ভারতবর্ষ: ১৯৪৭-৬৫

হোমেন বড়গোহাঞি-র গল্প 'ভারতবর্ষ: ১৯৪৭-৬৫' | ভাষান্তর: বাসুদেব দাস

হোমেন বরগোহাঞি

 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ: বাসুদেব দাস

 

১৯৩২ সালে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’, ‘অসম বাণী’ ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা’, ‘মৎস্যগন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনীমূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।

অগ্রহায়ণ মাসের সকালবেলার মিষ্টি রোদ গায়ে নিয়ে কয়েকজন বন্ধু কথা বলছিল। অবশ্য এর দ্বারা কেউ যেন ভুল না বোঝে যে করার মতো হাতে কোনও কাজ ছিল না বলেই আমরা বসে বসে কেবল কথার মালা গাঁথছিলাম। আসলে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল অত্যন্ত গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ। অধিক শস্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে জনগণকে বোঝানোর জন্য একজন মন্ত্রী আসবে, তার জন্য একটি জনসভার আয়োজন করতে হবে। সভা আহ্বান করার দায়িত্ব যার ওপর অর্পিত হয়েছিল সে একটা গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষ পক্ষ, গ্রামের স্ত্রী-পুরুষ সমস্ত মানুষ ধান কাটা এবং ফসল তোলায় ব্যস্ত। কারও নিঃশ্বাস ফেলার মতো সময় নেই। ঠিক তখনই মাঠের ফসল বাড়িতে না এনে শস্য উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে মন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার জন্য কোনও মানুষ যে আসবে তার কোনও আশা নেই। কিন্তু সভার আহ্বায়ককে সে কথা কে বোঝাবে? কিছু বললেই একথা প্রমাণ হয়ে যাবে যে সেই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে তার প্রভাব প্রতিপত্তি কোনও কিছুই নেই। তাই সে মন্ত্রীর পেছন পেছন ঘুরে বেড়ানোর যোগ্য নয়। সঙ্গে এই কথাও প্রকাশ হয়ে যাবে যে দেশপ্রেম এবং রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে সেই অঞ্চলের জনগণ বেশ পেছনে পড়ে রয়েছে। বক্তৃতা দিতে গিয়ে মন্ত্রী যদি দেখে যে পঞ্চায়েতের সভাপতি সম্পাদক এবং সভার আহ্বায়কের বাইরে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ সভাস্থলে আর কেউ নেই, কেবল টফি লজেন্সের লোভ দেখিয়ে পাশের পাঠশালা থেকে ধরে আনা ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল কখন সেখান থেকে পালিয়ে যাবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে বসে আছে তখন যে মন্ত্রীর মনের অবস্থা কী হবে সে কথা কল্পনা করে গত তিন রাত আহ্বায়কের ঘুম আসেনি। ভেবেচিন্তে কোনও উপায় বের করতে না পেরে আজ সে আমার কাছে এসেছে। সঙ্গে আরও তিনজনকে নিয়ে। তারই একজন পঞ্চায়েতের সভাপতি, বাকি দুইজন সরকারি কর্মচারী।

এই ধরনের সমস্যা আমার কাছে কোনও নতুন কথা নয়। বরং বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই আমি এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হই। বন্ধুটিকে উপায় বলে দিতে আমার খুব বেশি সময় লাগল না। কিন্তু এতক্ষণে আমার শরীরে মিষ্টি রোদ এবং কথার নেশা লেগেছে। উঠে যেতে ইচ্ছা করছে না। তার মধ্যে পঞ্চায়েতের সভাপতি হল অত্যন্ত সিরিয়াস স্বভাবের মানুষ। যেখানে যখনই সুবিধা পায় নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার কথা অবতারণা না করে থাকতে পারে না। একের পরে এক সে কথা বলে যেতে লাগল— পঞ্চায়েতের কৃষি পরিকল্পনা, জমিতে সার প্রয়োগের প্রতি জনগণের উদাসীনতা, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ, জিনিসপত্রের চড়া দাম— এবং প্রতিটি বিষয়ে নিজের নিজের জ্ঞানের গভীরতা এবং মৌলিকতা জাহির করতে পেরে বাকি কয়েকজনও আলোচনায় মশগুল হয়ে পড়ল। যুবক কর্মচারী দুইজন কিন্তু বেশি সময় গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষুদ্র পরিসর কিংবা জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির মতো তুচ্ছ বিষয়বস্তুতে আবদ্ধ থাকতে পারল না। কিছুক্ষণ পরে যুবকোচিত অসহিষ্ণুতায় তারা ঘোষণা করল যে এই সমস্ত ছোট ছোট কথায় মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই। এর ফলে সময়ের অপচয় হয় মাত্র। আসল সমস্যা হল সামাজিক অসাম্য এবং দারিদ্র্যের সংগ্রাম। কিন্তু পুঁজিপতির দ্বারা প্রভাবান্বিত বর্তমান সরকার সামাজিক অসাম্য বা দারিদ্র্য দূর করতে পারে না— বা আসল সত্য কথা বলতে গেলে— করতে চায় না। তাই (উত্তেজনায় যুবক দুজনের মুখ লাল হয়ে উঠল) বর্তমানের শাসনযন্ত্রে একটি আমূল পরিবর্তন অথবা সমগ্র সমাজে বিরাট একটা বিপ্লব না হওয়া পর্যন্ত কোনও একটি সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয়।

