ভারতে অভূতপূর্ব এক আন্দোলন থেকে পাওয়া শিক্ষা

অমিত ভাদুড়ি

 


জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক

 

 

 

দানবটিকে আমরা সম্পূর্ণ চিনি না বটে, তবে সম্প্রতি সে আহত হয়েছে। তবে কতটা হয়েছে, তা ভবিষ্যৎই বলবে। লোকে বলে, ভারতের গরিষ্ঠমূলক গণতন্ত্রের দুর্বৃত্তায়ন থেকে দানবটির সৃষ্টি। আবার অনেকে বলেন, সত্যের নামে সাংবিধানিক ও অসাংবিধানিক সোজা আর বাঁকা পথে বারবার সংবিধানকে বিকৃত করবার চেষ্টাগুলি থেকেই দানবটির উদ্ভব। দানবটিও নিরন্তর নিজের রূপ বদলায়। সত্যের ফাঁপা বুলি আউড়ে কিছু শূন্যগর্ভ আইনের অবতারণা করে, এবং দাবি করে তাই দিয়ে নাকি দেশকে অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের উগ্রবাদীদের থেকে রক্ষা করা হবে। শুধু বিরোধীদের নয়, সব ধরনের ভিন্নমতকে স্তব্ধ করবার জন্যে, সমস্ত বিরুদ্ধ মতের ওপর জবরদস্তি ইস্ত্রি চালিয়ে দিতে দানবটি রোগগ্রস্ত এক জাতীয়তাবাদের সংস্করণ প্রচার করেছে। ইতিমধ্যে দেশের প্রতিটি কোণে তা টের পাওয়া গেছে যেখানে আর্থিক বৃদ্ধি আর উন্নয়নের নামে, কালো টাকা আর দুর্নীতি দূর করার নামে দরিদ্র মানুষদের রুজি-রুটির উপায়গুলিকে ক্রমাগত নষ্ট করা হয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের যে পরিসরে দানবটি নিজের কীর্তির স্বাক্ষর রেখেছে, সেখানে বাস্তবের পরিবর্তে আছে বৈদ্যুতিন প্রতিবিম্ব, বিজ্ঞাপনই যেখানে সংবাদ আর সংবাদ যেখানে বিধ্বংসী প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত।

বহু-মাথা বিশিষ্ট এই দানবটিকে যে জোর আঘাত হানা হয়েছে, তা আচমকা নয়। এই আঘাতের জন্যে যে শক্তির প্রয়োজন, তা একীভূত হয়েছে শহর দিল্লির সীমানার বাইরে তাঁবু গেঁড়ে, ট্রাক্টর আর ট্রলিগুলিতে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা উপেক্ষা করে মাসের পর মাস অবস্থানের মধ্যে দিয়ে প্রচুর সংখ্যক ভারতীয় কৃষকদের সংগৃহীত এক বিষয়বিমুখ অসাধারণ সাহস আর দৃঢ়তা থেকে। তাঁদের শহরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তবুও তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষায় থেকেছেন, কবে তাঁদের কথা শোনা হবে। গত বছর সরকার যে সন্দেহজনকভাবে তড়িঘড়ি রাজ্যসভা থেকে তিনটি কৃষি বিল অনুমোদন করিয়ে আনে, সেগুলি তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। সরকার প্রথমে তাঁদের দাঙ্গাকারী জনতা হিসেবে চিহ্নিত করে জলকামান, টিয়ার গ্যাস দিয়ে হঠাতে চেষ্টা করে। সেগুলিতে কাজ না হওয়ায় দিল্লির মূল প্রবেশদ্বারে ব্যারিকেড বানিয়ে কৃষকদের আটকে দেয়। সরকার দেখাতে চায় যে কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। অথচ বহু মাসব্যাপী চলতে থাকা ১১ দফার আলোচনায় কৃষকরা কেন আইনগুলি প্রত্যাহারের দাবি তুলছে সেই মৌলিক প্রশ্নটিই বারবার এড়িয়ে যায়। অচলাবস্থা চলতেই থাকে, কিন্তু কৃষকরা তার মধ্যেই একটি নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে নিয়েছেন। পুলিশ মোতায়েন করে আর ব্যারিকেড গড়ে সরকার তো ইতিমধ্যেই তাঁদের ঘিরে রেখেছে। এবার কৃষকরা চারপাশের কৃষকদের আন্দোলনে সামিল করে গোটা এলাকাটিই ঘিরে নিলেন। শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী, অ্যান্টি-ন্যাশনালিস্ট, বাম চরমপন্থী, নকশাল, মাওয়িস্ট প্রভৃতি বিশেষণে দাগিয়ে সরকার বারবার কৃষকদের অভিযুক্ত করতে থাকে। এক বন্ধু মজা করে বললেন, মাও বলেছিলেন না ‘গ্রামগুলি দিয়ে শহরগুলি ঘিরে নাও’— কৃষকরা মাও সম্পর্কে কিছু না জেনেও ঠিক তাই করছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের জন্য এটাই দার্শনিক বিচার। কারণ, তাঁরাই মাওয়িস্ট বলে এঁদেরকে দাগিয়ে দিয়েছেন। কৃষকরা এত কিছু সংঘটিত করলেন হিংসার এতটুকুও হিংসার আশ্রয় না নিয়ে।

