল্লি চলে যাচ্ছি। এই তো সেদিন বন্ধুপত্নী বলছিল, মুসলমান অ্যাপ-ট্যাক্সি চালক কি গ্রাহকের নামে হিন্দু-পরিচয় দেখলে ভয় পায় এখন? মনে হয়, পায়। সে আরও বলছিল, আমাদের দেখলে নিশ্চয় ওরা সিএএ-র সমর্থক ভাবে। ভাবে শাহিনবাগকে ‘আমরা’ উগ্রবাদীদের আস্তানা ভাবি।

আমিও দেখছিলাম, আমাদের আবাসনের সামনে কীভাবে বেড়ে উঠেছে বিজেপির পতাকা-ঝোলানো ফ্ল্যাট। গাড়ির সামনে প্লাস্টিকের পতাকা। অ্যাংরি হনুমান তো ২০১৫ থেকেই বেড়েছিল, এখন সে আরও সাংঘাতিক। বিরাট হনুমান মূর্তি লাগানো অনেক মন্দিরেই দেখছি, হনুমানের গালে ধূসর দাড়ি। আমাদের মহামহিম সুপ্রিমোর অনুকরণে। হিন্দুত্ব ও হিন্দু ধর্মের কী প্রভেদ, তাই নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, এবং এই পত্রিকার পাঠককে মনে করিয়ে দিতে হবে না যে, কী করে বিজেপি তার ক্ষমতা বিস্তার করেছে। কেন আমরা এই ফাঁদে পা দিলাম, তার ইতিহাস কিন্তু আমরা বাঙালি হিসেবে এড়িয়েই এসেছি চিরকাল। আমরা ভেবেছি আমরা লিবারাল, কিন্তু আদতে গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী। উর্দুভাষার এক প্রধানতম ঔপন্যাসিক অশীতিপর যোগিন্দর পাল সেই ২০১০ সালে তাঁর দিল্লির বাড়িতে বসে আমাকে আর রবিশংকর বলকে বলেছিলেন, বিভেদবীজ অনেক আগেই পোঁতা হয়েছে, দেশভাগ এক বহিঃপ্রকাশ মাত্র, আর এর ফল আরও অনেক শতক চলতে পারে। কিন্তু এক দশকের মধ্যেই যা দেখা যাচ্ছে তাতে আর মনে হয় না কিছু থাকবে। রাজ্যের ক্ষমতা যেভাবে খর্ব করা হচ্ছে তাতে গৃহযুদ্ধ বাধলেও অবিশ্বাস্য হবে না, বলছিলেন এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার। অবশ্য তিনি বিদেশি। এদেশের কিছু পুরনো সেনার লোক অবশ্য বলছেন আনন্দের কথা। পারিবারিক আবহে বোঝা যাচ্ছে মুসলমান-বিদ্বেষের বহর। প্রতিটা টিভি চ্যানেলে, ইন্টারনেটে একের পর এক বেরিয়ে আসছে সেনা ও গুপ্তচরবৃত্তিকে আলোকিত করা সিনেমা বা সিরিয়াল। এতদিন চলছিল সন্ত্রাসবাদ, এখন নতুন এক ফিল্মে    দেখলাম মাওবাদীদের বিরুদ্ধেও সিনেমা আসছে। হয়তো যুক্তি পাওয়া যাবে, সে তো চিদম্বরমও সেনা নামাতে চেয়েছিলেন নিজের দেশের লোকের বিরুদ্ধে। প্রশ্নটা সেখানে নয়। প্রশ্নটা হল, যেভাবে হিন্দু তালিবানরা সমস্ত রকমের মাধ্যমকে ব্যবহার করে, একশো বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করে আজ ক্ষমতায় এসেছে। শিক্ষণীয়, কীভাবে তারা সমস্ত কিছুর খোলনলচে বদলে দিল। কীভাবে একের পর এক নতুন শত্রু তৈরি করে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিল। (এমনকী সামাজিক মাধ্যমকেও তারা কিনে ফেলল। আমি হলফ করে বলতে পারি, বিজেপি-বিরোধী সমস্ত পোস্টের আউটরিচ কমছে। দেখবেন, এই পত্রিকার এই সংখ্যাটির প্রচার কতটা কমে যায়!) মন্দির এমনিতে হবে না, তাই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ‘নিজের’ হল। মুসলমানের পর খালিস্তান। যদিও আরও আগে হয়েছিল বাঙালি। কিন্তু ব্যাপারটা আসামে (আমি জেনোফোবিক রাজ্যের নাম সঠিক উচ্চারণে লিখব না) ঘটায় আমাদের কিছু হল না। আমরা এনআরসি-র বিরোধিতা করলাম না। শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার দায়ে আমাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে, এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে! আর এই অবস্থায় পশ্চিম বাংলায় বিজেপিকে অর্ধেক রাজত্ব পাইয়ে দেওয়া হল লোকসভায়, বিধানসভাতেও তারা তেড়েফুঁড়ে এল বলে! এই দিল্লিতে বাংলায় কথা বললে এখনই বাংলাদেশি ভাবে কিছু লোক। গরিব হলে তো কথাই নেই! এত নেতির মধ্যে একমাত্র ইতির জায়গা— সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন কৃষকদের বিনা পয়সায় আইনি সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। বলেছে, নতুন কৃষি আইন অসাংবিধানিক।

