রোদ্দুর মিত্র
এগারোটা বাজতে তেরো মিনিট বাকি। ঘরময় জাঁকিয়ে বসছে তীব্র অন্ধকার। ভ্যাপসা চাঁদ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছে লাইটপোস্টের বুকে-পিঠে সেঁটে দেওয়া বিজ্ঞাপনের দিকে। গোরস্থানের প্রকাণ্ড ঘড়িটা ঠিক তেরো মিনিট পরে ঢং ঢং করে বলবে, মৃত্যু এবং সময় এখানে থেমে থাকে না। তারা অমোঘ…
পুবদিকের জানলা খোলা রাখা সত্ত্বেও ঘরে হাওয়া খেলছে না মোটেই। একবার মনে হল, ছাদে যাই। খানিকক্ষণ পায়চারি করে গায়ের ঘাম শুকোই। এই দেখুন, আত্মহত্যার পূর্বমুহূর্তের স্বস্তিটুকুও নির্লজ্জ হাতে নিংড়ে নিতে চাইছি আমি। কী ঢ্যামনা রে ভাই!… অহেতুক ছেলেমানুষি হচ্ছে। জানলার বাইরে চোখ রাখলে ঘুমের ঢুলুনি এসে পড়ে। কুকুরগুলোর চেঁচামেচিও জ্যোৎস্নায় আলুথালু হয়ে বড় মিষ্টি শোনায়। আধবোজা চোখ দুটো কেবলই দেখছে— খোলা জানলা দিয়ে বিষাক্ত, অপয়া মশা হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে— অবলীলায়— অথচ আমি স্থির। মড়ার মত।
নতুন এই ভাড়াবাড়িতে এসে থেকেই লক্ষ করছি, গোরস্থানের ঘড়ির ঢং ঢং-এর সঙ্গে গলা মিলিয়ে, ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায় একটা কোকিলও ডাকে— ক্ষ্যাপাটে কোকিল— থেমে থেমে তিনবার। আজকে যখন সে পাড়া জাগিয়ে তুলবে, আমি মাথার ডানদিকে রিভলভার ঠেকিয়ে… মুক্তি! তিন মাসের ইলেকট্রিক বিল বাকি। ঘরে আলো জ্বলে না যথারীতি, ফ্যানের পাখায় মরচে। রিভলভার টেবিলেই আছে, শোকেস খুলে টর্চ নিয়ে বেরোব।
গোরস্থানের দানবাকার লোহার গেটের মেরামতি চলছিল। অতএব ঢুকতে কোনও বাধা নেই, বাঁধনও নেই আর তাছাড়া কেই বা আমায় বাধা দিতে পারে— আমি তো হাওয়ার অংশ, হাওয়ার শরীর আমারই শরীর। রাত বাড়লে গোরস্থানের ভেতরে দিব্যি হাওয়া দেয়।
কাঠবাদাম আর মেহগনি গাছের অলিগলিতে হারিয়ে যেতে বেগ লাগে না। নিজেকে আরও ঘন আরও গোপন করে রাখা যায় পৃথিবীর থেকে। হাজার হাজার কবরের ওপর দিয়ে এলোপাথাড়ি হেঁটে বেড়াচ্ছি, নেচে বেড়াচ্ছি, দামী পাথরের তৈরি স্মৃতিশৌধের ওপর চড়ে বসে কান পেতে শোনার চেষ্টা করছি: সে এখনও বাঁচতে চায় কিনা!
আনাড়ির মতো লাফ মারতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়লাম— পড়েই রইলাম কিছুক্ষণ। কনুইয়ে রক্ত, থুতনিতে রক্ত, হাঁটুতে ঢুকেছে ভাঙা ভাঙা কাচ। টর্চটা হাত থেকে ছিটকে গিয়ে কখন যেন জ্বলে উঠল। আলোর গতিপথ যেখানে খেই হারিয়েছে— হতে পারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শেষতম বিন্দু; ঠিক সেইখানে আবছা অস্পষ্ট চোখে খেয়াল করলাম, দূরের বিন্দুবৎ আলোয় বসে আছি— এই আমিই— ঢাউস একটা কবরের ওপর। দেহের ওপর কত কত বিন্দু বিন্দু আলো— একটু আগেই জ্বলজ্বল করছিল— হঠাৎ করে নিভে যাচ্ছে। যেন আমার চেতনা, শরীর, ক্রোধ— অন্ধ হতে হতে আটকে পড়ছে দূরবর্তী আমিটার মাথায়, মাথার ডানপাশে। যেন আমার আত্মাটুকু কেবল জ্বলছে আমারই চোখের সামনে। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, এই আমি কে? এই দৃষ্টি, এই রক্তমাংসের শরীর, হতদরিদ্র ছেঁড়া পায়জামা— এইসব তাহলে কার?
