“আনিস হত্যার সুবিচার চাই”— একটি দ্বিমাত্রিক সংগ্রাম

অহনা গাঙ্গুলি

 



রাজনৈতিক কর্মী, প্রবন্ধকার

 

 

 

…তারপর একটা ধপাস করে শব্দ এল, বাড়ির সামনের রাস্তার দিক থেকে। ভারী কিছু মাটিতে পড়ার শব্দ। এক মিনিট বাদে তিনজন উপর থেকে নেমে এল, পিছনে উর্দিধারী লোকটাও… বেরিয়ে দেখলাম… মাটিতে পড়ে আছে ও, চাপ চাপ রক্ত…

১৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনা বলছিলেন আনিসের বাবা [1]। বাবার কানে ওই “ধপাস” শব্দের ওজন কতখানি তা আন্দাজ করার মানসিক শক্তি আমাদের নেই, কাউকে যেন সেই শক্তির আন্দাজটুকুও আর না পেতে হয়। কিন্তু, আমাদের রাজ্যের মাটিতে একের পর এক আছড়ে পড়া এমন ভারী “কিছুর” শব্দ কতদূর অনুরণিত হতে পারছে, এই আলোড়ন যথেষ্ট ধাক্কা দিতে পারছে কিনা আমাদের, কীভাবে ধাক্কা দিলে যথেষ্ট আলোড়ন হবে, এই আলোড়ন কী উপায়ে রাজনৈতিক এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে ইত্যাদি বহু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার মধ্যে।