পঞ্চায়েতের সভাপতি এবং গ্রামের নেতার মুখের ভাব থেকে বোঝা গেল যে তারা মনে মনে কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করছে। তাদের অবস্থা মহাভারতের ভীষ্ম দ্রোণ আদির মতো। কৌরবরা যে অন্যায় এবং দুষ্কার্য করেছে সে কথা এমনকি প্রকাশ্যভাবে স্বীকার করায় তো কোনও বাধা নেই, তার জন্য তাদের সদুপদেশ দেব এবং সমালোচনা করতেও পারি কিন্তু তাদের অন্নে প্রতিপালিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধেই অস্ত্রধারণ অসম্ভব। অত্যন্ত বিজ্ঞের মতো বিষণ্ণ একটা হাসি হেসে পঞ্চায়েত সভাপতি এবং গ্রাম‍্য নেতাটি সামনের পথ দিয়ে আসা-যাওয়া করা মানুষদের নিরীক্ষণ করতে লাগল।

শ্রোতার প্রতিক্রিয়ার দিকে লক্ষ্য করার জন্য বিপ্লবী যুবক দুজনের সময় নেই। তারই একজন আঙুল নেড়ে নেড়ে উত্তেজিত ভাবে বলতে লাগল— শইকিয়া সরকারি কর্মচারী হলেও আমি সত্যি কথা বলতে ভয় করি না। শুনুন, আপনি বলতে চান যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলির ফলে দেশের সমৃদ্ধি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সমৃদ্ধি হয়ে কী হবে— যদি উচিত মতো তার বিতরণ না হয়? উন্নতি হওয়া মানে আপনি কি বোঝেন, যদি স্বাধীনতা লাভের আঠারো বছর পরেও, তিনটি করে  পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পার হয়ে যাওয়ার পরেও আজও দেশের কোটি কোটি মানুষকে  অনাহারে অর্ধাহারে মৃত্যুবরণ করতে হয়?…

অন্য যুবকটি কখন তার কথা বলার সুযোগ আসে তার জন্য অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিল, কিন্তু বন্ধুটির মুখ সহজে বন্ধ হওয়ার আশা না দেখে খপ করে সে বলে উঠল— দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি বলছি শুনুন। ফাইভ ইয়ার প্ল‍্যানগুলি নিষ্ফল হয়েছে বলা ঠিক হবে না। আসলে সেগুলির ফলে দেশের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, জাতীয় সম্পদ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু হলে কী হবে? মহলানবিশ কমিটির রিপোর্টের কথা আপনারা বলতে পারেন না? আসল জিনিসটা সেখানেই রয়েছে। পারতপক্ষে রিপোর্টটা গোপন করার জন্য আপনাদের সরকার কম চেষ্টা করেছিল কি? এই বামপন্থী দলগুলি যে সভাসমিতিতে বলে বেড়ায় স্বাধীনতা লাভ করার পরই ধনীরা আরও অধিক ধনী এবং গরিব আরও গরিব হয়ে যাচ্ছে, মহলানবিশ কমিটি অঙ্ক করে প্রমাণ করে দিল সে কথা। তারা দেখিয়ে দিল গত ১৫ বছরে আমাদের যত সম্পদ বেড়েছে তার শতকরা ৭৫ ভাগ গিয়েছে সমগ্র জনসংখ্যার কেবল মাত্র শতকরা দশ জনের ভাঁড়ারে, বাকি শতকরা ৯০ জনের ভাগে পড়েছে মোট জাতীয় সম্পদের মাত্র ২৫শতাংশ। এই হল আপনাদের ডেমোক্রেটিক সোশিয়ালিজমের নমুনা? এসব করেই আপনি সামাজিক অসাম্য এবং দারিদ্র্য দূর করতে চান? ভণ্ড বদমাশের দল! স্ট্যাটিসটিকসের হাত সাফাইয়ের খেলা দেখিয়ে ওরা জনতার চোখে ধুলো দিতে চায়। অর্ধশিক্ষিত এক একটি তথাকথিত লিডার, সে ও তোতাপাখির মতো সরকারি ‘হেন্ড আউট’ মুখস্থ করে এসে ইলেকশন মিটিঙে বক্তৃতা দেয়… জনগণ, ১৯৪৭ সনে আমাদের জনপ্রতি আয় ছিল মাসে সাত টাকা মাত্র; আজ জাতীয় সরকারের প্রাণপণ চেষ্টার ফলে জন প্রতি আয় মাসে ২৫ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে; চতুর্থ পরিকল্পনার শেষে তার ৪০ টাকায় বৃদ্ধি পাবে। জনগণের অবস্থার যে উন্নতি হয়েছে এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী লাগে?’ ভণ্ড বদমাশের দল! দরিদ্রের অন্ন বস্ত্র হরণ করে কেবল সংখ্যার ভোজবাজি দেখিয়ে ওরা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। ওরা মানুষ চেনে না, চেনে কেবল সংখ্যা।

উঠে আসা সূর্যের রোদের উত্তাপ এবং যুবক দুজনের কথার উত্তাপ দুটো মিলে শীতের জড়তা একেবারে দূর করে দিল। আমার বেশ ভালোই লাগছিল। ভাবোচ্ছাসে লাল হয়ে ওঠা যুবক মানুষের মুখের দিকে তাকাতে কার না ভালো লাগে? অন্যের না হলেও এটা অন্তত নিজেকে বিজ্ঞতর বলে ভাবার সুযোগ দান করে। আহা বেচারারা! তোমাদের বয়সে আমিও একদিন বিপ্লব করার স্বপ্ন দেখেছিলাম। সমগ্র পৃথিবীটা ভেঙেচুরে চুরমার করে নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। ধনী এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তি মাত্রই আমাদের চোখে একদিন ছিল কেবল ভণ্ড এবং বদমাশ। তবে আজকাল আমরা সেভাবে ভাবি না। পৃথিবীটা নতুন করে গড়ার স্পর্ধাও আমাদের আর নেই। A sadder and a wiser man. এখন আমি অন্তত ছেলেদের জন্য এক টুকরো জমি কিনে একটা ঘর কোনওভাবে তৈরি করে দেওয়ার চিন্তায় অহরহ ব্যস্ত থাকি। তোমাদেরও সেই দিন খুব শীঘ্রই আসতে চলেছে বাবারা, কারণ প্রত্যেকেই জীবন আরম্ভ করে তোমাদের মতো শ্যেন হয়ে, শেষ করে আমাদের মতো পেঁচা হয়ে।

