ছায়াপাখি, নীল হ্রদের তীরে — পর্ব ৪ (প্রথমাংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

Wren House

বর্ডারের অ্যান আরবার অফিসে জয়েন করেছে সবে দিন পনেরো। হীরকের জীবনের দ্বিতীয় চাকরি। প্রথমটার থেকে একদমই আলাদা। হিন্দমোটরে ফ্যাক্টরির আবহাওয়া ছিল অন্যরকম। বর্ডারের সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে বরং ইউনিভার্সিটির চেহারা খাপ খায় বেশি। মন্দ লাগছে না। তবে নতুন জায়গায় ধাতস্থ হতে কদিন সময় লাগবে। এখনও সবার সঙ্গে সেরকম আলাপ জমেনি।

লাঞ্চের সময় হীরক খাবারের কৌটো খুলেছিল।

–আমি তোমার সঙ্গে বসতে পারি?

হীরক মাথা নীচু করে পরোটা আর চিকেন খাচ্ছিল। চোখ তুলে দেখল পাবলো। সাদা কালো চুল, মুখের ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ধবধবে সাদা। পাঁউরুটিরঙা মুখে অসংখ্য ভাঁজ, দাড়িতে ঢাকা না থাকলে মুখটা আরও চিমড়ানো লাগত। উপরের বোতাম খোলা জামার ফাঁক দিয়ে গলা পর্যন্ত উল্কির বিন্যাস চোখ এড়ায়নি। চেহারায় ছোটখাট হলেও একটা ক্যারাকটার আছে। বহু ঘাটের পোড়খাওয়া লোক। সারাজীবন এসি অফিসে বসলে এমন রাগেড হয় না। বয়েসও অনেকটা। প্রথম দিন ডিপার্টমেন্টের অনেকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পাবলোর নামটা মনে গেঁথে গেছিল। কিন্তু সকালে ঢোকার মুখে একবার হাই বলা ছাড়া এখনও তেমন কথা হয়নি।

–Sure Pablo.

পাবলো চেয়ার টেনে বসে নিজের খাবার রাখল। স্যালাড আর রাইয়ের ব্রেড।

–আমার খাবার ট্রাই করবে নাকি? নিজের বাটার চিকেনের টুকরোতে পরোটা গুঁজে বলল হীরক।
–Looks tantalizing! কিন্তু আজ থাক, আর এক দিন। তোমাদের ইন্ডিয়ান খাবার খুব মশলাদার হবে। আমাকে আগে থেকে প্ল্যান করতে হবে। গলা তুলে হাসল পাবলো। বিভিন্ন কালচার নিয়ে আমার খুব ইন্টারেস্ট। কিন্তু আমার স্টমাক খুব হিসেবি, নিয়মের বাইরে কিছু খেলে আগে থেকে বখশিশ দিয়ে রাখতে হয়। কম খাই আজকাল।

খেতে না চাইলেও লোকটা খুব মিশুকে। সেটা এই কদিনেই লক্ষ করেছে হীরক। সবার সঙ্গে খোশগল্প। বারবারা বলে এক মহিলা যাচ্ছিলেন। তাকেও হাঁক পাড়ল পাবলো। বার্ব, এই টেবিলে এসে বসো। আমাদের নতুন বন্ধু আছে এখানে। হিরো। তারপরেই হীরকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল, তোমার হিরো নামে কোনও আপত্তি নেই তো?

বারবারা পঞ্চাশোর্ধ্ব। বেশ মোটাসোটা চেহারা। সাজগোজ করতে ভালোবাসে। গলায় নিত্যনতুন বড় বড় মালা। কানে গোল্লামার্কা রিং। সুন্দর করে আঁকা ভুরু। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। জামাকাপড়ও খুব উজ্জ্বল রঙের। আজকেও লাল টপের উপর একটা কালো জ্যাকেট, সঙ্গে সরু লাল স্ট্রাইপ দেওয়া কালো স্কার্ট। এখানে সবার বাদামী, সাদা, আর বেজ কালারের দিকে ঝোঁক। কিন্তু বারবারাকে লাল, বেগুনী, সবুজ এইসব রঙেই আসতে দেখে হীরক। এটা এই কদিনেই হীরক খেয়াল করেছে। বারবারা কাগজের প্লেটে করে একটা চকোলেট কেকের স্লাইস নিয়ে যাচ্ছিল। বলল, আমার লাঞ্চ তো হয়ে গেছে। ওকে। আমি তোমাদের সঙ্গে ডেজার্ট নিয়ে বসতে পারি। এ কি, তোমরা কেক আনোনি?

–কোথায় পেলে?
–অ্যাকাউন্টসের রোসেলিনির জন্মদিন ছিল আজ, ওর বন্ধুরা কেক এনেছিল। অনেকটা ছিল, মাঝখানের আইল্যান্ডে রেখে দিয়েছে। পাবলো তো এসব খাবে না, হীরক তুমি খাবে?

জিজ্ঞেস করল কিন্তু হীরক কিছু বলার আগেই চলে গেল আনতে।

–তোমাকে খুব পছন্দ করে মনে হচ্ছে বার্ব?
–দুই-একটা কথা হয়েছে, পছন্দ করার মত আলাপ নেই।
–হয়ে যাবে। ও এখানে সবচেয়ে পুরনো। আমাদের পে রোলের অ্যাপ্লিকেশনটা বার্ব বানিয়েছিল পনেরো বছর আগে। পারচেজিং অ্যাপ্লিকেশানটাও ওর থেকে শুরু। এখানে সবাইকে হাতে ধরে শিখিয়েছে। আমাকেও। মজা করে হাসল পাবলো। বার্বকে ছাড়া ডিপার্টমেন্ট চলে না। তবে বড্ড খচখচ করে। বলে হাসতে হাসতে চোখ টিপল পাবলো।

হীরক এই কদিনেই বুঝেছে সেটা। ওদের সুপারভাইজার রায়ান খুব খাতির করে বারবারাকে। এছাড়া সেকশনের কেউ না কেউ সবসময় মহিলার ডেস্কের সামনে, কোনও কিছুতে আটকে গেছে, চলে এল পরামর্শ নেওয়ার জন্য। সিস্টেমের কোথায় কী কেন কবে করা হয়েছে বারবারার নখদর্পণে, কোনও ডকুমেন্ট ঘাঁটতে হয় না। এটা নিয়ে হীরক তার পাশের ডেস্কের ডিয়ানাকে বলেছিল, মাই গড, বারবারা তো চলতা ফিরতা সিস্টেম ম্যানুয়াল। ডিয়ানার গলায় অত উৎসাহ খেলেনি। চাপা স্বরে বলেছে, ভেবো না, সবাইকে সব কিছু বলে দিচ্ছে। তাহলে সেকশনটাকে নিজের কব্জায় রাখবে কেমন করে? হীরক নতুন, কার সঙ্গে কী পলিটিক্স এখনও জানে না, অবাক হয়ে গেছিল। তবে সাবধানও হয়ে গেল। শুধু নিন্দা নয়, কারও প্রশংসা করার আগেও সেকশনের পলিটিক্যাল ম্যাপটা জেনে নিতে হবে। এখানে কি কালো-সাদার ব্যাপার আছে নাকি? সেটাও মনে হয়েছিল। ডিয়ানা মুলাটো। মাথা ভরা কালো কোঁকড়া চুল, পুরু ঠোঁট। টিশার্ট ছাড়িয়ে জানান দেওয়া বুকের রেখা। খুব হাসতে শুনেছে ফোনে, ছেলের সঙ্গে কথা বলে। ডিয়ানার ডেস্ক এই সারির একদম শেষে, তার আগেই হীরক। কালো আর বাদামী পাশাপাশি। হয়তো সেই জন্যেই হীরককে পাশে বসিয়েছে। এই কথাটা মনে উঁকি দিয়েছে হীরকের। এক ধরনের অহিংস রেসিজম। ডিয়ানার আসল রাগের কারণ হতে পারে সেটাই। কিন্তু সেটাও কি সত্যি? এই যে পাবলো নিজে থেকে যেচে ওর টেবিলে খেতে বসে গেল আর বারবারা দৌড়াল ওর জন্য কেক আনতে, বর্ণবিদ্বেষ থাকলে করত এমন?

বারবারা এসে গেছিল।

–আমার নামে কী বলছ পাবলো? নতুন ছেলেটাকে বিগড়ে দিচ্ছ? হীরকের সামনে কাগজের প্লেটে কেক রাখতে রাখতে বলল বারবারা। জানো তো হীরক, এই পাবলোর জন্য আমার নামটা বার্ব হয়ে গেল, ও আসার আগে সবাই বার্বি বলে ডাকত।

এবার হো হো করে হাসল পাবলো। তার মানে বুঝেছ তো হিরো, তোমার আসল নামটাতেও কদিন বাদে আর কেউ ডাকবে না। সবাই বলবে হিরো।

বারবারা চেয়ার টেনে জমিয়ে বসল। সাবধানে তার টকটকে লাল লিপস্টিক বাঁচিয়ে চকোলেট কেক খাচ্ছিল। এখানে কেমন লাগছে হীরক?

