প্রলয়ের শবযাত্রী: গোদার

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

 



চলচ্চিত্রবেত্তা, গদ্যকার, সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার

 

 

 

একদিন যাবতীয় কোলাহল ও প্রতর্ককে বিদায় জানিয়ে তিনি রচনা করেছেন ‘বিদায়, ভাষা’ (২০১৪)। এই আখ্যান জাহাজডুবির আগে এক নাবিকের বিধুর রোজনামচা। আমরা বিষণ্ণ হয়েছিলাম। ভান গঘ স্থিরচিত্রের পটে মৃত্যুর আগের মুহূর্তে গমক্ষেতে উড়ন্ত কাকেদের মুক্তি দিয়েছিলেন সঙ্গীতের বিচ্ছুরণে। আর এই শতাব্দীর শুরুতেই গোদার যখন ‘নোতর মুজিক’ (২০০৪)-এর মতো ছিন্ন স্বরলিপি ছড়িয়ে দিলেন বসনিয়া ও চূর্ণ ব্যাবিলনে, ইউরোপ যখন টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি এক অমোঘ প্রশ্নচিহ্ন রেখে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের প্রতি: “Who is next to Kafka in your office?”

আজকাল খবরের কাগজ ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে। টেলিভিশন বাসি রজনীগন্ধার মালা। সিনেমার মতো একটি তুচ্ছ বিনোদনকে যাঁরা নশ্বরতার থেকে রক্ষা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই একজনই মাত্র বেঁচেছিলেন। চাঁদ, পাখি, ফুল, তারা, মিসাইল, পেশিবহুলতা; গল্পের দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে যখন মনে হয়— এখানে কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়, তখনই দৃশ্যের আড়ালে শূন্যতায় চিন্তার নানা ডালপালা ছড়িয়ে দিতে পারতেন এই আশ্চর্য বৃদ্ধ। সিনেমার নৈশাকাশে দীপ জ্বলে উঠত। এই যে মোবাইল বেজে উঠল দিবাদ্বিপ্রহরে, আমি দেখলাম প্রলয় সমুত্থিত। জঁ লুক গোদার চলে গেছেন পাতালের চিরকূট বিতরণ করার জন্য। আর কেউ নেই।

তথ্যের শাঁস ও কাহিনির খোসা উত্তীর্ণ হয়ে গোদার সময়ের নৃত্যরত গোড়ালিটি দেখে গেলেন৷ এই আকাঙ্খা, এই দ্রষ্টার চেতনা, যা কারিগরের নয়, যা নৈরাজ্য ও কিমিতিকে, যা মৃত্যু ও শূন্যতাকে, পাপ ও প্রজ্ঞানকে নিবেদন করে অসীমের সমীপে। আদি কবি অর্ফিউস নরক থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে পেছন ফিরে তাকানো মাত্র স্ত্রী ইউরিদিসের পুনরায় মৃত্যু হয়। সিনেমা অর্ফিউসকে অধিকার দেয় পেছন ফিরে তাকাতে, ইউরিদিসের মৃত্যু-ব্যতিরেকেই। অর্ফিউস থেকে গোদার, তথ্য থেকে কাহিনি, মধ্যে রইল প্রায় ষাট বছর। ইতিমধ্যে মার্কস ও কোকাকোলার সন্ততিরা পৃথিবীর নানা উদ্যান ও রাজপথে ছড়িয়ে পড়েছে। আর বলা গেল না— অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে। আর এই নরক সরণীতে কোনও বিয়াত্রিচে-কে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজকের পৃথিবীতে গোদার নেই।

 

ভাবা যায়, একটু ভাষার ভুলে মুক্তির পরেই কীরকম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র— ‘ব্রেথলেস’ (১৯৫৯)! যারা একদিন পিকাসোকে দেখে মনে করেছিলেন ফরাসি চারুকলার অন্তর্জলী যাত্রা, তারাই গোদারকে দেখে মনে করলেন ব্যাকরণের গণ্ডগোলে এক অপরিণামদর্শী নাস্তিক্য। আসলে বিমূর্ততার মহাসমুদ্রে পিকাসো যেমন সাকার কোনও কিছুর সংযোগে একদা কোলাজ নামের রাতের সঙ্কেতের পত্তন করেন, গোদারও তেমনই সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর ভাবনার অজস্র জট উন্মোচিত করার ফাঁকে ফাঁকে রেখে যান ভঙ্গুর কাহিনিপথের ইশারা। গোদারের নির্মাণকর্মের মধ্যে দিয়েই বস্তুত চলচ্চিত্রের নকলনবিশি পর্বের শেষ হল। সেই প্রথম আমরা প্রকাশ্যে জানলাম, চলচ্চিত্র আর কোনও কিছুর প্রতিরূপ নয়। সিনেমায় গল্প বলার দায়িত্বটুকু নিতে গোদার যখন অস্বীকার করলেন, তখন তাঁকে কালাপাহাড় বলাই আর যথেষ্ট রইল না। পরাবাস্তববাদীরা বা ‘ভূতলবাসীরা’ কেউ কেউ এরকম ভাংচুর আগেও করেছেন, কিন্তু তাঁদের উদ্দিষ্ট ছিল সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবী দর্শকসমাজ। গোদার-ই প্রথম চলচ্চিত্রের খোলা চত্বরে দাঁড়িয়ে সদর দপ্তরে কামান দাগলেন। এ জন্যেই সত্যজিৎ রায় এবং ঋত্বিক ঘটকও তাঁকে প্রবর্তকের সম্মান দিতেন।

