সমুদ্রের ধারে

সমুদ্রের ধারে -- উপল মুখোপাধ্যায়

উপল মুখোপাধ্যায়

 

বিস্কুট খাবে বলে কুকুরেরা ছেলেটিকে ঘিরে ধরেছিল। এক পাল কুকুর তাকিয়ে আছে একদিকে। কয়েকটা লোমশ— তারা নেকড়ে হয়ে যেতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। ছেলেটির চোখের দিকে তাকালে বোঝা যাচ্ছে সে ভয় পেয়েছে অথচ বিস্কুট দিতে ছাড়বে না। বিস্কুট দিতে দিতে ও চলে গেল। সঙ্গে— তার সঙ্গে একটি মেয়ে ছিল, সেও চলে গেল। মেয়েটি কি সমুদ্রের পাড় ছেড়ে যেতে চাইছিল? আগে যেখানে সাদা বালি দেখা যেত সেখানে কাদা দেখা যাচ্ছে। বালির ওপর লাল কাঁকড়ারা বিছিয়ে থাকত এখন তারা অন্য বালির খোঁজে চলে গেছে অথচ পরিষ্কার কাঁকড়া দেখতে পাচ্ছিলাম। নিমুদা ব্যবসা নিয়ে কথা বলছিল আর লিল্টু শুনছিল। নিমুদা বলল, “আমার দোকানে এখন যে দিন পাঁচ হাজার টাকার সেল হবে না— আমি বলব— ব্যস, বিন্দাস— কথা হবে না।” লিল্টু কিছু বলল না। সে সমুদ্রের পাড় দেখছিল। দূরে ছোট ছোট ঢেউ দেখা যাচ্ছে আর কাঁকড়ারা হাঁটছিল— আমি দেখলাম ভাঙা একটা বাড়ি যা একটু আগে সমুদ্রের তলায় ছিল, সেখানে কাঁকড়ারা রয়েছে। ওরা আগে সমুদ্রের পাড়ে বিছিয়ে থাকত। তখন সাদা বালিরা ছিল। তারা চকচক করছিল সেখানে কাঁকড়ারা হাঁটছিল— তারা লাল লাল বলে পাড় লাল হত আর আকাশও লাল লাল আর জলেরাও, সেখানে ঢেউ হয় বলে ঢেউরাও লাল লাল। লিল্টু ঢেউ দেখতে দেখতে বলল, “ঢেউ হয় কেন?”

–ঢেউ হয় না।
–তবে কী হয়?
–ঢেউরা হয়।
–মানে?
–অনেক ঢেউ হতে থাকে যাদের বলে ঢেউরা।
–একটা ঢেউ হয় না?
–হয়।
–তবে?
–তারপর ঢেউ চলে যায়।
–কোথায়?
–ওই জন্য আর একটা ঢেউ আসে।
–একটার পর একটা?
–একটার পর একটা।

আগে, কতক্ষণ আগে জানি না এখানে ঢেউ এসে প্রচুর জলের দাগ রেখে গেছে। জলের দাগই শুধু বোঝা যাচ্ছে। কতগুলো ঢেউ এসেছিল বোঝা যাচ্ছে না। একটা সাইনবোর্ডে লেখা আছে কোস্ট গার্ড। এই এবড়ো-খেবড়ো ভাঙাচোরা সমুদ্রের ধারে কোস্ট গার্ড পাহারা দিচ্ছে। নিমুদা বলল, “চা দাও।”

–চিনি?
–অল্প দাও।
–আর মাছভাজা।
–না। মাছভাজা নয়।
–মাছ ভাজা খেলে হত না?
–সব এখনই খেতে হবে?
–তবে কখন?
–সন্ধের পর খাব।
–ও।
–সন্ধের পর মাল দিয়ে খাব।
–ও আচ্ছা।
–হোটেলের কাছে যে সি-বিচ আছে সেখানে আলো আছে। সেখানে যাব মাল খেতে তখন মাছভাজা হবে।
–ভালো, তাই হোক।