–সবে তো পনেরো দিন হল। আরও কদিন যাক।
–এখানে মানে এই দেশের কথা বলছি। এই দেশে কতদিন?
–চার বছর।
–ইন্ডিয়া এখান থেকে অনেক দূর তাই না?
–ঘণ্টা কুড়ি লাগে, স্টপ ওভারে আরও ঘণ্টা পাঁচেক।
–মাই গড! আমি এতক্ষণ প্লেনে থাকলে দম আটকে মরে যেতাম। না হলে আমার ইন্ডিয়া দেখার খুব ইচ্ছে আছে। তোমাদের ওখানে অনেক হাতি আছে, তাই না?
–সে আছে। তাই বলে ভেবো না রাস্তায় ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
–কিন্তু গরু থাকে রাস্তায়। আমি নিউ ইয়র্ক টাইমসে একবার ছবি দেখেছিলাম। একটা গরু রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, আর সব গাড়ি সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে।
–যে দেশে যেমন বার্ব। অ্যান আরবারে তো গাড়ির সামনে যখন তখন হরিণ চলে আসে। আর গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে।
–পাবলো, একটা দুটো না শয়ে শয়ে গাড়ি। ভুরু জোড়া করে বড় বড় চোখে বলল বারবারা। ওই ছবি দেখার আগে তো আমি জানতামই না ইন্ডিয়াতে লোকে গাড়ি চড়ে।
–তোমার একটু পৃথিবী দর্শনে বেরোনো উচিত। চোখ ছোট করা হাসি টেনে বলল পাবলো।
–আমি বাবা মিশিগান ভালোবাসি, আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। এর বাইরে পা বাড়াতে হলেই ভাবি কখন নিজের বাড়িতে ফিরে আসব। তুমি বাড়ি যাও না হীরক?
–দুই বছরে একবার।
–ও মাই গড! নিজের বাড়ির থেকে এত দূরে আমি তো থাকতে পারতাম না।

খুব অবাক হয়েছিল হীরক। এই দেশের লোক হয়ে এমন কথা? এখানে তো স্কুলের গণ্ডি পেরোলেই যার যার তার তার। বলেও ফেলল সেটা। ঠিক এইভাবে নয়। হীরকের কথাটা এরকম হল, বড় হয়ে বাড়ির বাইরে তো যেতেই হয়। আমি স্কুল ছাড়ার পরে আর বাড়িতে থাকতে পারিনি কখনও। এখন ফারাক হল, অনেকটা দূরে চলে এসেছি। কিন্তু এই দেশে তো সেটাই ন্যাচারাল। তাই না?

–ইন্ডিয়াতেও এরকম? ছেলেমেয়েরা স্কুলের পরে বাড়ি ছেড়ে দেয়?
–না, সেরকম নয়। কিন্তু আমাকে পড়তে যেতে হয়েছিল অনেক দূরে। অন্য শহরে। এখানে যেমন এক শহরে থেকেও আলাদা, সেরকম নয়।

এবার বারবারা খুশি হল। এগজ্যাক্টলি। এক শহরে থাকলে বাবামায়ের সঙ্গে কেন থাকবে না? আমার ছোট ছেলেকে সেটাই বোঝাই। শুধু শুধু আলাদা একটা বাড়ি ভাড়া করে কেন পয়সা নষ্ট করবে। বরং আমার সঙ্গে থাকো, আমি তো আর ভাড়া চাইছি না।

–ছেলে রাজি হল? পাবলো খুব অবাক। ওর কোনও মেয়ে বন্ধু নেই? তারা টন্ট করবে না?
–আমি কি ওর মেয়ে বন্ধুদের উপর নজরদারি করছি? কিন্তু ছেলেকে এখনও রাজি করাতে পারিনি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আরে বাবা, আমার সঙ্গে থাকলে তো ওরই সুবিধা, মাঝে মাঝে খাবার বানিয়ে খাওয়াব, ঘরটাও গুছিয়ে দিতে পারি।
–That’s not good Barb. Allow him to be independent.
–তুমি একদম জনের মত বলছ। আমি যে অ্যালেক্সকে একসঙ্গে থাকতে বলছি, এটাতে জন খুব রাগ করে। বড় হয়েছে, নিজের হাতে সবকিছু করতে দাও। আমি ওসব মানি না। বড়টাকে তো বাড়িতে রাখতে পারিনি, অ্যারিজোনা গিয়ে বসে আছে। অন্তত একটা ছেলে— আবার মুচকি হাসল বারবারা। এর মধ্যে ও চিকাগো ইউনিভার্সিটিতে ট্র্যান্সফার নেওয়ার কথা ভাবছিল, অনেক কষ্টে থামিয়েছি। আসলে অ্যালেক্স ছোটবেলা থেকে আমার কোলঘেঁষা। দেখা যাক, যদি বাড়িতে থাকতে রাজি করাতে পারি। বিশ্বজয়ের হাসি হাসল বারবারা।

পাবলোর এটা মোটেই মনপূত হচ্ছিল না। ভাগ্যিস আমার মা তোমার মত ছিল না। অবশ্য Where I grew up it was ‘law of the father.’

–নেপলস? তাই না? তোমাকে দেখেই বুঝি নেপলসের লোকেদের প্রাণে কোনও মায়ামমতা নেই। বারবারা মজা করেই বলল, কিন্তু হীরকের মনে হল কথাটা ওর মনের।

পাবলো হীরকের জিজ্ঞাসু চোখের দিকে চেয়ে বল, আমরা নেপলসের ঠিক বাইরে একটা ছোট টাউনে থাকতাম। পুরো দুনিয়াটাকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা এক শহর। সবাই খুব পুরনোপন্থী। আমি একজনকেও চিনতাম না যে কখনও ওই টাউনের বাইরে পা দিয়েছে। বাইরের পৃথিবীতে কী হচ্ছে তা নিয়ে কোনও ভাবনা নেই। তাদের একমাত্র কাজ বাচ্চার জন্ম দেওয়া।

জোরে জোরে হাসল বারবারা। ওরা ঠিক আমার মতো, নিজের শহর ছেড়ে যেতে চায় না।

–কিন্তু কাজ না করলে খাওয়াত কী?
–খামার। কেউ স্কুলে যেত না কি? সবার বাড়িতে আর না হলেও দশটা বাচ্চা। আমার ওপরেই ছিল আরও আট ভাই। বলতে বলতে উদাস হয়ে গেল পাবলোর চোখ। আমি কি ভীষণভাবে ওই শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাইতাম।
–তাই বলে মাকে ভালোবাসতে না?
–আমার পরে মার আরও তিনটে বাচ্চা হয়, মার অত সময় কোথায়? পাবলো এমনভাবে বলছিল যেন অন্য কারও জীবন, অন্য কারও মা।
–তাই বলে তুমি মাকে ছেড়ে পালাবে? নিজের ফ্যামিলির জন্য টান থাকবে না? তোমার এই ব্যাপারটা আমার পছন্দ নয়।
–আরে, সে কতদিনের কথা। এখন আর পছন্দ অপছন্দের কী আছে। আমার বয়স তখন তেরো। ওই আনপড় শহরে একটা দুটো ম্যাগাজিন আসত। আমি সেখানে কানাডার প্রেয়ারি আর পাহাড়ের ছবি দেখতাম আর ভাবতাম কেমন করে ওখানে পৌঁছানো যায়।  তারপর অ্যারিজোনার মরুভূমি। এরকম আরও কত শহর। আমাকে টানত। তাই একদিন পালালাম। আর কোনও চয়েস ছিল না। ট্রেনের টিকেট কাটারও পয়সা ছিল না। আমার মা আমার হাত ধরে কম কান্নাকাটি করেছে? বাবাকে তো জানাইনি, তাহলে বেরোনোর পথ বন্ধ হয়ে যেত।
–তুমি পরে মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছ তো পাবলো?
–গেছি, মা বেঁচেছিল যখন বেশ কয়েকবার গেছি আমার শহরে। ওই এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা এখনও। পাউরুটিতে কামড় দিয়ে ঠোঁটের কোণা মুছল পাবলো। যতবার গেছি, বুঝেছি ওই বাচ্চা বয়সে কী দারুণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এবার হীরকের দিকে তাকিয়ে হাসল পাবলো। তাই তোমাকে দেখে এত ভালো লাগে আমার। তুমি কতদূর থেকে নিজের দেশ ছেড়ে পৃথিবী দেখতে বেরিয়ে পড়েছ।

হীরক জানে তার আর পাবলোর পরিস্থিতিটা আলাদা। সে বেরিয়েছে বড় ডিগ্রি জোগাড় করতে, টাকা রোজগারের ধান্দায়। মনে মনে ভাবছিল সেদিনের সেই তেরো বছরের ছেলেটা, পকেটে পয়সা নেই, মাথায় বিদ্যা নেই কীসের আকর্ষণে, কোন ভরসায় নিজের বাড়ি ছেড়েছিল। মুখে বলেও ফেলল, তোমার মত এত সাহস আমার নেই পাবলো।

পাবলো খুব জমিয়ে গল্প করে। কিন্তু বারবারার বোধহয় এসব গল্প অনেক শোনা।  হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল, এই অফিসে তোমার পজিশনটা পারফেক্ট পাবলো— অরগানাইজেশান চেঞ্জ ম্যানেজার। নিজেকে বদলাতে বদলাতে চলেছ। কিন্তু আমি বাপু অত বদল সহ্য করতে পারি না। রোজ অফিসে আসছি, ঠিক ওই চেয়ারটায় বসছি গত কুড়ি বছর। যেদিন অফিস বিল্ডিং বদল হল, আমি আমার চেয়ার সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম রায়ানকে বলে। অফিস যেখানে খুশি মুভ করুক, আমি আমার একান্ত নিজের জায়গাটা ছাড়ব না।

বারবারা চলে গেল। পাবলোরও খাওয়া শেষ। বারবারার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে বলল, বদলাতে সবাইকেই হয়, জীবন থমকে যেত তা না হলে। নাহলে আর বেঁচে থাকার কী মানে, বলো হিরো?

পাবলোর কথা যত শুনছিল ততই অবাক হচ্ছিল হীরক। তুমি ওইভাবে বেরোলে, আমি মোটেই পারতাম না। থাকলে কোথায়, খেলে কী? একবারও এসব নিয়ে ভাবলে না?