আসলে গোদার কোনও চলচ্চিত্রকার নন। তিনি একজন দার্শনিক, তাঁর পদচিহ্ন এমনভাবেই বিশ শতক ও একুশ শতকের প্রথমে দৃশ্যকলার জগতে মুদ্রিত থাকে। বেঠোফেন বলতে আমরা যেমন শুধুমাত্র সুরকার বুঝি না, বা পিকাসো বলতে শুধু শিল্পী, তেমনি গোদার বলতেও আমরা চলচ্চিত্রকার বুঝি না। তিনি আসলে এক ব্যাপক সাংস্কৃতিক উপস্থিতি যিনি আমাদের পক্ষে যা কিছু দর্শনীয় ছিল, তাকে চিন্তনীয় করে তুলেছেন। আমাদের শতাব্দী জুড়ে এমন প্রবল চিন্তক আর কজন আছেন? তাঁকে শুধু নবতরঙ্গের প্রতিনিধি ভাবা ভুল হবে। কিন্তু যখন আমরা এই নবতরঙ্গের কথা বলছি, তখন আমাদের একটু বলে নেওয়া উচিত, কী ছিল এই ন্যুভেল ভাগ-এ? ‘যে সিনেমা নেই, তার জন্য বিষণ্ণ অনুতাপ’, এই শব্দকটির মধ্য দিয়ে গোদার নবতরঙ্গ বিষয়ে তাঁর ধারণা ব্যক্ত করেছেন। পঞ্চাশের দশকে ত্রুফো সহ সবান্ধব গোদারের মনে হওয়া অতি যথার্থ, যে ভগ্নাংশে বিভক্ত আধুনিক জীবনকে রূপ দিতে চাইলে, চিত্রকলা ও সাহিত্যের মতোই সিনেমাকে সরলরেখায় এগিয়ে চলার ধ্রুপদী স্বভাব ভুলে যেতে হবে। ‘কাইয়ে দু সিনেমা’-র পাতায় তাঁদের সিনেমা সমালোচনা যা প্রায়ই তিক্ত, নিষ্করুণ, দুর্বোধ্য, উদ্ধৃতিময়, খণ্ডিত, পরিহাসমদির— এক নতুন চলচ্চিত্র ভাবনার আভাস দিচ্ছিল। একটি সিনেমা ও তার সমালোচনা— এইভাবে নতুন সিনেমায় পৌঁছে যাওয়া, থিসিস ও অ্যাান্টিথিসিসের যুগপৎ উপস্থিতি, এই গোষ্ঠীকে এক স্পষ্ট অবস্থান দেয়, জঁ লুক গোদার যাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বলেন— “সমালোচনা লেখার বদলে আমি তা ফিল্ম করি। কিন্তু সমালোচনার মাত্রা সেখানে যুক্ত থাকে। আমি নিজেকে প্রাবন্ধিক ভাবি। যে প্রবন্ধগুলি উপন্যাসের আকারে লেখা হচ্ছে বা যে উপন্যাসগুলি প্রবন্ধের আকারে। পার্থক্য শুধু এই যে লেখার বদলে আমি তাদের চলচ্চিত্রায়িত করি।” ক্ষণিকের জন্য যদি ফ্ল্যাশব্যাকে দেখে নিই ‘ব্রেথলেস’, তাহলে পর্দাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে হলিউডের গ্যাংস্টার থ্রিলার ও তার সমালোচনা। এই যে প্রস্তাব এবং প্রতিপ্রস্তাবের যুগ্ম উপস্থিতি, একেই কবি মার্লামে বলেছিলেন— la poisie critique এবং সার্ত্র এই যুক্তিকেই আধুনিকতার অন্যতম শর্ত হিসেবে মনে করেন, যেখানে শিল্প নিজেই তার সমালোচনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

আরেকবার গোদার জানান, দলিল তখনই আকর্ষণীয় যখন তাকে উপন্যাসের অনুষঙ্গে রাখা যায়। যেমন আখ্যান আকর্ষণীয় হতে পারে যদি তা দলিলের দ্বারা সমর্থিত হয়। আমরা অন্যত্র দেখব দৃশ্য ও শব্দকে তিনি স্বয়ম্ভরতা থেকে মুক্ত করে আপেক্ষিক করে তুলেছেন। তাঁর নির্মিত দৃশ্যপর্যায় কোনও চূড়ান্ত ও অখণ্ড অর্থ বহন করছে না। তাঁর বক্তব্য অজস্র উৎসনির্ভর, আন্তর্নির্ভরশীল অসংখ্য উদ্ধৃতির সমারোহ। আর তাঁর বক্তব্যপ্রীতি এতদূর শর্তহীন, যে শব্দের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে তিনি ভাবিত। তিনি কমিয়ে দিতে চেয়েছেন ভিস্যুয়ালের প্রাধান্য। যখন তিনি সন্দেহ ও সমালোচনার অধিকারকে, বক্তব্য ও প্রতিবক্তব্যকে, একই বন্ধনীভুক্ত করছেন, তখনই বোঝা যায় চলচ্চিত্রের জন্য নতুন একটি ভাষা খুঁজে পাওয়ার জন্য তাঁর আকুলতা।