বিকেল পড়ে আসতে কখন হবে কে জানে? সময় নিয়ে চায়ের দোকান ভাবছে না। সে দোকানের সামনে আলো টাঙায়নি। দিনের আলোতে সব দেখা গেলেও যেহেতু এটা বিকেল তাই কম দেখা যাচ্ছিল বলে মনে হয়। নাকি রঙের পরিবর্তন হয়েছে দেখা যাচ্ছে একইরকম। দুপুরের রং আর দেখা যাচ্ছে না। দুপুরের রং চলে গেছে। সে রং কীরকমই বা ছিল ভাবতে ভাবতে চা খাচ্ছিলাম। আমরা সবাই একইরকম ভাবছিলাম কারণ কোনও কথাবার্তা ছিল না। কথাদের ফেলে রেখে এসে আমরা সবাই এসেছি এটা কুকুরেরা বুঝে যায়। তারা আমাদের দিকে তাকায়। সকলে এক সঙ্গে তাকায় না। একটা দুটো করে আমাদের দিকে ফিরে তাকাতে তাকাতে আসতে থাকে। ক্রমশ সব কুকুরেরা আমাদের ঘিরে ধরে বসে থাকে। তারা মুখ উঁচু করে হাওয়া শোঁকে আর আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে কখন বিস্কুট দেওয়া হবে। তাদের মধ্যে কয়েকটা লোমশ কুকুর গায়ে বিকেলের রং নিয়ে বসে আছে। আমি দুপুরের রং নিয়ে ভাবছিলাম। কীভাবে এদের বিকেলের রং হল সে নিয়ে ভাবছিলাম। তখন বুঝলাম— যে কোনও মুহূর্তে তারা নেকড়ে হয়ে যেতে পারে। নিমুদার দিকে তাকালাম। লিল্টু আমার দিকে তাকিয়েছিল। কতক্ষণ থেকে ও তাকিয়েছিল কে জানে। নিমুদা বলল, “উঠে পড়।” আমি চা খেতে খেতে উঠে যাওয়ার আগে চা শেষ করে তবে উঠতে গিয়ে দেখলাম লিল্টু বিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সেখানে কাদারা ঢাকা পড়ে গেছে আর সাদা বালিরা ঢেকে দিচ্ছে সব। ঢেউরাও বড় হয়ে রয়েছে। সারা সাদা বিচটায় লাল লাল কাঁকড়া। হাজার হাজার লাল কাঁকড়া ভরে দিচ্ছে, ভরে যাচ্ছে। আমি ছুটে ছুটে তাদের ধরতে যাচ্ছিলাম আর নিমুদা বলল, “কী দেখছ।” আমি বললাম, “সাদা বিচ, সাদা বালি, লাল লাল কাঁকড়া।” নিমুদা শুনতে পেল না। আমরা চললাম। সন্ধে নেমে এল। আলো জ্বলে উঠল। সমুদ্র দূরে রেখে আমরা মদ কিনলাম। তারপর আলো যেখানে আছে সেই সি-বিচে গেলাম মদ খেতে। সকালবেলা আমরা সাদা মদ খেয়েছিলাম বিকেলে সেই মদের রং লাল হল কেন নিমুদাকে জিজ্ঞেস করায় বলল, “আমার বিকেলে লাল মদ খেতে ভালো লাগে।” লিল্টু ফোন করা শেষ করে বলল, “তাতে কিছু এসে যায় না। লাল না সাদা। মদ হলেই হল। আমি যাই মাছভাজা কিনে নিয়ে আসি।” নিমুদা বলল, “দেখে নিও। টাটকা দেখে নিও।” আমি বললাম, “না না ও মাছ ভালো চেনে। মাছের ব্যবসা করত না আগে।” লিল্টু আবাক হয়ে বলল, “আমি কোনও দিন মাছের ব্যবসা করিনি।” আমি বললাম, “কেন করিসনি?” নিমুদা থামাল, “ও সব ছাড়ো। মাছভাজা নিয়ে এসো।” লিল্টু মাছভাজা আনতে চলে গেল। আমি বলেছিলাম সঙ্গে যাব কিনা। ও বারণ করল আমাকে যেতে। আসলে আমি দরাদরি করতে পারি না। যা করে নিমুদা আর লিল্টুই করে। ফলে লাভ হতে পারে আবার অনেকক্ষণ দরাদরির পর দেখা গেল কিছুই হল না দরাদরি করে এমনটাও হতে পারে। কখন কী হবে বলা যায় না আবার কখন কী হবে বলা যেতে লাগল।