হাওয়া বইতে শুরু করল। সে কী দাপট! কিন্তু চোখের মণি ঠায় সেই ক্ষুদ্র আলোর অবয়বের ওপরেই আটকে আছে। অবাধ্য হাওয়ায় তার চুল উড়ছে, হাত চালিয়ে সামলে নিচ্ছে আমার মতো করে। মনে হল, এক দৌড়ে পালাই, পালিয়ে যাই, পালিয়েই বেড়াই, আজীবন তো পালিয়ে গেলাম, থামলাম কই!
এতক্ষণ পর কোকিল ডেকে উঠল। যেমনটা আমি স্থির করেছিলাম, কোকিল ডাকা মাত্রই ট্রিগারে আঙুল, তিনবার ডেকে ডেকে থেমে গেলেই… উল্টোদিকে আমারই মতন দেখতে কেউ একজন যেন ঠিক ঠিক তেমনটাই করবে বলে সঙ্কল্প করেছে। মাথার ডানদিকে রিভলভার। আমি চিৎকার করছি, তবু আলোর মধ্যে ক্রিয়াশীল সেই অন্য আমিটার কোনও হেলদোল নেই। কোকিল তিনবার ডেকে থেমে গেল। আমার আত্মহত্যার দৃশ্য আমার সামনেই পাট পাট করে সাজিয়ে দিয়ে কেউ যেন বলল, ফায়ার!
আর ঘুমোনো সম্ভব হল না। গেঞ্জিটা ভিজে গেছে। মুখ ধুতে গিয়ে খেয়াল হল, থুতনিতে প্রচণ্ড ব্যথা, কনুইয়ে শুকনো রক্ত লেগে, হাঁটুতেও। অনেক বেলা হয়েছে। দেওয়াল ঘড়িতে দেখলাম এগারোটা বাজতে এখনও তেরো মিনিট।
২.
ড্রামের তলানিতে যেটুকু মুড়ি বেঁচেছিল, তাই খেয়েই আপাতত পেট ভরাতে হবে। বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন, কিন্তু এইমুহূর্তে যে আমি নিঃস্ব! রান্নাঘরে আনাজপাতি রাখার তাক ঘেঁটেঘুঁটে তিন তিনটে আলুর হদিশ মিলল বটে, তার মধ্যে আবার একটা পচা। ক্ষতি তো কিছু হয়নি, দুপুরে আলুসেদ্ধ ভাত— জম্পেশ ভোজন।
আলুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, এই ছোট্ট ঘর জুড়ে আবার ছেলেমেয়েরা এসেছে। রং, তুলি, আঁকার খাতা, রামধনু, হইহই… প্রাণ ফিরে পেয়েছি।
–স্যার, আমাকে একটা পাহাড় এঁকে দাও না!
–পাহাড় যে বড় কঠিন। আমরা বরং আজকে ফুলের ছবি আঁকব। একটা, দুটো, তিনটে… তারপর সমস্ত ঘর হবে বাগান।
–সত্যি স্যার, সত্যি?
–তিনসত্যি। তারপর সেই বাগানে আমি, তুমি, তোমার বন্ধুরা সবাই মিলে প্রজাপতি সেজে উড়ব। ফুলের মধু খাব, প্রাণ ভরে গন্ধ নেব, পাখা দুলিয়ে দুলিয়ে নাচ করব, কেমন?
