দঙ্গল

স্বাতী মৈত্র

 



অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

অনুরাগ কাশ্যপের ‘মুক্কেবাজ’ ছবির নায়ক হলুদ রঙের ‘বক্সার’ লেখা টি-শার্ট পরে স্টেট বক্সিং ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টের বাড়ির বাজার করে দেয়। আটার বস্তার সঙ্গে সঙ্গে ধনে-লঙ্কাও এনে দেয় সে। আফসোস করে, আমাদের এখানে খেলোয়াড়দের কোনও সম্মান নেই, এইজন্যই উত্তরপ্রদেশের খেলাধূলায় এত বদনাম। ‘ভগবানজি’ অর্থাৎ বক্সিং ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ও ব্রাহ্মণ রাজনীতিবিদ ভগবানদাস মিশ্রর পিঠে মালিশ করে দেয়। করতে করতে শোনে প্রেসিডেন্টের বাণী, (হরিয়ানার) ভিওয়ানি মডেলে অলিম্পিয়ান উঠলেও সেই মডেলে তাঁর মোটেই ভরসা নেই। প্রেসিডেন্টের হাতে হেনস্থা হওয়ায় সে বলেই ফেলে, আমি এখানে ‘মুক্কেবাজি’ করতে আসি, আপনার পিঠে তেলমালিশ করতে নয়। ভগবানজি রুষ্ট হয়ে তার গায়ে হাত তুললে মুক্কেবাজির সহজাত অভ্যাসে কাটিয়ে যায় সে, পাল্টা মার দিয়ে ফেলে। এরপর যা হওয়ার তাই হয়। বাকি মুক্কেবাজদের হাতে প্রহৃত হয় উদ্ধত শ্রবণ, স্রেফ সত্যি কথা বলে ফেলবার জন্য।

‘মুক্কেবাজে’র মতন আরও অনেক খেলা-সংক্রান্ত হিন্দি ছবিতে রাজনীতিবিদ অথবা ‘কারিয়াকার্তা’ (সহজ বাংলায় কর্মকর্তা অথবা আমলা) চরিত্রদের দেখা যায় ভিলেন রূপে। আমির খানের ‘দঙ্গল’ ছবিতে কর্মকর্তা লাড্ডু খেতে খেতে বলেন, মেয়েদের কুস্তির জন্য পয়সা বিশেষ থাকে না, ম্যাট কেনবার টাকা তিনি কোথা থেকে দেবেন? মুখে অশ্লীল হাসি, চরম অবজ্ঞা। ক্ষুব্ধ মহাবীর ফোগট বলেই ফেলেন, আপনার মতন অফিসাররা চেয়ার দখল করে বসে আছেন বলে ভারত [কুস্তিতে] মেডেল জেতে না। আবার শাহরুখ খান অভিনীত ‘চক দে ইন্ডিয়া’ ছবিতে হকি ফেডারেশন কর্তারা বলে দেন, মেয়েদের দলকে হকি বিশ্বকাপে পাঠানো যাবে না, স্পন্সর নেই। সৃজিত মুখার্জির ‘সাবাস মিতু’ ছবিতে মহিলা দলকে সমর্থন করবার নামে পুরুষ খেলোয়াড়দের পুরনো, ঢোলা জার্সি পাঠিয়ে দেয় ক্রিকেট বোর্ড। মহিলা দল আরেকটু সুযোগ ও সুব্যবস্থা চাইতে গেলে অবজ্ঞার সঙ্গে কর্তারা বলেন, মহিলা খেলোয়াড়দের কোনও পরিচিতিই নেই। নাটকীয় দৃশ্যে নিজের জার্সির উপর পরা ‘সৌরভ’ লেখা জার্সি খুলে বোর্ড কর্তাদের সঙ্গে নিজের ও নিজের দলের পরিচয় করে দেন ছবির মিতালি রাজ।

