বাঁ-হাতি স্পিনার ও অন্যান্য

বাঁ-হাতি স্পিনার ও অন্যান্য -- কুশান গুপ্ত

কুশান গুপ্ত  

 

বাঁ-হাতি স্পিনার

বাঁ-হাতি স্পিনাররাই বেশি ভালো, ভেবেছে শ্রীতমা। সে আদতে কসমেটিক-অবিশ্বাসী, তার ব্যাগে একটিই লিপস্টিক থাকে আলগোছে, চিরুনি থাকে না।  সেভ করা, সদ্যপরিচিত নম্বরের একাধিক মিসড কলে এ-কূল ও-কূল ভাসে হৃদয়ের, এই সম্রাজ্ঞী-বোধ অন্যের ক্রিয়া-পেক্ষ, কিছু অনায়াস। জানালার নিকটে একটি কাক ডাকে, সামান্য কর্কশ, মন্দ লাগে না। ফ্লাইওভারের কাছে এসে মনে হয় আজ সব উচ্ছ্বসিত পথগুলি প্ৰকৃত কাঙ্খার অভিমুখে। ফোন বেজে ওঠে, সেই নাম ফুটে ওঠে, শ্রীতমার মুখে আলো, এরকম স্বতঃ হাসি ওষ্ঠে এলে বোঝা যাবে মাধুরী শব্দটি দীক্ষিত, রীণা ব্রাউন ক্লিশে না। কেউ দেখছিল না তাকে, বাইশ গজের ক্রিজ ডাকছিল, সামান্য দ্বিধায় সে ভাবছিল, মেন’স আফটারশেভ বিষয়ে পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন।

 

