বিপন্ন জোশিমঠ ও অনন্তলালদের কান্না

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 



গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

বিপন্ন অনন্তলালের আখ্যান

নিজের ধ্বস্ত বাড়ির সামনে উদাসী দরবেশের মতো দৃষ্টি নিয়ে বসেছিল অনন্তলাল। বাড়ি বলতে তেমন আলিশান মকান গোছের কিছু নয়। গরিবগুর্বো মানুষের ঘর আর কবেই বা তেমনটি হয়। ওই বাড়িই অনন্তলালের প্রাণ। কয়েক পুরুষ ধরে তাঁদের বাস পাহাড়তলির এই গাঁয়ে। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা আর পাহাড়ি ধসের সঙ্গে যুঝে টিঁকে থাকার লড়াইয়ে সামিল হওয়া। এখন বয়স হয়েছে, শরীরের তাকতও কমে এসেছে অনেকটাই। ছেলেরা সংসারের হাল ধরেছে। কাজ বলতে সামান্যই— গুটিকয়েক অবলা গৃহপালিত পশুকে ওই দূরের পাহাড়ি বুগিয়ালে চরাতে নিয়ে যাওয়া। খেতিবাড়ির কাজ দুই ছেলে মিলেই সামলে নেয়। বেশ কেটে যাচ্ছিল কষ্টেসৃষ্টে। উৎপাত শুরু হল ‘বিকাশ’-এর ভূত এসে অযাচিতভাবে জোশিমঠের অধিবাসীদের পর্ণকুটিরের দরজায় কড়া নাড়ার পর। এমন কাণ্ড যে একেবারে নতুন বা প্রথম, তাও নয়। অনন্তলালের মন পাহাড়ি পথের মতো আঁকাবাঁকা সময় ধরে পিছিয়ে যায় প্রায় পাঁচ দশক পেছনে। তখন অনন্তলালের যুবা বয়স। চামোলি জেলার মানুষেরা একযোগে রুখে দাঁড়াল পাহাড়ের ঢালের ওপর মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজির সমূল উৎপাটনের বিরুদ্ধে। এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি গাঁওয়ের ‘অনপঢ়’ প্রান্তিক মানুষেরা প্রতিবাদ করল এই অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে। গাছকে জড়িয়ে ধরে নিজেদের জীবন বাজি রেখে এক আশ্চর্য প্রতিরোধে সামিল হয়েছিল তারা। দেবভূম সেবার গর্জে উঠেছিল প্রকৃতি-পরিবেশকে ধ্বংস করে বিনাশী উন্নয়নের বিরুদ্ধে। পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল সরকার নিয়োজিত ঠিকাদারের লোকজন। আর সেই আন্দোলন ঠাঁই পেয়েছিল পরিবেশবাদী যাপনের অনন্য উদাহরণ হিসেবে ‘চিপকো’ আন্দোলনের আকারে।

সেইসব দিনের কথা মনে করে আজ একান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনন্তলাল। এই পাঁচ দশকে সবকিছুই বিলকুল বদলে গেছে। তাদের ছোট জোশিমঠ আর আশেপাশের এলাকা কেমন যেন অচেনা লাগে অনন্তলালের ঘোলাটে চোখে। তার ছোটবেলায় সে দেখেছে পায়ে হেঁটে আসা তীর্থযাত্রীদের। তাদের বিনম্র পদচারণায় জোশিমঠ ধন্য হত। কিছুদিন কাটিয়ে তীর্থযাত্রীরা পাড়ি দিত চারধামের অন্যান্য গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আর এখন? পর্যটকদের নিয়ন্ত্রণহীন দর্পিত দাপাদাপিতে জোশিমঠ বিপন্ন। পাহাড় কেটে রাস্তা, হোটেল, রিসর্ট, হাজার কিসিমের শহুরে আয়োজনের বহর দেখে কেমন ঘোর লাগে চোখে। ভূমিপুত্র অনন্তলালদের সব হারানোর হাহাকার ছাড়া আর কিছুই বোধহয় পাওয়ার নেই। অথচ জোশিমঠ হল ঈশ্বরের আবাসভূমি। তাহলে এমন ভয়ানক বিপর্যয় কেন? এই অবসরে জোশিমঠকে ঘিরে গড়ে ওঠা লোকবিশ্বাস আর পুরাণকথা জেনে নেওয়া যাক।