যুবকটির বক্তৃতা শেষ হতে দেখে পঞ্চায়েত সভাপতি আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল— এতক্ষণ বসলাম, এক কাপ চা খাওয়াবে না? খালি চা কিন্তু খেতে পারব না, সঙ্গে টায়ের ব্যবস্থাও করুন।

সভাপতির কথা শুনে মনে মনে একটু লজ্জাই পেলাম। অনেক আগেই ব্যবস্থা করা উচিত ছিল আমার। মানুষগুলোকে যত তাড়াতাড়ি পারি তাড়াব বলেই ইচ্ছা করে চায়ের প্রসঙ্গ উঠাইনি। কিন্তু এখন আর উপায় নেই, রাঁধুনি ছেলেটাকে ডেকে চা জলখাবারের হুকুম দিতে বাধ্য হলাম।

উঠবার সময় হয়েছে বলে ভেবে বোধহয় আমার যুবক বন্ধু দুজন নীরব হয়ে পড়েছিল, কিন্তু এখন চায়ের প্রস্তাব শুনে আরও একটা বক্তৃতার জন্য তাদের প্রস্তুত হতে দেখা গেল। সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়ে প্রথম যুবকটি বলে উঠল— এই বরা ঠিকই বলেছে। শোষক পুঁজিপতি এবং তাদের ক্রীতদাস এই সরকারের চোখে মানুষের কোনও মূল্য নেই। না হলে লক্ষ লক্ষ মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে তিলে তিলে মরতে দেখেও ওরা নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতে পারে কি? একটা চোরাকারবারি, একটা মুনাফাখোর, একটা গোপন মজুতদারকেও ওরা জেলে পাঠাতে পারে না কি? ঠিক একই সুরে যুবকের বক্তৃতা চলতে থাকল। পঞ্চায়েত সভাপতি এবং গ্রামের নেতাটি এরকম একটি অপরাধী মুখভঙ্গি করে মাথা নিচু করে রইল— যেন এই সমস্ত অগ্নিগর্ভ সমালোচনার লক্ষ‍্য  তারা দুজনেই। অবশ্য আমার সন্দেহ হল— এই অপরাধ বোধের সঙ্গে যেন মিশ্রিত হয়ে আছে কিছু গর্ব কিছু আত্মপ্রসাদের ভাব— কারণ দেশের সমস্ত ক্ষুদ্র বঞ্চিত মানুষের অক্ষম ক্রোধের লক্ষ্য শাসক দলের যারা তারাও জানে যে অনেক সময়ে প্রিয়পাত্র বা প্রশংসিত হওয়ার চেয়ে ঈর্ষিত হওয়ার তৃপ্তি বেশি।

যাইহোক তখনই চা এল। সঙ্গে একটা করে সিদ্ধ ডিম। রোদে বসে বসে সবারই বোধহয় তৃষ্ণা পেয়েছিল, প্রত্যেকেই পরম আগ্রহে চায়ের কাপে মুখ দিল।

কিছুক্ষণ কারও  মুখে কথাবার্তা নেই, সবার দৃষ্টিও হাতের চায়ের কাপ এবং ডিমে নিবদ্ধ। হঠাৎ কানের কাছে ‘বাবা গো’ বলে একটা কাতর স্বর শুনে আমরা প্রত্যেকেই প্রায় চমকে উঠলাম। ঘুরে তাকিয়ে দেখি তিনটি শিশুর সঙ্গে একজন ভিখারিনি।

আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কাতর এবং অস্ফুট কণ্ঠে সে বলে উঠল— এক মুঠো ভিক্ষা, বাবা…

পঞ্চায়েত সভাপতি একবার তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে হাতের অর্ধেক খাওয়া ডিমটা মুখে ভরে দিল। ডিমটা কিছুক্ষণ চিবিয়ে কথা বলতে পারার মতো অবস্থায় এসে সে বলে উঠল— এই, এই মহিলার সাহস তো কম নয়। একেবারে এখানে চলে এসেছে। যা যা কথা বলার সময় একেবারে দিগদারি করবি না। পকেট থেকে পাঁচ পয়সা বের করে তার দিকে মাটিতে ছুড়ে দিয়ে সে পুনরায় চায়ের কাপে মুখ দিল।

গ্রামের নেতাটি (দুঃখের বিষয় আমি তার নাম জানি না) জিহ্বার সামনে ঠোঁটে লেগে থাকা ডিমের কিছুটা কুসুম চেটে নিয়ে প্রশ্ন করল— কোথাকার মহিলা এটি? আপনি জানেন নাকি?

–কেন, আপনি চিনতে পারছেন না? পঞ্চায়েত সভাপতি কিছুটা বিরক্তির সঙ্গে উত্তর দিল— পশুমারার মহেন্দ্র মোড়লের বাড়ির পাশে সেই যে বাঙালি পরিবারের ঘরটা, স্বামীর নাম বোধহয় কানাই— একে সেই অঞ্চলের কে না জানে। তারপর কণ্ঠস্বর নিচু করে চোখ মুখের অদ্ভুত ভঙ্গিতেই সে ঘোষণা করল— প্রস!

সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণ কৌতূহলহীন এবং নির্বিকার হয়ে থাকা তিন জোড়া চোখের দৃষ্টি ভিখারিনির দিকে ধাবিত হল। ভিখারিনি বা জননী হিসেবে যার কোনও মূল্য ছিল না, প্রস(!) হিসেবে সেই বিষয়ে সে একটা আকর্ষণের বস্তু হয়ে পড়ল।

সুলভ নারীদেহের প্রতি স্বভাবসুলভ কৌতূহলের জন্যই বোধহয় গ্রামের নেতাটি ভিখারিনির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে এ কথাও বোধহয় তার মনে খেলল যে তার মতো বয়স্ক নেতা একজনের পক্ষে এই ধরনের কৌতূহল অশোভনীয়। কৃত্রিম ঘৃণায় মুখটা বিকৃত করে সে বিড়বিড় করে বলে উঠল— ছি ছি সকাল-সকাল কী দেখলাম। এই বাংলাদেশই আমাদের গ্রামীণ সমাজটা নষ্ট করতে আরম্ভ করেছে।

যুবক কর্মচারী দুজনের বোধহয় সেরকম কোনও নৈতিক আনুগত্য বা দায়িত্ব নেই। নিবিড় কৌতূহলে তারা কিছুক্ষণ মহিলাটিকে লক্ষ‍ করল। কিছুক্ষণ পরে হতাশ মুখভঙ্গি করে অনুচ্চ কণ্ঠে একজন বলে উঠল— ভ্যাট, এরকম একটি মহিলার কাছে যে কোনও মানুষ যেতে পারে আমি সে কথা কল্পনাও করতে পারি না। শরীরে কেবল হাড় এবং চামড়া। আর কী নোংরা!— অকৃত্রিম ঘৃণায় নিজে থেকে তার নাকটা কুঁচকে গেল।

ভিখারিনির সম্পর্কে এই ধরনের বিভিন্ন মন্তব্য এবং প্রতিক্রিয়া চলতে থাকার মাঝে সে মাটি থেকে পয়সাটা কুড়িয়ে নিয়ে হাত দুটি জোর করে পুনরায় বলল— বাবা একটা কথা…

আমার বন্ধুদের তার কথা শোনার মত সময় নেই। তারা তখন তাকে পরীক্ষা করায় এবং তার বিষয়ে নিজের নিজের মন্তব্য দেওয়ায় ব্যস্ত।

আমি যেহেতু তার কোনওটাই করিনি, আমি মনোযোগের সঙ্গে তাকে লক্ষ করলাম। মহিলাটি যথেষ্ট কালো এবং ক্ষীণ, কিন্তু মুখে একটি প্রচ্ছন্ন লাবণ্যের আভাস আছে— যার জন্য তাকে বোধহয় প্রস আখ‍্যা পেতে হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ভিখারিনি সুন্দরী হওয়া একটি অপরাধ, সে যে কেউ হোক না কেন। তার বয়স ২৪-২৫-এর বেশি হবে না বলেই মনে হয় কিন্তু দুঃখ-কষ্ট অকালে তাকে বার্ধক‍্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অত্যন্ত নোংরা কালো একটি শাড়ি ছাড়া তার শরীরে দ্বিতীয় কোনও কাপড় নেই। তারই আঁচল দিয়ে প্রায় এক বছরের উলঙ্গ শিশু একটাকে সেই পুঁটলিতে বেঁধে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। বাকি দুটি ছেলে, একটি প্রায় পাঁচ বছরের, অন্যটি তিন বছরের— মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়া একই দৃষ্টিতে আমার প্লেটের ডিমটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওদের পরনে কোনওদিন জলের মুখ না দেখা শতচ্ছিন্ন দুটি গেঞ্জির বাইরে আর কিছু নেই। পহুমরা থেকে ভিক্ষা করে আসতে  আসতে এখানে এসে পৌঁছেছে যখন ওদের নিশ্চয় খুব সকালে বাড়ি থেকে বের হতে হয়েছে। আর ডিসেম্বর মাসের এই হাড় কাঁপানো শীতে ছোট্ট শিশুদের শরীরে মাত্র দুটি শতচ্ছিন্ন গেঞ্জি, তাও নিশ্চয় ভিক্ষা করে পেয়েছে।

দৃশ্যটির দিকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগল না। নিজের অজান্তেই আমার মুখ থেকে একটা ধমক বেরিয়ে এল। এই পয়সা পেয়েছিস, এখান থেকে যাচ্ছিস না কেন? যা যা— ভাগ।

–বাবা একটা কথা…

পঞ্চায়েত সভাপতির এবার বোধহয় ধৈর্যচ‍্যুতি ঘটল। আমাদের পর্যন্ত চমকে দিয়ে একটা মস্ত ধমক দিয়ে সে চিৎকার করে উঠল— কী একটা কথা, একটা কথা বলে তখন থেকে ঘ‍্যানঘ‍্যান করছিস। তোকে যেতে বলছি না। পয়সা পেয়েছিস, চলে যাওয়া উচিত। তোর আর কী কথা থাকতে পারে?

চেয়ারটা আরও একটু ঘুরিয়ে নিয়ে তার দিকে সম্পূর্ণ পিঠ দিয়ে সে একটা সিগারেট জ্বালাল। তার মুখের ভাব দেখে বোঝা গেল মহিলাটি যাক বা না যাক, অন্তত তার কাছে মহিলাটির কোনও অস্তিত্ব নেই। সেকথা সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সে একজন সরকারি কর্মচারীকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল— আচ্ছা বরা, আপনি আমাদের সেই মাল্টিপারপাস ফার্মের স্কিমের বিষয়টি কী করলেন? ওটা তাড়াতাড়ি শেষ করা উচিত ছিল। জানুয়ারির ভেতরে স্কিমটা দিতে না পারলে এই বছর টাকা পাওয়াটা মুশকিল হয়ে যাবে।