নারী ও  হাঙর

হাঙরের, দাঁতের চেয়ে অধিক ক্রূরতা আছে, বাহ্যিক মুখের গঠনে। এছাড়া বিশিষ্ট তার মিষ্ট রক্তের লোভ, ঘ্রাণশক্তি এবং জলীয় ক্ষিপ্রতা। কিন্তু ওই নারীটির ওষ্ঠের গঠন দেখে, যা তাকে অনন্য করে তুলেছিল, কেনই বা এসমস্ত মনে পড়ছিল? আসলে তার ওপরের ঠোঁট, প্রকৃতই, নীচের ঠোঁটের চেয়ে সামান্য এগিয়ে। একথা বুঝেছি আমি প্রোফাইল-ভিউ থেকে, কেননা সে  আমার বাঁ দিকে বসে ছিল। কফিশপের একটি চেয়ারে তার সামান্য হেলানো মাথা, চুলগুলি পেছন থেকে আশ্চর্য তুলে দেওয়া, মাঝখানে একটি উৎকৃষ্ট গোল ঢিপি, প্রাচীন মুনির ছবি যেরকম চাঁদমামা পুস্তকে দেখেছি। এসময়ে সে কিছু একটা বলছিল, প্রথমে মনে পড়ল বঁড়শিতে গেঁথে নেওয়া একটি ইঞ্চিছয় আকৃতির মৃগেল, যা থেকে থেকে খপখপ করে, ডাঙায় ওঠার পরে। সে কীসব বলছিল, আমার ঠিক মনে নেই। শুধু দেখলাম তার ওষ্ঠ ও অধর ওরকম কম্পনরত, সে তখন ক্রুদ্ধ হয়,বলে, অমন হাঁ করে আছিস কেন। তখন আমার তাকে হরিহর মনে হয়, ও নিজেকে অপু। কিন্তু এই চিন্তা সম্পূর্ণ অবান্তর। সুতরাং, আমি হতচকিত হয়ে অপ্রস্তুত, জিজ্ঞেস করি, তার কোন জোডিয়াক সাইন। সে তখন প্রথমে— ‘কেন?’ বলে ঈষৎ সলজ্জ হতে চেয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই সপ্রতিভভাবে বলে উঠল, পাইসিজ। এসময়ে তার ওপরের খুদে খুদে দাঁতগুলি নীচের ঠোঁটটিকে কামড়ে ধরে। আমার ‘মীন’ রাশি মনে পড়ে। অনুমান সঙ্গত ছিল তবে, অতঃপর মনে হয় এই নারী মৎস্যগন্ধা, ঘাটে এসে পার করে দেয় যাত্রীদের তার বাবার নৌকায়। ওদের নদীতীরবর্তি বাড়িটি টালির ছিল মনে হয়। জানি ভুল, আসলে কুটীর, কিন্তু তবু মনে হয় টালির, শান্তনুকে দরজায় ঝুঁকে ঢুকতে হয়েছিল তবে। ‘আবার হাঁ করে কি ভাবছিস?’ পুনরায় প্রশ্নালু হওয়ার সময়ে আমি তার দাঁতগুলির সামান্য অংশ দেখতে পাই। ‘সত্যবতী কে?’— এই প্রশ্নে সে মুহূর্তেই রেগে ওঠে, ‘বোর করতে পারিস বটে। কোনও মানে হয়?’ এই সময়ে তার ওষ্ঠের আড়াল থেকে দাঁতগুলি স্পষ্ট হয়, তখন আমার তাকে মনে হয় অবিকল এক হাস্যময় হাঙর। মনে আসে হাঙরের সারিবদ্ধ সুশৃঙ্খল দাঁতগুলি ক্ষুদ্র, যদিও ত্রিভুজাকার, তবুও মুখের অবয়বটুকু সুন্দর ও অবিশ্বাস্য হাসি হাসি, অভিবাদনরত। তবুও আশ্চর্য মানসিকতা আমাদের, কিছুতেই হাঙরকে নারীর প্রতীক বলে আজও ভাবতে শিখিনি, কেননা হিংস্রতা। কিন্তু, স্বচ্ছন্দ মিল পাওয়া গেল মানবী ও হাঙরের। এই কফিশপ বড় নির্জন, সে নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে: আর ইউ হাংরি? এসময়ে হাংরি শব্দটি বেশ পরিশীলিত উচ্চারিত হয়। এভাবেই প্রতিটি শব্দ শ্রুতিশ্রাব্য হওয়া উচিত। তবেই প্রতিটি মুহূর্ত মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু হাংরি শব্দে ক্ষুধা মনে পড়ে না, মনে আসে জলতোড়, শেষের রি অংশটি যেন মুখে জল নিয়ে গার্গল করার ভঙ্গিতে ছাড়া।  লিঙ্গ পরিবর্তনের কথা কেন মনে এল? আসলে ওই হাঙরের নারীত্বের বিষয়ে আমার অক্ষম পুরুষতন্ত্রবাদ ধিক্কারজনক। কিন্তু, হাংরি এই মধুর উচ্চারণটি এসে চিন্তাস্রোত ভেঙে বিরক্ত করছিল। কিন্তু, হাংরি কি তাহলে স্ত্রী-হাঙর, যেভাবে হরিণ, হরিণী? ‘কী ভাবছিস?’ আমি এই প্রশ্নে বলি, ‘শিক্ষিকার ইংরিজি প্রতিশব্দ কী?’  তার মুখে নিশ্চয়ত হতাশা ও ক্ষোভ জাগ্রত হয়, সে নীচু গলায় বলে: তুই খুব যাচ্ছেতাই, বিরক্তিকর!