হিন্দি ছবির অতিনাটকীয়তা মার্জনা করে দিলেও বার-বার উঠে আসা এই ভিলেন চরিত্র হয়তো কিছুটা হলেও বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। অর্থনৈতিক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি, ক্ষমতা দখল ও রাজনৈতিক লবিবাজি, খেলা ও খেলোয়াড়দের সম্পর্কে চরম উদাসীনতা— এটাই ভারতীয় ক্রীড়াজগতের দৈনন্দিন কাহিনি। এর সঙ্গে রয়েছে যৌন হেনস্থার অগণিত কাহিনি। গত কয়েক মাসে বিভিন্ন খেলার উদাহরণ দেখা যাক। ২০২২ সালের মে মাসে একজন ১৯ বছর বয়সী মহিলা অ্যাথলিট বিখ্যাত কোচ পি নাগরাজনের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন। এরপর আরও ৭ জন খেলোয়াড় অভিযোগ নিয়ে এগিয়ে আসেন। এরপর নাগরাজন গ্রেফতার হন। জুন মাসে আন্ডার-১৭ মহিলা ফুটবল দলের কোচ, অ্যালেক্স অ্যামব্রোজের বিরুদ্ধে এক নাবালিকা খেলোয়াড়কে হেনস্থার অভিযোগ ওঠে। তাঁকে সে সময় নরওয়ের ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে ফেরত পাঠিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়, তবে তারপর থেকে সেই কেসের আর বিশেষ খবর শোনা যায়নি। ৪ জন মহিলা সাইক্লিস্ট জাতীয় দলের হেড কোচ, আর কে শর্মার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। ডিসেম্বর মাসে হরিয়ানার একজন জুনিয়র কোচ রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী সন্দীপ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ নিয়ে আসেন। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে এক অভাবনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন আন্তর্জাতিক স্তরে খেলা কুস্তিগিররা দিল্লির যন্তর মন্তরে ধর্নায় বসেন। বিনেশ ফোগট, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়ার মতন তারকা কুস্তিগিরদের নেতৃত্বে তাঁরা দাবি তোলেন যে কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান, ভারতীয় জনতা পার্টির এমপি ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবিলম্বে সরিয়ে দিতে হবে, এর সঙ্গে ফেডারেশন ভেঙে দিয়ে নতুন করে গঠন করতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক— একাধারে যৌন হেনস্থা, আর্থিক নয়ছয় ও স্বৈরাচারী ব্যবহার।

ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে দেখে হিন্দি ছবির রাজনীতিবিদ-কর্মকর্তা চরিত্রদের কথা মনে পড়তেই পারে। ৬ বারের জনপ্রিয় এমপি (মাঝে একবার সমাজবাদীর টিকিটেও জিতেছেন), ব্রিজভূষণ আদপে উত্তর ভারতীয় বাহুবলি নেতা, এলাকায় ‘দবং’ বলে পরিচিত। এককালে নিজেই কুস্তি লড়তেন, জনপ্রিয় খেলোয়াড়ও ছিলেন। ১৯৯০ নাগাদ রামজন্মভূমি আন্দোলনের সময় প্রচারের আলোয় আসেন তিনি। দাউদ ইব্রাহিমের বন্দুকবাজদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে টাডায় কেস হয়েছিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংস ষড়যন্ত্রের মামলাতেও অভিযুক্ত ছিলেন ব্রিজভূষণ। পরে অবশ্য দুটি কেসেই ছাড়া পান। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে তাঁকে বলতে দেখা গেছে, আমার হাত দিয়ে কেবলমাত্র একজন মানুষের হত্যা হয়েছে, যদিও এই ভিডিও এখনও যাচাই হয়নি। উত্তরপ্রদেশের ৬টি জেলায় বিস্তারিত প্রভাব ব্রিজভূষণের, সমর্থকেরা তাঁকে নেতা ও অভিভাবক হিসেবে দেখেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় হিন্দি ছবির চরিত্রদের মতন অতিনাটকীয়ভাবেই তিনি ঘোষণা করে দিয়েছেন, “আমি মুখ খুললে সুনামি হয়ে যাবে।” যদিও কুস্তিগিরদের চাপে পড়ে ব্রিজভূষণকে আপাতত সরানো হয়েছে, ব্রিজভূষণের প্রভাব খুব কম নয়। তদন্ত হয়ে যাওয়ার পরে তিনি একেবারে পদচ্যুত হবেন, এ কথা এখনই বলা যাচ্ছে না। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশ বনাম হরিয়ানার ক্রীড়াজগৎ দখলের লড়াইয়ের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। কেউ কেউ আবার বিরোধীদের তথা কংগ্রেসের ষড়যন্ত্রও দেখতে পেয়েছেন, যদিও বিনেশ ফোগটের দিদি প্রাক্তন কুস্তিগির ও অধুনা বিজেপি নেত্রী ববিতা ফোগটও এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে খেলোয়াড়দের চাপ ও প্রতিবাদের নাটকীয় রূপ কিছুটা হলেও সরকারের উচ্চতম স্তরে প্রভাব ফেলেছে। খেলোয়াড়দের সঙ্গে বার বার ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বৈঠক করেছেন।