যেমনটা হওয়ার ছিল, তেমনটাই ঘটল। আশপাশের গ্রামগুলি থেকে অধিকাংশ কৃষকরা তাঁদের পরিবার পরিজনদের নিয়ে আন্দোলনে যোগ দিলেন। ক্ষেতে পালা করে কাজ চলতে লাগল। দিনের শেষে মহিলারা এলেন। তাঁদের দৃঢ়মনস্কতার কারণে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা সবার কল্পনা ছাড়িয়ে ক্রমশ বাড়তেই থাকল। মাঠে বা কারখানার দৈনিক মজুরদের চেয়ে তাঁদের আন্দোলনে রয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ঢের বেশি। দৈনন্দিন কর্তব্যপালনে ওঁরা যে বিষয়বিমুখ দৃঢ়তায় অভ্যস্ত, সেই দৃঢ়তা এবার এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিমুখে সংবদ্ধ হল। এর ফলে আন্দোলনটি যে শক্তিশালী আকার ধারণ করল, সরকার তা একেবারেই আন্দাজ করতে পারেনি। যে সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছিল একটা হিংসাত্মক দমন নামানোর, সেই সরকার এবার ভয় পেতে শুরু করল।

এই এলাকাগুলিতে, বিশেষ করে পাঞ্জাবের পাশে হরিয়ানার গ্রামগুলিতে পিতৃতন্ত্রের জোর বেশি। উঁচু জাতের প্রতিনিধিরা এখানে ‘খাপ পঞ্চায়েত’ চালায় এবং জাতপাতের ভেদবিভাজন এখানে প্রবল। মাঠে কাজ করা দলিত মজুরেরা আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছেন কারণ তাঁরা বুঝতে পারছেন নতুন তিনটি কৃষি আইন কার্যকর হওয়ার পর যে শস্যের জনবিতরণ ব্যবস্থায় নির্ভর করে তাঁরা বেঁচে আছেন, বেসরকারি মুনাফালোভীরা সেই ব্যবস্থা দখল করে নেবে। সংবাদমাধ্যমগুলি থেকে যাঁরা এখানে এসেছিলেন তাঁরা আশ্চর্য হয়ে নিজেদের রিপোর্টে জানিয়েছেন, যে জাতিভেদ প্রথা এখানে প্রচলিত, তা দিল্লি সীমানার বাইরে এবং অন্যত্র ভেঙে পড়েছে। জাত, ধর্ম, লিঙ্গ এবং ধর্ম— বিশাল এই আন্দোলনে সব মিলেমিশে গেছে। এখানে সবার লক্ষ্য একটাই— কৃষি আইনগুলিকে প্রত্যাহার করাতে হবে এবং কৃষিপণ্যের কেনাবেচায় ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এবং বিজেপি-কে যে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে তা বোঝা গেছে। গ্রামেতে কৃষকরা বিজেপি কর্মীদের বয়কট করেছেন এবং বিজেপি-র রাজনীতিকরা যখনই বক্তব্য রাখতে উঠছেন, কৃষকরা তাঁদের ঘিরে ধরছেন। ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা অচল হয়ে বসে আছেন, কোথাও যেতে আসতে হলে পুলিশ প্রহরার প্রয়োজন হচ্ছে।