 

পুরাণের পাতা থেকে

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী ভারতের নানা স্থানে অবস্থানরত দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের একটি জোশিমঠে স্বমহিমায় বিরাজমান। এই কারণে জোশিমঠ জ্যোতির্মঠ নামেও পরিচিত। এই ধার্মিক জনপদটিকে পবিত্র তীর্থদ্বার হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে কেননা জোশিমঠের দরজা দিয়েই তীর্থযাত্রীরা বদ্রিনাথ ও শিখ সম্প্রদায়ের পবিত্র গন্তব্য হেমকুণ্ড সাহিব-এর পথে যাত্রা করেন। এহ বাহ্য! শীতকালে যখন প্রবল তুষারপাতের কারণে বদ্রিনারায়ণ দর্শনযাত্রা অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন শীতার্ত ভগবান বিষ্ণুকে সসম্মানে নামিয়ে আনা হয় জোশিমঠের উষ্ণতর আবাসে। গোটা শীতকাল তিনি এখানেই অতিবাহিত করেন পরমানন্দে। পৌরাণিক আখ্যানসূত্রে জানা যায় দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুকে হত্যার পর নরসিংহ অবতাররূপী ভগবান বিষ্ণু মানসিক শান্তির জন্য জোশিমঠে এসে বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নিয়েছিলেন। আজকের জোশিমঠের নৃসিংহদেবের মন্দির বুঝি সেই পৌরাণিক বিশ্বাসেরই ইঙ্গিতবাহী।

জোশিমঠের স্থাপনার ইতিহাসটিও বেশ প্রাচীন। সপ্তম শতকে জোশিমঠের নাম ছিল কার্তিকেয়পুর। এখানেই স্থাপিত হয়েছিল কাতুরি রাজবংশের রাজধানী, অবশ্য পরবর্তীকালে বাগেশ্বরের বৈজনাথে রাজধানী স্থানান্তরিত করা হয় নিরাপত্তার কারণে। অনেকেই মনে করেন, শ্রীবিষ্ণুনারায়ণ বদ্রিবিশালের শীতাবকাশ যাপনের জন্য নৃসিংহ মন্দিরটি কাতুরি রাজবংশের দ্বারাই নির্মিত হয়েছিল। অন্যদিকে সংখ্যাগুরু অংশের বিশ্বাস নবম শতকে আদি শঙ্করাচার্যদেব যখন এই অঞ্চল সন্দর্শনে আসেন, তখন তিনিই এই নরসিংহদেবরূপী ভগবান নারায়ণকে প্রতিষ্ঠিত করেন এই মন্দিরে। সেই সময় থেকেই জোশিমঠ হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বী তীর্থযাত্রী মানুষের কাছে একটি জনপ্রিয় গন্তব্য হিসেবে ক্রমশ পরিচিত হয়ে উঠতে থাকে।

এমনই এক ঐতিহ্যবাহী ধার্মিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করেই সময়ের হাত ধরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক জোশিমঠ জনপদ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ৬০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত জোশিমঠ শহরটি আজ তালুকের সদর শহর। ফলে সারাবছর ধরেই আশেপাশের গ্রামীণ এলাকার মানুষজনের ভিড় লেগে থাকে এই শহরে। প্রতিবেশী চিনের খুব কাছে অবস্থিত হওয়ার ভূ-নিরাপত্তার দিক থেকেও জোশিমঠের অপার গুরুত্ব রয়েছে।

