কৃষক আন্দোলন, না বিজেপি সরকারের মৃত্যুঘন্টা?

সৈয়দ কওসর জামাল

 



কবি, প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

যাকে ইংরেজিতে বলে ‘পয়েন্টস অফ নো রিটার্নস’, কৃষক আন্দোলনকে সেই অবস্থায় পৌঁছে দিল বিজেপি সরকার। সম্প্রতি যেভাবে বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইনকে সমর্থন করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমার, তাতে অন্তত এ কথা স্পষ্ট যে তিনটি কৃষি আইন নিয়ে আর চাষিদের সঙ্গে আলোচনার অবকাশ নেই। খুব সাধারণ বুদ্ধিতে এই প্রশ্ন জাগে, কৃষি আইন যদি চাষিদের উপকারের জন্যই হয়, তবে চাষিরা যখন সেগুলোকে উপকারী বলে মনে করছেন না, তখন গায়ের জোরে সে আইন তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অর্থ কী?

আসলে, উপকার বা অপকারের প্রশ্ন নয়, আত্মম্ভরী দলের কাছে এটাই দেখার তাঁদের চিন্তার বিরুদ্ধে কেউ বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করছেন কি না। গণতন্ত্রের প্রতি শাসক দলের সামান্য আনুগত্য থাকলে এভাবে পার্লামেন্টে কৃষি বিলগুলো পাশ করিয়ে নেওয়ার তাড়া তাঁরা দেখাতেন না। কোনও আলোচনার সুযোগ দিতে তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন না, কারণ তাঁরা জানতেন তাঁদের কাছে দুই-তৃতীয়াংশ সঙ্খ্যাগরিষ্ঠতা আছে। শুধুমাত্র এই শক্তির জোরে তাঁরা যে কোনও বিল আইনসভায় পাশ করিয়ে নিতে পারেন। এ এক দুঃসহ পরিস্থিতি।

দুঃসহ পরিস্থিতি আরও এক দিক থেকে যে কৃষকদের আন্দোলন যত শক্তিশালী হচ্ছে, সরকারের তরফ থেকে তত চেষ্টা করা হচ্ছে এই আন্দোলনকে দেশের পক্ষে অহিতকারী, এমনকি, দেশদ্রোহিতার সামিল বলে প্রচার করার। সারা দেশজুড়ে চাষিরা চান তাদের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এবং প্রতিশ্রুত লাভজনক অবস্থা। কৃষি আইনগুলোর যতই ভালো দিকের প্রচার প্রশাসনের দিক থেকে করা হোক না কেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত না করা পর্যন্ত চাষিদের সন্তুষ্ট করা যাবে না। কৃষি আইন এই সুরক্ষা দিতে অপারগ বলেই তাঁরা মনে করছেন, এবং তাঁদের আশঙ্কাকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণ নেই।

শাসক দল একটা বিষয়ে কৃষক আন্দোলনের মূল্যায়ণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা কৃষকদের প্রতিবাদের ক্ষমতাকে বুঝতে পারেননি। কৃষকদের মনোবল, আন্দোলনের প্রতি তাঁদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানসিকতা, আত্মনিবেদনের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা বোঝার ক্ষমতা এই সরকারের নেই। নিজেদের অহমিকা ও আত্মম্ভরিতা, দর্প ও আত্মবিশ্বাস এমন পর্যায়ের যে তাঁরা ভাবতেই পারেন না যে তাঁদের শক্তির কাছে মাথা নোয়াতে অস্বীকার করার সমান আত্মবিশ্বাস কৃষকদেরও আছে। এর ফল হিসেবে আমরা দেখছি, এই আন্দোলন এখন আর শুধুমাত্র কৃষি আইন প্রত্যাহারের আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ হয়ে নেই, এ এক ব্যাপক জনআন্দোলনের আকার গ্রহণ করেছে। পঞ্জাবের চাষিরা আন্দোলন শুরু করলেও এই আন্দোলন এখন হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানেও প্রসার লাভ করেছে। রাজনীতি, জাতি ও ধর্মের বেড়া ভেঙে চাষিরা এইসব প্রদেশগুলোতে ‘মহাপঞ্চায়েত’ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁরা যে ‘চাক্কা জ্যাম’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, তাতে অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে। প্রধান আন্দোলন-স্থল— সিংঘু, টিকরি ও গাজিপুরে নিজেদের ক্রমশ সংহত করছেন চাষিরা। স্থানীয় লোকের ছদ্মবেশে ও পুলিশের সহায়তায় রাজনৈতিক দলের কর্মীদের আন্দোলন ব্যর্থ করার চক্রান্তকে চাষিরা সুচারুভাবে প্রতিহত করেছেন।

তিনটি আন্দোলন-স্থলই সরকারের কাছে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা প্রশাসনের নেই। তাই রাস্তা কাটা, ব্যারিকেড তৈরি করা, রাস্তায় লোহার পেরেক পুঁতে রাখার মতো কাজ প্রমাণ করছে সরকারের আত্মবিশ্বাসে কোথাও চিড় ধরেছে। না হলে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে এমন যুদ্ধঘোষণার পরিস্থিতি তৈরি করার প্রয়োজন হত না। সরকারের আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটেছে বলেই সোস্যাল মিডিয়ার প্রতিবাদী, সংবাদপত্রের সৎ রিপোর্টারদের নিপীড়ন ও গ্রেফতার করতেও পিছপা হচ্ছে না সরকার। তবু দিনে দিনে আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন বেড়েই চলেছে। দেশ-বিদেশের সাধারণ মানুষের সমর্থনকে ‘দেশবিরোধী’ আখ্যা দিতেও বাধছে না সরকারের। যে কোনও সমর্থনের পিছনে ‘খলিস্তানি’দের অদৃশ্য হাত লক্ষ করছে সরকার। অথচ, দেশের সরকার যখন জনগণের এক বৃহৎ অংশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তখন তা আর অন্তর্দেশীয় বিষয় থাকে না। তাই সঙ্গতভাবেই বিভিন্ন দেশের মানুষ এই আন্দোলনকে সমর্থন জানাচ্ছেন। নির্লজ্জভাবে দেশের এক শ্রেণির তথাকথিত ‘সেলিব্রিটি’রা সরকারের চাটুকারিতা করছেন এবং সাধারণ মানুষের চোখে নিজেদের হীন করে তুলেছেন।

এ কথা আজ স্পষ্ট যে বিতর্কিত কৃষি আইন সরকার প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আন্দোলন থামবে না। এ ব্যাপারে চাষিরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অনমনীয় সরকার যত চেষ্টা করবেন চাষিদের মধ্যে অনৈক্যের বীজ ছড়াতে, চাষিরা তত বেশি ঐক্যবদ্ধ হবেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জনগণই শেষ কথা বলে। কোনও শাসকই জনশক্তির কাছে অধিকতর শক্তিশালী নন। যেভাবে চাষিদের আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছে, মোদি সরকারের পতনের ইঙ্গিত স্পষ্টতর হচ্ছে। জনচেতনাবিরোধী, মানুষের প্রতি অসংবেদনশীল ও উৎপীড়ক সরকারের বিদায়বেলার ঘন্টাধ্বনি আমরা কি শুনতে পাচ্ছি না?

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. বাংলায় একটা কথা আছে পিপিলিকার পাখা হয় মরিবার তরে ৷ এমনিতেই মোদির ডানা এবার ছাঁটা হতো ৷সেটা তরান্বিত হলো ৷

Leave a Reply to Achintya Sen Cancel reply