মমতা পারেদ— এক ওয়ারলি আদিবাসী নারীর ইচ্ছেশক্তির গল্প

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

মমতা পারেদের গল্প। অনেকগুলো লেয়ারের গল্প। গাঁথুনি বুনে বুনে যেভাবে পাকা একটা বাড়ি হয়, তেমনই এক গল্প। যার কেন্দ্রে মমতা, এক ওয়ারলি আদিবাসী মেয়ে। প্রেক্ষিত মহারাষ্ট্রের পালঘাড় জেলার নিম্বাভালি গ্রাম। এই ওয়ারলিদের হয়ে একসময় স্বপ্ন দেখেছিলেন গোদাবরী পারুলেকর। গোদাবরীর ব্যাটন যোগ্য হাতে।

কিন্তু কোথায় উত্তরণ? যন্ত্রণা থেকে স্বপ্নের উড়ান। শুরুটা হোক শুরু থেকেই। মমতার প্রপিতামহ অত্যাচারিত ওয়ারলি আদিবাসীদের লেগ্যাসির প্রতিনিধি। সুযোগ বুঝে কোপ মারে ধূর্ত মহাজন। পরিণতিতে বন্ডেড লেবারার। সকাল থেকে রাত অবধি বেগার খাটনি। বিশ্রামের সুযোগ নেই। সামান্য একটু ঘুম। রোববার, ছুটি এসব আকাশকুসুম হয়ত বা। বিনিময়ে বছরে ৩০ কেজি চাল এবং দুএকটা ধুতি, চাদর। ব্যস। পরে বন্ডেড লেবারের লেগ্যাসি মুছে গেলেও দারিদ্র এবং শোষণের ইতিহাস খুব একটা বদলায়নি। মমতার বাবা স্কুল ড্রপআউট। ক্লাস ফোর। মা কিছুই পড়েননি। ইটভাটায় তাঁদের দেখা। বিয়ে। পরিযায়ী হয়ে বছরে ছ মাসই একাধিক ইটভাটায় গিয়ে কাজকর্মের অভিজ্ঞতা। এভাবে কদ্দিন আর? ১৯৮৭। পড়শি অরণ্যে চাষ করা শুরু মমতার পরিবারের। ধান, কিছু সবজি, তৈলবীজ। কিন্তু সমস্যার শেষ নেই। জমি পাহাড়ের ধারে। প্রকৃতির রোষের কোপ। ছোট ছোট বাঁধের মতো তৈরি করে জল ধরে রাখার প্রচেষ্টা মমতাদের। অথচ ধান চাষে তো জল লাগে অনেকটাই। এভাবেই চাষ। পশু দিয়ে ট্রাক্টরের অভাব মেটানো। যন্ত্র কেনার খরচা অনেক। আর যদিও বা ধার দেনা করে কেনা যায়, তাহলেও পাহাড়ি জমিতে চালানো দূর হস্ত। জলের সমস্যার জন্য জঙ্গলের একধারে কুয়ো খোঁড়ার অনুমতি চাইলে বন দপ্তরের থেকে অনুমতি মেলে না। আদিবাসী যে। দলিত। লড়াই ছাড়া যাঁদের আর কিচ্ছু নেই জীবনে। নিজস্ব জমির মালিকানা থাকলেও ল্যান্ড অনারশিপ ডকুমেন্ট সবই বন দপ্তরের নামে। মমতার পরিবারের লড়াইয়ে সামগ্রিকভাবে এখনও তথাকথিত ভালো খবর জোটেনি।

কিন্তু এটা তো পারিবারিক ইতিহাস। মমতার নিজের? সেখানেই উত্তরণ। তাঁর চার ভাইবোনের সে বড় মেয়ে। ছোট ভাইবনেদের দেখার দায়িত্বে কোথায় পাবে পড়াশোনার সময়? খরচ? অগত্যা ত্যাগ। ছ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হলেও অনেকটা রাস্তা হেঁটে যাওয়া আসা, ইটভাটার নোংরা জলে স্নান তাঁর ত্বকে বেশ কিছু দাগ তৈরি করে দেয়। বন্ধু, শিক্ষক কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। ভাগ্যিস দাঁড়ায়নি। মমতাদের জেদ তাতেই যে বহুগুণ বেড়ে গেছিল। মমতা জানতেন শিক্ষা, একমাত্র শিক্ষাই সমস্ত আলো আনতে পারে।

অতএব অসম্ভব সাধনা। পড়াশুনো। ক্লাস এইটে স্কলারশিপ পরীক্ষা পাশ। ক্লাস টেনের পর সরকারি হোস্টেলে থেকে পড়াশুনো চালানো শুরু করেন তিনি। পারিবারিক চাপ। খরচা। তবুও অটল এই নারী। ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি-স্লেভারি অ্যাওয়ার্ডজয়ী শ্রমজীবী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বিবেক পণ্ডিতের চোখ পড়ল মমতার উপর। পরিণতিতে উচ্চশিক্ষায় সাফল্য। মারাঠি ভাষায় শিক্ষা শুরু করে মুম্বইয়ের রামানুজন ঝুনঝুনওয়ালা কলেজ থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনো। একসময় মাস মিডিয়ায় স্নাতক হলেন। শেষমেশ পড়গুম্মি সাইনাথের পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়াতে কাজ শুরু করলেন রিসোর্স হিসেবে। সাংবাদিক হিসেবে পালঘাড় এবং থানে জেলার ওয়ারলি ও কাতাকারি কমিউনিটির প্রতিনিধিদের লড়ে ওঠার, জেতার গল্পগুলো তুলে ধরলেন সাইনাথের স্বপ্নের প্ল্যাটফর্মে। সে কাজ এখনও চলছে।

মমতা ছোটবেলায় ডাক্তার হতে চাইতেন। এখন সাংবাদিক হতে চান। পুনের আবাসাহেব গারওয়াড় কলেজে স্নাতকোত্তরের পড়াশুনো করছেন মমতা।

ক্রনোলজির হিসেবে এই হল গল্প। বন্ডেড লেবার থেকে সাংবাদিকতার পাঠে দেশের অগ্রগণ্য এক নির্ভীক সাংবাদিকের স্বপ্নের জমিতে কলমের চাষ। স্বপ্নের চাষ। ব্যাটন। মমতা আকাশে উড়ুন। ওয়ারলিরা আলো পাক। এভাবেই…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...