এই কৃষক আন্দোলন শুরুর কয়েক মাস আগে মোদি-শাহের শাসনকে এক অনভিপ্রেত পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। যখন সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিরাপত্তাহীন করবার স্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে বানানো নাগরিক সংশোধনী আইন (CAA) প্রত্যাহারের দাবি নিয়ে হাজার হাজার মুসলমান মহিলা এক স্বতঃস্ফূর্ত অবস্থান বিক্ষোভে যোগ দেন। এই যে এক অনভিপ্রেত পরিস্থিতি যার ফলশ্রুতিতে মহিলাদের যে এই স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ, দেখা গেল মোদির আচমকা ঘোষণায় শাসন চালানোর রীতিটির সবচেয়ে কড়া ওষুধ— এটি উল্টে মোদিকেই স্তম্ভিত করে দিচ্ছে। এর ফলে অবশ্য বিরোধীরাও অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছেন— সে যাই হোক। আগে এই আচমকা ঘোষণাগুলিতে বেশ কাজ হত। যখন মোদি নোটবন্দি করেন এবং কোনও প্রস্তুতি বা সাবধানতা ছাড়াই লকডাউন জারি করেন।

এমনকি, কৃষি আইন পাশ করবার আগে মোদি সরকার তাড়াহুড়ো করে যখন শ্রমবিরোধী আইনগুলি পেশ করে, তখনও তার বিরোধিতা ছিল যথেষ্ট ক্ষীণ, যেহেতু পার্টি-নির্ভর বিশাল ট্রেড ইউনিয়নগুলি কার্যকরী এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অসমর্থ ছিল। এই প্রেক্ষিতে বুকে বল পেয়ে সরকার তিনটি কৃষি আইন সংসদে তড়িঘড়ি পাশ করিয়ে নিয়ে দেশের জন্য শস্য কেনা-খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থাগুলিকে তাদের দুই গুজরাটি কর্পোরেট বন্ধুর তৈরি ভারতের দুই বৃহত্তম বেসরকারি শিল্প সংস্থার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল।

কৃষকরা দিল্লির বাইরে অস্থায়ী টাউনশিপ বানিয়ে নিঃশব্দে এক দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তারপর তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যাওয়ায় নতুন স্থানীয় নেতৃত্ব এবং নতুন উদ্যোগের উদ্ভব ঘটে। রাজনৈতিক দলগুলির পরামর্শ বা নির্দেশের তোয়াক্কা না করে আন্দোলনের নেতৃত্ব তাঁরা নিজেদেরই কাছে রাখেন। এতে রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রায় বাধ্য হয়েই এই বিশাল আন্দোলনকে সমর্থন করতে হল। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা কী এবং তা কীভাবে কাজ করে সেগুলি সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকলেও তাঁরা সারা দুনিয়াকে তা হাতেকলমে দেখিয়ে দেন। সবার জন্যে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পথ খোলা, যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা সবার সামনে নেওয়া হচ্ছে এবং শত প্ররোচনাতেও সব কিছুই চলছে শান্তিপূর্ণভাবে। এই আন্দোলনকে রুখবার ক্ষমতা কারও নেই কারণ, যাঁরা এই আন্দোলনে শরিক, তাঁদের সবার এর গতি-প্রকৃতির প্রতি সম্পূর্ণ সায় আছে। এতকাল ধরে ওপরমহল দ্বারা নির্দেশিত দলীয় অনুশাসন ব্যবস্থার ধারণাকে নস্যাৎ করে দেখা গেল স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারীদের স্বয়ং-প্রবৃত্ত হয়ে একটি লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে সমন্বিত অনুশাসন।