মাছভাজা ভালো পাওয়া গেল। হাওয়া ভালো দিচ্ছিল। আর হাওয়া ভালো দিলে অনেক কিছু উড়ে চলে যায় আবার উড়ে এসে অনেক কিছু পড়ে। আমি শর্মিলাকে দেখতে পেলাম। সে কোথা থেকে এসেছে? ভালো হাওয়া দিচ্ছিল বলে সে কি উড়ে এসে এখানে পড়েছে। শর্মিলা একটু দূরে বসেছিল। আমরা মদ ও মাছভাজা খেয়ে হোটেলে ফিরব ফিরব করছি সে সময় ওকে দেখা যায়। আমি নিমুদাকে বললাম, “ওই দেখো শর্মিলা।” নিমুদা বলল, “সেকি! তুমি ঠিক দেখেছ তো!” আমি বলেছি, “আলবাৎ।” লিল্টু বলল, “কী করে বুঝলি?” আমি লিল্টুকে বললাম, “আরও মাছ ভাজা খেতে ইচ্ছে করছে।” লিল্টু ছাড়বে না, সে জিজ্ঞেস করেই চলল, “কী করে বুঝলি? কী করে বুঝলি? কী করে বুঝলি?” আমি ওকে বোঝাতে নিয়ে গিয়ে শর্মিলার কাছে নিয়ে গেলাম। শর্মিলা একটা টুপি পরে বসেছিল। তার গাল ফোলা-ফোলা। চোখে রাতেও কালো চশমা পরে বসে আছে। সামনে, একটু দূরে, টেবিলে একটা সফট ড্রিঙ্কসের গেলাস রয়েছে। শর্মিলা সেই গেলাস থেকে মাঝে মধ্যে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে খাচ্ছে একটা বাঁকানো স্ট্র থেকে। ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না তবে মোটা মোটা ঠোঁট দেখা যাচ্ছে। ভোঁতা ভোঁতা নাক দেখা যাচ্ছে। শর্মিলা মাথাটা নামিয়ে রয়েছে, টুপি পরে রয়েছে। তার পা দেখা যাচ্ছে কি? পা কি টেবিলের তলায়? আমি নিচু হতে যেতেই শর্মিলা আগের মতন কথা বলে উঠছে, “কী করছ কী!” আমি বললাম, “তুমি কি শর্মিলা?” শর্মিলা কোনও উত্তর দিল না। লিল্টুকে বললাম, “ঠিক ধরেছি, দেখছিস তো।” লিল্টু বলল, “কিন্তু ও তো কোনও উত্তর করেনি।”

–মানে?
–তুই জিজ্ঞেস করতে ও কী বলল?
–কী আর বলবে।
–কিছু বলল কি?
–তা বলেনি তবে আমি ঠিক বুঝেছি।
–কীভাবে?
–শর্মিলার ঠোঁটের তলায় একটা আঁচিল আছে।
–তাতে কী?
–কিছুক্ষণ পরে ও ঠিক আঁচিলটা চুলকোবে।
–চুলকোবে?
–হ্যাঁ। ওটা ওর আদরের আঁচিল।
—কী করে বুঝলি?
—কারণ ও চুলকোতেই থাকবে। চুলকোতেই থাকবে। থামবে না।
—রক্ত পড়বে না?
—না। আঁচিল চুলকোলে রক্ত পড়ে না।
—কী সব বলছিস!
—আদরের আঁচিলের কথা বলছি।