–বয়েসটাই ছিল ওইরকম। তবে সোজা ছিল না ব্যাপারটা। তখন তো ইংরাজিও জানি না। হোটেলে বাসন মেজেছি, ঝাড়ুদারের কাজ করেছি। এইভাবেই স্কটল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ঘুরলাম। ইংল্যান্ডে থাকতেই পড়াশোনার সুযোগ হল।
–কীভাবে?
–ম্যানচেস্টারে টেক্সটাইল কারখানায় কাজ করছিলাম। ওখানেই শ্রমিকদের পড়াশোনার সুযোগ ছিল সন্ধ্যাবেলায়। একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলাম। আমার বয়স তখন আঠেরো।
–তুমি অ্যামেরিকায় কবে এলে পাবলো?
–তেইশ বছর বয়সে। আমার বউ ক্যাথির সঙ্গে ম্যানচেস্টারে থাকতেই আলাপ। ক্যাথি অ্যামেরিকান। গ্যাপ ইয়ার নিয়ে ইওরোপ ঘুরতে এসেছিল। আমি টানা অতদিন ম্যানচেস্টারে থেকে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। ইটালি, ফ্রান্স, সুইডেন সব ঘুরলাম আমরা এক সঙ্গে। ওকে নিয়ে আমার টাউনেও গেছিলাম। তারপর ক্যাথির সঙ্গে চলে এলাম অ্যামেরিকায়। বউ টিচার হলে কেমন সুবিধে দেখো। আমার মতো মুখ্যুও অফিসের চাকরিতে ঢুকে গেল একদিন। প্রথম অফিস জবে ঢুকলাম যখন, আমার বয়েস চল্লিশ। সেই প্রথম চেয়ারে বসে চাকরি করা। হাসতে হাসতে বলল পাবলো।

অবাক হয়ে দেখছিল লোকটাকে। কতরকম মানুষের সঙ্গেই তো দেখা হয়। কিন্তু পাবলো যেন সবার থেকে আলাদা। চোখেমুখে এখনও কীভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছে ঝলকে পড়ছে।

–এরপর তুমি যখন ইন্ডিয়া যাবে, হয়তো আমিও যাব তোমার সঙ্গে। অনেকদিন বেরোনো হয় না। এশিয়াটা একদম দেখা হয়নি। শুনেছি তোমাদের দেশে অনেক গুহাচিত্র আছে, আমি দেখতে চাই।
–ছবি ভালোবাসো পাবলো?
–শিখছি তো এখন।
–শিখছ? কী শিখছ?
–ছবি আঁকতে। গত দু বছর আঁকা ধরেছি।

হঠাত ছবি আঁকা শিখতে ইচ্ছে হল! খুব জানতে ইচ্ছা করছিল হীরকের। আগে আঁকতে?

–আঁকতে জানলে আর কেন শিখতে যাব? পাবলো এমনভাবে বলল যেন এটাই স্বাভাবিক, জীবনটা এরকমটাই হওয়া উচিত। এর আগে তো ক্রিয়েটিভ রাইটিং শিখতে গেছিলাম।

এর কথা যত শুনছে ততই তাজ্জব লাগছে হীরকের।

–অবাক হচ্ছ কেন? নিজের মনের কথা ভালোভাবে লিখে রাখতে চাই, এটা কি অন্যায়? এত কিছু দেখতে ইচ্ছা করে, সেগুলোর একটুখানিও যদি ক্যানভাসে আনতে পারি— আমার খুব ইচ্ছা হত।
–তোমাকে দেখে আমারও ছবি আঁকতে ইচ্ছা করছে আবার। আমি ছোটবেলায় খুব আঁকতাম। তারপর সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছি।
–একদম শুরু করে দাও আবার। আমি তোমাকে একদিন আমার ছবি দেখাব হিরো। জলরং শিখেছি। এখন অয়েল করছি। ইচ্ছা হয় বেরিয়ে পড়ি আবার। দূরে, খুব দূরে কোথাও।
–কোথায়?
–কত দেশ দেখা বাকি আছে। এই চেয়ার টেবিলে বসা চাকরি আর ভালো লাগছে না।
–তাহলে যাচ্ছ না কেন?

ফিকে হাসল পাবলো। আজ থেকে পনেরো বছর আগে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে গেছিলাম আমরা। আমি, ক্যাথি আর আমার ছেলে। ক্যাথি হ্যাড আ ফল। প্রাণে বেঁচে গেল। কিন্তু পুরোপুরি বিছানায়। এখন আমরা মনে মনে ঘুরি শুধু। এই যে তোমাকে বললাম ইন্ডিয়া যাব— আমি আর ক্যাথি এরকম কত জায়গায় যাওয়ার কথা ভাবি, কল্পনায় চলে যাই। ব্যস।

শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল হীরক। কোনওমতে বলল, এদেশে তো হুইলচেয়ারে করে অনেক জায়গায় যাওয়া যায়।

হাসি ফুটে উঠল পাবলোর মুখে। যাই তো। যেসব জায়গায় হুইলচেয়ারে করে যাওয়া যায়, নিয়ে গেছি ক্যাথিকে। কিন্তু আমরা যেরকমভাবে আগে বন জঙ্গল ভেদ করে বেরোতাম তার স্বাদ ছিল আলাদা। কিন্তু ক্যাথিকে ছাড়া কোথাও যেতে আনন্দ পাই না আর।

যে লোকটা ভবঘুরে হওয়ার জন্য বেরিয়েছিল, সে এখন শয্যাশায়ী বউয়ের পাশে বসে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। একটু আগেই ভাবছিল, পাবলোর কি কারও জন্য ভালোবাসা নেই। নিজের খেয়ালে মা বাবা ভাই বোন সবাইকে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে, একবার পিছন ফিরেও তাকায়নি। ভাবনাটা একটু নড়েচড়ে বসল এবার।

–দেশের জন্য সত্যিই মন কেমন করে না তোমার? ইচ্ছা করে না নিজের ছোটবেলার রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে?
–করে। আমি তো যাই এখনও। হয়তো পাঁচ বছরে একবার। কিন্তু সত্যি কথা বলব একটা? ওই রাস্তাগুলো এখনও একইরকম আছে। বাড়িগুলোও। হয়তো লোক বদলে গেছে, বুড়ো হয়ে গেছে আমার মত। ছোটবেলাটাকে সহজেই মনে করিয়ে দেয়। ভালো লাগে। কিন্তু আমি যদি ওইখানেই থেকে যেতাম তবুও কি ভালো লাগত হীরক? পালিয়ে এসেছিলাম বলেই ফিরে গেলে ভালো লাগে। ভালো লাগে এই ভেবেও যে আমি একটা সীমানা পেরিয়ে এসেছি, এক জায়গায় বাঁধা পরে থাকিনি।

কাজে ফিরতে হবে। টিফিনের কৌটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল হীরক। তোমার ভাবনাচিন্তাগুলো খুব অন্যরকম পাবলো। আমিও তো বাড়ি, দেশ সব ছেড়ে বেরিয়েছি, কিন্তু তোমার মত করে এখনও ভাবতে পারি না। আমি আমার দেশ, আমার বাড়ি খুব মিস করি। অথচ এত দেশ দেখেও তোমার মধ্যে কী দেখোনি তার জন্য আফশোস।

পাবলোর দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা টানটান। চেহারা ছোটখাট হতে পারে, বয়েসও হয়েছে। কিন্তু মেরুদণ্ড ঋজু। সাদা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, না আফশোস ঠিক করি না। তবে সব ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছাটা জারি রেখেছি। ছোটবেলায় ভাবতাম সারা পৃথিবীর সব কটা দেশে যাব। অথচ দেখো এখনও এশিয়াতেই যাওয়া হয়নি। তোমার দেশে এখনও হুইলচেয়ারে করে বেড়াবার অবস্থা নেই, নাহলে ঠিক যেতাম। যাকগে, সান্ত্বনা একটাই। আমি আমার বাবার জীবন তো কাটাইনি— কফিনে ঢোকার সময়ে মনে এই শান্তিটা নিয়ে যেতে পারব।

 

২.

–আর কদিন বলো? তারপরে একটু ফেলে ছড়িয়ে থাকা যাবে। জিনি যখনই কোনও জিনিস রাখতে জায়গা হাতড়ে বেড়ায় এই কথাটা বলে। কিংবা সুপার মার্কেটে ঘুরতে গিয়ে কিছু পছন্দ হল, ঘাড় ঘুরিয়ে হীরকের দিকে চায়, আমেজিং না? নিই? তারপরেই আফশোসের সঙ্গে বলবে জায়গা কোথায় এটা ঝোলাবার? তবে বাড়িটা পেয়ে গেলেই…
–এই বাড়িটা ছাড়তে কষ্ট হবে না তোমার? ব্রেকফাস্ট টেবিলে খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে বলল হীরক। এই ক বছরের কত স্মৃতি জমে আছে।
–স্মৃতির পাহাড়ের চূড়ায় বসে হাওয়া খেলে চলবে? জিনির গলার বিরক্তি গোপন রইল না। এইটুকু জায়গায় হয় আর বলো? তিস্তা হওয়ার সময় বাবা মা যখন এসেছিল পা রাখার জায়গা ছিল না একদম। একটা বাথরুম, সকালবেলা হুড়োতাড়া এত। মানুষকে তো এগিয়ে যেতেই হয়। কিছু পেলে কিছু না ছেড়ে উপায় কী।

জিনির বাস্তবতাবোধকে অস্বীকার করা যায় না। অ্যাপার্টমেন্টটা একদম ছোট। প্রথমে বেশ বড় লাগত, কিন্তু একটা একটা করে জিনিস ঢুকতে ঢুকতে এখন একদম টইটম্বুর। তিস্তার জন্য একটা নার্সারি বানাবার খুব শখ জিনির। কিন্তু এখানে দুটো বেডরুমে দুখানা খাট, তারপর আর জায়গা কোথায়? জীবনের ছোট বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িকেও কমতে বাড়তে হয়। এই ইলাস্টিসিটা এদেশের জীবনের অঙ্গ। প্রথম গার্হস্থ পত্তনে অ্যাপার্টমেন্ট। বাচ্চা হওয়ার পর বাড়ি চাই, সঙ্গে ব্যাকইয়ার্ড। মেয়ে খেলবে, দৌড়াবে কোথায় না হলে? একটা দোলনা কিনব হ্যাঁ? মাঝে মাঝেই বলে জিনি। তিস্তাও ঝুলবে, মাঝে মাঝে আমরাও…

–হ্যাঁ, আর গান গাইব সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে।

হীরকের ব্যঙ্গকে পাত্তা দেয়নি জিনি। তুমি বেরসিক, না হলে জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলোয় আমার সঙ্গে ঝুলা ঝুলতে পেলে বর্তে যেতে।