এক বছর আগে নভেম্বর ২৬, ২০২০-তে শুরু হওয়া এই ঐতিহাসিক আন্দোলনটির প্রথম কৌশলগত জয় এল নভেম্বর ১৯, ২০২১-এ, যেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী আচমকা টিভির পর্দায় আবির্ভূত হয়ে পিছু হঠার ঘোষণা করে জানালেন তিনি চান কৃষি আইনগুলি প্রত্যাহৃত হোক।

২০১৬ সালে যখন উনি আচমকা নোটবন্দির ঘোষণা করেন তখন বলা হয়েছিল ওঁর নাকি ইচ্ছা কালো টাকা অপসারিত হোক। তখনও উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন ছিল আসন্ন। বিজেপির হাতে যেহেতু ভেতরকার খবরগুলি ছিল ফলে ওঁর এই ঘোষণায় তাদের এতটাই লক্ষ্মীলাভ হয় যে নির্বাচনে তার ধারেকাছে কেউ আসতে পারেনি, কারণ বিরোধী দলগুলি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তখন একেবারে বিভ্রান্ত। প্রধানমন্ত্রী তখন জনপ্রিয়তার শিখরে অবস্থান করছেন এবং কালো টাকা অপসারণের যুদ্ধে নিজেকে এক ধর্মসৈনিক হিসেবে বিজ্ঞাপিত করছেন, যদিও তিনি নির্বাচনের আগে যে প্রতিটি নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা জমা করাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তবুও গরীব মানুষরা যাবতীয় প্রতিকূলতা বরদাস্ত করলেন, কারণ তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কথায় বিশ্বাস রেখেছিলেন। তাই উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল। সালটি ছিল ২০১৭।

সেই ঔজ্জ্বল্য আর নেই। দেশের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে উত্তরপ্রদেশের আগামী নির্বাচন এখন দোরগোড়ায়। দেশের পূর্বদিকে পশ্চিমবঙ্গ আর দক্ষিণে তামিলনাডুর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ইতিমধ্যেই ধরাশায়ী হয়েছে। মধ্য আর উত্তর ভারত এবার যুদ্ধক্ষেত্র, এবং কৃষকদের আন্দোলন এখানকার অনেক এলাকাতেই জমাট বেঁধেছে। রামের নামে বিশাল মন্দির বানিয়ে বিজেপি এই পরম্পরাগত হিন্দু হৃদয়ভূমিতে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের আশা রাখছে। বিভাজনমূলক এই ধর্মীয় আদর্শের বিরুদ্ধে কৃষকদের লড়বার মত রসদ কী? তাঁদের অনেকেই জন্মপরম্পরায় হিন্দু এবং তাঁরা অনেকে ইতিমধ্যে স্বীকারও করেছেন যে গত নির্বাচনে তাঁরা বিজেপি-কে সমর্থন করেছিলেন এবং সেই কারণে তাঁদের এলাকাগুলিতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে।