নিমুদা শেষ মদটা খেয়ে, শেষ মাছভাজাটা শেষ করে উঠে আসছিল আমাদের কাছে।

আমরা তখন শর্মিলার টেবিলের সামনেটায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। এর কিছুক্ষণ পরেই আমরা বুঝতে পারব মেয়েটা শর্মিলা কিনা। নিমুদাকে বললাম, “দাদা দাঁড়াও।” নিমুদা বলল, “কেন? কী হল কী! যত মাল খেয়ে ভ্যানতাড়া! মাংসটা বানাতে দিয়ে এসেছি, নিতে হবে না?” বলে নিমুদা হাঁটা দেয়। আর তখনই একটা বাতাস দিল। সন্ধেবেলার আলোরা বেঁকে গেল। দোকানের আলোরা ঠিক থাকতে পারল না। মদের বোতল থেকে আলোরা অন্যরকম হয়ে চলে গেল। শর্মিলার টেবিলের তলাটা যেন নড়ে উঠল। এখনও আমি ওর পা দেখতে পাইনি। লিল্টু চলে যেতে গেল। একটা কুকুর ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি দেখলাম এই সময় হাওয়া দেওয়ার ফলে যা রং থাকার কথা কুকুরের সেই রং নেই। তারপর একটার পর একটা কুকুর আসছে দেখে আমিও থমকে গেলাম। লিল্টু আর আমাকে ঘিরে কুকুরেরা হাওয়া শুঁকছে আর কী যেন চাইতে লাগল। ওরা কী বিস্কুট চাইছিল? লিল্টু বলল, “কয়েকটা মাছভাজা রেখে দিলে হত।” আমি বললাম, “কেন?” ও বলল, “কুকুরগুলোকে দেওয়া যেত।” আমি বললাম, “ওরা মাছ ভাজা খেত কি?” লিল্টু বলল, “নিশ্চয়ই খেত।” হাওয়ারা জোরে জোরে দেওয়ার ফলে সব দুলছে যেমন ঠিক তেমনি সময়ের জন্য রাখা সব রংও বদলে বদলে যাচ্ছে। সি-বিচের ওপর ঠেলাগাড়ি করে সাজানো সব দোকানের পশরাগুলোও রং বদলে ফেলেছে। আমি শর্মিলার দিকে তাকালাম। ওর পোশাকের রংও বদলে গেছে, টুপিটা অন্যরকমের লাগছে। আরও কাছে গিয়ে চশমাটার রং দেখতে ওর আরও কাছে চলে যেতে শর্মিলা ওর ঠোঁটের তলার আঁচিলটা চুলকোতে আরম্ভ করেছে। আমি বললাম, “ওটা কি তোমার আদরের আঁচিল?” শর্মিলা কোনও উত্তর দিল না। ও আঁচিলটা চুলকোচ্ছে তো চুলকোচ্ছেই। কুকুরগুলো ক্রমে আরও বেশি করে হাওয়া শুঁকছে আর নিজেদের গায়ে গা লাগিয়ে গরগর করছে। চারদিকে গরগর গরগর করে আওয়াজ হচ্ছে। কুকুরগুলোর সবগুলোই কি লোমশ? নাকি তাদের সবারই লোম খাড়া খাড়া হয়ে উঠে ওরকম লাগছে। তারা কি নেকড়ে হয়ে যেতে পারে যে কোনও মুহূর্তে? আমি শর্মিলার দিকে তাকালাম। ও আঁচিল চুলকোচ্ছে বেশ আদর করে করে আর আরও হাওয়া দিতে যেন তার রং বদলে বদলে ক্রমশ রক্তাভ হয়ে উঠছিল। সেখান থেকে রক্ত পড়ছে। কুকুরগুলো ছুটে আসছে। তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। এখন তাদের দেখতে পাঁশুটে পাঁশুটে রঙা নেকড়ের মতো লাগছে। তারা দলবদ্ধ নেকড়ের মতো মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকাচ্ছে। সেখান থেকে, চাঁদের আলো থেকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে রক্তের ফোঁটারা আবারও পড়ছে টপ টপ টপ টপ। সমুদ্রের পাড়ে দোকানগুলো সরে সরে যাচ্ছে। আলোরা চলতে আরম্ভ করছে, আগুনের মতো করে তারা জ্জ্বলছে। যেন সার সার চিতা, কাঠের চিতা সব সাজানো ছিল পর পর পর— তাতে এই মাত্র আগুন দেওয়া হবে। গন্ধ পাওয়া যাবে মাংসের, মারির, না-শোঁকা রোগের আর প্রিয় শরীরের।

হাওয়া বেড়ে যেতে সে হাওয়ায় উড়ে আমরা দুজন, লিল্টু আর আমি অনেক ওপরে উঠে গেছি। ওপর থেকে আর কুকুরের দলটাকে নেকড়ের দলের মতো মনে করতে পারছি না। তবু যেন দেখা যাচ্ছে টেবিলের ধার থেকে শর্মিলা টুপিটা ঠিক করতে করতে ভারী শরীরটা টেনে হাওয়ার ভেতর হাওয়া হয়ে এগিয়েছে ওই সব বিক্ষিপ্ত চিতার দিকে। কাঠ চুড়ো করে রাখা চিতা। যেন ও এলেই তাতে আগুন লাগানো চলে। চিতার গন্ধ নিয়ে হোটেলে ফিরে সেই আগুনের কথা মনে করছি— সময় যাকে রং পাল্টাতে বাধ্য করে থাকে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...