কুস্তিগিরদের এই অভাবনীয় প্রতিবাদ নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। যৌন হেনস্থাকে কেন্দ্র করে এত বড় প্রতিবাদ হয়তো এর আগে ভারতীয় ক্রীড়াজগতে দেখা যায়নি। বিনেশ ফোগট জানান, তাঁর কাছে বেশ কিছু উঠতি মহিলা কুস্তিগির ফোন করে জানান যে লখনৌতে হতে চলা জাতীয় শিবিরে যেতে তাঁরা ভয় পাচ্ছেন, কোচ ও কর্মকর্তাদের হাতে যৌন হেনস্থা হওয়ার থেকে খেলা ছেড়ে দেওয়া ভাল। অভিযোগ, ব্রিজভূষণের নিজের লখনৌ শহরে বাড়ি আছে, তাই সেখানে বার বার জাতীয় শিবির অনুষ্ঠিত হয়। এর উত্তরে তারকা খেলোয়াড়রা সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ করবার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের সঙ্গ দিতে এগিয়ে আসেন তারকা পুরুষ কুস্তিগিররাও। এঁরা প্রত্যেকেই প্রতিবাদ করতে গিয়ে যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়েছেন, নিজেদের ক্রীড়া-ভবিষ্যৎকে বাজি রেখেই প্রতিবাদের মঞ্চে নেমেছেন। খেলোয়াড়দের প্রতিনিধি হিসেবে বিনেশ বার বার বলেছেন, আমার খেলা বন্ধ হয়ে যাক, ক্ষতি নেই, আমার বাড়ি আছে, পাতে খাবার আছে। কিন্তু উঠতি মেয়েগুলোর বলবার জোর নেই, তাদের খেলা যেন বন্ধ না হয়ে যায়। ভারতীয় ক্রীড়াবিদেরা বেশিরভাগই খুব একটা স্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসেন না। অনেক ক্ষেত্রেই খেলা তাঁদের সামাজিক উত্তরণের একমাত্র পথ। সেই খেলোয়াড়দের যখন খেলবার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন অনেকের পক্ষেই মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না। এর সুযোগ নিয়ে থাকেন সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তারা। ঠিক এই অসহায়তাই ফুটে উঠেছে কুস্তিগিরদের ধর্নায়। ভেঙে গিয়েছে আরও একটি মিথ, যে বাহুবল থাকলেই যৌন হেনস্থা এড়িয়ে যাওয়া যায়। তথাকথিত প্রগতিশীল ভাষ্যে খুব একটা সড়গড় না হওয়া সত্ত্বেও যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন পুরুষ খেলোয়াড়রা, কুস্তিজগৎ সম্পর্কে আরও কিছু গতানুগতিক ধারণা ভেঙে দিয়ে। এ কথা বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে #মিটু আন্দোলনের ভাষ্য এই প্রথম কুস্তিগিরদের হাত ধরে ভারতবর্ষের শহুরে প্রতিষ্ঠানের বাইরে বেরিয়ে দিল্লি-হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশের গ্রামীণ দঙ্গলে, কুস্তির আখড়ায়, মাটির কাছে পৌঁছতে পেরেছে।

২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহিলা জিমনাস্টরা এক বৃহৎ যৌন হেনস্থা চক্র ফাঁস করেন, যার কাণ্ডারি ছিলেন জাতীয় দলের মূল ডাক্তার, ল্যারি নাসার। ভারতীয় কুস্তিগিরদের হাত ধরে এ দেশেও এরকম মুহূর্ত আসবে কি না, তা সময় বলবে। তবে এ কথা বলা যায় উঠতি মহিলা কুস্তিগিররা— যাঁদের অনেকেই এখনও সম্ভবত নাবালিকা— যাতে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে অন্তত সুরক্ষিত থাকতে পারেন, তাঁদের পক্ষে এ এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নাম প্রকাশ না হওয়া একজন কুস্তিগির বলেন—

আমরা [কুস্তিতে] হনুমানের আরাধনা করে থাকি। মনে রাখবেন, তিনি রাবণের লঙ্কা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। কুস্তিজগতের বাহুবলির ভবিষ্যৎও তাই হবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4658 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...