উত্তরে বরা কীসব অনেক কথা বলল, মাঝখানে অন্য একজন কর্মচারী এবং গ্রামের নেতাটিও আলোচনায় অংশগ্রহণ করল। পঞ্চায়েত সভাপতি পুনরায় দুই একটি প্রশ্ন করল— মোটামুটি অনেক সময় ধরে দেশের কৃষিবিপ্লবের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা চলতে থাকল। আমিও মাঝে মধ্যে মাথা নেড়ে এবং হু হা করে তাদের কথা শোনার ভান করতে বাধ্য হলাম। কিন্তু আসলে তাদের একটা কথাও আমার কানের ভেতর ঢুকল না। ভিখারিনির ‘একটা কথা’টা কী তা শোনার জন্য তার দিকে না তাকিয়ে আমি উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। কারণ পঞ্চায়েত সভাপতির গর্জনের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে মহিলাটি তখনও একজায়গায় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবং বার বার বলতে চেয়েও বলতে না পারা তার ‘একটা কথা’র অপ্রকাশের যন্ত্রণায় তার ঠোঁট দুটি বারবার কেঁপে উঠছিল। তার এই একটি কথা শোনার জন্য কতজনের কাছে সে এভাবে হাতজোড় করে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ঠিক এভাবেই কাউকে শোনাতে না পেরে কতদিন বোধহয় সে সেই অপ্রকাশের বেদনার ভার নীরবে বহন করে ফিরেছে সে কথা কল্পনা করে আমি কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে রইলাম।

অনেকক্ষণ পরে তার মুখের একটিও কথা না শুনে আমি এবার আড়চোখে তার দিকে তাকালাম। ঠিক সেই মুহূর্তটির জন্যই সে যেন এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। আমার চোখে চোখ পড়ামাত্র সে বলতে আরম্ভ করল— বাবা, আপনারা আমার কথা না শুনলে কে শুনবে? আমি তো চিরদিন এরকম ভিখারিনি ছিলাম না। আমাদের নিজেদের ক্ষেত ছিল বাবা। ক্ষেতে কাজ করে ঘরের ভাত দিনে একবার হলেও খেতে পেতাম। কিন্তু…

ভিখারিনিটিকে এই কথা বলতে শুনে আমার বন্ধুবর্গের আলোচনা কিন্তু বন্ধ হয়নি। তারা তখন পরম উৎসাহের সঙ্গে বহুমুখী কৃষিফার্মের খুঁটিনাটি আলোচনা করাতে ব্যস্ত। এরকম একটি জরুরি আলোচনার মধ্যে তার কাকুতিমিনতি আরম্ভ করে দেওয়ার জন্য বন্ধুদের খুব রাগ হল। প্রত্যেকেই প্রায় একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল— এই চুপ করে থাকিস না কেন? শুনছিস না আমরা একটা জরুরি জনগণের বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি? তারা পুনরায় নিজেদের আলোচনায় মগ্ন হল।

প্রত্যেকের কাছ থেকে আচম্বিতে এরকম একটি ধমক খেয়ে মহিলাটি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইল। তখনই হঠাৎ বোধহয় সে আমার চোখে নীরব সহানুভূতি এবং আগ্রহের কণিকার আভাস দেখতে পেল। এবার সে কেবল আমাকে উদ্দেশ্য করে আগের চেয়ে নিম্নকণ্ঠে বলতে লাগল— বাবা, বিশ্বাস করুন, আমরা সব সময় ভিক্ষা করে খেতাম না। আজ এক বছর চার মাস হয়েছে, এদের বাবার একদিন মাঠে হাল বাইবার সময়ে পায়ে একটা সূঁচোলো বাঁশ  ঢুকে গিয়েছিল। বাঁশটা তখনই টান মেরে বের করে মানুষটা কোনওমতে বাড়িতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত বিছানায় পড়ে আছে। আজ এক বছর চার মাস হল। যতই নিম্নকণ্ঠে বলুক না কেন মহিলাটির কথা আমার বন্ধুদের আলোচনায় নিশ্চয় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল। বরা নামের যুবকটি মাঝখানে একবার কথা বন্ধ করে বাঘের দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকাল। দেশের কোটি কোটি দরিদ্র জনসাধারণের জন্য একটা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করার সময় সামান্য একজন ভিখারিনির এই ধরনের বিরক্তিকর কাজ সত্যি অসহ্য।

পায়ে একটা বাঁশ ঢোকার জন্য আজ এক বছর চার  মাস মানুষটাকে কেন বিছানায় পড়ে থাকতে হল— আমি চোখের দৃষ্টিতে মহিলাকে প্রশ্ন করলাম।

মহিলা আবার বলতে শুরু করল— বাবা, বাঁশটা  বের করার পর অনেক রক্তপাত হল, ঘা শুকোবার জন্য গ্রামের চিকিৎসক বনৌষধ বেঁধে দিলেন। আশেপাশে তো ডাক্তারখানা নেই বাবা, ডাক্তারি ঔষধ আর কোথায় পাব? কিন্তু ঘাগুলি শুকোনো তো দূরের কথা, দিন দিন বেড়ে যেতে লাগল। কাজের জন্য মাঠে যাওয়া দূরের কথা, পায়খানা প্রস্রাব করার জন্যও মানুষটা বিছানা থেকে উঠতে পারল না। ঘা-টা বাড়তে বাড়তে সমস্ত পা-টা গলে পচে গেল, দুটো আঙুল ইতিমধ্যে খসে গেছে। মানুষটা আস্তে আস্তে পচে মরতে শুরু করেছে বাবা, আপনি যদি দেখতেন…।

হঠাৎ একটা অদম্য কান্নায় মহিলাটির কথা বন্ধ হয়ে গেল। দুটি হাতে মুখটা চেপে ধরে কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করায় তার সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল।

শুনব না বলেও আমার বন্ধু কয়েকজন বোধহয় তার দুটি একটি কথা শুনতে বাধ্য হয়েছিল। যুবক কর্মচারী একজন  চট করে উত্তর দিল— এই তোর স্বামীর গ্যাংগ্রিন হয়েছে। ডাক্তার দেখিয়ে ভালোভাবে চিকিৎসা কর, আমাদের সামনে এভাবে প্যাকপ্যাক করতে থাকলে কোনও লাভ হবে না।

