![angshuman](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/12/angshuman.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
অংশুমান দাশ
পরিবেশকর্মী, খাদ্য ও কৃষি বিষয়ে দীর্ঘদিনের কর্মী
সন্ধে হয়ে এল। মহাদেবদা আর একটা বিড়ি ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল। শীতের হালকা কুয়াশার সঙ্গে সেই ধোঁয়া আর আলাদা করা যাচ্ছিল না। সারাদিন জলে জলে ধানকাটার পরে হাত-পায়ের চামড়া সাদা হয়ে কুঁচকে গেছে। অনেক ধান তোলা যায়নি। ধানমাঠেই পড়ে আছে তিনমাসের পরিশ্রম।
–প্রায় এমনই হইংছিল গেল বছর। তাই লয়? একদিন কি দুদিন ইদিক উদিক। আমি ঠিক সময়মত কাটিছিলম বলে কিছুদিন চলেছিল। সুনীলের ধান তো পুরোটাই মাঠেই পচল।
–প্রতি বছরই এমন হচ্ছে মহাদেবদা?
–ইবার দেখলি না— কত্ত দেরি করে আকাশের জল এল। ধান রুইতেই তো দেরি। তা আবার এখন…
–এই সব কিছু বদলে যাচ্ছে— জলবায়ু বদল। তাই নিয়েই তো সব দেশের মাথারা মিটিং করছিলেন।
–জলও বটে বাতাসও বটে— সবই তো কেমনপারা হইং গেল দেখতে দেখতে। এদিকে ঝোরাগুলান রুখু হয়ে গেল— ওদিকে আকাশজলের আর শেষ নেই। কার্তিক মাসের হিমেই তো ধানে দুধ আসত— তা কার্তিকে দেখি গরম ছাড়ে। এবছর বনে ছাতু ফুটে নাই। মিটিন তো করতেই হবেক। তা কী বললেক মিটিনে? সব আবার আগের মত হইং যাবেক?
–বলছে তো। তুমি আমি দেখে যেতে পারব না— তবে একদিন নাকি ঠিক হবে।
–কী ঠিক হবেক বল দেখি? মহাদেবদা নেভা বিড়িতে আবার আগুন দেয়। সারাদিন কোঁচড়ে থেকে মাঠের জলের ছিটেয় বিড়ি ভিজে গেছে। দেশলাইয়ের আগুনে মহাদেবদার উদাসীন চোখদুটোয় একবিন্দু দেশলাইয়ের আলোর ছায়া দেখা যায়। অবশ্য আলোর ঠিক ছায়া হয় কিনা জানি না। চোখে তো কোনও কিছুর ছায়া পড়ে না— প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। তেমনি দেশলাইয়ের আলোর আলোটুকুই ফুটে ওঠে চোখের মণিতে।
–যদি পৃথিবীর গরম হয়ে যাওয়া কমাতে হয়, ওই যত ধোঁয়া বেরোচ্ছে গাড়িঘোড়া কলকারখানা থেকে তা নাকি ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কমিয়ে দিতে হবে। তবে গড় তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি বাড়ার মধ্যে রাখতে পারবে— আমি বিড়বিড় করি— নিজের কাছেই যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না— তাই আমার গলা মহাদেবদার কান অবধি পৌঁছায় না। মহাদেবদা শোনার জন্য আমার কাছে এগিয়ে আসে। আমি সারাদিনের জলে ভেজার সোঁদা গন্ধ পাই মহাদেবদার গা থেকে।
–তা মোদিবাবু গেছিল? কী বইল্লেক?
–অনেককিছু। সবাই বলছিল কয়লা পোড়ানো বন্ধ করতে— মোদিসাহেব জোরজার করে সেটাকে বন্ধ না করে কম ব্যবহারের কথা বললেন। সবাই বলল ২০৫০-এর মধ্যে কয়লা বন্ধ হবে, মোদি বললেন ২০৭০। বললেন সূর্যের আলো, হাওয়া এইসব থেকে কলকারখানা চলবে। এমনি পাঁচ দফা নানা পরিকল্পনা দিয়েছেন…
–তা ৫০ই কী আর ৭০ই কী। আমার তো এখনি বয়স তিনকুড়ি পেরিয়ে গেছে। তা কয়লার উপরে এত রাগ কিসের?
–কয়লা পুড়িয়েই তো বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। আর সেই ধোঁয়ায় গরম বাড়ছে আরও। আর গরম বাড়ছে বলেই জল হাওয়া সব উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে।
–অ। তা বিদ্যুৎ কোথা? এই তো টিমটিম করে আলো জ্বলছে। কী নাকি সূর্যের আলো ধরার জন্যে প্লেট লাগানো এই রাস্তার আলো— তা তো রোদ নেই বলে জ্বলেনি। কিছু তো খারাপ। তার দাম এত— কে সারাবেক বল দেখি?
