তিনটি অণুগল্প

অনির্বাণ চন্দ

 

জল

রাতটুকুই যা শান্তি। সকাল হতে না হতেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায় সামনের বস্তিটায়। কী, না কলে জল এসেছে। খাওয়ার জল বড় বালতি ভরে রেখে দিলে গোটা দিন নিশ্চিন্ত। বিরাট লাইন করে জল ভরে ওরা। গালাগালি, হাতাহাতি প্রায় রোজই। বিপুলবাবুদের ফ্ল্যাটে যদিও এসবের জ্বালা নেই। কর্পোরেশনের জলের লাইন দিব্যি তিনতলা অবধি জল পৌঁছে দেয়। ঘরে অ্যাকোয়াগার্ডও লাগিয়ে নিয়েছেন।

বেজায় ঝড় হল কাল রাতে। ট্যাঙ্ক ভরে নেবার আগে থেকেই জল চলে গেছে। খালি হয়ে আছে ট্যাঙ্কটা। সাপ্লাই লাইন ফেটে না উপড়ে গেছে কে জানে। কবে আসবে তাও বোধহয় জানে না কেউ। তপতী মেয়ের কাছে। বিপুলবাবু ফ্ল্যাটে একাই। সঙ্গে পোষা অ্যালসেশিয়ান কালু। তাঁর পায়ে-পায়ে ঘোরে সে।

জল তো ভরতেই হবে। কালুকে সঙ্গে করে সকাল-সকালই দুটো খালি বালতি হাতে কলের কাছে পৌঁছে বিপুলবাবু দেখলেন, সামনে অন্তত জনা বিশেক লোক। ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। কবে যে এই আপদ ঠিক হবে! ভাবলেন, একবার বলবেন, বুড়ো মানুষকে কি আগে-ভাগে ছেড়ে দেবে… বললেন না সাহস করে। যেচে খিস্তি কে খেতে চায়?

বেশ খানিকক্ষণ পরে ভরা হল জল। দু হাতে দুটো ভারী বালতি টেনে টেনে ফিরতে লাগলেন ফ্ল্যাটের দিকে। ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসেই গেছেন, এমন সময় কালু কুঁই-কুঁই আওয়াজ করে আবাসনের বাউন্ডারি ওয়ালটার দিকে ছুটে গেল।

ঝড়ের চোটে বড় পেয়ারাগাছটা পড়ে গেছিল। একটা মাদি কুকুর আর দুটো বাচ্চা… একেবারে থেঁতলে গেছে! বাচ্চাগুলো মরেই গেছে, মা-কুকুরটার এখনও শ্বাস চলছে ক্ষীণ… আওয়াজ বেরুচ্ছে না কোনও। চোখের কোণে তার শুকিয়ে আছে জল।

বিপুলবাবু মা-কুকুরটার মুখে জল দিলেন একটু। কতটা পেটে গেল কে জানে, চোখের কোণটা আবার ভিজে উঠল তার।

কালুরও।

 

এক মুঠো

–বাবি, খেয়েছ?
–হ্যাঁ মামমাম।
–গুড বয়। আমি বেরুচ্ছি অফিস। নিনিমাসিকে ফোন করেছিলাম, অন হার ওয়ে।
–ওকে মম।

ফ্ল্যাটের দরজাটা টেনে দিয়ে প্রীতা অফিস বের হয়ে গেল। বাবিন এখন একা। এই সময়টুকুই তার…

জানলার কাছে চেয়ারটা টেনে নেয় বাবিন। রাস্তার ওপারে ফুটপাতে কল থেকে হু-হু করে জল পড়ে। বস্তির মেয়েগুলো চান করে এই সময়েই। হোক না বস্তির মেয়ে, কিন্তু সব এক সে বড়কর এক!

বাবিন অপেক্ষা করে। রোজ। তার হাতে হাই এন্ড স্মার্টফোন। অপটিক্যাল জুম, ডিজিটাল জুম, দুটোই তাগড়া। জুম করলেই তেরো বছরের ছেলের চোখের সামনে স্বচ্ছ জামাকাপড়ে লাইভ বেদিং সিন!

