হে পুরাতন: ধান্যকুড়িয়ার গায়েনবাড়ি, সাউবাড়ি, বল্লভবাড়ি

পায়েল চ্যাটার্জি

 

টাকি রোড ধরে গাড়িটা যখন ছুটছে, মনে হচ্ছিল মেঘের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছি। পথের ‘পরে পথ। তাতে ‘মেঘেদের মিনার’। আঁধারের আস্তরণ। ঘড়ির কাঁটায় ‘সূর্য ডোবার পালা’ আসতে অনেক দেরি তখন। আকাশে ঘন কালো মেঘ। তবুও কোথাও আলো দেখা যাচ্ছে সবুজের ফাঁক দিয়ে।

টাকি রোড ধরে যাওয়ার সময়

টাকি রোডের দুধারের দৃশ্য মন-কেমন করা। সবুজের মেলা। সেই মেলা দেখার ইচ্ছে নিয়েই পথে নেমেছিলাম। কিন্তু অসময়ের মেঘ ধূসর মহাকাব্যের মত। আকাশের ধূসর রং, পথের দুধারের সবুজ আর তার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া আলো তেপান্তরের মাঠের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। রাস্তার ইতিউতি কাশফুল।‌ ধানের গোলা। জীবনের হাতছানি।

মেঘের বাধায় থামতে হচ্ছিল মাঝে মাঝে। দূরে বিন্দুর মতো মানুষ।‌ কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে, কেউ আবার সন্তানস্নেহে আগলাচ্ছেন ফসল। আমার চোখে চিত্রকল্প ভেসে উঠছে। ধানের শীষ আর মানুষ। জড়াজড়ি করে আছে। কোথাও শিউলিফুলের মত ভাত বাড়া হচ্ছে। তবুও মেঘ ছাড়ছে না আকাশকে। উৎসবের আকাশে বারবার অন্ধকার নামছে। ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল বৃষ্টির শব্দে। ধান্যকুড়িয়া পৌঁছনোর কয়েক কিলোমিটার আগের রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। রীতিমত চড়াই-উৎরাই। তবে কাজ চলছে মেরামতির।

এই রাস্তার দুধারের রং ঘন, গাঢ় সবুজ। জনবসতিবিহীন। বৃষ্টি নেমেছে তুমুল। তাই যাত্রাপথ দীর্ঘায়িত হল। পথটুকু অতিক্রম করতেই অদ্ভুত আলো এসে পড়ল চোখে। বৃষ্টিশেষের সোনালী আলো। ঝলমলে রোদ্দুরকে ছেড়ে যেতে চাইছে না মেঘ। কয়েক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে সময় লাগল অনেকখানি। যখন ধান্যকুড়িয়া পৌঁছলাম মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে পাশ থেকে।

ধান্যকুড়িয়া বসিরহাটের কাছে প্রাচীন জনপদ। বাস বা ট্রেন দুভাবেই যাওয়া যায়। ট্রেনে গেলে শিয়ালদহ-হাসনাবাদ লাইনের কাঁকড়া মির্জানগর স্টেশন থেকে নেমে যাওয়া যায় ধান্যকুড়িয়া। আর বাসে গেলে টাকি রোড ধরে এগিয়ে বেড়াচাঁপা মোড় থেকে পৌঁছানো যায় এই ‘স্থাপত্য গ্রামে’। উত্তর চব্বিশ পরগণার এই গ্রামে দুর্গাপুজোর আগে ভিড় থাকত চোখে পড়ার মতো। এই গ্রাম সুবিশাল ঐতিহ্যের সাক্ষী আজও। সপ্তাহের শেষে গ্রামের ভেতরে ভিড় জমায় শহুরে পর্যটকরা। তবে সপ্তাহের মাঝে গেলে নিটোল গ্রাম্য-গন্ধ। কথা-বলা রাস্তা। চণ্ডীমণ্ডপ। খলবল করতে করতে আসছে কচিকাঁচারা। শহুরে ছোঁয়া লাগেনি ধান্যকুড়িয়ার গায়ে। পঞ্চায়েত পরিচালিত গ্রাম। মণ্ডপে মণ্ডপে ঝিলিক দিচ্ছে পুজোর গন্ধ। লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা বেণী, কচুপাতা মাথায় থেকে কিশোর-কিশোরী ভিড় জমিয়েছে সেইসব মন্ডপের ধারে।

–জমিদারবাড়ি কোথায় বলতে পারো?