বিগত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ কর্তৃক ছাত্রখুন একটা বড় প্রকল্পের আওতায় এসেছে। মিছিলে, প্রতিবাদে, বিক্ষোভে নিরস্ত্র একদল ছেলেমেয়েকে কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ, জেলের গরাদ ইত্যাদির সামনে দাঁড় করিয়ে তাদের ধৈর্য এবং ঐক্যের বহু পরীক্ষা পুলিশ নিয়েছে। রাজ্যসরকার একের পর এক অর্ডার দিয়ে গেছে, নেপথ্যের মুখ্য নেতা— পুলিশমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তৃণমূলের লেঠেল বাহিনি, কখনও উর্দি পরে আবার কখনও উর্দিছাড়া জান নিয়েছে আমাদের সহযোদ্ধার, শহীদ হয়েছেন আমাদের সঙ্গে মিছিলে হাঁটা তরতাজা প্রাণ। নির্বাচিত ছাত্র সংসদের দাবীতে, দুর্নীতিমুক্ত পদ্ধতিতে চাকরি পাওয়ার দাবীতে— খুন হয়েছেন সুদীপ্ত মউদুলরা। খুন হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, নিহত হয়েছে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ। অতঃপর, যে মাটিতে বারবার প্রতিবাদী ছাত্র-যুবর লাশ আছড়ে পড়ে, বারবার মেহনতি মানুষের দাবীদাওয়া আছড়ে পড়ে, ভোট দেওয়ার— লেখাপড়া করার— চাকরি পাওয়ার— চিকিৎসা পাওয়ার মতো ন্যুনতম মানবিক অধিকারগুলো নিথর হয়ে যায়— সেই মাটিই হয়ে ওঠে উগ্র মৌলবাদের উর্বর ক্ষেত, সেই মাটিতেই নির্দ্বিধায় বাড়ে আরএসএস। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার, মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে নিরবচ্ছিন্নভাবে আরএসএস-এর বেড়ে ওঠার জমিকে উর্বর করতে থেকেছে। সেইজন্যই, বিজেপি নির্বাচনের পাটিগণিতে পরাজিত হলেও, আরএসএস-এর প্রিয় রাজনীতি বেঁচে আছে— গণতন্ত্রের হত্যা, বিভাজনের রাজনীতি, সংখ্যালঘুর নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি। একটা ২৭ বছরের ছেলেকে মারতে মারতে, শেষ হয়ে যাওয়াটা নিশ্চিত করতে, আড়াই তলা থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে খুন করা হল, প্রশাসনের উর্দিতেই নিরাপদে একাজ করা যাবে ভেবে নেওয়া হল— অথচ ‘তীব্র তৃণমূল-বিরোধী’ ভারতীয় জনতা পার্টির মুখে একটা শব্দ নেই এই বিষয়ে। আনিস খানরা খুন হলে যে রাজনীতির কারণে একটা টুঁ শব্দ এরা করে না, সেই রাজনীতিকে তৃণমূল পরাস্ত করতে পারেনি, পারবে না কোনওদিন। অর্থাৎ, আনিস-হত্যা আমাদের ভিতরে যে দাবানল তৈরি করছে, ৩/৪ জন সিভিক পুলিশের সাসপেনশন বা আমতা থানার ওসিকে ছুটিতে পাঠানো বা খোদ আনিসের বাড়ির লোককে সার্ভেইলেন্সের মধ্যে নিয়ে এসে সিট (SIT)-এর হিরো সাজা ইত্যাদি এবং ইত্যাদি, সেই দাবানলে বৃষ্টিপাতের কাজ করবে না। কয়েকজন পুলিশের উপর দিয়ে গোটা ঘটনার নির্মমতাকে চালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আসল মাথাদের নাম ঢাকা পড়তে দেওয়া চলে না। সেইসব মাথাদের নাম জানা চাই, যারা আনিসকে “ইচ্ছে করে” মেরে ফেলতে চায়নি— এমন খবর খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাখেন। সেইজন্য প্রতিবাদী, জনপ্রিয় ছাত্রনেতা আনিস-হত্যার বিচার চাওয়ার সময়ে আমরা যেন কঠোর থাকি বেঁচে থাকার ন্যূনতম দাবীগুলি নিয়েও, যে দাবীসমূহ নিয়ে আনিস বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী কণ্ঠস্বরগুলির সঙ্গে নিজেকে বিলীন করেছেন বারবার। আনিসের হত্যাকারীদের শাস্তি চেয়ে আকাশের দিকে তর্জনী তোলার সময়ে আমরা যেন ভুলে না যাই, এই বাংলার বুকে বীভৎস বিভাজনের সময়ে একজন সংখ্যালঘু পরিবারের মানুষ হয়েও আনিস “কমফর্ট জোন” হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসকে বেছে নেননি; বরং নানাভাবে লিখে রেখে গেছেন— কোনও কিছুর বিনিময়ে মাথা না নোওয়ানোর জেদ। আনিস আমাদের বলে দিয়ে গেছেন, পশ্চিমবঙ্গের বুকে আরএসএস-বিজেপির বিকল্প অন্তত তৃণমূল কংগ্রেস নয়। সেইজন্যই আনিস-হত্যার বিচারের লড়াই গিয়ে মিশবে ভোটলুঠের বিরুদ্ধের লড়াইয়ে। আমাদের সকলের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের সহযোদ্ধা আনিস খানের মৃত্যু আমাদের আরও বেশি করে ঠেলে দেবে মানুষ-মারা শ্রমকোড বাতিলের লড়াইয়ে। আনিস খানের নাম উচ্চারিত হচ্ছে ২৮/২৯ মার্চ ধর্মঘটের হুঁশিয়ারিতে, আনিস খান দেওয়াল তুলবে তাদের সামনে যারা কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরূদ্ধে ডাকা ধর্মঘট ভাঙতে আসবে। আনিস আমাদের ব্যারিকেডের নাম। আনিস খানের লড়াইকে বাঁচিয়ে রাখার মধ্যে দিয়েই সবথেকে বড় সুবিচার হবে তাঁর নির্মম হত্যার।