–সেই জন্যই ওর ওপরে আমার রাগ হয়— পঞ্চায়েত সভাপতি বলে ওঠে— স্বামীর অসুখ করেছে। চিকিৎসা কর, তা না করে ঘরে ঘরে অসুখের কথা বলে বেড়ালেই বা ডাক্তারের বদনাম করে বেড়ালেই তোর স্বামী ভালো হয়ে যাবে নাকি? এর মধ্যে অনেক কথা আছে, আমি একদিন বলব।… আপনিও বেশ ভালো মশাই, শুরু থেকেই ওর প্যানপ্যানানি শুনে আসছেন। তাড়িয়ে দিন ওকে।… আপনি কী বলছিলেন বরা আলুর বিষয়ে?

স্থির অশ্রুসজল দৃষ্টিতে মহিলাটি আমার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারেনি তার চোখে-মুখে এরকম একটি বিস্ময়কর ভাব ফুটে উঠল। ততক্ষণে আমার বন্ধু কয়েকজন বিষয়ান্তরে গমন করেছে। সামাজিক প্রগতির বিষয়ে আলোচনারত আমার বন্ধু কয়েকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মহিলাটি বোধহয় অবশেষে সিদ্ধান্ত করল যে তারা নিশ্চয় মানুষ নয়। অন্তত তার দৃষ্টিতে। বিদ্যুৎ-চমকের মতো একটা আতঙ্কের ভাব তার উপর দিয়ে ঢেউ খেলে যেতে আমি দেখতে পেলাম।

পুনরায় তাঁর দৃষ্টি আমার মুখের দিকে ফিরে এল। আমি মনে মনে বড় অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলাম। প্রত্যেকের মধ্যে সে বোধহয় আমাকেই অত্যন্ত দুর্বল বলে বুঝতে পেরেছে। তাছাড়া আমার বন্ধু কয়েকজন যে সময়ে সমগ্র সমাজের ভবিষ্যতের চিন্তায় নিমগ্ন সেই সময়ে আমার একজন মাত্র মহিলার দুঃখ-কষ্টের বিষয়ে এত ভাবপ্রবণ হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমার অস্বস্তির দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সে পুনরায় বলতে শুরু করল— বাবা ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। একবার দুবার নয় অনেকবার। আমাদের গ্রাম থেকে ডাক্তারখানা সাত মাইল। ডাক্তার কুড়ি টাকা ফিজ চায়। কুড়িটা টাকা আমি মেয়েমানুষ কোথা থেকে পাব? কিছু একটা বিক্রি করে বা বন্ধক রেখে টাকা আনার মতো ঘরে কোনও জিনিস নেই। তাছাড়া প্রথম অবস্থায় এত টাকা খরচ করে ডাক্তার আনার কথা বেশি চিন্তা করলাম না। কারণ গ্রামের মানুষেরা বলল গ্রামের ডাক্তারের ঔষধে ঘা শুকিয়ে যাবে। সেই আশায় বসে থাকতে গিয়ে দিন-দিন ঘা বেশি করে বেড়ে যেতে লাগল। মাঠের জমি আধা চাষ হয়ে মাঠেই পড়ে রইল। বাড়িতে যে কয়েক মুঠো ছিল তা বসে বসে খেয়ে শেষ করলাম। তারপরে আমি ভিক্ষা করতে বের হলাম। আমরা বাইরে থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি মানুষ বাবা, এখানে কোনও আত্মীয়-স্বজন নেই, কে আমাদের দেখবে? মানুষটার পা-টা যখন বেশি করে গলে পচে যেতে লাগল পুনরায় একদিন ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তারের সেই একই কথা, টাকা না পেলে তিনি আসতে পারবেন না। আসবে তো না-ই, আমার কথাটা শোনার মতোও সময় নাই। সংসারে আমার মতো কত গরিব দুঃখী আছে। প্রত্যেকের কথা শুনতে হলে তাকে ডাক্তারি করা ছাড়তে হবে। কী আর করব বাবা। পুনরায় গ্রামে গ্রামে চিকিৎসকের ঔষধের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কোলের শিশুটিকে নিয়ে, এই দুটিকে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে চামগুরি সত্র পর্যন্ত পায়ে হেঁটে ঔষধের খোঁজে গিয়েছি বাবা— বাড়ি থেকে ১৪  মাইল। কিন্তু যতই ঔষধ দিতে লাগলাম ততই ঘা বেশি করে বাড়তে লাগল। দিনরাত শরীরে জ্বর। এভাবেই আজ এক বছর চার মাস হয়েছে। দুটো আঙুল ইতিমধ্যে খসে পড়ে গেছে। পা-টা একদিক থেকে গলে পচে গেছে। এভাবে থাকতে হলে চোখের সামনে মানুষটা গলে পচে একদিক থেকে খসে যাবে। আমি কীভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব বাবা। হঠাৎ এমন একটি অমানুষিক অর্ধস্ফুট শব্দ করে মহিলাটি কেঁদে উঠল যে আমার বন্ধু কয়েকজন ভূতের কণ্ঠ শোনার মতো চমকে উঠল— এখন মানুষ বলছে এটা ইঁদুরের অসুখ। ডাক্তারের কাছে গিয়ে তাকে বললাম আর পায়ে ধরে কাকুতি-মিনতি করলাম মানুষটাকে একবার এসে দেখার জন্য। তিনি বললেন কী অসুখ হয়েছে, তিনি না দেখেই বুঝতে পেরেছেন। পা দুটি কেটে ফেলতে হবে। সেই কাজ তিনি এখানে করতে পারবেন না। যোরহাট নিয়ে যেতে হবে। যোরহাটে আমি কীভাবে নিয়ে যাব বাবা? মানুষটা পায়ে হাঁটা তো দূরের কথা, দাঁড়াতে পারে না। একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে। ১০০ টাকার কমে গাড়ি কোথায় পাব? এখান থেকে কত জিপ, লরি শহরে যাতায়াত করে, ইচ্ছে করলেই যে কোনও একটি মানুষটাকে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সে কথা বলব বলে মুখ খুলতেই গাড়ির মানুষগুলি এক ধমকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। বাবা, আপনি বড় মানুষ, কিছু একটা করে আপনি আমাকে রক্ষা করুন বাবা, এই কথাগুলোই আজ পর্যন্ত কাউকে শোনাতে পারলাম না। আপনি আজ শুনলেন। আমি মরে গেছি বাবা, আর আমার শক্তি নেই। পাঁচটি ছেলেমেয়ের সঙ্গে, খাওয়ার মানুষ সাতজন। এই সাতজনের মুখে কেবল নুন-ভাত তুলে দেওয়ার জন্য কোলে শিশু নিয়ে আমাকে দিনে দশ-বারো মাইল পথ ভিক্ষা করে বেড়াতে হয়। এত কষ্ট করেও রাতের বেলা এক মুহূর্ত শান্তিতে শুতে পারি না, কানের কাছে মানুষটা যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে। আপনি নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করবেন না বাবা, বুক কাঁপানো কী বিকট সেই চিৎকার। শুনতে শুনতে আমি পাগল হয়ে যাই, মাঝেমধ্যে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সবাই একসঙ্গে পুড়ে মরব বলে ভাবি। আজ পর্যন্ত তা করতে পারিনি। কিছু একটা উপায় করে আমাকে রক্ষা করুন বাবা। মানুষটা ভালো হলেই আমার আর চিন্তা নেই। যেভাবেই হোক সে আমার এক মুঠো খাবার জোগাড় করবে।