এই কথাগুলি পাঠকের কাছে পেশ করার একটিই মাত্র উদ্দেশ্য। তা হল জোশিমঠের গুরুত্ব বিষয়ে সকলকে অবহিত করা। এমনই এক অঞ্চল ক্রমশ অবলুপ্তির পথে চলে যাওয়া মানেই হল একটি গুরুত্বপূর্ণ সমৃদ্ধ অঞ্চল ও তার সম্ভাব্য পরিষেবাগুলি থেকে চিরকালের মতো বঞ্চিত হওয়া। অনন্তলালদের আশঙ্কা এখানেই। জোশিমঠ ক্রমশ ডুবছে, মানে বসে যাচ্ছে। কেন বসে যাচ্ছে? কী হারে বসে যাচ্ছে? এই বসে যাওয়ার বিষয়টি কি একান্তভাবেই প্রাকৃতিক নাকি উন্নয়নমুখী মানুষের পর্বতপ্রমাণ ভুলের জন্যই আজ দেবভূম জুড়ে বিপন্নতার হাহাকার? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের জোশিমঠ তথা চামোলির ভূ-তাত্ত্বিক ও ভূ-সংস্থানিক গঠন বিষয়ে দু-একটি কথা খুব সহজে আলোচনা করে নেওয়া প্রয়োজন৷

 

নগাধিরাজ হিমালয় প্রসঙ্গ

ভারতীয় উপমহাদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কথা আলোচনা করতে বসলে প্রথমেই আসে উত্তর সীমানায় খাড়া প্রাচীরের মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হিমালয় পর্বতের কথা। তিনটি সমান্তরাল পর্বতশ্রেণির সমাহারে গঠিত নগাধিরাজ হিমালয়ে একটি নবীন ভঙ্গিল পর্বতমালা। হিমালয় পর্বতের কথা বলতে বসলে যে দুটি বিশেষণ অনিবার্য— নবীন এবং ভঙ্গিল— তা বিশেষভাবে অনুধাবনীয়। নবীন মানে নতুন, অর্থাৎ হিমালয়ের উৎপত্তি অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক সময়ে। প্রশ্ন হল কতটা সাম্প্রতিক? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় মাত্র ৫০ লক্ষ বছর। পৃথিবীর গড় বয়স যদি ৪৫০ কোটি বছর ধরা হয়, তাহলে ৫০ লক্ষ বছর আগে তৈরি হওয়া একটি পর্বতশ্রেণিকে নওল, নওজোয়ান বললে তা খুব ভুল বলা হবে না। নবীনত্বের বিষয়টি হয়তো আরও একটু স্পষ্ট হবে যদি বলা হয় ভারতের তথা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন পর্বত আরাবল্লীর উৎপত্তি হয়েছিল আনুমানিক ৩০ কোটি থেকে ১৮ কোটি বছর আগে। নবীন বয়সে একজন মানুষ যেমন সটান, ঋজু থাকে হিমালয়ও তাই। অন্যদিকে নানান ঝড়ঝাপটা সামলে আরাবল্লী এখন বৃদ্ধ, ন্যুব্জদেহী।