আমার প্রশ্নে খেলা ছেড়ে তাকাল সরল দুই চোখ। ধান্যকুড়িয়া ঢোকার মুখেই সাদা সুদৃশ্য প্রবেশদ্বার। সেই প্রবেশদ্বার ছেড়ে এগিয়ে যেতেই মাঠ। বিকেল। ইটের রাস্তা। ছোট দুই আঙুলের দেখানো পথে এগিয়ে চললাম। গ্রাম্য বিকেলের কি আলাদা গন্ধ থাকে? একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় স্পষ্ট ছাপ। মাটির সোঁদা গন্ধ।

–জমিদারবাড়ি দেখবেন তো? ওইদিকে।

একটা পুজোমণ্ডপের সামনে থেকে বৃদ্ধের গলা। আমার ইতস্তত ভাব দেখে নিজেই এগিয়ে এসেছেন। ধান্যকুড়িয়ার ‘গায়েন ম্যানসন’ পৌঁছতে চোখে যেন ঘোর লেগে গেল।

 

গায়েন ম্যানসন

সুবিস্তৃত লোহার দরজা পেরিয়ে প্রবেশ করলাম প্রাসাদে। সুবিশাল রাজবাড়ি। প্রায় দুশো ত্রিশ বছর আগের তৈরি। ধান্যকুড়িয়া জমিদার গোপীচাঁদ গায়েন-এর তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়েছিল রাজবাড়িটি। আর মহেন্দ্রনাথ গায়েন তৈরি করেছিলেন ধান্যকুড়িয়ার গায়েনদের বাগানবাড়ি।

সুবিস্তৃত লোহার দরজা

তখন ব্যবসা-বাণিজ্যে উজ্জ্বল দিন। মূলত ইংরেজদের সঙ্গেই চলত ব্যবসা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে পাটের ব্যবসা চলেছিল রমরমিয়ে। এই অঞ্চলে তখন নিত্য যাতায়াত লেগে থাকত ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের।

তাই ইউরোপীয় স্থাপত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরি হয়েছিল গায়েনদের রাজবাড়ি ও বাগানবাড়ি। গায়েন ম্যানসনের ভিতরে সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি মন্দির সম্ভবত নতুন হাতে তৈরি। অপূর্ব কারুকার্য। ঐতিহ্যময় স্থাপত্য সম্পূর্ণ গায়েন রাজবাড়ি জুড়ে। নিত্য পুজোর ব্যবস্থা হয় এই মন্দিরে। পুজোর কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত দম্পতি তখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন পরের দিনের পুজোর। অনুমতি ছাড়া গেলে একটা নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্তই ঘুরে দেখা যায় গায়েন ম্যানসনে।

নতুন মন্দির

নতুন মন্দিরটি ছাড়াও আরেকটি মন্দির রয়েছে গায়েন রাজবাড়ির ভেতরে। পুরনো মন্দিরের দরজায় তালা। তবে দক্ষ হাতের পরিচ্ছন্নতার ছাপ। সিঁড়ি, মেঝে জুড়ে পুরাতনের গন্ধ। গায়েন ম্যানসনের অন্দরমহলে ঢুকতে গেলে প্রয়োজন বিশেষ অনুমতির। স্থানীয় থানা থেকে অনুমতি নিলেও হয়। পুজোর কিছুদিন আগে থেকে সাধারণত ঠাকুরদালান খুলে দেওয়া হয় সকলের জন্য। গত দু বছর ধরে পুজো না হওয়ায় অন্দরমহলে তালা। তবে দালান, থাম জুড়ে পুরাতন আর অতীত মিলেমিশে রয়েছে। স্মৃতিরা যেন অন্ধকার অন্দরমহল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। গায়েনদের অসাধারণ স্থাপত্য-কীর্তির অন্যতম নিদর্শন নহবতখানা।

–এখানে নহবত বসত গো! কয়েক বছর আগেও। কী সব অসুখে সব পাল্টে গেছে!