হঠাৎ মানুষটি নীরব হয়ে গেল। আমি তার দিকে মাথা তুলে তাকালাম। আমি যেন তার একমাত্র এবং শেষ ভরসা। এই ধরনের একটা একান্ত  নির্ভরতার সঙ্গে  সে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি বেশিক্ষণ তার সেই দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে চোখদুটি বুজে নিলাম এবং তার সমস্যাটা ভাবতে শুরু করলাম। নিজের অজ্ঞতার জন্য বেচারি মহিলাটি ভেবেছে যে টাকা একশো পেলেই গাড়িতে তুলে সে মানুষটাকে যোরহাটে নিয়ে যেতে পারবে, এবং একবার সেখানে গিয়ে পৌঁছালেই সমস্ত ঠিক হয়ে যাবে। হাসপাতালে সিট পাওয়ার কী সমস্যা, তার জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে, সিট পেলে পাঁচটা ছেলেমেয়ে এবং গলিত দেহের বেমারি মানুষটাকে নিয়ে সে কোথায় থাকবে, এই সমস্ত কথার বিষয়ে বেচারির কোনও ধারণাই নেই। হাসপাতালে সিট যে কখনও পাবে তারই  কী নিশ্চয়তা আছে। হাসপাতালগুলিতে তো আজকাল ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী’র অবস্থা। আমি যতই তার সমস্যার কথা ভাবতে লাগলাম ততই চারপাশে নৈরাশ্য দেখতে পেলাম নির্ভুল স্পষ্টভাবে। যে সম্ভাবনা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেটা হল এই যে আমাদের তথাকথিত জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে এই মহিলার স্বামীর মতো মানুষ আহত পশুর মতো চিৎকার করে করে তিলে তিলে পচে মরার বাইরে আর কোনও উপায় নেই।

ভাবলে অবাক লাগে কত সামান্য ব‍্যয়  এবং চেষ্টায় একটি সংসারের পক্ষে মর্মন্তুদ এই নির্মম ট্রাজেডি সংঘটিত না হতে দিয়ে বন্ধ করা যেত।

হঠাৎ আমি একটা অস্বস্তিকর নীরবতা অনুভব করে চোখ মেলে চারপাশের তাকালাম। আমার বন্ধু কয়েকজন আশ্চর্য বস্তু দেখার মতো অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই পঞ্চায়েত সভাপতি জিজ্ঞেস করল— কী হল গোঁহাই, মাথা ঘুরছে নাকি?

আমার তখনই চেতনা হল যে নিজের অজান্তেই আমি বোধহয় এরকম মুখভঙ্গি করে আছি যে বন্ধুরা আমার মাথা ব্যথা করছে বলে ভাবছে। আমার মনের প্রকৃত অবস্থা গোপন করার জন্য আমিও ধীরে ধীরে বললাম— মাথাটা একটু ব্যথা করছে বলে মনে হচ্ছে।

–ইস তা বলছেন না কেন? তারা বসা থেকে প্রায় উঠে দাঁড়াল— আমাদের কথা শুনে শুনে আপনার মাথা ব্যথা করছে বোধহয়। আপনি বরং কিছুক্ষণ বিছানায় গিয়ে বিশ্রাম নিন।
–কিছুক্ষণ বসুন সভাপতি— আমার মনে হঠাৎ একটা কথা খেলে গেল— আপনার পঞ্চায়েতের পুঁজি থেকে নিঃসম্বল অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা রয়েছে। এই মহিলাটিকে ৫০টা টাকা আপনি দিতে পারেন না কি?

