মেক বিলিভের দেশ

চার্বাক মিত্র

 

রাজনৈতিক ভাষ্যকার

 

ঠিক ওয়েব সিরিজের চিত্রনাট্যের মতো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। একজন স্বঘোষিত প্যাট্রিয়ট নিউজ অ্যাঙ্কর, যিনি ‘মুঝে ড্রাগ দো’ হুঙ্কার ছুড়ে দেশের লোককে ড্রাগের নেশায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন— ভুয়ো দেশপ্রেমের ড্রাগ, বিরোধীদের দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে গণ-হিংসা উসকে দেওয়ার ড্রাগ, কখনও বা বলিউডের গুষ্টির ড্রাগ নেওয়া নিয়ে সিআইডি মার্কা সস্তা গোয়েন্দাগল্পের ড্রাগ— সেই তিনি নিজের কেরদানি দেখাতে গিয়ে একটু গোলমাল করে ফেললেন। অনেকটা যেমন করেছিলেন পরেশ দত্ত। ‘পরশ পাথর’ ছবিতে। মদ খেয়ে নিজের আসল তুরুপের তাস ফটাস করে বের করে দিয়েছিলেন একপার্টি মাতালের সামনে। তারপর তার ভিটেমাটি চাটি হয়েছিল। অর্ণবের হবে কি? কে জানে!

‘মগ্নমৈনাক’ মনে থাকবে নিশ্চয়ই। ব্যোমকেশ এমন একটা খুনের সমাধান করতে গিয়েছিল, যা ওপর ওপর যৌন কেচ্ছা। সেই যৌন কেচ্ছার কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে এক জাতীয় কেচ্ছার কেউটে বেরিয়ে এসেছিল। সন্তোষ সমাদ্দার প্রেমের বশে জাতীয় তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের চরের কাছে। তা এমন উদাহরণ এদেশে বিস্তর পাওয়া যায়। সামান্য ন্যুডের লোভে দেশের তথ্য পাচার করে একজন স্বীকারও করেছে সম্প্রতি। কিন্তু সেসব আদতেই নিরীহ ক্রাইম। দেশে জঙ্গি হানার পরে প্রায় ভায়াগ্রার উত্তেজনায় একজন শীর্ষস্থানীয়, রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক যখন বলছে, ‘দিস অ্যাটাক উই ওন লাইক ক্রেজি’, তখন টাপিওকা বা কর্নেল স্পঞ্জের কথা মনে পড়তে পারে। টিনটিনের গল্পের মতো।

যাই হোক, এই ফাঁস হওয়া চ্যাটের প্রসঙ্গে পরে আসব। আগে একটা অন্য কথা বলি। ক্রোনি ক্যাপিটাল বলে একটা কথা তো খুব চলে। এই সরকারকে কেন্দ্র করে ক্রোনি ক্যাপিটালের অভিযোগ উঠেছে আরও বেশি। স্বাভাবিক সেটাই। ক্রোনি মিডিয়া শব্দবন্ধটিও আমাদের চালু করা উচিত। এই সরকারের আমলে এই শব্দবন্ধটা খুব জরুরি। কারণ, কর্পোরেটদের পুঁজি এই সরকারের ক্ষমতায় আসার পথ যেমন মসৃণ করেছিল, তেমন মিডিয়ার এক বড় অংশের সমর্থন ছিল সরকারের সঙ্গে। কীভাবে? একটু ভেবে দেখুন। ইউপিএ-২ সরকারের পতনের আগের সময়টা ভাবুন। পরের পর আর্থিক কেলেঙ্কারির খবর আসতে থাকল। আর মিডিয়া কোমর বেঁধে নামল। ‘ইন্ডিয়া এগেনস্ট কোরাপশন’ নামক এক অলীক কুনাট্য শুরু হল দেশজুড়ে। আন্না হাজারে নামলেন ময়দানে, ময়দানে নামলেন কেজরিওয়ালের মতো কর্পোরেট বিপ্লবী। আইটি সেক্টরের যে বিশাল অংশ তার আগে অবধি বুঝতেই পারত না রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, তাদের এই বলিউডি চিত্রনাট্য খুব পছন্দ হল। বাংলা, হিন্দি, দক্ষিণী মূলধারার ছবিতে চিরকালই তো আপনি ভিলেন কোরাপশন। বোঝা গেল, গলি গলি মে শোর হ্যায়-এর সঙ্গে চোর হ্যায়-এর অন্তমিল এদেশের লোককে যত সহজে খেপিয়ে তুলতে পারে, তার সঙ্গে আর কোনও রাজনৈতিক ইস্যু তুলনীয় নয়। তার মাঝেই রয়েছে নির্ভয়ার মতো ভয়াবহ ঘটনা। আস্তে আস্তে দেশের লোকের স্বাধীনতার পর সাত দশক ধরে চলতে থাকা রাজনৈতিক ন্যারেটিভের ওপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে যেতে থাকল। নতুন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ কারা গড়ে তুলবে? কেজরিওয়াল? শিক্ষিত আইটি কর্মীরা? ‘স্বদেশ’-এর শাহরুখ খানের মতো কোনও নায়ক?

