২৬-এর ট্রাক্টর মিছিল: ভায়োলেন্স শুরু হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকেই

আদিত্য নিগম

 




অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

 

 

 

প্রথমেই বলে দিই, আমার ৩০-৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় আমি কখনওই কোনও আন্দোলনে মানুষের এইরকম উৎসাহ দেখিনি।

আজ পুরো দু মাস হল কৃষকরা বসে আছেন দিল্লি সীমান্তে। এই ঠান্ডার মধ্যে। তারপরেও আজকের মিছিলে তাঁরা যেরকম উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখালেন— অভূতপূর্ব। এখন পর্যন্ত দেড়শো মতো মানুষ মারা গেছেন শুধু এই ঠান্ডা ইত্যাদির কারণে। আমি বহুদিন ধরেই এইধরনের আন্দোলন দেখছি। এর আগে বামপন্থীদের মোবিলাইজ করা বিভিন্ন আন্দোলন দেখেছি ৮০-৯০-এর দশকে। বড় বড় মিছিল— দু-আড়াই লাখ মানুষের। নিজেও তার অংশ ছিলাম। কিন্তু সেগুলির মধ্যে একটা মোবিলাইজেশন ছিল। আজকের— বা এই গোটা কৃষক আন্দোলনটারই যেটা বিশেষত্ব, সেটা হল এর স্বতঃস্ফূর্ততা।

আমার বাড়ির কাছে গাজিপুর সীমান্ত। এর সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের সীমানা, উত্তরাখণ্ড থেকে দিল্লি আসতে গেলেও এখান দিয়েই যেতে হয়। আজ এখান থেকে যাওয়ার সময় আরেকটা যে অসাধারণ ঘটনার সাক্ষী থাকলাম সেটা হল স্থানীয় জনসাধারণের ব্যাপক অংশগ্রহণ। জায়গায় জায়গায় প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা কেউ জল দিচ্ছেন, কেউ কিছু খাবার দিচ্ছেন, কেউ শুধু ফুল ছুড়ছেন। এই যে ব্যাপক জনসমর্থন এই আন্দোলন আদায় করে নিতে পেরেছে, এটাও কিন্তু অভূতপূর্ব। নইলে কৃষক আন্দোলন বড় বড় তো অনেকই হয়েছে। আশির দশকের শেষ দিকে— কৃষকরা শহরে ঢুকে সব তুলকালাম করে দিয়েছিলেন— ওই বোট ক্লাব অঞ্চলগুলিতে তারপর থেকেই মিছিল নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এইরকম জনসমর্থন পেতে আগের আন্দোলনগুলিকে দেখা যায়নি।

সিংঘু আর টিকরি বর্ডার— যে দুটো বর্ডার সরাসরি হরিয়ানার সঙ্গে, এবং পাঞ্জাব থেকে আসতে গেলেও এই বর্ডার দুটোই ব্যবহার করতে হয়— আর যেখানে গত দু মাস ধরে বড় বড় ক্যান্টনমেন্ট জাতীয় চালানো হচ্ছে– সেখানেই সকাল থেকে একটা উত্তেজনা ছিল। এমনিতে ১২টা থেকে ট্র্যাক্টর র‍্যালির কথা ছিল। সরকারের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর ওদের ব্যারিকেডগুলো খোলার কথা ছিল। কিন্তু এক তো লোকেদের প্রচুর উৎসাহ, আর দুই যেটার কথা আমি বলব— প্রচুর রাগও ছিল। দু মাস ধরে মানুষগুলো ঠান্ডার মধ্যে ওখানে পড়ে আছেন আর এরা শুধু নাচাচ্ছে! এই যে এগারোবার বৈঠক হল, আর কিছুই হল না, কিছুই বেরোল না, স্রেফ নেতাদের ডেকে সময় নষ্ট করা— সেই সব মিলিয়ে একটা রাগ ছিলই, যেটার ফলেই আমার মনে হয় সকাল থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সাড়ে নটা-দশটায় ওঁরা ওখান থেকে ব্যারিকেডগুলো ভেঙে হাঁটতে শুরু করেন। ট্রাক্টর না কিন্তু— দুদিক থেকেই হাঁটাটা শুরু হল। সিংঘু বর্ডারের দিকে পুলিশ তখন লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস এইসব শুরু করে। আমরা পৌঁছনোর আগে এইগুলি কিছুটা গাজিপুর বর্ডারেও হয়েছিল। কিন্তু ওই দিকটায় বেশি হয়। একটা অদ্ভুত মজার দৃশ্য— পুলিশ লাঠিচার্জ করছে, তার মধ্যে নিহাংরা হঠাৎ ঘোড়ায় উঠে তরোয়াল টরোয়াল নিয়ে ছুটে আসেন। যাই হোক, তারপর পুলিশ সরে যায় আর ওদের প্রসেশন শুরু হয়। পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করছিল, তারপর টিয়ার গ্যাস ছোড়ে।