এই ভাষা শুধু হলিউড-বিরোধিতা থেকে জাত নয়, জড়ের পৃথিবীতে যে ভয়, পণ্যের পৃথিবীতে যে আতঙ্ক, তা থেকে মুক্তির আকাঙ্খায় গোদার প্রতিচ্ছায়া চান না। কিন্তু এক ‘অপর’-কে খুঁজে চলেন। ‘I need an other, so as not to be afraid of the image of myself.’ যখন চলচ্চিত্রের ইতিহাস এই সুইস-ফরাসি শিল্পীর জন্য এক প্রশস্ত অধ্যায় রচনা করেছে, তখনও শিল্পের উৎকর্ষে তিনি যে বার্গম্যান, বুনুয়েল, আন্তোনিওনি বা তারকোভস্কির পাশে হাঁটেন, তা নয়, বরং গোদারের অনেক রক্তাক্ত পতন চিহ্নিত করা যায় যাতে ক্ষমাহীন মূঢ়তা রয়েছে। তবু স্মরণীয় তিনি, কারণ সময় তাঁর বাহুলগ্না, সেই সূত্রে ছায়াছবির ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে আর্তপ্রশ্নকারী। ধ্বনিতত্ত্ব থেকে বক্ষবন্ধনী, ভাস্কর্য থেকে সসেজ— সবই তাঁর জিজ্ঞাসার অন্তর্ভুক্ত। তাঁর কোনও বক্তব্যই বদ্ধবয়ান নয়। তা নিজে যত প্রশ্ন করে তার চেয়ে বেশি প্রশ্নের সম্ভাবনা জাগ্রত করে। ‘ব্রেথলেস’ থেকে ‘বিদায়, ভাষা’, বা এমনকি তার পরের ছবিও, সব অর্থেই অসমাপ্ত, ছেদচিহ্নহীন। আমরা তার যেকোনও অংশে ঢুকে পড়তে পারি, যেকোনও অংশ থেকে বেরিয়েও আসতে পারি। প্রতি মুহূর্তেই ছবিগুলি আমাদের কাছে প্রার্থনা করে সংযোজনী। বয়ানের সম্পূরকতার এই ধর্মই জঁ লুক গোদার-কে সভ্যতার সম্পদ করে তুলেছিল। হতে পারে একুশ শতকের গোদার এক পরাভূত আত্মার বিবরণী, তবু মানুষ সেখানে আসে দীর্ঘ শ্রম, নিদ্রাহীন রাত্রি এবং প্রতীকের অরণ্য পেরিয়ে। গোদারের বিদায় শুধু চলচ্চিত্রের ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের অবসান নয়, তাঁর বিদায় এই মাধ্যমটিকে, এই অনভিজাতের জন্য অপেরাকে পুনর্বিন্যস্ত করার ডাক দেবে। গোদারকে গুণী বা নির্গুণ চলচ্চিত্রকার হিসেবে ভেবে লাভ নেই, তিনি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর অনন্যব্রত ব্যর্থতা ও রক্তাক্ত ঠাট্টা সত্ত্বেও স্মরণীয় ও নিরুপায় একক সন্ন্যাসী। তাঁর এই প্রশ্নসমূহ প্রায় এলসিনোর ক্যাসেলে হ্যামলেটের যেসব আর্তজিজ্ঞাসা ধ্বনিত হয়েছিল, তার পাঁচশো বছর পরেও তাকে বাঁচিয়ে রাখল। গোদারের মৃত্যু মানে একটি অস্থায়ী ছেদচিহ্ন, আসলে চলচ্চিত্রের মতো এক সামান্য রূপোপজীবিনীকে সে স্বর্গে পৌঁছনোর বার্তা দিয়ে যায়। জেমস বন্ড ও ভিয়েতনাম, মার্ক্স-কোকাকোলা প্রজন্ম, কম্পিউটারের বাইনারি বিভাজন— সমস্তই তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, এবং পরিত্যাগ না করে চূড়ান্ত আবেগে চুম্বন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তবুও মহৎ শিল্পীরা যা যুগে যুগে জেনে এসেছেন, তেমনভাবেই ইমেজ তাঁর কাছে স্বাতী নক্ষত্রের জল হয়ে রয়ে গেল। বিদায়, গোদার।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4658 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

Leave a Reply to নিরুপম চক্রবর্তী Cancel reply