গায়েন ম্যানসনের ভেতরে পুজোর কাজে ব্যস্ত সেই পুরোহিত-মশাইয়ের চোখেমুখে আলো-আঁধারির ছায়া। চিকচিক করছে স্মৃতিরা। ঐতিহ্যের গর্ব আর মলিন হয়ে যাওয়া বর্তমান পরিস্থিতির ঝাপটা। গম্বুজ আকৃতির ত্রিতল নহবতখানার অন্ধকারে তখন সূর্যের আলো পড়েছে তেরচাভাবে। দৃশ্যকল্প ভেসে উঠছে। সুর। গান। ঝলমলে রাত।

নহবতখানা

গায়েন প্রাসাদ ও গায়েনদের বাগানবাড়ির দূরত্ব বেশ কয়েক কিলোমিটার। ধান্যকুড়িয়া গ্রামে ঢোকার মূল প্রবেশস্থল থেকে একটু এগিয়ে গেলেই এই বাগানবাড়ি। প্রায় তিরিশ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে গায়েনদের বাগানবাড়ি। বিকেলের আলোয় পুকুর জুড়ে বাগানবাড়ির জলছবি। বাগানবাড়ির ইতিউতি আগাছা, অচেনা ফুলগাছ মাথা দোলাচ্ছে। পুরাতনের শেকড় নিয়ে আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে রয়েছে গাছেরা। বাগানবাড়ির গায়ে স্মৃতির মতো লেপ্টে রয়েছে অচেনা, সবুজ রঙের অবলম্বন।

বাগানবাড়ির ফটক জুড়ে বৃত্তাকার দুটি স্তম্ভ। মাঝে ধনুকাকৃতি ঝুলন্ত ছাদ। ছাদের ওপরে পাথরে খোদাই করা মূর্তি। ছোরা দিয়ে সিংহ বধ করছেন এক সাহেব। সনাতনী ভিক্টোরিয়ার গঠন। বাগানবাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ একেবারেই অনুমতিসাপেক্ষে। পুজো উপলক্ষে মানুষ ভিড় করত এখানেও। দুর্গের আদলে তৈরি বাগানবাড়ির ভিক্টোরিয়ান কারুকার্য মনোমুগ্ধকর। গ্রীষ্মকালে নাকি এখানে অনেক সময় ছুটি কাটাতেন ব্রিটিশ সাহেবরা। তাঁদের জন্য এলাহি আয়োজন থাকত। এমনকি আলাদা রেলস্টেশনের ব্যবস্থা ছিল একসময়। মার্টিন কোম্পানির তৈরি। গায়েন গার্ডেন নামের সেই স্টেশনে এসে থামত ন্যারো গেজের ছোট বাষ্প-চালিত ট্রেন।

বাগানবাড়ি থেকে যখন বেরোচ্ছি, দূরে শব্দকল্প শোনা যাচ্ছে। ট্রেনের হুইসল, উদযাপনে ব্যস্ত মানুষ। পিছন ফিরে তাকাতেই শিউরে উঠলাম। যাপন-হীন সময়ের উদযাপন। নিঃসঙ্গতার উদযাপন।

গায়েনবাড়ির অদূরেই সাউদের জমিদারবাড়ি। মূলত ব্যবসার সূত্রেই আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল গায়েনদের সঙ্গে। বল্লভদের সঙ্গেও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল গায়েন ও সাউদের সঙ্গে।

–এখানে কেউ থাকে না এখন। সবাই শহরে থাকে নাকি। আপনিও কি শহর থেকে এসেছেন?

বয়স্ক মানুষের কথায় চমকে উঠলাম। শহর! কোথায়? যেন অন্য কোনও দেশ! বা অন্য কোনও জন্ম! গ্রাম, শহর! কোথায় এদের বিস্তার! সুযোগ, সুবিধা আর অসুবিধার মাঝের পথেই তার উত্তর।

সাউবাড়ি

সাউবাড়িও জমিদারবাড়ি। বন্ধ থাকে বছরের বেশিরভাগ সময়। এই জমিদার বাড়ির কোনাকুনি দূরত্বেই এদের ‘নজর মিনার’। সাউবাড়ির মূল দরজায় ভিক্টোরিয়ান কারুকার্য।