এবার এই ঘটনাটা নিয়ে আমি নিজে চারিদিক থেকে যা খোঁজখবর নিয়েছি, তাতে এই লাঠিচার্জ-টিয়ার গ্যাস ইত্যাদির পেছনে কিন্তু সেরকম কোনও প্ররোচনার কথা শুনিনি। হ্যাঁ, একটাই প্ররোচনা বলা যায়, সেটা হল ওঁরা ব্যারিকেড ভেঙে বেরিয়ে গেছিলেন, যেটা ওনাদের যাওয়ার কথা ছিল না। এবার এটার পরে যেটা হল, যেটা নিয়ে এখন নেতৃত্বের মধ্যেও অনেক আলোচনা চলছে, সেটা হচ্ছে এই যাঁরা দ্বিতীয় ব্যারিকেডটা ভেঙে লালকেল্লার দিকে চলে গেলেন আর ওখানে গিয়ে ওই যে নিশান সাহেব-এর ঝান্ডাটা লাগালেন— এই পুরো ব্যাপারটা আসলে নেতৃত্বের হাত থেকে বেরিয়ে গেছিল, নেতৃত্বের কিছু করার ছিল না। একজন দায়িত্ব নিয়েছেন ঘটনাটার, দীপ সিন্ধু বলে পাঞ্জাবের একজন গায়ক, লোকে আবার বলছে ওঁর বিজেপি কানেকশনও আছে— জানি না— তবে মোদির সঙ্গে ওঁর ছবি আছে সেটা জানি। সানি দেওল আর উনি মোদির সঙ্গে। কিন্তু উনি এর মধ্যে একটা স্টেটমেন্ট দিয়েছেন— দায়িত্ব নিয়েছেন। উনি বলেছেন, এই ফার্ম বিলগুলো নিয়ে ওঁর একটা রাগ ছিল, সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু এর ফলাফল যেটা হল, ওই কয়েকজন এটা শুরু করাতে, সামগ্রিকভাবে উত্তেজনাটা এতটাই বেশি ছিল, যে তখন একটা বিরাট ভিড় ওঁদের সঙ্গে যেতে শুরু করে, যাঁরা আল্টিমেটলি লালকেল্লা পৌঁছন। এখানে বলে দেওয়া দরকার, ওঁরা কিন্তু রাস্তায় কোনওরকম কারও সঙ্গে কিছু মিসবিহেভ করা, ভায়োলেন্স করা, বা যেকোনওরকম খারাপ কিছু করা— সেসব কিছুই করেননি। লালকেল্লার ভেতরে ঢুকে পতাকা তুলেছেন। ভায়োলেন্সটা যে দু-তিন জায়গায় হয়েছে মূলত পুলিশের তরফ থেকেই শুরু হয়েছে আমরা যা খবর পেয়েছি। আমি দু-তিনটে জায়গার লাইভ ভিডিওও দেখেছি।

