কোভিড ভ্যাকসিনের জন্যে আরও সরকারি আশ্বাস প্রয়োজন

সত্যব্রত ঘোষ

 


প্রবন্ধকার, চলচ্চিত্রবেত্তা

 

 

 

১৪ই জানুয়ারি ২০২১ অবধি ভারতে দেড় কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে প্রায় ১৫ লক্ষ ২ হাজারের প্রাণ মূলত এই সার্স-কোভ-২ (অর্থাৎ করোনা ভাইরাস)-এর কারণে গেছে। এই ভাইরাসটি সারা বিশ্বে ৯ কোটি ২০ লক্ষের বেশি মানুষকে আক্রমণ করেছে। মোট প্রাণহানির সংখ্যা ১ কোটি ৯০ লক্ষ।

অতিমারির এই প্রাদুর্ভাবের পর সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসকে রুখতে গণ টিকাকরণ শুরু হয়েছে। এদের মধ্যে চিন ও রাশিয়া তিন মাস আগেই নিজেদের টিকা তৈরি করলেও সেগুলি বাস্তবে রোগপ্রতিরোধে কতটা কার্যকর, তা জনসমক্ষে আনেনি।

এই মুহূর্তে অধিকাংশ দেশ ফাইজার-বায়োএনটেক-এর বানানো ভ্যাক্সিনগুলিকে গণ টিকাকরণের জন্য বেছে নিয়েছে। কিন্তু নিজেদের দেশের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সেই দেশগুলির সরকার সাবধানে পা ফেলছেন। কারণ, অন্য ভ্যাকসিন ডেভেলপাররা ইতিমধ্যে তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলির ফলাফল ঘোষণা করে দিয়েছে। নিয়ামক সংস্থাদের থেকে টিকা হিসেবে ব্যবহার করবার সবুজ সঙ্কেতও পাওয়া গেছে।

ভারত বেছে নিয়েছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা-র কোভিশিল্ড, যা পুনের সিরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি হায়দ্রাবাদের ভারত বায়োটেক-এর কোভ্যাকসিন-ও আছে। ১৬ই জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সারা দেশে টিকাকরণের কাজ শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের সচিব রাজেশ ভূষণ গত ডিসেম্বর মাসে জানিয়েছিলেন ২০১৯-এর নির্বাচন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রায় ৬১ কোটি ১০ লক্ষ ভোটদাতা সহ ২৬ কোটি ৭০ লক্ষ শিশু এবং ২ কোটি ৯০ লক্ষ গর্ভবতী মহিলাদের ৩৯০ কোটি টিকা নিয়মিতভাবে দেওয়া হবে।

প্রথমদিন পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশের ৩০০৬টি কেন্দ্রে এক লপ্তে প্রায় ৩ লক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দেওয়া হল। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে পেশিতে টিকার প্রথম ডোজটির ২৯ দিন পরে দ্বিতীয়বার তাঁদের সূচ ফোটানো হবে। বলা হচ্ছে, ওই দ্বিতীয় ডোজটি দেওয়ার ১৪ দিন পরে কাজ করবে ভ্যাকসিন। আপাতত, ৩০ কোটি নাগরিককে সরকারি খরচে টিকা দেওয়া হবে। যার মধ্যে তিন কোটি ‘কোভিড যোদ্ধা’ রয়েছেন ‘এমার্জেন্সি ইউজ’-এর তালিকায়। সারা ভারতে টিকাগুলি বিতরণ এবং সংরক্ষণের জন্যে সরকারকে ৮৫ হাজার ৬৩৪টি কোল্ড স্টোরেজ ইক্যুইপমেন্ট এবং ২৮,৯৪৭টি কোল্ড ডেন পয়েন্টের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

এত ব্যাপক হারে ভারতবর্ষের প্রাপ্তবয়স্কদের এর আগে কোনও টিকাকরণ প্রকল্পে সামিল করা হয়নি। প্রথম রাউন্ডে স্বাস্থ্যপরিষেবায় যুক্ত মানুষদের টিকা দেওয়ার পর প্রায় ২৭ কোটি মানুষদের টিকা দেওয়া শুরু হবে যারা পঞ্চাশোর্ধ্ব এবং/অথবা অন্যান্য রোগ (কোমর্বিডিটি)-এর শিকার। টিকাকরণের সমগ্র এই বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি দপ্তর থেকে যেভাবে ঢাক বাজানো হচ্ছে, তাতে মানুষের আশঙ্কা কিন্তু দূর হচ্ছে না। গত বছর মার্চ মাসে লকডাউন ঘোষণার ঠিক আগে এবং পরবর্তীকালেও যেভাবে মোদি সরকার প্রচারযন্ত্র ব্যবহার করে মানুষদের প্রথমে বিভ্রান্ত এবং পড়ে ত্রস্ত করেছিল, এই বছরেও তার বিশেষ ব্যতিক্রম নেই।