অন্যদিকে ‘ভঙ্গিল পর্বত’ কথাটাও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথিবীতে যে তিন ধরনের সংস্থানিক পর্বত দেখা যায় (ভঙ্গিল, স্তূপ ও আগ্নেয়) ভঙ্গিল পর্বত তার মধ্যে অন্যতম। ভঙ্গিল শব্দের অর্থ ‘ভাঁজ’। অর্থাৎ হিমালয় ভাঁজযুক্ত শিলাদ্বারা গঠিত। টারশিয়ারি যুগে যে প্রবল গিরিজনি আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রভাবে দুই অগ্রসরমান মহাদেশীয় ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী মহীখাতে সঞ্চিত পলল রাশি প্রবল প্রেষণে ভাঁজ খেয়ে উঠে গিয়ে আজকের হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি করেছে। মূলত ভাঁজযুক্ত পাললিক শিলায় গঠিত বলে ভঙ্গিল পর্বত গঠনগতভাবে বেশ দুর্বল। উপরন্তু এখনও এই পর্বতের নির্মাণ চলছে। ফলে মাঝেমধ্যেই এই সংবেদনশীল পার্বত্য অংশে ঘটে প্রবল ভূমিকম্প। এটি একটি বিরামহীন প্রক্রিয়া। ১৮৯৭ সালের শিলং ভূকম্প, ১৯০৫ সালের কাংড়ার ভূমিকম্প, ১৯৩৪-এর নেপাল-বিহারের ভূমিকম্প, ১৯৫০-এর অসম ভূকম্প থেকে শুরু করে ১৯৯১-এর উত্তরকাশী, ১৯৯৯-এর চামোলি, ২০০৫-এর কাশ্মির ভূকম্প, ২০১১-র সিকিম, ২০১৫-র নেপাল-ভারত ভূকম্প— এ ধারা চলছে নিরন্তর। ভূপৃষ্ঠের এমন এক দুর্বল অংশে প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য, সুস্থিতির সামান্যতম তোয়াক্কা না করেই চলছে তথাকথিত ধ্বংসাত্মক উন্নয়ন। যে উন্নয়ন অনন্তলালদের বিপন্ন করে, গৃহহীন করে, এলোমেলো করে দেয় এতদিনের কষ্টসৃজিত সম্পর্কের বনিয়াদ তা কেমন উন্নয়ন? এই প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা বলার আগে জোশিমঠের হালফিল বিপর্যয় নিয়ে আরও কিছু প্রয়োজনীয় কথা পাঠকের দরবারে পেশ করা যাক।

 

ছোটবেলার সুড়ঙ্গ ও আজকের জোশিমঠ

চলুন, বেশ কিছুটা পেছনে ফিরে গিয়ে আমাদের ছেলেবেলায় উঁকি মারি। কখনও বালি খুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করেছেন? ছোটবেলায় এমনই এক আজব খেলায় মজে থাকতাম আমরা। পাড়ায় নতুন কারও বাড়ি তৈরি হবে। বিল্ডার্সের লোকজনেরা বালি বয়ে এনে জমির একপাশে স্তূপ করে রেখে গেছে। সেই বালির স্তূপে হাত ঢুকিয়ে বালি সরিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করতাম বন্ধুরা মিলে। যতই খুঁড়ি ততই ওপর থেকে বালি গড়িয়ে এসে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ পণ্ড করে দেয়। বেশ কয়েকবার এমন অনর্থ ঘটার পর হতাশ হয়ে হাল ছাড়তাম আমরা। আমাদের এহেন বালখিল্যতা দেখে কোনও প্রাজ্ঞ বরিষ্ঠ মানুষ বেশ গ্রাম্ভারী চালে এসে বলতেন— বালিতে সুড়ঙ্গ খোঁড়া যায়? এতটুকু মাথা খাটাবি না? বেকার পণ্ডশ্রম করা। যাও, বাড়ি গিয়ে মায়ের বকুনি খাও। কী আশ্চর্য, তেমনটাই ছিল আমাদের ললাট লিখন!