 

নিরুদ্দিষ্টের প্রতি ফেসবুকরত সুদক্ষিণার স্বগতোক্তি

৯৭ সালে বোনের সঙ্গে স্টেশনে দেখা হওয়ায় খোঁজ নিয়েছিল। অর্থাৎ, ৯৭ সাল অবধি আমাকে সে মনে রেখেছিল। নাকি ৯৮? তারও পরে অন্তত ২৪ বছর। এখন কি আর…? (আবার দৃশ্যে আসে গালে ঘষে দেওয়া দুই পুরুষালি হাত… সান্ধ্য নরম আবির, বিলম্বিত দোল, তার দাড়িমুখ। ঠিক পরপর নয়, প্রাচীন সিঁড়ির মুখে যুগপৎ, যখন গোধূলি)। ওই একদিন আমি ঠিকঠাক লজ্জিত ও সমর্পিতা হতে পেরেছিলাম। অন্যথায় ওকে… (নতুন মেসেজের টং শব্দ হয়, মেসেঞ্জারে গোয়া থেকে ফুল পাঠায় মাসকয় আগে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো জনৈক  আর্টিস্ট, সদ্যবিবাহিত। ফুল নয়, ফুলের ইমোজি। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর চায় আবার। পরক্ষণে ঠোঁটের শংসাপত্র লেখে দুর্বল ভাষায়)। একদিন হাত ধরেছিল, কাঁপছিল অনির্বাণ, হ্যাঁ আমিও একদিন ঘুম ভেঙে সন্ধেয় বলেছিলাম, এক্ষুণি তোর কথাই ভাবছিলাম, সেই থেকেই কি? অন্যদিন কাঁদছিল… কিন্তু ওর ডুকরে ওঠা আমাকে নিষ্ঠুর করে ফেলছিল দিনদিন… আর আসেনি, শুধু জয়েন্ট এন্ট্রান্সের র‍্যাঙ্ক বলে দ্রুত চলে যায় শেষবার, কার একটা স্কুটারে বসে ছিল। আচ্ছা, সঙ্গীতাদির সঙ্গে কি ওর কিছু ছিল? (ফেসবুক সার্চে অজস্র অনির্বাণ চক্রবর্তী ভেসে ওঠে পুনর্বার, এরা নয়, এরা কেউ নয়, গুগলে আসে না, ইনস্টাগ্রামে নয়, ডিপ সার্চ ইঞ্জিনেও কখনও আসেনি…)

কোথায় থাকে অনির্বাণ, যে এই তিরিশ বছর ধরে শূন্যতার দিকে এগিয়ে যাওয়া অন্ধকার একটা সিঁড়ি, একটা গোপন অথচ ব্যর্থ ডাকনাম যে জানে শুধু?

 

শম্পা?  

‘শম্পাআআ!’ বলে রাস্তা থেকে মাঝবয়সি টাকমাথার একজন ডাকে, ভেতর থেকে পরমুহূর্তে মেয়েলি গলায় ‘আসছিইই’ ভেসে আসে। স্ট্যান্ডহীন সাইকেল বড় অসহায়, মানুষ এ-সময়ে আপ্রাণ একটি উপযুক্ত দেওয়াল অথবা একটি ল্যাম্পপোস্ট খোঁজে। লক্ষ্যণীয়, বাড়িটির পাশে ড্রেন, কিন্তু গেটটি ড্রেনের ওপাশে। গেটটি সুউচ্চ, লাগানো,  অন্তরালে বাগান রয়েছে এটুকু বোঝা যায়। ড্রেনের ওপাশে গেটের গা লাগিয়ে সাইকেলটি রাখা যায়, কিন্তু দুই হ্যান্ডেলে ব্যাগ। অর্থাৎ রিস্ক রয়েছে। এছাড়া হ্যান্ডেল ব্যাগের প্রভাবে ঠিকমত ম্যানুভার করে ওই সামান্য জায়গায় রাখা কষ্টকর। লোকটি নিজের বা ধরে থাকা বিকলাঙ্গ সাইকেলের দুরবস্থা স্মরণ করে ঈষৎ লজ্জিত ও অপমানিত বোধ করে। এমন সময়ে মানুষ মাথা নিচু করে ফেলে, ইতস্তত তাকায়, দ্যাখে কেউ তাকে লক্ষ্য করছে কিনা। লোকটিও তাই করল। দ্বিতীয়বার ‘শম্পাআআ’ ডাকে লোকটা, এবার একটু প্রলম্বিত হয় তার শেষের আ-কার… এই দ্বিতীয় ডাকে সে নিজের ক্রোধ ও হালকা বিরক্তি ঠিক অনুপাতে মেশায়, নিজের স্বরের তীব্রতা সম্পর্কে আশ্চর্য নিয়ন্ত্রণ তার। কেউ টের পায় না। বাস্তবিক কেউ নেই, কেউ দেখছে না কাউকে। একটা পরিচিত কুকুর কোত্থেকে দৌড়ে এসে ল্যাজ নাড়ে। লোকটা তাকে  ‘নো। নট নাউ!’— রাগত গলায় বলে। বিগলিত কুকুরটা তবু ল্যাজ নেড়ে যায়, একবার সাইকেলের ঝুলন্ত ব্যাগ শুঁকতে চায়। একবার লোকটা মোড়ের দিকে অনর্থক তাকায়। গেটটা এবার ভেতর থেকে খুলে যায়। কে খুলল? শম্পা আসলে কে?