সাউবাড়ি আর বল্লভবাড়ির দূরত্ব সামান্যই। হেঁটে মিনিট দশেক। বল্লভবাড়ি পৌঁছতেই ‘মানুষের’ দেখা পাওয়া গেল। পাহারাদার ‘পুতুল-মানুষ’। তাই এই জমিদারবাড়ির আরেক নাম পুতুলবাড়ি। সুবিশাল ফটক পেরোলেই বল্লভবাড়ির মাথায় সুউচ্চ পাহারাদার। তিনটি পুতুল-মানুষ। ছাদের ওপর। নাকি মানুষ-পুতুল! সত্যিকারের বাস্তব! দুর্গাপুজো হত এখানেও! আনন্দে অসুখের দাগ। গত দু বছর ধরে পুজো বন্ধ।

বল্লভবাড়ি

বল্লভবাড়ির দরজা-জানালায় আধুনিকতার ছোঁয়া। খুব সম্প্রতি রং করা হয়েছে। পুরাতনের গায়ে নতুনের আদল। রং লেগেছে বর্তমানের। তবুও অদৃশ্য, অদেখা হয়ে ‘অতীত’ উঁকি দিচ্ছে। নহবত বসত এখানেও। অতিথি, মানুষ সব স্মৃতি-বন্দি দেওয়ালের গায়ে।

বল্লভবাড়ির নহবতখানা

বল্লভবাড়ি থেকে কিছুটা এগোলেই রাস মঞ্চ। নবরত্ন মন্দিরের আদলে তৈরি। রাসের মেলা বসে এই মঞ্চকে ঘিরে। যদিও অতিমারির থাবায় বন্ধ সেই উৎসব।

রাস মঞ্চ

রাস মঞ্চ থেকে এগোলেই সুবিশাল মাঠ। সেই মাঠে ত্রিপল ঘেরা ছোট ছোট তাঁবু। রং ক্ষয়াটে। বৃষ্টি, রোদ, ঝড় সয়ে তাতে ‘ছাতা’ পড়েছে। ভেতরের কাঠামো উঁকি দিচ্ছে।

–এসব পুরনো! বাতিল! যাত্রা হত এখানে একসময়! নাট্য কোম্পানিরা ভিড় করত। কলকাতার সব নামীদামী অভিনেতারা এসে ‘অ্যাক্টো’ করেছেন। রাত-ভোর যাত্রাপালা চলত।

সাউবাড়িতে দেখা হওয়া সেই বয়স্ক মানুষটি। পুরাতনের কাছে পুরাতনের কথা। তবে অতীতের কিছু স্মৃতি বোধহয় বর্তমান সেই ব্যক্তির স্মৃতিপটে। চোখে তেমনই দিশা। দৃশ্যকল্পরা আবার ভেসে উঠছে। সন্ধে-রাত। মাঠ। ভিড়। মানুষ। শরত রাতের যাত্রা-পালা। মানুষ, মানুষের ছোঁয়া লাগিয়ে বসে আছে। অসুখের ভয়হীনতা। তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে ঘোমটা মাথায় আলতা-মাখা পা যাত্রা দেখতে আসছে।

–এই গ্রামে ঠাকুর তৈরি হয়। দেখতে যাবে?

ভাবনার জাল কেটে গেল সেই বৃদ্ধের কথায়। ক্লান্ত সূর্য বিদায় নিচ্ছে। ঠাকুর গড়া দেখে যখন বাড়ির পথে পা বাড়াচ্ছি পুতুলমানুষের গায়েও আঁধার লেগেছে। চণ্ডীমণ্ডপ নিস্তব্ধ। তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলছে। ছেলেমেয়েরা পড়া মুখস্থ করা শুরু করেছে। হঠাৎ মনে হল আমার চারপাশে শুধুই মানুষ ঘুরছে। কেউ নহবত আয়োজনে ব্যস্ত। কেউ অতিথি সামলাচ্ছে। চারিদিকে যেন টুংটাং আওয়াজ। হাতের চুড়ি, পায়ের মল খলবল করছে। হাতা খুন্তির শব্দ। তারপর হঠাৎ করে সব পাথুরে। বাড়ি, আগাছা, মানুষ সব লেপ্টে যাচ্ছে অতীতের সঙ্গে। ধান্যকুড়িয়া ছেড়ে যখন বেরোচ্ছি, শরতের হিমেল হাওয়ার হাত ধরে উপচে পড়ছে বিষণ্ণতা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4663 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...