বিজেপি-র দিন শেষ হতে চলেছে কারণ কৃষকরাও এবার নিজেদের রাজনৈতিক বোধ নিয়ে এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছেন সরকারের কাছে এই তিনটি কৃষি আইন এত গুরুত্বপূর্ণ কেন। আন্দোলন শুরু হতে না হতেই কৃষকরা টের পেয়েছিলেন কৃষি আইনগুলি পাশ হওয়ার নেপথ্যে বিশেষ কর্পোরেট স্বার্থ রয়েছে। তাঁরা ঝুলি থেকে সেইসব হট্টাকাট্টা বিড়ালগুলি বার করে দেখিয়ে দিলেন মোদিই সেই কর্পোরেটদের পথ দেখাচ্ছেন। মিডিয়া, মুক্তবাজারের হয়ে সওয়ালকারী, এমনকি বিশ্বব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ-এর যে অর্থনীতিবিদেরা বিভিন্ন সরকারকে অলঙ্কৃত করে থাকেন— কৃষকরা তাঁদেরও চিহ্নিত করলেন। গুজরাটের দুই বিরাট ব্যবসাদারকে তাঁরা দেখিয়ে দিলেন যারা শুধু প্রধানমন্ত্রীর ভালো বন্ধুই নয়, সহযোগীও বটে, যারা এই তিনটি কৃষি আইনের ফলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন। কিছু প্রমাণ তো চোখের সামনেই ছিল— আদানিদের বানানো শস্যের গুদামঘর, রিটেল ফুড মার্কেটের প্রশস্ত পথ এবং আম্বানিদের বাল্ক অন-লাইন ট্রেডিং-এর প্রস্তুতি। নিজেদের জীবন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ কৃষকদের সামান্যবাদী আদর্শ এতটাই জোরালো এবং জীবন্ত যে তাঁরা এগুলি বলতে এবং দেখাতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করলেন না। তাঁদের কোনও পার্টি লাইন মেনে চলতে হয়নি।

অনেকে কৃষকদের এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের আদর্শগত মৌলিকতা নিয়ে ফ্যাসাদে পড়ে ভাবছিলেন এটি কি গান্ধিবাদী, না আন্না হাজারে-র দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের মতো আর একটা কিছু। শান্তিপূর্ণ বলেই যে আন্দোলনটি গান্ধিবাদী, তা বলা যায় না। গান্ধি যেভাবে দেশের সম্পত্তির ট্রাস্টিশিপটিকে দেশের উদ্যোগপতিদের হাতে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন, তার বিপ্রতীপে গিয়ে কৃষকেরা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন কৃষি নিয়ে বড় ব্যবসায় তাঁরা সায় দিচ্ছেন না। এবং দুটি কর্পোরেশনের মুনাফার জন্য প্রধানমন্ত্রী যে ভারতের কৃষিব্যবস্থাকে বেচে দিচ্ছেন, সেই দুর্নীতির উপস্থিতি আছে মানেই তা একটি দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, তা নয়। কারণ, দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনে ব্যক্তির টাকা নেওয়া আর দেওয়াকে দুর্নীতি বলা হচ্ছে। মোদিসাহেব তো আসলে সবকিছুকেই আইনে পরিণত করবার জন্যে আইন পরিবর্তন করছেন।

দৃঢ়তা এবং টিঁকে থাকার শক্তির দিক থেকে, জাত, শ্রেণি, লিঙ্গ এবং ধর্ম নির্বিশেষে মানুষদের সামিল করবার ক্ষমতার দিক থেকে এই আন্দোলনটি অদ্বিতীয় যার সোজাসাপটা আদর্শ হৃদয়ে পৌঁছায়। সেই কারণে একে ভেঙে চুরমার করা যায়নি। আর এখন তো আন্দোলনটি ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে, সরকার আন্দোলনটিকে চূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