হয়তো। মনে মনে ভেবেছে হীরক। নিজেকে পুরোপুরি উজাড় করে দিতে পারে না। বাক্সের তালা বন্ধ করে চাবি লুকিয়ে ফেলেছে কেউ।

শুধু ব্যাকইয়ার্ড দিয়ে তো বাড়ি হয় না। কোথায় বাড়ি হবে তার অনেক হিসাবনিকাশ আছে। বাচ্চা স্কুলে পড়ার মত হলে লোকেশান খুব ইম্পর্ট্যান্ট, বাড়ি কোনও স্কুল ডিস্ট্রিক্টে পড়ছে সেটা নিয়ে চুলচেরা বিচার। আচ্ছা তুমি কোন সাবডিভিশনে, ওখানের স্কুল কেমন, এইসব প্রশ্ন চলে নিরন্তর। শুধু দেশিরা নয়, খোদ অ্যামেরিকান ফ্যামিলিতেও। হীরকরা শুরু থেকেই অ্যান আরবারে, এটাই মস্ত সুবিধা। এখানে পাবলিক স্কুল খুবই ভালো। নীলাদ্রিদারা যেমন ইপ্সিল্যান্তির অত ভালো বাড়িটা ছেড়ে অ্যান আরবারে ছোট বাড়িতে চলে এল শুধু ছেলেকে ভালো স্কুলে পড়াবে বলে। ছেলের স্কুল শেষ হলেই আবার কোথাও বড় বাড়ি নেবে ভেবেছে, তখন আর স্কুলের চিন্তা নেই। যদিও ছেলে তখন বাড়িতেই থাকবে না। কিন্তু ওটাও স্ট্যাটাস সিম্বল। ছেলেমেয়ের বিয়ে হবে, দেশবিদেশ থেকে আত্মীয়স্বজন আসবে। সেই সময় একটা চকমিলানো বাড়ি চাই। তারপর রিটায়ার করে না হয় স্কেল ডাউন করে আবার অ্যাপার্টমেন্টে। কিংবা মিশিগানের শীত থেকে দূরে রৌদ্রোজ্জ্বল ফ্লোরিডায়। মোটামুটি সবারই এই ছক। এরকম আলোচনা শুনে হীরকের নিজেদের দুর্গাপুরের বাড়ির কথা মনে পড়ে বারবার। তাদের বাড়িও বদলেছিল ধাপে ধাপে। মার মুখে শুনেছে প্রথম যখন বাড়ি হল, তখন শুধু একটা ঘর, আর রান্নাঘর। বারান্দা ছিল একটা চিলতে মতন যেখানে বাবা চেয়ার পেতে খবরের কাগজ পড়ত। কিন্তু খোলা বারান্দা, এদেশের ডেকের মত। সেই প্রথম ঘরটার মেঝে লাল রঙের, ওইসময়কার ফ্যাশান। রূপা আর হীরু জন্মাবার পর আরেকটা ঘর জুড়ল। ততদিনে বছর পাঁচেক কেটে গেছে, লাল মেঝের আর ফ্যাশান নেই। ঝিল্লি জানালা তখনও চালু ছিল। এই পর্যন্ত হীরকের জ্ঞানত বয়সের আগে। তারপর রান্নাঘরের লাগোয়া বাথরুম হল। সেই নিয়ে কত গবেষণা। রান্নাঘরের পাশে বাথরুম, গন্ধ হবে না? জ্যাঠা শুনে বলেছিল তোরা দিন দিন ম্লেচ্ছ হয়ে যাচ্ছিস। সেই বারান্দা ঘিরে দিয়ে খাওয়ার জায়গা বানানো হল। বসার ঘর বলে সেরকম কিছু ছিল না। সেটাও একসময় এসে গেল। হীরু, চিনু বন্ধুবান্ধব নিয়ে ক্যারাম খেলেছে সেখানে বসে। হিসেব করলে কুড়ি বছর ধরে তৈরি হয়েছিল তাদের বাড়ির একতলা। সেই পুরো একতলা জুড়ে জলছাদ হল, দিনের পর দিন ছাদ পিটাই। হীরক তখন হাইস্কুল। গরমের ছুটির টুকটুক আওয়াজ তোলা দুপুরের সেই দিনগুলো এখনও যেন স্পষ্ট।

লাল মেঝের ঘরের বয়স সবচেয়ে বেশি। তার দেওয়ালে ড্যাম্প পরে এখন। কেউ শোয় না ওই ঘরে আর। হীরক দোতলা বানিয়ে দিয়েছে। তার মেঝেতে মোজায়েক। ওখানেই থাকে বাবা মা এখন। নীচটা খালি পড়ে আছে। সেই বাড়ির ছোট হওয়ার কোনও উপায় নেই। ছেড়ে যাওয়ার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। প্রতিটা ঘর, জানালা, দরজার সঙ্গে কত গল্প জড়িয়ে আছে। নিচের তলা ভাড়া দেওয়া যেত। বিমল আর নীলিমার কতটুকুই বা লাগে। কিন্তু পুরনো আসবাবপত্র যাবে কোথায়? নীলিমা প্রাণে ধরে নুয়ে পড়া বেতের চেয়ারগুলোও ফেলতে দেবে না। কিছু পুরনো কাপড় আর পাঁচ টাকা দিয়ে কিনেছিল যখন বাড়িতে আর কোনও চেয়ার ছিল না। আগেকার দিনের খাট— উঁচু আর অনেকখানি জায়গা জুড়ে। কিন্তু সেটা ফেলা আর নীলিমার বুকের পাঁজর একটা একটা করে খুলে নেওয়ায় কোনও ফারাক নেই। স্মৃতিরা জমানো আছে থরে থরে।

এখানে জমিয়ে রাখার বালাই নেই। ভবিষ্যতের দিকে মুখ করে বর্তমানে বেঁচে থাকা। মডার্ন সুবিধাগুলো নিতে হলে সেটা না করলে হয় না। জিনি যেটা বারবার মনে করিয়ে দেয়। এদেশের লোকেরা বাঁচতে জানে। মানুষ যেমন বুড়ো হয়, মারা যায়। বাড়ি, আসবাব, ঘর সাজানোর সরঞ্জাম এদেরও বয়স হয়, মরচে ধরে, অকেজো হয়। সময়ে না বদলালে রোজকার বেঁচে থাকায় খিটপিট চলতে থাকে। কীসের জন্য? জিনিস পুরনো হলে ফেলে দাও, কাজের অবস্থায় থাকলে স্যালভেশন আর্মিতে দিতে পারো, অন্য কেউ ব্যাবহার করুক। নতুন জিনিসের ছোঁয়ায় মানুষের সজীবতা বাড়ে। বাড়িতে কোনও নতুন জিনিস আসলে জিনির চোখ মুখে প্রাণচাঞ্চল্য সত্যিই বেড়ে যায়। বাড়ি নতুন করে গোছানোর ইচ্ছা জাগে। হীরকেরও ভালো লাগে, ঝকঝকে রাংতা মোড়া জীবনের আকর্ষণ অস্বীকার করা যায় না। তবে জিনিস বদলানো আর বাড়ি বদলানো এক গোত্রের নয়। সেই মায়ায় পুরনো বাড়িকেই নতুন করে বানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে অনেকে। পুরনো বাড়িকে মডার্নাইজ করা এখানে অনেক সোজা। ইট পাথরের বাড়ি তো নয়। কাঠের বাড়ি প্যান্ডেলের মত। ঘর ছোট বড় করতে হলে দেওয়াল কেটে সরিয়ে দাও। তারপর নতুন রঙের পোঁচ দিয়ে একেবারে মনের মত। কিন্তু সেটা তাদের অ্যাপার্টমেন্টে হবে না, নিজের বাড়ি হলে না হয় করা যেত। তাছাড়া আর একটু বেশি জায়গার যে দরকার সেটাও সত্যি। নিজের জন্য একটু জায়গা চায় হীরক। নতুন করে ছবি আঁকা ধরেছে আবার। কিন্তু কোথাও ইজেল পাতার জায়গা নেই। ঘর থইথই করছে জিনিসে।

ছবি আঁকার ব্যাপারটা আচমকাই শুরু হয়েছে আবার। ছোটবেলায় কত ছবি এঁকেছে হীরক। ভালো আঁকত। কিন্তু একটু বড় হতে ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং-এর বাইরে শুধু নোটবুকে আঁকিবুকি কেটেছে। বর্ডার বুকসে জয়েন করার পর পাবলোর উৎসাহে আবার শুরু। চোখের দুপাশে মাকড়সার জালের মত কুঁচকানো চামড়া, হাতের শিরা বের করা পাবলো যদি নিজের বয়সকে অগ্রাহ্য করে নতুন কিছু শেখার কথা ভাবতে পারে, সে কেন নয়।

পাবলোকে যেটুকু জেনেছে, ছবি আঁকাটা ওর কাছে বুড়োমানুষের খেয়ালের থেকে বেশি। জীবনটাকে নতুনভাবে দেখার জানার ইচ্ছা সজীব করার প্রয়াস। বউ বিছানায়, একা হাতে তার যত্ন করে। এক ছেলে, সে থাকে লুইজিয়ানা। কদিন আগেই পাবলো বলেছিল, হিরো! আসবে আমার এগজিবিশানে? আমাদের একটা শো আছে, আমারও তিনটে ছবি থাকবে।

দেখতে গেছিল হীরক। একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। ষাট বছরে তুলি ধরেছে। অয়েলে একটা ফ্রুটবাস্কেটের স্টিল ছিল। ভালো কাজ। জলরঙের বরফে ঢাকা মিশিগান লেকের ছবিটাও দারুণ। হীরককে দেখে আনন্দে চোখ চকচক করছিল পাবলোর। গর্ব, তৃপ্তি মিলেমিশে একাকার। আরও চারজন আর্টিস্টের শোকেস ছিল। তারা সবাই পাবলোর বয়সি না হলেও, মধ্যবয়স পার করেছে। বিভিন্ন পেশায় আছে, কিন্তু ছবি আঁকা শিখছে।

এটাও একরকম জীবনকে রিনিউ করা। নতুনভাবে বাঁচা। মনের জগতে নতুন ঘর জুড়ে দেওয়া। হীরক এতেই উৎসাহ পেয়ে গেল। অফিসের স্টোরে বহুরকমের ছবি আঁকার সরঞ্জাম পাওয়া যায়। প্রথম জলরং আর কয়েকটা তুলি কিনেছিল। জিনি দেখে অবাক। তুমি ছবি আঁকো? কই বলোনি তো কখনও?