এইখানেই মিডিয়া এক আশ্চর্য ভূমিকা নিতে শুরু করল। গুজরাট গণহত্যার নায়ক নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি যে আদতে আদালতের ক্লিনচিট পেয়ে গিয়েছেন, তিনি যে আদতে নির্দোষ, একথা খুব যত্ন করে দেশের লোককে বোঝানো হল। ২০১৩-র সেপ্টেম্বরে তিনি বিজেপির কাণ্ডারি যেইমাত্র হলেন, পরিষ্কার হয়ে গেল, তিনি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হতে চলেছেন। যে রাজনৈতিক আন্দোলন তখন ইউপিএ-২-এর বিরুদ্ধে দানা বেঁধেছিল, তা সূক্ষ্মভাবে চ্যানেলাইজ করা গেল। মোদি সহজেই রক্ষাকর্তা হয়ে উঠলেন দেশের। তখন কিন্তু দেশের রাজনীতিতে কোথাও হিন্দুত্বের ন্যারেটিভ নেই, ভারত-পাকিস্তান চুকিতকিত খেলা নেই। আছে বিকাশ, অর্থনৈতিক সংস্কার (সম্প্রতি হিন্দুস্তান টাইমস-এ একটি উত্তর সম্পাদকীয়তে রাজদীপ সরদেশাই খুব সঠিকভাবেই বলেছেন, এই সংস্কারের জন্য সবচেয়ে বেশি লালায়িত হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি), আছে দুর্নীতিমুক্ত সরকার হ্যানোত্যানো।

২০১৩ সালেরই ছবি বোধহয় ‘ডি ডে’। সেই ছবির শেষে দাউদ ইব্রাহিমের ভূমিকায় অবতীর্ণ ঋষি কাপুর বলছেন, ‘আমাকে গ্রেফতার করে কোনও লাভ নেই, খানিক মিডিয়া সার্কাস হবে, অর্ণব গোস্বামী খানিক চিৎকার চেঁচামেচি করবে…।’ এই যে আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে সরকারি নির্লিপ্তি এবং তার বিরুদ্ধে অর্ণব গোস্বামীর ক্রুসেড, সেটা বহুদিন ধরেই খুব স্পষ্ট হয়ে ছিল। ২০১৪-তে ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যেই মোদি হাওয়া ফেড আউট করছিল। দিল্লি এবং বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি হেরেছিল লজ্জাজনকভাবে। তখন থেকেই আস্তে আস্তে লোকখ্যাপানো রাজনৈতিক বয়ান হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। অমিত শাহ বিহারের ভোটের আগে বলে বসলেন, বিহারে বিজেপি হারলে পাকিস্তানে বাজি ফাটবে। তখনও অর্ণব সেই বয়ানে ধুনোর গন্ধ দিচ্ছেন না। বরং, বিহারের ভোটের রেজাল্টের দিন টাইমস নাও-এর স্টুডিওতে ভারতের মানচিত্র ধরে ধরে দেখাচ্ছেন, বা মজা করছেন এই বলে, যদি বিজেপির এই পতন ধারাবাহিক হয়— তাহলে কী দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে তাদের কপালে।

যে মুহূর্তে এই বিপর্যয়ের আঁচ সরকার পেল, তখনই কিন্তু এক অন্য খেলা শুরু হল। ২০১৬-র ফেব্রুয়ারি মাসে জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাশ্মিরের মুক্তির পক্ষে একটি সংগঠনের মিছিলের ভিডিওতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান ভাসিয়ে তোলা হল হঠাৎ। সেই ভিডিও যে কারিকুরি করে বানানো সে কথা তো জি নিউজের প্রাক্তন কর্মচারী থেকে ফরেনসিক, অনেকেই পরবর্তীতে বলেছেন। কী লাভ হয়েছে? কটা মিডিয়া দিনরাত ফাটা রেকর্ড বাজিয়ে লোককে বলেছে, ওই ছেলেমেয়েদের ভুল বুঝেছিল দেশের লোক? লোককে ভুল বোঝানো হয়েছিল?