এই গল্পটা পেশ করলাম এই কারণে যে জোশিমঠের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে আমাদের ছেলেবেলার খেলার বেশ মিল আছে৷ অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণসূত্রে জানা গেছে সে অঞ্চলে এমন সব নির্মাণকর্ম চালানো হচ্ছিল এতকাল ধরে তা কখনওই গাঙ্গেয় সমভূমি বা উপদ্বীপীয় মালভূমির মতো আপাত সুস্থিত ভূপৃষ্ঠের ওপর সংস্থাপিত নয়। হিমালয়ের দক্ষিণ ঢাল বরাবর নেমে আসা অসংখ্য জলধারা এবং হিমবাহ-বাহিত অবস্করের দ্বারা গঠিত, ফলে এখানে যেকোনও নির্মাণকাজই অত্যন্ত ঝুঁকিবহুল। হিমালয়ের উত্থানের পর থেকেই নদী, হিমবাহের যৌথ ক্রিয়ার ফলে এই বিপুল পরিমাণ শিথিল, দুর্বল অবস্কর পুঞ্জচলনের ফলে এসে জমা হয়েছে এই অঞ্চলে যা কখনও বৃহদায়তন নির্মাণের উপযোগী নয়। বালির ভেতরে জল ঢাললে কী হয়? বালি বসে যায়। এখানেও ঠিক তেমনটাই হয়েছে। প্রাকৃতিক অনুশাসনের কথা মাথায় না রেখে কেবল উন্নয়নের বেলাগাম পাগলা ঘোড়া ছোটালে এমনটাই যে পরিণতি হবে সেকথা আর কবে বুঝব আমরা? ভূ-বিজ্ঞানীরা তাঁদের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আরও জানিয়েছেন যে উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার মাঝবরাবর একটি সংস্থানিক অসমতা অবস্থান করছে যার ফলে জেলার দুই প্রান্তসীমার মধ্যে গাঠনিক সাযুজ্যের অভাব থাকায় অঞ্চলটি স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল প্রকৃতির। এতেই শেষ নয়। অলকানন্দা নদী তার পাদপীঠ ক্ষয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলের দুর্বল পার্বত্য ঢালের স্থিতিস্থাপকতাকে প্রতিনিয়তই বিঘ্নিত করছে। জানি প্রশ্ন উঠবে, এতসব বিপদ সম্পর্কে কেউ নির্মাতাদের আগেভাগে সতর্ক করেনি? এতসব প্রাজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ, স্থপতিরা এখানে এতসব নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়ার আগে এইসব সম্ভাব্য বিপদ বিষয়ে আগাম অনুমান করতে পারেননি? এর উত্তর হল, আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেই (১৯৭৬) এমন বিপদ সম্পর্কে আগাম সতর্ক করা হয়েছিল এম সি মিশ্র কমিশনের রিপোর্টে। কিন্তু সেইসব সুপরামর্শ কারও কানে ঢুকলে তো! কথায় বলে না— চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি! এক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে। মিশ্র কমিটির সুপারিশগুলোর কথা না মেনেই উন্নয়নের ডঙ্কা বাজানো হল। ফলে আজ বাপ-পিতামহের ভিটে হারিয়ে এক অনিশ্চিত জীবনপথের পথিক হতে বাধ্য করা হল অনন্তলাল সহ আরও বহু বহু জোশিমঠবাসীকে। একবার মিশ্র কমিটির সুপারিশগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক। বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পর পাঁচ দশক আগের সুপারিশগুলোকে হয়তো অর্থহীন মনে হবে, তবুও তাকে স্মরণ করা জরুরি বইকি!

 

মিশ্রসাহেব উবাচ…

জোশিমঠ ডুবছে, বসে যাচ্ছে, এমন খবরে সংবাদপত্র ও সম্প্রচারমাধ্যম এখন যতই হইচই, আলোচনার তুফান তুলুক না কেন, সমস্যাটা একেবারেই সাম্প্রতিক— তেমনটা নয়। আসলে একটি প্রাকৃতিক বিষয় মানুষ নামধারী উন্নয়নবাদীদের কাজকর্মের দৌরাত্মে বিপন্নতার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে ১৯৭৬ সালে সমস্যার কথা বুঝতে পেরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার গাড়োয়াল জেলার মুখ্য তহশিলদার (Collector) এম সি মিশ্রের তত্ত্বাবধানে ১৮ সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির প্রধান দয়িত্ব ছিল জোশিমঠের এই সমস্যা বিষয়ে অনুপুঙ্খ অনুসন্ধান করা। নানান ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ মানুষের সমন্বয়ে গঠিত এই কমিটি সমস্যাটি খতিয়ে দেখে তাদের রিপোর্ট জমা দেয় এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জোশিমঠ অঞ্চলে কোনওরকম উন্নয়নমুখী নির্মাণকার্য না করার সুপারিশ করে। কী বলা হয়েছিল মিশ্র কমিটির রিপোর্টে?