এখানে বলে দিই, দু-তিন সপ্তাহ আগে থেকেই কিছু মাথাগরম মানুষ— এটাও আবার সত্য, যেকোনও গণ-আন্দোলনের মধ্যে কিছু মাথাগরম মানুষ থাকেই। নইলে ভাবুন না, গান্ধিজিকে চৌরিচৌরা ফেরত নিতে হয়েছিল কেন! তাই মাথাগরম লোকজন কিছু থাকবেই। আর যেভাবে সরকার একেবারে হিউমিলিয়েট করে রেখেছে এঁদের, তাতে ওই আক্রোশটা বেড়েছে— যেটা কম হওয়ার কোনও লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বরং এই যে তাঁরা এতদিন ধরে এই শৃঙ্খলা দেখিয়ে গেছেন— একটা কোনও ঘটনা ঘটেনি— সেইজন্য তাঁদের ইতিমধ্যেই কুর্নিশ প্রাপ্য। তা যেটা বলছিলাম, দু তিন সপ্তাহ আগে ওদের এক নেতা বলছিলেন যে, আমরা খবর পাচ্ছি আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মাথাগরম ছেলে ট্রাক্টরে বেশি হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন লাগিয়ে… এইসব খবর আসছিল আর কি! তো উনি বললেন, দেখো আমাদের একটা জিনিস একদম মনে রাখতে হবে, আমাদের আন্দোলন দেশের ভেতরে এবং বাইরে যে বিশাল বড় সমর্থন পেয়েছে তার প্রধান কারণ হচ্ছে আমরা আন্দোলনটা শান্তিপূর্ণভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে চালাচ্ছি। সেটা যেন না ভাঙা হয়। ফলে এইটা তখন থেকেই ওদের মাথায় ছিল যে কিছু একটা হতে পারে।

আসলে আক্রোশটা যে জায়গায় পৌঁছেছে সেখানে বিন্দুমাত্র প্ররোচনা হলেই— প্ররোচনাও লাগবে না, কেউ একজন কিছু একটা করে বসলেই সেটা ছড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। যে দু জায়গায় ব্যারিকেডটা ভেঙেছে সেখানেও তাইই ঘটেছে। তবে এইসব জায়গাতেও কিন্তু কোনও ভায়োলেন্স হয়নি। ভায়োলেন্সটা তখনই হয়েছে, যখন পুলিশ লাঠিচার্জ করা শুরু করেছে।

এখনও (রাত সাড়ে সাতটা) কিছু লোকজন বসে আছেন বিশেষ করে ওই ছেলেটি যেখানে মারা গেছে সেইখানটায়। কৃষক সংগঠনগুলির কথাও আসতে শুরু করেছে। ওরাও বিষয়গুলি নিয়ে আরও আলোচনা করবে। যেটুকু উত্তেজনা বা বিশৃঙ্খলা ঘটেছে, আমার মনে হয় না সেটাও কোনও পরিকল্পিত ঘটনা বলে। ওগুলিও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়েছে। আবার ওই গায়ক ছেলেটির কথাও যদি বলি, উনি যে বিবৃতিটা দিয়েছেন সেটা শুনে আমার মনে হচ্ছে না উনি বিজেপির হয়ে কাজ করছেন। তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক, বিজেপি এই আন্দোলনকে ভাঙার প্রচুর চেষ্টা করেছে এবং করে চলেছে। ফলে বলা যায় না কোথায় কে কী প্রোভোকেশন ছড়িয়েছে। কিন্তু দীপ সিন্ধুর ব্যাপারটা এখন অব্দি আমার কোনও কন্সপিরেসি বলে মনে হচ্ছে না।

সব মিলিয়ে একটা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকলাম, সেটাই আরেকবার বলি।


সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত। লেখার ভেতরের ছবি এবং ভিডিও লেখকের।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. কুর্নিশ জানাই এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে! সামনের দিনগুলো তীক্ষ্ণতম বিচরণদাস দাবী করে।

Leave a Reply to Jayanta Bhattacharya Cancel reply