সত্যিই নাচ করব। খোসা ছাড়ানোর ছুরি হাতে নিয়েই ঘরের এই কোণ ঐ কোণে নেচে বেড়াচ্ছি আমি। খোসা ছাড়াতে গিয়ে ইতিমধ্যেই বাম হাতের বুড়ো আঙুল কেটে ফালাফালা করেছি— কী জ্বালা! রক্ত ছিটকে পড়ছে দেওয়ালে, মেঝেতে, সিলিঙে, অথচ একফোঁটাও গায়ে এসে পড়ছে না। আমি আমার রক্তের স্বাদ চেখে দেখতে আপ্রাণ চেষ্টা করছি, প্রতিবার হেরে যাচ্ছি, প্রতিবার মাথার ডানদিকে তিরতির করে একটা ব্যথা গোল্লা পাকিয়ে উঠছে। অথচ ঘুম থেকে উঠে কিচ্ছু টের পাইনি। আবার! আবার! মনে হচ্ছে মস্তিষ্কের সকল স্নায়ু জট পাকিয়ে ফেটে পড়বে তুলোর বীজের মতো।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে মাথার ডানপাশটা নেড়েচেড়ে দেখলাম। না, কিচ্ছু নেই। কিন্তু কিচ্ছু নেই বললেই হবে, এইমাত্র আবার যেন একটা ছুঁচ ফুটল। নির্ঘাত মনের ভুল। এদিকে আবার বুড়ো আঙুলের ক্ষতস্থান থেকে ক্রমাগত রক্ত ঝরেই যাচ্ছে, আমি ভ্রূক্ষেপ করছি না। এত নিস্পৃহতা আমার জীবনে! মা ঠিকই বলত।
আলু যেমন অর্ধেক কেটে রেখেছিলাম, তেমনই রইল। গ্যাস জ্বালতে পারলাম না। শেষমেশ কিনা আগুনও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল! টেবিলের ওপরেই ঘুমিয়ে পড়লাম। বহুযুগের ঘুম এসে কড়া নাড়ল দরজায়।
ঘুম আর হল কই। অমানুষিক যন্ত্রণা। মাথার ভেতর থেকে, মাংসের পুরু আবরণ ভেদ করে এক্ষুণি প্রচণ্ড বেগে ফেটে পড়বে রক্তমাংসপিণ্ড। আয়নার সামনে ফের একবার দাঁড়ালাম। না, এবারও কিচ্ছু নেই। শুধু মাথার ডানদিকে প্রগাঢ় নীল রঙের বুনোফুল ফুটে ওঠার জন্যে উন্মুখ। হাত বুলিয়ে দেখলাম, কী আরাম! টিপে দেখলাম, অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেল আঙুল। কেমন নেশার মতো লাগল। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ঢুকতে অনন্ত গর্তে পৌঁছে গেল আঙুল। যেখানে অগুনতি নীল নীল ফুল। আরও আরও ভেতরে ঢোকার আকাঙ্খায় আমি তখন আত্মহারা। আহ! কী তৃপ্তি! আজ বরং আমরা ফুলের ছবি আঁকব। একটা, দুটো, তিনটে…
৩.
পঁয়ত্রিশ বছরের অবিবাহিত আঁকিয়ের জীবন এত ভঙ্গুর বোধ হয় আজই প্রথম। মায়ের ছবিতে শুকনো রজনীগন্ধার মালা। গায়ে কাঁটা দিল, পেট মোচড় দিল, টলতে টলতে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়ালাম। ধুলোর পুরু আস্তরণের দয়াদাক্ষিণ্যে মায়ের মুখটাও ধুলোই হয়ে গেছে। খুব বেশি মনেও পড়ে না আজকাল। চেষ্টা করলে একটা জ্যোৎস্নামাখা রাত দুরপাল্লার গাড়িতে চেপে হুইসল দিতে দিতে স্নায়ু-সুষুম্নায় সজোরে ধাক্কা মারল— রেললাইনের ওপর স্রোতহীন লাল রঙের গঙ্গা, ছড়ানো ছেটানো কাঁচা মাংসের টুকরো সমেত মায়ের মুণ্ডুহীন শরীর বুকে চেপে ধরে কতখানি একা হওয়া সম্ভব?
পুবদিকের জানলা খোলাই আছে পরশু থেকে। আজ অন্ধকার ঘন হয়ে সঙ্গে করে নিয়ে এল তার আত্মাকে। তার কোলের মধ্যে নিজেকে সদ্যোজাতর মতো গুটিয়ে নিলাম। সারাটা সন্ধে মাথার ডানপাশে আঙুল বুলিয়ে দিল সে, ডানপাশে বিরাট ওজনের যে পাথর জন্মেছিল, তাকে ফাটিয়ে দিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, এবার ওঠা যাক। মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেবিল থেকে পিস্তল, আলমারি থেকে টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমায় কী ভূতে পেয়েছে!