তবে যাই হোক, আন্দোলনটি সম্ভবত এই যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সামনে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একটি বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়া জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে গড়ে ওঠা আন্দোলন কি রাজনৈতিক দলের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে? পারে কোনও নির্দিষ্ট আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাণপ্রাচুর্য, ইতিবাচক রূপান্তরকামিতা, সাধারণ মানুষের স্বার্থবাহী মতাদর্শসমৃদ্ধ এক রাজনীতি গড়ে তুলতে? রাজনৈতিক দলগুলি বারবার দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা সক্ষম নয়। তারা নির্বাচনী রাজনীতিতে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, যেখানে টাকার খেলা চলছে। মানুষের কুসংস্কার এবং পূর্বধারণাগুলির সঙ্গে সুরে সুর মিলিয়ে চলাটা তাদের জন্য জরুরি। কোদাল হলেই যে তাকে কোদাল বলতে হবে এমনটা জরুরি নয়। কারণ, প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতিতে ইমেজ-কে বাস্তবতার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। জনসাধারণকে সম্মোহন করে মায়া তৈরির ক্ষমতা দিয়ে কুৎসিত বাস্তবতাকে ঢেকে দেওয়াটাই আসল খেলা। কাজ করার চেয়ে সেখানে জরুরি ভালো ভালো কথা বলা। বাস্তবতাকে ঢাকতে মিডিয়া আর বিজ্ঞাপনের সাহায্য নিতে হবে। তাই বিশাল অঙ্কের টাকা পেতে বড় বড় শিল্পপতিদের দ্বারস্থ হওয়াটা অপরিহার্য। পার্টির সংহতির জন্য সাংগঠনিক অনুশাসন চাই, যে নির্দেশ ওপরমহল থেকে আসবে, মাঝের নেতারা সে নির্দেশ কার্যকর করবে, এবং অনুগামীরা স্রেফ অনুগমন করবে। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বলে এখন আমরা যা বুঝি তার কেন্দ্রে রয়েছে গরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য ধর্ম আর জাতপাতে সুড়সুড়ি দিয়ে তৈরি ভোট ব্যাঙ্ক। কৃষকদের আন্দোলন আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে এই বিকৃতিগুলিকে শুধরে নেওয়া যায়।

কৃষকরা একবারও বলেননি বিরোধী দল বা অন্য কাউকে ভোট দিন। বিজেপি-র কৃষিবিরোধী নীতির বিরোধিতা করেছেন তাঁরা, মোদির রাজকীয় স্পর্ধায় বীতশ্রদ্ধ তাঁরা, ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টির জন্য তাঁর রাজনীতি এবং শালীনতার অভাবের কারণে তাঁর থেকে দূরে সরতে চান তাঁরা। তিনি তো একটিবারও ৬৭০ জন কৃষকের মৃত্যুর জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেননি। বরং তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যের ছেলেকে যখন চারজন কৃষককে গাড়ির ধাক্কায় মেরে ফেলার অপরাধে সন্দেহ করা হয়, তখন তিনি নীরব ছিলেন। অথচ ঘটনাটির আগে সেই মন্ত্রী স্বয়ং প্রকাশ্য সভায় কৃষকদের হুমকি দিয়েছিলেন।

মানুষকে ভোট দিতে বলা হয় তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। তাঁদের এমন নীতির বিচার করতে আহ্বান জানানো হয় যা কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করে। সরকারের অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক দিকগুলি সম্পর্কে তাঁদের সচেতন করা হয়। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এর আগেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে সরানো হয়েছে। দিল্লিতে আম আদমি পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল সম্পূর্ণভাবেই আন্না হাজারে-র দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের কাঁধে চেপে। আদর্শের গর্বে গর্বিত ছিল সেই দল। ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই সেই দলের একমাত্র আদর্শ কীভাবে ক্ষমতায় টিঁকে থাকা যায়। একদা শক্তিশালী সিপিএম, যে নিজের মার্ক্সীয় আদর্শের জন্য গর্বিত ছিল, সেই দলই কৃষকদের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নটিকে অগ্রাহ্য করে। তখন সুশীল সমাজ কৃষকদের পাশে দাঁড়ায় এবং তৃণমূল কংগ্রেস জনসাধারণের মেজাজ বুঝে তার বলে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে। বাংলার রাজনীতি থেকে সিপিএম-কে প্রায় অপসারিত করে দিয়েছে তারা এবং সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজেপি-কেও চুরমার করে দিয়েছে। রাইট টু ইনফরমেশন এবং দেশব্যাপী রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট পাশ করে ২০০৯ সালে কংগ্রেস পার্টি যথেষ্ট রাজনৈতিক ফায়দা তুললেও তারপরে প্রমাণ হয়ে গেছে সে ধর্মনিরপেক্ষ এক উদার গণতন্ত্রে ততক্ষণই আস্থাশীল থাকবে যতক্ষণ তাদের পারিবারিক শাসনের ওপর আঁচ না পড়ে। বিজেপি এই বিশ্বাস নিয়ে ঔদ্ধত্য দেখায় যে সে হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় বিভাজনকে সুচতুরভাবে ব্যবহার করে নির্বাচনে জিতেছে। তারা আরও সুচতুরভাবে হিন্দুদের জাতপাতভিত্তিক বিভাজনমূলক কুৎসিত বিষয়গুলিকে, দলিতদের, তফসিলি জাতির মানুষদের ওপর করা অত্যাচারকে এবং আদিবাসীদের অধিকার দমনকে ঢাকতে চায়।