পৌষসংক্রান্তির দিন কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে যে বার্তা এসে পৌঁছাল, তাতে ভয় বাড়ল বই কমল না। এই বার্তায় সাফ জানিয়ে দেওয়া হল যে টিকা নেওয়ার পরে যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে তার দায় মোদি সরকার নেবে না। ভ্যাকসিনের কারণে শারীরিক সমস্যা হলে চিকিৎসার দায়িত্ব ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থার ওপরেই বর্তাবে। সরকার শুধু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ওপর নজরদারি চালাবে। প্রথম দফার এই টিকাকরণকে কিন্তু সার্বিক ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। ‘রেস্ট্রিকটেড ইমার্জেন্সি ইউজ’ হিসেবে এই কার্যক্রম চলবে। কিন্তু ‘কোভ্যাকসিন’-এর চূড়ান্ত ট্রায়ালে ভারতীয়দের এভাবে পরীক্ষাগারের জীবজন্তুর মতো ব্যবহার করাটা মোটেই কাঙ্খিত নয়।

মাথায় রাখতে হবে, ভারত বায়োটেক-এর কোভ্যাকসিন-টির চূড়ান্ত পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে, টেকনিক্যালি যা আসলে চতুর্থ দফার ট্রায়াল বললে ভুল হবে না। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে এই টিকা দেওয়ার পর কারও যদি অস্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়, তাহলে তার ক্ষতিপূরণ তথা আইনি বিষয়টি সরকার দেখুক বলে সংশ্লিষ্ট দুই ভ্যাকসিন উৎপাদক আবেদন জানান। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে তা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।

আদৌ যদি টিকা থেকে ব্যাপক শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে তা বিচার-বিশ্লেষণের ভার এথিক্স কমিটি, ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া (ডিসিজিআই) এবং ডাটা অ্যান্ড সেফটি মনিটরিং বোর্ড (ডিএসএমবি)-এর ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। তারাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি দেখবেন। ইতিমধ্যেই ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা এবং বিতরণবিধি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন উঠছে। যেগুলির সন্তোষজনক উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ বায়োএথিক্স-এর ভূতপূর্ব সভাপতি অনন্ত ভান সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে আরও স্বচ্ছতা দাবি করছেন। তাঁর বক্তব্য, “তথ্য প্রকাশ্যে আনবার ব্যাপারে ভারতের কর্তৃপক্ষরা তুলনামূলকভাবে বেশি গোঁড়া। যা তথ্য আমাদের কাছে আসছে তা আসছে উৎপাদকদের সৌজন্যেই। এক্ষেত্রে স্বার্থের বিরোধ প্রকট। এর পরিবর্তে নিয়ন্ত্রকদের তরফ থেকে যদি তথ্য প্রকাশ হত, তাহলে মানুষের আস্থা বাড়ত।”

না, ভারতে প্রস্তুত ভ্যাকসিন দুটি যে ক্ষতিকর— এমন কোনও প্রমাণ নেই। কোভিশিল্ড ইতিমধ্যেই ‘ইমিউনোজেনেসিটি’ এবং ‘নিরাপত্তার দিকটি নিশ্চিন্ত করেছে। কার্যকারিতা বিষয়েও কোনও বিরূপ রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। কিন্তু যে প্রশ্ন এবং আশঙ্কাগুলি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে, সেগুলি এই ব্যাপক টিকাকরণের সাফল্যের পক্ষে মোটেই শুভ নয়। তাই, কৃতিত্ব প্রচারের পাশাপাশি মোদি সরকার যদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রমাণ তুলে ধরে নাগরিকদের আশ্বস্ত করত, তাহলে তাতে জনচেতনা বাড়ত। কোভিড যুদ্ধের শেষ ধাপটিতে পৌঁছে যদি আসন্ন নির্বাচনে মিথ্যাচার ও গায়ের জোরে বিরোধীদের নীরব করা এবং জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করাই মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে তা অত্যন্ত দুঃখজনক হবে।

ভারতের জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার দৈন্য বিষয়ে নতুন কিছু বলবার নেই, এর পাশাপাশি খাদ্য এবং পুষ্টি বিষয়েও সরকারের গা-ছাড়া মনোভাব বাড়ছে বই কমছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত ক্ষুধা এবং পুষ্টির সূচকে বিশ্বের তথাকথিত ‘উন্নয়নশীল’ অনেকগুলি দেশের নিচে ভারতের স্থান। ভ্যাকসিন প্রকল্পে সরকার যতটা মনযোগী, তার কিছুটা যদি দেশের মানুষের রোগপ্রতিরোধ শক্তিবৃদ্ধিতে ব্যয় হত বাস্তবিকই জনকল্যাণের দাবিটি অন্তত মিথ্যা হত না।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...