আনিসকে বাঁচিয়ে রাখার আরেকটা লড়াই— তাঁর পরিচয়, তাঁর সত্তাকে, তাঁর সামাজিক ভূমিকাকে সঠিকভাবে তুলে ধরা। ১৯ তারিখ সকালে খবরের কাগজ খুলেই, ৩ এপ্রিল সকালটার ফ্ল্যাশব্যাক হয়েছিল। ২ এপ্রিল কমরেড সুদীপ্ত গুপ্তকে পুলিশি হেফাজতে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল; পরদিন সকাল সকাল বাজারের হাতে ক্রীতদাস হওয়া সংবাদপত্র কান্না জুড়েছিল, “সুদীপ্ত ভালো ছেলে ছিল, রাজনীতি করতে গিয়ে বলি হল”। ১৯ তারিখ সকালেও সেই কান্নার রোল, “আনিস পড়ুয়া ছিল, দুষ্কৃ্তিদের (ভাগ্যিস দুষ্টু লোক লেখেনি) দ্বারা খুন হল” এবং , যেটা না লিখলেই নয়— “পড়ুয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যু”! কমরেড সুদীপ্ত গুপ্ত নির্বাচিত ছাত্র সংসদের দাবী করতে গিয়ে খুন হয়েছিলেন, সুদীপ্ত ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের সংগঠক ছিলেন, সবার জন্য শিক্ষা ও কাজের দাবীতে ছাত্রদের সংগঠিত করতেন, তাই তিনি খুন হয়েছেন। বাজারের চোখে তিনি “ভালো” বা “মন্দ” বা “নিষ্পাপ একাকী ছেলেটি” হতে চাননি। একইভাবে, আনিস খান একজন সংগঠক ছিলেন। সিএএ/এনআরসি-র বিরূদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করেছেন, কলেজজীবনে “সবার জন্য শিক্ষা চাই”-এর দাবীতে ছাত্রদের মধ্যে সংগঠিত আন্দোলন তৈরি করার চেষ্টা করেছেন— জীবনের শেষ দিন অবধি এলাকার/কলেজের স্বতঃস্ফূর্ত নেতৃত্ব হিসেবে ‘দালাল’-দের বিরূদ্ধে মাথা উঁচু রেখেছেন। মাথা উঁচু রেখেছেন বলেই, আনিস খুন হয়েছেন। ছাত্রনেতা আনিস খানকে নিছক পড়ুয়া বানানো, একটা পরিকল্পিত হত্যাকে “অস্বাভাবিক মৃত্যু” বানানো— আসলে তাঁর পরিচয়, তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকা, তাঁর সামাজিক সচেতনতাকে আবছা করে দেয়। এই কারণেই রাজনীতি খুব খারাপ জিনিস বলে আনিস খুন হয়েছেন— এই রেটরিককে আমরা সফল হতে দেব না। প্রবল চাপেও আনিস খানের নতজানু না হওয়ার জেদকে, তাঁর নিথর দেহের রাজনৈতিক/ঐতিহাসিক ওজনকে হাল্কা হতে দেব না।

আসলে, আনিসের ঘটনায় যারা তৃণমূলকে বাঁচাতে চায়, তারাই “রাজনীতির উর্ধ্বে” ওঠার লিফট খোঁজে। রাজনীতি আছে বলেই আনিস স্বপ্ন দেখতে জানতেন, তাঁর মতো একটা উপরের দিকে এগোনো স্বপ্ন মাটিতে আছড়ে পড়েছেও রাজনীতির জন্যই। এটা দুর্ঘটনা নয়। শুরুতে লেখার চেষ্টা করছিলাম, ভারী কিছু আছড়ে পড়লে যেমন ‘ধপাস’ আওয়াজ হয়, তেমন আওয়াজ পেয়েছিলেন আনিসের বাবা; আসলে তাঁর হার-না-মানা রাজনীতির ভারে ওই আওয়াজ এত জোরালো হয়েছে। আমাদের মাথার মধ্যে, আমাদের মস্তিষ্কের জড়তার মধ্যে, আমাদের বুকের উপর আছড়ে পড়েছে আনিস; জোরালোভাবে; আছড়ে পড়েছে আপসহীন লড়াই। এমন প্রতিটি ভারী মৃত্যু প্রতিদিন বয়ে চলেছি যারা, আনিসকে দেওয়া ধাক্কাটা সত্যি সত্যি যারা অনুভব করছি রোজ, আসুন একটা স্পষ্ট মোড়ে এসে দাঁড়াই। গ্রেটার গ্রেটার এবং গ্রেটার দ্যান গ্রেটার বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সামিল হব; দেখবেন, বাকি সব ফাঁকা আওয়াজগুলিকে সত্যি সত্যি লেসার মনে হবে।

সহযোদ্ধা আনিস খানকে সংগ্রামী সেলাম।


[1] সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...