–আঁকতাম ছোটবেলায়, সবাই তো আঁকে ওই বয়সে। বলার মত কিছু না।
–কিন্তু এই বয়সে তো সবাই আর আঁকে না। হঠাৎ ইচ্ছে হল?
–এতদিন তো দৌড়েছি। এখন একটু থামার সুযোগ পেলাম, তাই ভাবলাম দেখি না যদি পুরনো অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনতে পারি।
–এই আমাকে আঁকবে? উৎসাহে হীরকের কাঁধ খামচে ধরেছিল জিনি।
–দাঁড়াও, কদিন যেতে দাও। দেখি কেমন আঁকছি। তারপর তো আমার ন্যুড মডেলের দরকার হবেই। সেটা তুমি ছাড়া আর কে হবে?
–অ্যাই, ইয়ার্কি হচ্ছে? আরও কাছে এসে ঘন হয়ে বসেছিল জিনি। আমি ন্যুড পোজ দিয়ে বসলে তুমি ছবি আঁকতে পারবে?
–শিল্পীরা যোগী হয় জানো তো? আর্ট কলেজে ন্যুড মডেল নিয়ে কাজ করতে হয়। শিল্পী আর মডেলের সম্পর্ক সেক্সুয়াল নয়। এই যে পাবলো ছবি আঁকা শিখতে যায়, ন্যুড মডেল থাকে না সেখানে?
–তুমিও যাবে নাকি? চোখ সরু করে বলেছিল জিনি। একদম ওইদিকে পা বাড়িও না, ঠ্যাং ভেঙে দেব তোমার। যদিও মজা করে বলেছিল, সত্যি হীরক যেতে চাইলে যে বাধা দেবে না সেই ভরসা হীরক পায়নি। যখন সময় হবে দেখা যাবে বলে কাটিয়ে দিয়েছিল হীরক। আগে তো শুরু হোক!

জলরঙে অ্যাপার্টমেন্টের বাইরেটা ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে মনে নতুন এক উত্তেজনা অনুভব করেছিল হীরক। দারুণ কিছু হয়নি, কিন্তু তার আঁকার হাতে যে একেবারে মরচে পড়ে যায়নি, সেটা বুঝতে পারল। এমনকি জিনিও এসে তারিফ করল। বাঃ, বেশ ভালো আঁকো তো তুমি। ছেড়ো না, প্রথমটাতেই যদি এমন হয় এরপর আরও ভালো হবে।

তার হাতমকশো চলেছে। জলরঙে আঁকত ছোটবেলায়, কিছু টেকনিক জানা। বাকিটা একটা বই পড়ে পড়ে চেষ্টা করছে। কিন্তু অন্য মিডিয়ামগুলো কখনও ইউজ করেনি। নিজে নিজে হবে না, কোথাও গিয়ে শিখতে হবে। তার আগে একটা আঁকার জায়গা চাই। নতুন বাড়িতে বেসমেন্ট থাকবে। সেখানেই নিজের ছবি আঁকার আস্তানা বানাবার প্ল্যান।

–কিন্তু খরচ বেড়ে যাবে জিনি। এখন আমরা মর্টগেজে নশো দিই, সেটা ডাবল হয়ে যাবে। সেই খেয়াল আছে? তিস্তার জন্যও খরচ কিছু কমবে না।
–সংসারটা আমি চালাই মশাই, আমি খেয়াল না রাখলে হবে? এখন আমিও তো রোজগার করছি, সেটা ভুলে যেও না। আজকাল আমার অনেক লয়্যাল খদ্দের হয়েছে, তারা উদার হস্তে টিপস দিচ্ছে।

টিপস শুনলেই ভিতরে কেমন কুঁকড়ে যায় হীরক। জিনি যে কাজটা করে হীরকের মোটেই মনঃপূত হয়নি। এই নিয়ে অনেক কথা হয়েছে ওদের, ঝগড়াও। এখন মেনে নিয়েছে, কিন্তু অপছন্দটা রয়েই গেছে।

জিনি যখন এদেশে কাজ করার জন্য এলিজিবল হল, হীরককে চমকে দিয়ে ও বলল চুল কাটা শিখবে।

–মানে? তুমি নাপিত হতে চাও?
–কেন, ওটা তোমার রেসপেক্টেবল প্রফেশন বলে মনে হচ্ছে না?
–এদেশে কোনও প্রফেশানই আনরেস্পেক্টেবল নয়। কিন্তু তুমি গ্রাজুয়েশন করেছ, ইজিলি একটা টিচার ট্রেনিং কোর্স করে নিয়ে টিচিং প্রফেশানে ঢুকতে পারো। কিংবা কোনও অফিসে চাকরি নিতে পারো।
–মাই গড, চুল কাটাটা খারাপ কিসে? এদেশের লোকদের দেখেছো? সবাই চুলের ফ্যাশান সম্বন্ধে সচেতন। কতরকমের কাট, রং, বাহার। দেখলেই লোভ হয় না? জিনির নিজের চুলেও ব্লন্ডের শেড। মাঝে মাঝেই চুলের স্টাইল বদল করে। কিন্তু ওর ফ্যাসিনেশানটা যে এই জায়গায় পৌঁছে গেছে সেটা ভাবেনি। আমার দেশিবাবু, চুল কাটা একটা শিল্প, তোমার ইটালিয়ান সেলুনে উড়ে নাপিতের কাছে গলায় কাপড় বেঁধে বাটিছাট দেওয়া নয়।
–দেখেছ, তুমিও কেমন ডিসরেসপেক্টেফুললি উড়ে নাপিত বললে।
–সেটা তোমাকে ডিফারেন্সটা বোঝানোর জন্যে বললাম। এই যে তুমি ইজেলে রং দাও, তার সঙ্গে বাড়ির দেওয়ালে রং দেওয়ার ফারাক আছে তো? তার মানে আমি বলিনি বাড়িতে রং দেওয়া কিছু ছোট কাজ। তবে ইন্টারেস্টিং কাজ নয়।
–কিন্তু বাঙালি মহলে ঢি ঢি পড়ে যাবে। সামনে না বললেও আড়ালে বলবে।
–বলুক। আমি জানি, there is nothing wrong with it. তাছাড়া ফ্যাশান আমার ভালো লাগে, পড়াতে ভালো লাগে না। ব্যস!

ছয় সপ্তাহের ট্রেনিং নিয়ে কাজও পেয়ে গেল। ততদিনে জিনি প্রেগন্যান্ট। কিন্তু তাতে কিছু আটাকায়নি। ব্রায়ারউড মলে হাই ফ্যাশান স্যালনে কাজ করে। মাঝখানে তিস্তা হওয়ার আগে আর পরে মিলিয়ে মাস পাঁচেক করতে পারেনি। এখন আবার পুরোদমে কাজ।

জিনি জানে বঙ্গমহলে তাকে নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু কেয়ার করেনি। চুল কাটতে, রং করতে ভালোই লাগছে। এরপর একটা বিউটিশিয়ান ট্রেনিং নেবে। আর বছর খানেক গেলে নিজের একটা দোকান শুরু করার ইচ্ছা। হীরকের কাছে কথাটা ভাঙেনি, সেটা সময়ে হবে। কোনও একটা বিউটি ব্র্যান্ডের ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে নেবে। এইসব ভেবে রেখেছে জিনি। হাই ফ্যাশানে তার প্রিয় সঙ্গী এসিলার সঙ্গে মাঝে মাঝেই আলোচনা হয় এই নিয়ে। যদিও মেয়েটার বিজনেসে কোনও ইচ্ছা নেই, জিনি দোকান দিলে সেখানে কাজ করতে রাজি আছে। কাজ ভালো জানে মেয়েটা। কিন্তু ওর উৎসাহ অন্য দিকে। লেখক। ক্রিয়েটিভ রাইটিং নিয়ে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নিয়েছে।

শুনে জিনি নিজেও অবাক হয়েছিল। তোমার কোনও বই বেরিয়েছে?

হেসেছিল এসিলা। বেরোবে, খুব শিগগির।

–তাহলে তুমি এখানে কেন কাজ করছ?

কেন নয়? এবার ছিল এসিলার অবাক হওয়ার পালা। আট ঘণ্টা কাজ করি। সেরকম কোনও টেনশন নেই কাজে। এখানে দাঁড়িয়ে কাজ করি, বাড়ি গিয়ে লেখার কাজ বসে। আমার এক্সারসাইজ করতে হয় না আলাদা করে। ছিপছিপে চেহারার এসিলাকে দেখলে সেই সত্যিটা নিয়ে সন্দেহ নেই। অসম্ভব ভালো দেখতে মেয়েটা। খুব ফ্যাশনেবল। অ্যাপ্রন পড়া থাকে, না হলে ওর ক্লিভাজ বের করা ডিপ কাট ফ্রকে খুব সেন্সুয়াস লাগে এসিলাকে। বুকের কাছে মাথা ধরে যখন ছেলেদের চুল কাটে তখন অ্যাপ্রন না থাকলে তাদের কী দুর্দশা হত ভেবেই হাসি পায় জিনির।

–তুমি কী নিয়ে বই লেখো এসিলা?
–থ্রিলার, এখন লিখছি স্টর্মচেজারদের উপর।

ওর সঙ্গে কথা বলে কত কিছু যে জানতে পারে জিনি। স্ট্রর্মচেজার মানে ঝড় তাড়া করে বেড়ায়? কিন্তু কেন?