প্রত্যেকেই পুনরায় বসে পড়ল। পঞ্চায়েত সভাপতি একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকাল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল— এই মহিলা আপনাকে বেশ ভালোই ভুলিয়েছি  দেখছি। তার কথা আপনি কেন বিশ্বাস করেছেন? তার অনেক উপার্জন, আমি জানি, তাছাড়া তার নাইবা রইল এক পয়সা উপার্জন। পঞ্চায়েতের পুঁজি থেকে তাকে কীভাবে টাকা দেব? এবার আমরা প্রত্যেকেই টাকা উৎপাদন পরিকল্পনায় নিয়োগ করব বলে ঠিক করেছি। অন্য কাজে খরচ করার মতো অতিরিক্ত পয়সা নেই।

অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং অভিজ্ঞ মানুষের মতো মুখে হাসি ফুটিয়ে বরা বলে উঠল— তাছাড়া এভাবে সাহায্য করে লাভ নেই। অন প্রিন্সিপল আমি কখনও ভিখারিদের ভিক্ষা দিই না। ভিখারি দেখলেই আমার স্কুলের দিনে দেখা একটি বাংলা সিনেমার কথা মনে পড়ে যায়। ‘উদয়ের পথে’ দেখেছেন বোধহয়। তাতে একটি কথা আছে: ভিক্ষা দিয়ে কেবল দারিদ্র্যকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, দরিদ্রকে নয়। অত্যন্ত খাঁটি কথা। দরিদ্রের প্রতি সস্তা সেন্টিমেন্ট দেখিয়ে বা দুটি পয়সা ছুড়ে দিয়ে আপনি ওদের কোনও উপকার করতে পারবেন না। আসল প্রয়োজন হল এক বিরাট সামাজিক বিপ্লবের। তাছাড়া…

বরার বক্তৃতা কখন শেষ হল, কখন তারা আমাকে বলে উঠে গেল আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল জরাজীর্ণ একটা ঝুপড়ি ঘর এবং তাতে শুয়ে শুয়ে অহরহ চিৎকার করতে থাকা একটি গলিতাঙ্গ মানুষ। সামান্য সহানুভূতি এবং ১০০ টাকা খরচ করলে সে আজকেই নতুন জীবন যাপন আরম্ভ করতে পারে, কিন্তু তা করার মতো কারও সময় বা ইচ্ছা নেই। কারণ সরকারি কর্মচারী পঞ্চায়েত সভাপতি এবং গ্রামের নেতারা ব্যস্ত তার ভবিষ্যতের চিন্তা করায়। সে কেবলমাত্র একটি মানুষ নয়, সে ভারতবর্ষের চিরকালের সেই দরিদ্র জনসাধারণ। একদিক থেকে সে পচে মরতে শুরু করেছে, আর নেতা-মন্ত্রীরা তার জন্য রচনা করছে সমাজবাদী পরিকল্পনা। সে কোনওদিন মানুষ ছিল না, আজও সে মানুষ নয়; ভারতবর্ষের দার্শনিকের জন্য সে চিরকাল একটা নির্লিপ্ত চিন্তার বিষয়।

মহিলাটিকে কী বলে বিদায় করি তাই মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম। একদিক থেকে গলে গলে খসে পড়া দেহটার সঙ্গে তার স্বামী তার কাছে নির্লিপ্ত চিন্তার বিষয় নয়, সে একটা জীবন্ত বাস্তব। দেশনেতারা তাকে দেখেনি, তাই ধীরেসুস্থে, নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে তারা তার ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করতে পারে। সভাপতি বা গ্রামের নেতা তাকে দেখার কোনও আগ্রহ অনুভব করছে না, কারণ কয়েক হাজার বছর ধরে সে এভাবেই আছে, তার মধ্যে কোনও কিছুই নতুনত্ব নেই। কিন্তু এই মহিলা তিনটি শিশুর সঙ্গে অভুক্ত দেহটি নিয়ে  ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে এই দুপুর বেলা সাত মাইল রাস্তা অতিক্রম করে বাড়ি গিয়ে যখন দেখবে যে তার অভ্যর্থনার জন্য ঘরে রয়েছে মাত্র স্বামীর যন্ত্রণাকাতর আর্তচিৎকার, মনু পরাশরের প্রতিশ্রুতি পরজন্মের স্বর্গীয় সুখ বা দেশের মাথাদের পঞ্চম ফাইভ ইয়ার প্লান-এর সাফল্য তাকে সান্ত্বনা দিতে পারবে কি? কী আশার বাণী নিয়ে আমি এই মুহূর্তে তাকে সেই নরককুণ্ডে ফিরে পাঠাব? ভাবতে ভাবতে আমি কিছুই ঠিক করতে পারছি না। সূর্য মাথার উপরে এসে গেছে, প্রত্যেকেরই দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু মহিলাটির সামনে এখনও পড়ে আছে বাড়ি ফিরে যাওয়ার দীর্ঘ পথ, অনেকের দরজায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা। ক্ষুধা ভুলে, ঠিক এই মুহূর্তে সে অপেক্ষা করছে কেবল আমার উত্তরের জন্য। কিন্তু আমি ভেবে কিছুই বের করতে পারছি না। কারণ এটা একটি বড় প্রশ্ন। আমাদের যুগের সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাকে আমি কী উত্তর দেব তার উপরে নির্ভর করছে আমাদের যুগের ইতিহাসের গতিধারা, সভ্যতার ভবিষ্যৎ। প্রিয় পাঠক, আমি একা কিছুই ভেবে বের করতে পারছি না, আপনিও কথাটা চিন্তা করুন এবং আমাকে সাহায্য করুন। মনে রাখবেন, এই মহিলার স্বামীর ঘা-টা  গলে এসেছে, পেশির মাংসগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে ছেড়ে দিয়েছে। আগামী ইলেকশনে উপযুক্ত লোক বা পার্টিকে ভোট দিয়ে তার চিকিৎসার জন্য টাকা মঞ্জুর করাব বলে মিথ্যা আশা দেবেন না। মনে রাখবেন যার দেহ পচে গলে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সেই জানে অপেক্ষা করার যন্ত্রণা কত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...