ভিডিও ক্যামেরা সেটিং ঠিকঠাক করে এক হাতে ফোন ধরে বাবিন, অন্য হাতে নিজেকে। দ্রুত চড়তে থাকে পারদ। চরম মুহূর্তের তীব্রতায় সে কেঁপে ওঠে খুব…

রেকর্ডেড ভিডিওটা যথাযথ সাইটে আপলোড করতে এরপর মিনিট পাঁচেক আর।

নিনিমাসি এসে গেছে। দরজাটা বন্ধ করতে-করতে সে বলে, বাবু, আজ তোমার হুইলচেয়ারটা মেন্টেনেন্সের লোক আসবে।

 

প্রতীক্ষা

বিরাট বটগাছটা ছড়িয়েছে অজস্র ঝুরি। একটাই গাছেতে যেন এক অরণ্য। গাছটার গুঁড়িটা হাতির পেটের মতো মোটা। আর সেইখানেই আস্তানা পীর সাহেবের। অনেকে বলে, ইনি নাকি মহা জাগ্রত। খালি হাতে কেউ নাকি ফিরে যায় না।

শবরীর শূন্য চোখ মাঝেমধ্যে ইতিউতি চলে যাচ্ছে। তারপর ফিরে আসছে পীরসাহেবের কাছেই।

সব বিশ্বাস সত্যি হয় না। অথচ কত মানুষ স্রেফ বিশ্বাসের বলে বলীয়ান হয়ে এসে বসে আছে এইখানে। দু দণ্ড শান্তি চায় কেউ। কেউ চায় ছেলের চাকরি। কেউ বা অন্য কিছু। শবরী কী চায়, সে বুঝতে পারে না। বা, বুঝতে চায় না। মাসে একটা করে দিন সে এখানে আসে। সকাল-সকালই। হাতব্যাগে সামান্য কিছু খাবার। জলের বোতল। সাজগোজ ততটাই, যতটায় ভিড়ে মিশে যাওয়া খুব সহজে। সারাটা  দিন সে শুধু বসে থাকে। পীরসাহেবের চারপাশের ভিড় থেকে সামান্য দূরে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামলে ফের চলে যায়। কাউকে কিছু বলে না, কোনও তাগা বাঁধে না বটগাছে। তার আসা-যাওয়ায় নৈঃশব্দ্য লেগে থাকে।

আজকেও দিনটা এমনভাবেই কেটে যাচ্ছিল। সন্ধে হয়-হয়। অন্যান্য দিনের মতোই দুই হাঁটুর মাঝে ক্লান্ত মাথাটা গুঁজে শবরী অপেক্ষা করছিল আলো একেবারে মুছে যাওয়ার। এমন সময় কে যেন তার পেছন থেকে নরম গলায় বলে উঠল, দিদি, পীরবাবা ডাকছেন।

শবরী চমকে তাকিয়ে দেখল, পীরের এক সাগরেদ। অবাক হল। আজ কি তাহলে সত্যি হবে বিশ্বাস?

একটুখানিই পথ, অথচ পেরোতে লাগল যেন এক জীবন। দূরত্ব পেরিয়ে পীরের সামনে শবরী বসল এসে। দূরত্ব বজায় রেখেই।

হাতের ইশারায় সাগরেদকে চলে যেতে বলে হাসিমুখে পীরসাহেব বললেন, কেমন আছ?

শবরীর চোখ ভিজে। কিন্তু সে হাসিমুখেই বলল, ভালোই আছি।

একটু যেন ইতস্তত করে পীরসাহেব বললেন, ওরা সবাই… ভালো আছে তো?

শবরী এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কবে আসবে…?

পীরসাহেব তাঁর ধূসর দু চোখে আরেকটু নির্লিপ্তি সাজিয়ে বললেন, যবে নির্বাণ লাভ হবে… তুমি তো জানোই সব…

শবরী হাসল। উঠে দাঁড়াল। পীরসাহেবের পা ছুঁয়ে সে হাত বুলিয়ে নিল নিজের মাথায়। চলে যেতে-যেতে সে শুধু বলল, আচ্ছা… আমি অপেক্ষা করব, কেমন…? আসি?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. শেষ দুটো গল্প বেশ ভালো লাগলো।

Leave a Reply to সমরেন্দ্র বিশ্বাস Cancel reply