কৃষকদের আন্দোলন এতদূর অবধি এই বিকারগুলির বেশ কয়েকটির বিরুদ্ধে কড়া ওষুধ হিসেবে কাজ করেছে। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দলগুলিকে এর ফল ভুগতে হবে।

বেকারত্ব যত বড় বিষয়ই হোক না কেন, একমাত্র নির্বাচন এলেই তা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কোনও রাজনৈতিক দল আজ অবধি গুরুত্ব দিয়ে এই সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। দারিদ্র, শিশুদের অপুষ্টি, প্রকৃতিকে এবং জীবনধারণের উপায়গুলিকে আর্থিক বৃদ্ধি আর উন্নয়নের নামে বিনষ্ট করার বিষয়গুলির গুরুত্বও টিঁকে থাকে শুধু নির্বাচনী তরজায়। সব রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রেই ক্ষমতায় থাকলে এই প্রবণতা দেখা গেছে। না থাকলে তারা সবাই এই প্রবণতাগুলির বিরোধিতা করে।

কৃষকদের আন্দোলন এই খেলাটাকেই সোজাসুজি চিহ্নিত করেছে। এ সেই চিরাচরিত খেলা যা দেশের আর্থিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব হাতে গোনা কয়েকটি কর্পোরেশনকে সঁপে দিয়ে মাঝে মাঝে দানধ্যান করে দরিদ্রদের চাহিদাহীন এবং বিনীত রাখতে চায়। দল-বিশেষে কিছু তফাৎ থাকলেও তা কেবল মাত্রার রকমফের। এই খেলায় মোদিসাহেব নিষ্ঠুরভাবে লক্ষ্যে অবিচল থেকে সবাইকে ডিঙিয়ে গেছেন। কৃষকদের আন্দোলন জোর করে চোখ খুলিয়ে দেশের মানুষকে এই ফন্দি বিষয়ে সচেতন করেছে। এখনও এই আন্দোলনের সব বৈপরীত্যের সমাধা হয়নি, তবে প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ভারতের কৃষকদের। তার চেয়েও বড় কথা, এই কৃষকরা দেশের সাধারণ জনগণের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছেন। মানুষ উপলব্ধি করতে পারছে সব বুঝে, একত্রিত হয়ে টিঁকে থাকলে ভুলগুলিকে শোধরানো সম্ভব। সব শ্রেণির রাজনীতিবিদদের জন্য একদিক থেকে এটি ভয়ের বিষয়, কারণ এতকাল ধরে যেভাবে তাঁরা মানুষদের নাচিয়েছেন, তা এখন সেইভাবেই চালানোটা তাঁদের পক্ষে একটু মুশকিল। ত্রুটি ভরা একটি গণতন্ত্র নিয়ে রাজনীতিবিদের কচকচির বাইরে এক নতুন বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠা করল কৃষকদের আন্দোলন।


*মূল ইংরাজি থেকে বাংলা ভাষান্তর: সত্যব্রত ঘোষ

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...