শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

পিতৃব্যবচ্ছেদ | শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

পিতৃব্যবচ্ছেদ

 

বাবার মৃত্যুশয্যা মানে আমার আলোক সরকার
ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতাল
“আমাদের খেলাগুলো ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে যায়
বৈশাখ মাসের আবর্তিত ধুলো, নিঃস্ব পাতা, রক্তিম আলোর
ভিতরে অমোঘ জাগে দুটি চোখ সংহত বিরাম”
আমার সামনে বাবার জন্ম ও মৃত্যুমাসপাতা নভেম্বর গাছে জাঁকিয়ে

আমার ভাষাগত সংহতি পিতৃব্যবচ্ছেদ
সন্তানকে ক্রমাগত আক্রমণের মুখে ফেলে মজা দেখার
একধরনের অবয়ব

যে প্রজন্ম যুদ্ধ দেখেনি তারা আয়নার অভাব বোঝে না
আমাদের সমস্ত খেলা পরস্পরের হাতে বিবর্ণ হয়েছে

একটানা রোদ্দুরের একটা একঘেয়েমি থাকে, টানা যন্ত্রণারও

“উন্মত্ততা কিছুতেই ভালো নয়”
আমি পরস্পরের শরীরের শান্ত ব্যবচ্ছেদ ভাবি

মৃত্যুর কতটা পরে আমাদের মেদ সম্পূর্ণ রোদ্দুরের মতো হলুদ হবে
মাথার ব্যবচ্ছেদে কি প্রাত্যহিক অ্যানালজেসিক ধরা পড়ে?

আসলে পুরো সময়টা একটা ষাট পাওয়ারের
বাল্বের রাত ন’টার উপর মথ

আমি সচেতন অনুরোধ করছি
যেন আমার মৃতদেহের হাঁমুখ খোলা না থাকে

 

 

 

আমি প্রতিদিন বাবাকে আমার ছায়া থেকে মাংস কেটে
মাছেদের খাওয়াতে দেখি

ছায়ামাংস গেলা মাছ আমাদের প্রাত্যহিক খাবারের দুপুরে থাকে

“পাখির নিকটে গিয়ে আনন্দ দেখি না”
তেমনই প্রতিটা থালায় স্পন্দিত হয় আমার মাংসের ফ্যাকাশে

যা কোনওভাবেই বাবার ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে তুলনীয় নয় পিতৃব্যবচ্ছেদে

 

 

পিতৃব্যবচ্ছেদে আমি নভেম্বরকে ধেবড়ে যেতে দেখছিলাম
“সহজ বিকেলবেলা চিরদিন অবোধ্য নির্জন”
আমার আঁশ-ফ্যাকাশে বিকেলের দাঁতে দিনাংশের টুকরো

প্রতিটা বিকেল প্রত্যেক আগামীর মধ্যে ঢুকে থাকা
অসুস্থ একধরনের পেশির টুকরো

বাবার রাতের খাবারে আমার মাংস
আমার চর্বির হলুদ নভেম্বর দুপুরের আলো

 

 

আক্রমণ জড়ো করেছি যতবার
বিড়ালের ক্রীড়নক থাবার নীচে পতঙ্গের মতো
নিজেকে আবিষ্কার করেছি বাবার সামনে

পিতৃব্যবচ্ছেদের প্রেক্ষিত আড়াআড়ি কেটে দেয় শূন্যতা
অক্ষম কিশোর তার বুদ্ধিদীপ্তিহীন চোখ নিয়ে
হুইলচেয়ারের মতো প্রতিহিংসাপরায়ণ
কিছু সন্ধের মধ্যে ঢুকে গান শোনা

আলোক সরকার যেখানে আমাকে
হাস্নুহানার মুখোমুখি দাঁড় করান
ঠিক তার সামনে আমার
তাঁরই কাছ থেকে পাওয়া অবনত অক্ষম মৌনতা
আমার মায়ের সন্ধে মায়ের বিকেল ও দিন

একটা ফাঁপা আগুন আমার সর্বাঙ্গ ঘিরে রাখে
মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক লোম পোড়া গন্ধ
সচকিত করে দেয় বিকেলের চা খাওয়া

 

 

যেন কোনও সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হয় না বরং
অসম্ভবতাই ক্রমশ সত্য হয়ে ওঠে

যেন বিদায় মানে বৃষ্টি ফোঁটা রোপন করা
যাতে চুম্বনের লালায় রক্ত না আসে

যেন আগুনের ডেলা শান্তভাবে নীল ঝলসে দিল পানকৌড়ি
এমনই কথাহীন বার্তা পিতৃব্যবচ্ছেদ

“দৃশ্যজগতের সব ছবি অপর ছবির অনুষঙ্গ আনে”
সেভাবেই হয়তো পিতাপুত্র বুঝতে চেষ্টা করি

মফস্বলের অল্প আলোয় পুকুরে ঘাই মারা ভারি মাছ
তরঙ্গ মিলিয়ে যায় এই সত্য মেনে নিলে
সন্তানেচ্ছা কারণ হারায়

 

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...