কয়লার সস্তা বিদ্যুতে শহরে রাস্তা রাস্তায় অনাবশ্যক আলো জ্বলবে আর এই বাঁকুড়ায় আসবে দামি সৌর বিদ্যুৎ। এই নিয়ে আমরা কয়লা খরচ কমাব— এই সোনার পাথরবাটির কথা ভেবে আমি চুপ করে থাকি। উত্তর পাওয়ার জন্য প্রশ্ন করেনি মহাদেবদা। সে আমিও জানি। আবার দ্বিচারিতার কথাও জানি। ওদিকে কয়লা পোড়ানো কমানোর কথা হবে, অথচ নতুন কয়লাখনি নিয়ে সাড়ম্বড়ে সরকারি ঢেঁড়া পেটানো চলবে। রাতের আকাশ ফুটো হওয়া ছাতার মত মাথার উপর নেমে আসছে। এক একটা তারা যেন এক একটা ফুটো— একটা দুটো করে জেগে উঠছে। যে সব দেশের মানুষের ছাদ এই ছাতা— আর আলো ওই রাতের তারা— সে সব দেশের কী হবে? এ কথা মনে হতেই নিজেকে মনে করাই, সে সব দেশে বৈষম্যেরও শেষ নেই। রাতের শহর, দিনের শপিং মলে জ্বলে থাকার জন্যে কয়লা তোলার সম্মতি আদায় হল ২০৭০ অবধি, অথচ কাল থেকেই বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল যত কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের উৎস।
–তা মিটিনে ওমনি অনেক কথা হয়।
কী করে যেন ধরে ফেলেছে মহাদেবদা যে ২০১৫ প্যারিস এগ্রিমেন্টের ধারেকাছেও যেতে পারিনি আমরা। মিটিং-এ সত্যিই অমন অনেক কথা হয়। ২০৩০এর মধ্যে কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা মানতে পারলেও গড় তাপমাত্রা ২.৪ ডিগ্রি বাড়বে— এমনও বলছেন কেউ কেউ।
–অনেক টাকাও দেবে বলেছে, মহাদেবদা।
–কিসের ট্যাকা?
–এইসব কলকারখানার যন্ত্রপাতি বদলে দিয়ে এমন করবে যে আর ধোঁয়া বেরোবেই না।
–তাতে কি জল বদলাবে? আবার ঝোরাতে জল আসবে? আমাদের জঙ্গলের গাছগুলান ফিরত আসবেক? কে দিবে ট্যাকা?
–ওই তো যাদের দেশে অনেক এমন গাড়ি ঘোড়া কারখানা, তারা দেবে যাদের নেই তাদের— যাতে তারা যেটুকু আছে সেটুকু বদলে ফেলে।
–ভিক্ষা না ঘুষ? যাদের আছে— তারাই তো বদলাক বটে আগে। যাদের নেই তারা কী বদলাবে!
এ প্রশ্নের উত্তর নেই আমার কাছে। তাই বলি,
–সে অনেক টাকা। ১০০ বিলিয়ন ডলার।
–সে টাকা পাবেক কে? সেই তো এমএলএ কালী সোরেন।
–না গো— এসব সরকারি কাজে লাগবে। সরকার করবে। এ টাকা তোমার আমার কাছে আসবে না। যদিও মনে মনে ভাবি এই টাকা দেওয়ার কথা প্যারিস এগ্রিমেন্টেও হয়েছিল, কিন্তু আসেনি। দেব বলে না দিলেও কেউ জেলে যায় না— আর টাকা চুরি করলে তো যায়ই না! প্রতিশ্রুতি মাপার জন্য কোনও আইনকানুন নেই। এবারেও ১০৯টা দেশ বলেছে ২০৩০এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মিথেন নিঃসরণ কমাবে, ১৪১টা দেশ বলেছে জঙ্গল বাড়াবে। কিন্তু না বাড়ালেই বা দেখছে কে? আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু জঙ্গল নিয়ে কিছু বলেননি!
–এই যে এ বছর ধানের জমিতে জল জমল— সেই কথা কিছু হল?
অন্ধকার আরও ঘন হয়েছে। মাঠের ধারে বটগাছ কালোর মধ্যে আরও কালো দেখাচ্ছে। প্রশ্ন জমে জমে ওমনি কালো অন্ধকারের মত হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়া ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখার জন্য বছরে ২ গিগাটন কার্বন ডাই অক্সাইড কমানোর দরকার ছিল— ফি বছর, ২০৪০ অবধি। হয়নি। গত বছর ৫.৪ শতাংশ কমেছিল লকডাউনের জন্য, এ বছর আবার ৪.৯ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ বেড়ে গেছে। ১ শতাংশ ধনী দেশগুলো এখনও ১৬ শতাংশ কার্বনের জন্য দায়ী। গরিব দেশরাও কম নয়— যার মধ্যে ভারতও আছে। আমাদের আরও উন্নয়ন দরকার— এই অজুহাতে কার্বন পোড়ানোর ছাড়পত্র দাবি করে দেশজুড়ে বৈষম্য বাড়িয়েই চলেছি— কার্বন কার জন্য পুড়বে? চিন কয়লা পোড়ানো দ্বিগুণ করে ফেলেছে প্রায়।
–হয়নি হয়নি হয়নি, আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি।
–অ, তবে আর কী। মহাদেবদা বিড়ির শেষটুকু ছুঁড়ে ফেলে দূরে। এখন আর মুখ দেখা যাচ্ছে না।
–নেতারা ওমনি বলবেক। বলবেকই। আমাদের ধান লাগাতেই হবেক— যার যা কাজ।
৪৬টা দেশ বলেছে ২০৫০এর মধ্যে কয়লা পোড়ানো বন্ধ করবে। আর ২৫টা দেশ বলেছে তার জন্য যা সাহায্য লাগে দেবে। বলেছে— এই অবধি। যদি না হয়, মহাদেবদার প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? যেমন প্যারিস এগ্রিমেন্টের ব্যর্থতার পরেও গ্লাসগোতে প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে গেল। কেন করা গেল না— সে নিয়ে পর্যালোচনার থেকে ধামাচাপা দেওয়াতেই নজর বেশি। যাদের ক্ষতি, যাদের ধ্বংস তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেওয়ার টাকার প্রতিশ্রুতি এল ৩৫৬ মিলিয়ন ডলার— সে টাকায় উন্নয়নের নামে লাক্ষাদ্বীপকে শপিং মল বানিয়ে দেওয়া হবে না তো?
মহাদেবদা হেঁটে চলে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে। আমরাও।