সর্বোপরি, অর্ণব কি নিজে একথা একবারও বলেছেন? কেন অর্ণবের কথা আলাদা করে বলছি? কারণ, কেউই ভুলে যাননি, সেসময় টাইমস নাও-এর স্টুডিওতে অর্ণব কী শুরু করেছিলেন? মাকড়সার কামড় খেয়ে স্পাইডারম্যান হওয়ার মতো সেসময় অর্ণবের যে সুপারহিরো বা মতান্তরে সুপারভিলেনে রূপান্তর— তা কোন ভারতীয় ভুলতে পারেন? দেশের লোকের মাথা থেকে মোদি হাওয়া ঘুরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেমালুম লোপাট হয়ে গেল। হতে বাধ্য। কারণ দৃশ্য ও শব্দ এই সময়ের মানুষের ওপর যে প্রভাব ফেলে, তেমনটা আর কোনও বস্তু ফেলে না। যে ক্রোনি মিডিয়া, যে ব্রাদার ও সিস্টারহুড ২০১৪-র আগে থেকে মোদি সরকার আসার ঢক্কানিনাদ শুরু করেছিল, তারা হাতা গুটিয়ে মাঠে নামল। সেই সময় থেকেই আখ্যান পালটাতে থাকল দেশের রাজনীতির।

বেশি মহাভারত বর্ণনার দরকার নেই, ভাবুন না, ডিমনিটাইজেশন, জিএসটি যেমন দেশের লোকের জয়ধ্বনি পেয়েছে, তেমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তো খেপেও গিয়েছিল। গুজরাটের ভোটে জিতলেও ভালোরকম ধাক্কা খেয়েছিল মোদি সরকার। ২০১৮-র শেষদিকে কৃষকরা নেমে এল রাস্তায়। রাফালে দুর্নীতি সামনে এল। এন রাম দ্য হিন্দু-তে ধারাবাহিকভাবে ব্রেক করলেন সেই কেলেঙ্কারি। রাজীব গান্ধির বোফর্স অপবাদের প্রতিশোধ নিতে রাহুল স্লোগান তুললেন, ‘চৌকিদার চোর হ্যায়!’ চৌকিদার ইমেজে চোট খাওয়া স্পষ্ট হয়ে উঠল পরপর তিন রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফলে— রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়। বোঝা গেল, ২০১৯-এ আদৌ মোদি সরকারের জয় নিশ্চিত নয়।

২০১৯-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি চেন্নাই শহরে নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কনক্লেভ চলছে আইটিসি চোলা-তে। সেখানে এসেছেন ফারুখ আবদুল্লা। সকলের মোবাইলে খবর ভেসে উঠছে, ‘পুলওয়ামাতে ৪০জন জওয়ান নিহত।’ ফারুখ আবদুল্লার কথার মাঝেই কনক্লেভের একদল দর্শক উঠেপড়ে লাগল, চেপে ধরল ফারুখকে। একজন সাংবাদিক রীতিমতো চিৎকার করে প্রশ্ন করলেন ফারুখকে, ‘এই যে কাশ্মিরে আজ এত বড় পাকিস্তান-স্পনসর্ড হামলা হল, কী বলবেন আপনি?’ ফারুখ বললেন, ‘কী করে জানলেন, এটা পাকিস্তান স্পনসর্ড? ভারতে যে লিঞ্চিংগুলো হয়, সেগুলোকে কি ইন্ডিয়া স্পনসর্ড টেররিজম বলেন?’ আরও খেপে উঠল জনতা।

আর ঠিক সেসময় দেশের ত্রাতা জার্নালিস্ট বলছেন, ‘দিস অ্যাটাক উই ওন লাইক ক্রেজি’!

কিন্তু এতে আদতে কতটুকু যায় আসে? যায় আসে না, কারণ জেএনইউ-তে কেউ পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দেয়নি জেনেও দেশের লোক উমর খলিদকে দেশদ্রোহী বলে গাল পাড়তে থামে না। আদত কথা হল, ভোটের আগে হাওয়া তোলার প্রয়োজনে এমন পরিকল্পিত নাটকও যদি ঘটে থাকে, তাতেও দেশের লোকের কিছু যাওয়া আসার কথা নয়। যে দেশে রাম সেতু খোঁজার কাজ করে দেশের প্রত্ন দফতর, সেই দেশে এই মেক বিলিভে না হয় বিশ্বাসই করবে লোক। অন্যান্য দেশ হলে হয়তো ক্যু ঘটত, পিএইচ বা এএস নামক সেই রহস্যময় ব্যক্তির এমন কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য জেল হত। কিন্তু এ দেশ ব্যাপম দুর্নীতির। এ দেশে বাস্তব ওয়েব সিরিজ, আর বলিউড বাস্তব।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...