এই অদ্ভুতুড়ে আকর্ষণ টানতে টানতে আমায় নিয়ে এল গোরস্থানের দরজায়। মাথা তুলে প্রকাণ্ড ঘড়িতে দেখলাম, এগারোটা বাজতে তেরো মিনিট বাকি। মেহগনি আর কাঠবাদাম গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঠান্ডা হাওয়ার বাসা আছে। একচিলতে হাওয়া, প্রথম উড়তে শিখেই আমার চুলের ওপর এসে ডানা ঝাপটায়। মন্দ লাগে না।
এলোপাথাড়ি হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে একটু জিরিয়ে নিলে মন্দ হয় না। অজান্তেই একটা সিমেন্ট বাঁধানো কবরের ওপরে শরীর এলিয়ে দিয়ে ভাবছি, এবার কাজ খুঁজতে হবে। কতবার ভেবেছি রংতুলির ছেলেখেলার পাট চুকিয়ে চাকরি করব, তবুও কে যেন টানে। কীসের টান, কীসের জন্যে বারবার সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টির দিকে মন চলে যায়, কীসের মোহে… মাথার ডানপাশে তড়িৎ খেলে গেল। যন্ত্রণা, তীব্র যন্ত্রণা সকাল থেকে ছায়ামানুষের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছে কেন আমাকে? উঠে বসতেই চোখের ওপর একটা সর্বগ্রাসী ফ্ল্যাশবাল্ব!
ধবধবে সাদা একটা পর্দা চোখের ওপর আছড়ে পড়ল। মাথাটা কেমন ঝিম ধরে যাচ্ছে… সাদা পর্দা সরে যেতেই এবার এল হলুদ। তুলনায় নরম, মলিন। চোখ সয়ে যায়। আলোর উৎস খুঁজতে খুঁজতে নক্ষত্রের আলো হয়ে দেখা দিল একটা আদ্যিকালের টর্চ। খুব আপন মনে হল, মনে হল যেন এ টর্চের সাথে আশৈশব সখ্য। ঠিক, এ যে আমারই টর্চ। কিন্তু ঐ দূরে… আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়েই দেখি— আমারই ছেঁড়া গেঞ্জি, আধময়লা পাজামায়, হুবহু আমারই মতো দেখতে একটা মানুষ মড়ার মতন এতক্ষণ শুয়েছিল। আমাকে দেখে সে প্রাণ ফিরে পেয়েছে, খিলখিল করে হাসছে, এ অট্টহাসির সীমা নেই।
গোরস্থানের নিরবিচ্ছিন্ন হাওয়ায় হাওয়ায় ঠুনকো জীবন আমাকে ছেড়েছুড়ে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। সমস্ত অক্ষমতা, নির্জীবতা আমারই মতো দেখতে একটা মানুষের রূপ নিয়ে আমাকেই দুয়ো দিচ্ছে। হেরো, হেরো, হেরো… টের পেলাম মাথার যন্ত্রণা শিরা-উপশিরার চোরাগোপ্তা পথে সম্পূর্ণ মাথাটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। মুক্তির কোনও উপায় নেই। আমার সেই ছায়ামানুষ ততই হেসে কুটোপাটি খাচ্ছে। মস্তিষ্কের ওজন এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছে, রিভলভার হাতে নিলাম। নিজের মাথায় ঠেকানোর আগে আমার বিপরীতের ছায়ামানুষের দিকে তাক করে ট্রিগার টানলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কাচ ভাঙার শব্দে আমার সামনের একটা অদৃশ্য আয়না টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল গোরস্থানের মাটিতে। তবু প্রতিবিম্বের মৃত্যু নেই। খিলখিল হাসির অগুনতি টুকরো ইতিউতি ছিটকে গিয়ে আমাকে ঘিরে ফেলল। এই নিঃশব্দ আঁধারে ওরা উল্লাস করবে। হেরো, হেরো, হেরো…
আমি পালাব, পালাব, আজীবন তো পালিয়েই গেলাম।
গোরস্থানের ঘড়িতে ঢংঢং করে সাড়ে এগারোটা বাজল। পিস্তলটা একটু একটু করে মাথার ডানপাশে উঠে এল। ট্রিগারে অসাড় আঙুল রেখে ফায়ার।
দূরে কাঠবাদাম গাছে তিনবার থেমে থেমে একটা ক্ষ্যাপা কোকিল ডেকে উঠবে এইবার। আমি নিশ্চিত।
একদম অন্যরকম। তীব্র এক প্রলাপ। যেন একটা ক্ষ্যাপা কোকিল এক্ষুণি ডাকবে পাঠকের মাথার মধ্যে আর কেউ বলবে ফায়ার-
তবে ‘সখ্যতা’ নয়। সখ্য।