–যেখানে টর্নেডো কিংবা সাইক্লোন হয় সবাই ওখান থেকে পালায়। এই স্ট্রর্মচেজাররা সেই ঝড়ের দিকেই ধেয়ে যায়।
–লাভ?
–It’s really thrilling! আমার আগের বয়ফ্রেন্ড অ্যাবি ছিল স্ট্রর্মচেজার। আমি ওর সঙ্গে হারিকেন বব দেখতে গেছিলাম। নিউ ইংল্যান্ডে তার আগে আমরা সাতদিন ক্যাম্প করেছিলাম। আরেকবার ওকলাহামায়।
–রিস্ক নেই? একেকটা ঝড় যা ভয়ানক হয়।
–আছে তো। ওই ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ঢোকার মানে নিজের জীবন ঝড়ের ওঠাপড়ার হাতে ছেড়ে দেওয়া। জিনি, কিন্তু সেই সময়টুকুর যে উত্তেজনা তুমি ভাবতে পারবে না। মনে করো সাতদিন তুমি অপেক্ষা করছ পথেঘাটে, কফি শপে। সে আসবে, আসছে, তারপর যখন চারদিক অন্ধকার করে এসে গেল আর তার থেকে না পালিয়ে তার চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করছ, ঢেউয়ের চূড়ায় উঠে তার ঝুঁটি ধরে নেড়ে দেওয়ার মত।
–এটা কী এক ধরনের স্পোর্টস তোমাদের?
–কাজও। অ্যাবির বেশ ভালোই রোজগার ছিল এইসব করে।
–এখন আর যাও না?
–আমার কারেন্ট বয়ফ্রেন্ড মিখাইল পাইলট। ঝড় একদম ভালোবাসে না। আমরা প্যারাগ্লাইডিং করতে যাই।

কী বয়স হবে মেয়েটার? বেশি হলে পঁচিশ। তার চেয়ে তো ছোট। অথচ কতরকমের অভিজ্ঞতা, জীবনটাকে একেবারে নিজের হিসেবে চালাচ্ছে। একটাই জীবন, তার আস্তানা পাল্টে পাল্টে চলেছে।

–তোমার সঙ্গে যত আলাপ হচ্ছে, আমি ততই অবাক হচ্ছি এসিলা। কফিশপে বসে অকপটে বলেছিল জিনি।

নিজের স্ট্রবেরি ব্লন্ড চুল চোখের উপর থেকে সরাতে সরাতে হাসছিল এসিলা। তুমি আমার কাজিন সিস্টার সুজানের কথা শুনলে কী বলবে? বোধহয় অবাক হতেও ভুলে যেতে।

–কেন?
–পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছয় মাসের বেশি এক জায়গায় থাকে না। কত জায়গায় যে গেছে। তিরিশ পেরোয়নি, কিন্তু পঞ্চাশটার বেশি দেশে গেছে। আজ ব্যাঙ্কক তো কালকে ভিয়েনা।
–কী করে? অত টাকা পায় কী করে?
–ট্রাভেলগ লেখে। নিউজ রিপোর্ট পাঠায়। কিন্তু সব ফ্রিলান্স। যাতে ওকে এক জায়গায় আটকে পড়তে না হয়। তাছাড়া যেখানে যায় হোটেল কিংবা বারে কাজ নেয়। কত দেশের কত শহরে যে ওর বয়ফ্রেন্ড! ওর টেস্ট খুব এক্সোটিক। চোখ টিপে বলেছিল এসিলা।

ওদের জীবনটা বেশ অন্যরকম। বাইরে থেকে দেখলে বোহেমিয়ান জীবন মনে হতে পারে, হয়তো অনেক লোকের সঙ্গে সেক্সুয়াল রিলেশন হয়েছে। কিন্তু ওর কথা শুনে জিনির ওকে একবারও প্রমিস্কুয়াস মনে হয়নি। এসিলার চোখ নিস্পাপ আনন্দে ঝলমলায় যেন সবসময়। তার অন্য পরিচিত মেয়েদের থেকে এত আলাদা।

জিনির মাঝে মাঝে মনে হয় সে যেন দুটো জীবন যাপন করছে। একটা পরস্পরবিরোধী টান অনুভব করে। এসিলার মত জীবনের জন্য লোভ জেগে ওঠে কখনও বা। আরও বেশি জেনে ফেললে পারবে তো নিজেকে সামলাতে? ভেবে নিজের অজান্তে কেঁপে ওঠে জিনি।

 

৩.

এসিলার আঙুলগুলো জন্মদিনের মোমবাতির মত। যখন ঝড়ের বেগে চুলে কাঁচি চালায়, আঙুলগুলো খেলা করে ঝালার সময়ে রবিশঙ্করের তৎপরতায়। নিজের হাতে যখন কাজ থাকে না, ওকেই দেখত জিনি। এসিলা কেমন লেখে সেটা ওর জানা নেই। কিন্তু ওর মধ্যে একটা অসম্ভব শেকলভাঙা সৌন্দর্য আছে যেটা ওকে সবার থেকে আলাদা করে দেয়। তীব্র আকর্ষণে কাছে টানে। টমবয়িশপনা আছে। বিশেষত ও যেইসব অ্যাডভেঞ্চারের কথা শুনিয়েছে আর কোনও কিছুতে একটুও তোয়াক্কা না রেখে জীবন কাটায় সেটাকে আর কী বলবে জিনি? অথচ ওর মসৃণ ত্বক, পেলব হাতে এইসব অভিজ্ঞতার কোনও স্মৃতি নেই। ওর লম্বা টানা টানা চোখের বাদামী কালো গভীরতার সঙ্গে ঈষৎ রক্তাভ চুলের বৈপরীত্যে এক মায়াবী অনন্যতা। হেসে বলেছিল, আমার জিনের ষোলো ভাগের এক ভাগ আফ্রিকান, সেটাই নাকি ওই কালো চোখের রহস্য। কিছু সৌন্দর্য এরকম হয় যা কামনা কিংবা অন্তরঙ্গতার প্রত্যশা ছাড়িয়ে কিছু অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। চুল কাটতে কাটতে যখন এসিলা ওর খদ্দেরদের সঙ্গে ধীর সমান্তরাল গলায় গল্প করে, জিনি স্পষ্ট বুঝতে পারে ওই লোকগুলোর— সে ছেলে কিংবা মেয়ে যাই হোক, যেন সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাইছে এই চুল কাটাটা চলতেই থাকুক, আরও অনেকক্ষণ। জিনির কখনও মনে হয় এসিলা যেন ছোটবেলায় শোনা নিশির ডাক কিংবা অমোঘ নিয়তি যা ডেকে নিয়ে যায় বন্ধ দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ার জন্য। এসিলাকে ভালো করে জানার ইচ্ছেটা দিনে দিনে বাড়ছিল। সেই জন্যেই এসিলা আর জিনির অফ ডে যেবার একসঙ্গে পড়ল, প্ল্যান করল একটা বেলা একত্রে কাটাবার। তিস্তা ডে কেয়ারে থাকবে, জিনিই আসবে এসিলার বাড়ি।

–আমি তোমার জন্য একটা কিছু খাবার বানিয়ে আনব। কী খাবে বলো।
–আমি কিন্তু ভেগান।

ভেজিটেরিয়ান জানত, ভেগানদের সঙ্গে পরিচিত ছিল না জিনি। খোঁজ নিয়ে জানল দুধ কিংবা ডিমও খায় না এরা। আগে ভেবেছিল পনির বানাবে, ভেগানদের খাওয়ার নমুনা জেনে ধোঁকার ডালনা বানিয়ে নিয়ে এসেছিল জিনি। ডাল খেতে ভেগানদের আপত্তি নেই।

ডাউনটাউনের কাছে সাউথ মেন স্ট্রিটের ওপর ছোট্ট একটা বাড়ি। বোঝাই যায় অনেকদিন আগেকার। জানালা দরজাগুলো ছোট ছোট। পেস্তা রঙের বাড়িটার সামনে ফুলের বাগান, ড্রাইভওয়েতে শুধু একটা গাড়ি রাখার জায়গা। সেখানে এসিলার সাদা রঙের বিটলটা রাখা আছে। জিনি নিজের গাড়ি রাস্তায় পার্ক করে হাতে তরকারির বাটিটা ব্যালেন্স করে এগোল। আজ শাড়ি পরে এসেছে, এসিলার খুব ইচ্ছা ছিল ওকে শাড়িতে দেখার। ছবিতে দেখেছে, সামনাসামনি দেখতে চায়।

এসিলা দরজা খুলতেই যে চমকটা পেতে হবে তার জন্য তৈরি ছিল না জিনি। নির্মল হাসি মুখে নিয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিল এসিলা। সম্পূর্ণ নিরাবরণ। গায়ে কোনও পোশাক নেই! জিনি এত অবাক হয়ে গেছিল যে কয়েক মুহূর্তের জন্য মুখ ফুটে কোনও কথাও বেরোল না। তারপর শুকনো হেসে বলল, এমা, আমি ভুল করে তোমার স্নানের সময়ে চলে এসেছি। সেটাই মনে হয়েছিল শুরুতে। স্নান করতে করতে দৌড়ে চলে এসেছে, তাড়াহুড়োয় কোনও রোব জড়িয়ে নেয়নি। যদিও এসিলার শরীরে জলের ছিটাফোঁটা ছিল না। কিন্তু এছাড়া আর কোনও কারণ খুঁজে পায়নি জিনি।

–না তো। আমি তো কিচেনে ছিলাম। এসিলা এমনভাবে বলল যেন কোনও অস্বাভাবিক কিছু হয়নি, এমনটাই তো হওয়ার কথা। যদিও পরমুহূর্তে জিনির অবস্থাটা যেন বুঝতে পারল। এই বুঝতে পারাটা ওর চোখেমুখে এমনভাবে ফুটে উঠল, যেটা সত্যি ছাড়া অন্য কিছু হতে পারত না। ও ফাক! আমি তো তোমাকে কখনও বলিনি। আমি বাইরে না বেরোলে সাধারণত কোনও পোশাক পরি না। তোমার কি অসুবিধা হবে?