এ এক তীব্র অসহায়তা। রবিশংকর বলের ভাষায়, একটা সাপ নিজেকে নিজের লেজের দিক থেকে খেয়ে চলেছে। আমাদের বহুত্বের দেশে ভাবের ঘরে বহুকালই ভেদের চাষ হয়েছে। বিশেষ করে বাঙালি সবসময় মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলের বাইনারি পছন্দ করে। আর তাকেই কাজে লাগায় খবরের কাগজ। কলকাতা বনাম জেলা। অমুক বনাম তমুক। এখন তারা চাষ করছে অন্য প্রতিপক্ষের। আমাদের মনে রাখা উচিত, বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় সংবাদপত্র গোষ্ঠীর হিন্দি নিউজ চ্যানেল কিন্তু গোদি মিডিয়ার অংশ। অতএব তাদের উপর ভরসা করলে নিশ্চিতভাবে হিন্দু তালিবান ক্ষমতায় আসবে এবং আমাদের দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়ে উঠবে, এমনকী নিজের রাজ্যেও।

এ এক অসহ্য অসহায়তা। যেখানে বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের বর্ডারে শাহিনবাগে গিয়ে আমরা সবাই বসিনি। কারণ, বসার কথা মনেই হয়নি। বৃদ্ধা রোমিলা থাপার গেছেন, উনি যাবেনই, কারণ উনি কমিউনিস্ট। বন্ধু অধ্যাপক অপূর্বানন্দ ঝা-কে পুলিশ মিথ্যে মামলায় জেলে পুরেছে, আমি তারপর থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলিনি, কারণ যদি জুজু ধরে। আমি কাশ্মির নিয়ে কোনও প্রশ্ন করিনি, কারণ সে তো হওয়ারই ছিল। বরং নোয়ম চমস্কি যখন বলেছেন ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, আমি ভেবে গিয়েছি ভারত সেই মহান দেশ যে কখনও কোনও দেশ দখল করেনি। হ্যাঁ, আমিই সেই লোক, যে মনে প্রাণে বাংলা ভাষাকে তৎসম শব্দের বন্যায় ভরিয়ে দিয়েছি। শুদ্ধ ভাষার নামে তাকে বামুন করে তুলেছি। সংস্কৃত আমার মা বলে কালীমন্ত্রেও সংস্কৃত দিয়েছি। আমার কি শোভা পায় কৃষক-বিদ্রোহ বা শাহিনবাগ নিয়ে কথা বলা? না। আমার একমাত্র কাজ নীরব ও নম্র হয়ে এইসব বিরোধের পাশে দাঁড়ানো— কথা না-বাড়িয়ে তাঁদের কথা শোনা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...