 

তরুণী ও ভুরিশ্রবা    

সিলভিয়া প্লাথের ফরাসি ভাষায় অনুবাদ পড়ে চলে একটি তরুণী। ভুরিশ্রবা, তরুণীর বিশিষ্ট নখযুক্ত আঙুলগুলি, যাদের অতিকায় বইটি ঢেকে রেখেছে, দেখতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু, শুধুমাত্র বুড়ো আঙুলদুটি নজরে আসে। ফরাসি জানে না ভুরি, এব্যাতীত মূলে বা অনুবাদে সিলভিয়া প্লাথ কখনও পড়েনি। বস্তুত, সে কোনওদিন পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কবিতাই পড়েনি। কতগুলি অবান্তর ধ্বনি তুলে যায় এই বদ্ধ ঘর। ঘাড় ঘুরিয়ে তরুণীর নামমাত্র দুটি বুড়ো-নখের অপাপবিদ্ধ মেরুন ভুরি আপ্রাণ চেষ্টায় এক মুহূর্ত দেখতে পায়। পরক্ষণে চোখ তুলে দ্যাখে সেই তরুণীর চোখদুটি ব্রীড়াময়। তরুণী অতঃপর বই হাতে, পাঠরত, ঈষৎ নৃত্যভঙ্গিমায় পায়চারি করে, ভুরি একই স্থানে বসে, শুধু তার দৃষ্টিপথ ইতিউতি পরিবর্তিত হয়। নখগুলি, নখসহ আঙুলগুলি একেবারেই দৃশ্য থেকে অন্তর্হিত, ফলে ভুরির অসহায়তা বাড়ে। দুপাক ফিরে এসে তরুণী পাতা ওল্টায়, সামান্য দেখা গিয়েছিল, তবে তা এক ঝলক মেরুনের আভাস, একটু দেখেই তরুণী বই বন্ধ করে ও টেবিলে আলগোছে ছুঁড়ে দেয়। অতঃপর বিজয়িনী স্টেজ পারফর্মারের ভঙ্গিমায়, দুহাত সামনে ছড়ায়, অনুষ্ঠানশেষ অভিবাদন কুড়ানোর ভঙ্গিমায়… ভুরি চেয়ে থাকে বিহ্বল, কেননা তরুণী হাতের পাতা উল্টে ফেলেছে। তার নীরবতায় তরুণী ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল, অসহায় ভুরি নিজের এই মুহূর্তের শরীরি ভাষায় যথাযথ অনুশোচনা আনতে সচেষ্ট হয়, এ-সময়ে দুহাতে মুখখানি ঢেকে ফেলে তরুণী, ভুরি মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে দশখানি অসমান আঙুল, সবকটির ডগায় নির্ভুল মেরুন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. ঈর্ষণীয় স্টাইল লেখকের ! কিঞ্চিত বিষণ্নতা, কিঞ্চিত উদাসীনতা আর প্রচুর বিদ্রুপ !

Leave a Reply to prativa sarker Cancel reply