এসিলার শরীর থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না জিনি। কোনও নগ্নতাকে কি নিষ্কাম বলা যায়? ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা এমন অনায়াস, ভণিতাবিহীন যে নীলাভ পদ্মের মত ঊর্ধ্বমুখী স্তন, রক্তাভ কেশে ঢাকা যোনিদেশ প্রথম চমক কেটে যেতে জিনিকে সেভাবে বিচলিত করছিল না আর। ছবি আঁকার মডেলরাও কি এমনি অনায়াস তাদের নগ্নতায়? হীরকের কাছে জানতে হবে। মুখে বলল, না না ঠিক আছে তুমি যেভাবে স্বচ্ছন্দ, তেমনিই থাকো।

–তোমার পোশাকটা কিন্তু খুব সুন্দর। জিনি নীল রঙের একটা শিফন পরেছিল আজ। তার মধ্যে বড় বড় মোটিফে হালকা হলদে গোলাপি রঙের ফুলের ছবি সারা শাড়ি জুড়ে। সঙ্গে গোলাপি স্লিভলেস ব্লাউজ, বেশ ডিপ কাট। জিনির হঠাৎ মনে হল তার পোশাক যেন অনেক বেশি প্রোভোকেটিভ এসিলার নগ্নতার থেকে। এসিলা ওর না জ্বালানো মোমবাতির মত আঙুল জিনির কাঁধে রেখেছিল। ও জিনির থেকে ইঞ্চি চারেক লম্বা। দুটো শরীর এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে জিনি ওর প্রতিটা রোমকূপ দেখতে পাচ্ছে। ওর গলার নীল শিরাটা দপদপ করছে। দেখে কেমন গা শিরশির করছিল জিনির। অথচ এসিলার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। খুব মনোযোগের সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করছিল কীভাবে এই লম্বা কাপড়টাকে এত সুন্দরভাবে শরীরে জড়িয়েছে জিনি। আমাকে শেখাবে কেমনভাবে পড়তে হয় তোমাদের শাড়ি? প্লিজ প্লিজ দেখাও কীভাবে পড়েছ। বলতে বলতেই জিনির হাত থেকে তরকারির পাত্রটা নিয়ে টেবিলে নামিয়ে রাখল। বলার ভঙ্গিতে কী ছিল, জিনির মনে হল এইটাই বোধহয় এসিলাকে এমন নিষ্পাপ রূপ দেয়— নিজের বিষয়ে সম্পূর্ণ অসচেতন হয়ে এইভাবে চাইবার তাৎক্ষণিকতা, সবকিছু বুঝে দেখার শিশুসুলভ কৌতূহল। জিনি শাড়িটা খুলে ফেলল। একটা মন বলছিল, এ কীসের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে সে। এ কোন অতল। অথচ এসিলার সামনে সে যেন নদীতে ভেসে যাওয়া কাঠের টুকরোর মত। কোনও এক সময়ে নৌকা ছিল সেটা, তার দাঁড় ছিল, পাল ছিল। নিজের গন্তব্য ছিল। এখন নেহাতই কাঠের পাটাতন, স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া ছাড়া যার গত্যন্তর নেই।

নীল রঙের সায়াটা দেখিয়ে এসিলা বলল, এই স্কার্টটা কি নিচে পড়তেই হয়, এটা কি এনসম্বলের অংশ?

–এটা শাড়িটাকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। শাড়ির কুঁচিটা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে বলল জিনি।
–শুধু শাড়িটা পরা যায় না?
–পরে দেখতে চাও? এসিলার মনের কথা পড়ে ফেলল জিনি।

বাচ্চারা যেমন খুশি হয়ে মাথা ঝাঁকায় তেমনিভাবে ওর লালচে চুল নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল এসিলা। এখুনি, এখুনি। বলার ভঙ্গিতে আবদার আর চাপল্য। চোখের ঝিকমিকানিতে কোনও দেওয়াল নেই।

জিনি আবার শাড়ি খুলে এবার এসিলাকে পরাবার চেষ্টা শুরু করল। ওর শরীরের পেলবতা স্পর্শ করে জিনির মনে হচ্ছিল যেন তিস্তাকে ছুঁয়েছে, ওমনি নরম আর মসৃণ। সেটা মনে হতেই ওকে শাড়ি পরানোটা স্নান করিয়ে তিস্তার পোশাক বদলানোর মত সহজ হয়ে গেল। আঁচল বুকের উপর দিয়ে টানার সময় জিনির আঙুল ছুঁয়ে গেল এসিলার স্তনের চূড়ায় কোনও শিহরন ছাড়াই।

খুব সুন্দর লাগছে এসিলাকে। নীল শিফন শাড়ি ওকে ঠিক আকাশের স্বচ্ছতায় জড়িয়ে ধরেছে। তোমাকে ঠিক আমাদের গডেস স্বরস্বতীর মত লাগছে।

–রিয়ালি? তোমাদের এই গডেস কী করে?
–বিদ্যার দেবী। তুমি তো লেখক, তাই পারফেক্ট ম্যাচ।

খুশির হাসি ছড়াল এসিলার মুখে। আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর  নিজেই আস্তে আস্তে শাড়িটা খুলে আবার জিনিকে দিয়ে দিল। তোমার দেশ দেখার খুব ইচ্ছে আমার। যাব একদিন। এবার চলো, আমি একটা ইন্ডিয়ান ডিশ নিজেও বানাচ্ছি। দেখো কেমন হয়।

–রিয়ালি?
–হ্যাঁ, রায়তা। তবে আমি কোকোনাট ইয়োগার্ট ব্যাবহার করছি, তাই এর স্বাদ একটু আলাদা হবে।

শাড়িটা আর পরেনি জিনি। সায়া আর ব্লাউজ তো প্রায় স্কার্ট আর টপের মতই। এর বেশি কিছু গায়ে চড়ালে এসিলার পাশে নিজেকে কেমন ওভারড্রেসড লাগছিল। রান্নাঘরের কাউন্টার টপের উপর মেয়েটা ওর দক্ষ হাতে ছুরি দিয়ে শশা কুচিকুচি করছিল। রান্নাঘরে ছুরি হাতে নগ্নতা কেমন চোখে লাগছিল জিনির। হয়তো খোলা ছুরির মধ্যে যৌনতার সঙ্কেত থাকে। জিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে ঘরের চারপাশে চোখ বুলাল। ছোট বাড়ি, ঘরগুলো ছোট ছোট। রূপকথার বাড়ির মত। আসবাব পুরনো দিনের। মনে হয় সময় থমকে গেছে। শুধু এই যুগের চিহ্ন বহন করে অজস্র বই থাকে থাকে সাজানো। কোণার স্ট্যান্ডে টিভি।

–এই বাড়িটা অনেক পুরনো, তাই না এসিলা?
–আঠেরোশো বাহান্ন।
–সে তো অনেকদিন। দেড়শো বছর হতে চলল।
–হ্যাঁ আমার গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডড্যাড বাড়িটা বানিয়েছিলেন।
–তাহলে কি তুমি এখানেই বড় হয়েছ? এতক্ষণে সোফায় গা ছড়িয়ে বসেছিল জিনি। উল্টোদিকের সোফায় এসিলা কুণ্ডলি পাকিয়ে বসে। দুজনের হাতে ওয়াইনের গ্লাস।
–আসলে আমি এখানে এসেছি অনেক পরে। জোহানা, আমার মা জার্মানিতে পড়তে গেছিল, ডুসেলডর্ফ। সেখানে এক মিউজিক কম্পোজারের প্রেমে পড়ে। বিকেম প্রেগন্যান্ট। জোহানা তখন জাস্ট আ সোফোমর। আমার বাবা ছিল টার্কিজ। তার সঙ্গে ইস্তাম্বুল চলে যায় জোহানা। ওখানেই আমার জন্ম।
–সেটা তো শুনেছি দারুণ জায়গা।
–আমি বেশিদিন ছিলাম না ওখানে। আমার বাবা অন্য একটি মেয়েকে নিয়ে চলে গেল, তখন জোহানা ফিরে এল ডুসেলডর্ফে। এসিলা বলছিল, কোনও ওঠাপড়া ছিল না এই কথাটা বলার সময়। জিনির মনে হল ওর বাবা চলে গেল, এসিলার কিছু মনে হয়নি? সেরকম অনুভূতিহীন মেয়ে তো ও নয়। জিনি নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারে বাপি যদি তাকে পাঁচ বছর বয়সে ছেড়ে চলে যেত কেমন লাগত। নিজেকে সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলল, তোমার খারাপ লাগেনি এসিলা?
–কিসে? চোখের পাতা পুরো মেলে দিয়ে তাকাল এসিলা।
–বাবা চলে গেল যে… কী বলবে বুঝতে পারল না জিনি।
–সেই সময়ে হয়তো খারাপ লেগেছিল, কিন্তু তখন আমার কীইবা বয়েস। এরপর এতগুলো বছর কেটে গেছে, ছবি না দেখলে বাবার মুখ মনেও পড়ে না। ডুসেলডর্ফে ফিরে মা তার এডুকেশন কমপ্লিট করল। ওখানেই পড়াত। আমি প্রায় দশ বছর ছিলাম ওখানেই। খুব মিস করি রাইনের ধারে বসন্তের সন্ধ্যাগুলো। কিন্তু দিদিমার শরীর খুব ভেঙে পড়ে, একা আর পারছিল না। আমি আর মা ফিরে এলাম। আমি, জোহানা আর আমেলিয়া। এই বাড়িতে। দাদু মারা গেছিল অনেকদিন আগেই।

জিনির কেমন যেন মনে হল ওই তিন জেনারেশনের তিনটি মেয়ে ঘরের মধ্যে পাখির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে, কারও শরীরে কোনও পোশাক নেই। এসিলা যেন ওর মনের কথা বুঝতে পারল। হেসে বলল, বাড়িতে আমরা কেউ পোশাক পরতাম না। আসলে ওই সময়েই আমরা ন্যাচারাল লিভিং অ্যাডাপ্ট করি। এটা জোহানার আইডিয়া। আমেলিয়াও রাজি হয়ে গেল।

–আর কারও অসুবিধা হয় না। মানে ধরো তোমাদের কোনও নেবার কিংবা যদি মনে করো কোনও হ্যান্ডিম্যানকে বাড়িতে ডাকলে।

চোখ কুঁচকে ভাবল এসিলা। এটা তো স্ক্যান্ডেভেনিয়ান কান্ট্রি নয়, তাই ওপেন ন্যুডিটি এখানে অ্যাক্সেপ্টেবল না। বাইরের কেউ এলে আমি হয়তো রোব পড়ে নিই। আমার এক নেবার ছিল। হি ওয়াজ আ ক্রিপ। জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করত। কিন্তু সেই পিপিং টম এখন চলে গেছে।

–তোমার মা দিদিমা এরা কোথায়? কলেজ থাকতে যদি এসিলার জন্ম হয় তাহলে মায়ের বয়স তো বেশি হওয়ার কথা নয়।
–আমেলিয়া মারা গেছে। বলতে বলতে গলাটা কেঁপে উঠল এসিলার। খুব মিস করি। জোহানা তার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ইয়াচ নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে বছর দেড়েক আগে। হয়তো ফিরবে শিগগির।
–কী দারুণ জীবন না তোমাদের। অস্ফুটে বলল জিনি। যেন কোনও ভালোবাসার বাঁধন নেই, পিছুটান নেই। নিজের খেয়ালে ভেসে বেড়াচ্ছ। এটা ভালো না খারাপ এই ধন্দে ঢুকে যেতে চাইছিল জিনির মন।

এসিলা চোখ কুঁচকে ভাবল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ভালোবাসা বাঁধে না জিনি। সেটা তো পজেশন। তবে ভালোবাসার দায়িত্ব আছে। আমার মাকেই দেখো। কলেজে পড়তে পড়তে আমি এসে গেলাম। বাবা মাকে ছেড়ে চলে গেল। তারপর জোহানা আমার দায়িত্ব একা নিয়ে এগিয়ে চলেছে কত বছর। জোহানার বহুদিনের ইচ্ছা একটা গ্যাপ ইয়ার নেবে, একটা বাঁধনছাড়া জীবন কাটাবে এক বছর। এত বছর পারেনি। ভালোবাসার জন্যেই তো।

–মা এখানে থাকলে তুমি কি মার সঙ্গেই থাকো?
–নট রিয়ালি। জোহানা বেরোনোর আগে আমি অন্য একটা বাড়িতে রেন্টে ছিলাম। ফিরে এলে আবার নিজের একটা জায়গা খুঁজে নেব।
–তোমার এই গ্যাপ ইয়ার কনসেপ্টটা আমার দারুণ লাগল শুনে। হয়তো আমিও এমনি কখনও বেরিয়ে যাব।
–চলো না, আমার সঙ্গে। আমার খুব ইন্ডিয়া ঘুরে দেখার ইচ্ছে। আমি আর তুমি বেরিয়ে পড়ব।
–আমারও যে দায়িত্ব আছে এসিলা। ভালোবাসার। আমার মেয়ে আছে না!
–মে বি আফটার টু ইয়ারস? ওকেও সঙ্গে নিয়ে বেরোবে। শিশুর চাপল্য ঝড়ে পড়ছিল এসিলার গলায়।

শুনলে হীরকের চোখমুখের কী অবস্থা হবে ভেবে হাসি পেল জিনির। কিন্তু এইরকম একটা অনাবিল জীবন খুব টানছিল জিনিকে। মনে হল এসিলার সঙ্গে অন্য কোনও জীবনের স্বাদ পেতে পারে। এদের কি হিপি বলে? কিন্তু হিপিরা তো গাঁজা খায়। দেখে বেশ নোংরাও লাগে। এসিলাকে দেখে সেরকম মনে হল না মোটেই। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল, নিশ্চয় যাব এসিলা। আই উইল লাভ টু। কিন্তু স্টর্ম চেজ করতে নয় তাই বলে।

জোরে হাসল এবার এসিলা। আমিও যাই না আর।

–আমাকে বলো না তোমার স্টর্ম চেজের গল্পটা।
–আমার লেখা গল্প নয়, আমি তোমাকে আমার এক্সপিরিয়েন্সের কথা বলতে পারি। নড়েচড়ে বসল এসিলা। সোফায় পা তুলে হাঁটুর উপর থুঁতনি রেখে জিনিকে নিয়ে যাচ্ছিল ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে।
–এটা হয়েছিল এল রেনো, ওকলাহামায়। আমরা একটা গ্যাস স্টেশনে বসে টর্নেডোর অপেক্ষা করছিলাম। ঝড় তাড়া করতে গিয়ে এরকম হয়, সময় থমকে থাকে। সবাই একসঙ্গে বসে হ্যাকি স্যাক খেলছে আর ক্রমাগত জাঙ্ক ফুড। আমি অবশ্য স্যালাড। দাঁত দেখিয়ে হাসল এসিলা। ওয়েদার রিপোর্ট বলছিল কিছু হতে চলেছে। হলও। বিকেল পাঁচটার পর ঝড় এল। প্রথমে একদম বুঝতে পারবে না জানো। শুধু দূর আকাশে এক খণ্ড মেঘ। তার মধ্যে ফেটে পড়ার কোনও সম্ভাবনা বোঝা যায়নি। কিন্তু মিনিট পনেরোর মধ্যে ওই ছোট্ট মেঘ হয়ে গেল দুরন্ত ঘূর্ণি। আমি তখনও জানালা দিয়ে দেখছিলাম। দূরে যেন লম্বা একটা দেওয়ালের মত। অ্যাবি ক্যামেরা নিয়ে বাইরে চলে গেছিল। আমি ভেবেছিলাম টর্নেডো বুঝি ওই দেওয়ালের পিছনে লুকিয়ে আছে। আসলে বুঝিনি, ওই দেওয়ালটাই টর্নেডো। দেওয়াল যেটাকে বলছি সেটা মনে করো লম্বায় ৩ মাইল। দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে দেখাল এসিলা। আর সেই দেওয়াল ছুটে আসছে ঘণ্টায় তিনশো মাইলের গতিতে। বুঝতে পারছ অবস্থাটা? টর্নেডো ওয়ার্নিং এলে সবাইকে শেল্টারে ঢুকে যেতে হয়। আর আমরা শেল্টার ছেড়ে গাড়ি নিয়ে ছুটলাম ওই টর্নেডোর দিকে। শুধু আমরা না, আমাদের মত এরকম আরও অনেক চেজার, সবাই। অ্যাবি একটা এফ-১৫০ চালাচ্ছিল। ভাবতে পারবে না, ওই হাওয়ায় মনে হচ্ছিল যে কোনও মুহূর্তে ট্রাকটা পাখির মত উড়ে যাবে। উত্তেজনায় চকচক করছিল এসিলার চোখ। যেন এখনও চোখের সামনে ওই ঝড় দেখতে পাচ্ছে। টর্নেডোর হাওয়ায় একটা টান থাকে, আমাদের গাড়ি ওই টানে এক তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছিল ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে একটা সুতোয় ঝুলছিলাম আমরা। সেদিন তিনজন স্টর্ম চেজার মারা গেছিল। ভাবো, একটু আগেই আমরা একসঙ্গে হ্যাকি স্যাক খেলছিলাম।
–ভয় লাগেনি এসিলা?
–টর্নেডো খুব কম সময়ের মধ্যে উড়ে চলে গেছিল। ভয় পেয়েছিলাম হয়তো, আসলে সেই মুহূর্তের তীব্র উত্তেজনায় অনুভূতিগুলো অন্যভাবে প্রকাশ পায়, তাকে ঠিক ভয় বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এই ঝড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে আমার মনে হয়েছিল জীবনকে আরও বেশি ভালোবাসার প্রয়োজন, আমার সবকিছু দিয়ে, প্রতিমুহূর্তে বাঁচার মধ্যে দিয়ে।

জিনি অবাক হয়ে শুনছিল। এই যে ওরা নতুন বাড়ি কিনল, রোজ নতুন নতুন জিনিস এনে সাজাচ্ছে। তাতেও তো আনন্দ হচ্ছে। জীবনটাকে পরিপূর্ণ মনে হয়েছে। এখন এসিলার কথা শুনে তবে কেন মনে হচ্ছে সেখানে কোনও ফাঁক রয়ে গেছে? ঝড়ের কথা বলতে গিয়ে এসিলার শরীর কেমন ইত্তেজনায় টানটান হয়ে গেছিল। হাত মুঠি পাকিয়ে উঠেছিল অজান্তেই। ওর দৃঢ় হয়ে ওঠা স্তনবৃন্ত বোঝাচ্ছিল কী দুরন্তভাবে ওই ঝড়কে কামনা করছে এসিলা। সমস্ত শরীর দিয়ে। এখনও সেই ঘূর্ণি যেন ওর শরীরের প্রতিটা রোমকূপে জমা হয়ে আছে। এ এক অন্য জীবনের হাতছানি। জিনির মনে হল এই দেশে বাইরে থেকে যে জীবন ওরা দেখতে পায় তাছাড়াও অন্য একটা জীবনের অন্তঃসলিলা ধারা বয়ে চলেছে। সেই নদীতে ডুব দিতে না পারলে দেশটাকে পুরোপুরি বোঝা হবে না।

সেদিন এসিলার বাড়ি থেকে ফিরেছিল একটা বিভ্রান্তি নিয়ে। সাজানো জীবনের যে ছক বাঁধছিল সেটা কেমন নাড়া খেয়েছিল। তবে হীরককে কিছু বলেনি। কিছু কিছু কথা মনের মধ্যে একা পুষতে হয়, আদর করতে হয় সঙ্গোপনে।

 

[ক্রমশ]


ছায়াপাখি-র সব কটি পর্বের জন্য ক্লিক করুন: ছায়াপাখি — বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...