‘জোশিমঠ অঞ্চলটি ধ্বস্ত অবস্কর স্তূপের— যা বালি ও নুড়িপাথরের সমন্বয়ে গঠিত— ওপরে অবস্থান করছে। এখানে কঠিন পীঠশিলার অস্তিত্ব নেই। ফলে এই অঞ্চলে নগরায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা হবে বিপুল হঠকারিতা। গৃহনির্মাণ তথা সড়ক ও অন্যান্য নাগরিক পরিষেবা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে যদি বিস্ফোরণ ঘটানো হয় অথবা ভারী পণ্যবাহী শকটের চলাচল বাড়ানো হয়, তা প্রাকৃতিক ভারসাম্যকেই কেবল নষ্ট করবে না, মানবীয় সম্পদেরও বিপুল বিনষ্টির কারণ হয়ে উঠবে।’ আজকের নগরায়িত আধুনিক হর্ম্যমালাশোভিত জোশিমঠে ঠিক তেমন ঘটনাই ঘটেছে।

গোটা অঞ্চলটিকে অত্যন্ত ধসপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করে রিপোর্টে বলা হয়েছিল জোশিমঠের জলনিকাশী ব্যবস্থা যথাযথ নয়। যথেচ্ছভাবে হোটেল, রিসর্ট, বাড়িঘর ইত্যাদির বর্জ্য জল জমা করার জন্য যেসব soak pit তৈরি করা হয়েছে সেগুলোতে জমা জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে মাটির গভীরে প্রবেশ করার ফলে মাটির কণাগুলি সংলগ্ন বোল্ডারগুলি থেকে ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে। তার ফলে মাটির ভেতরে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য ফাঁকফোকর যা ধসের সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন না হলে অনেক বড় বিপর্যয়ের জন্য জোশিমঠবাসীকে প্রস্তুত থাকতে হবে। মিশ্র কমিশনের রিপোর্টের কথাগুলো কি খুব অবান্তর বলে মনে হচ্ছে?

জোশিমঠকে সম্ভাব্য অবনমনজনিত বিপর্যয়ের থেকে রক্ষা করার জন্য রিপোর্টে কতগুলো প্রশাসনিক তথা নাগরিক বিধিনিষেধ আরোপের কথা খুব স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল। যেমন—

  • বড় মাপের গৃহাদি নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যদি একান্তই তেমন কিছু নির্মাণের প্রয়োজন হয়, তাহলে ভূমির ভার বহন করার ক্ষমতা ও স্থিরতা যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন। পার্বত্য ঢালের স্থিতিস্থাপকতা বা ভারসাম্য নষ্ট করে এমন কোনও খোঁড়াখুঁড়ি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় ও জেলা প্রশাসনকে তৎপর হতে হবে।
  • সড়ক মেরামতি ও সড়ক সম্প্রসারণের জন্য পার্বত্য ঢালের অংশে কোনওরকম বিস্ফোরণ ঘটানো যাবে না। পর্বতের পাদমূলে গড়িয়ে নেমে আসা বড় বড় পাথর বা বোল্ডারগুলোকে কোনওভাবেই সরিয়ে ফেলা যাবে না। কারণ এর ফলে ঢালের বস্তুভারসাম্য নষ্ট হবে এবং ভূমিস্খলন, ভূমিপাত বা ভূমি-অবনমনের মাত্রা বেড়ে যাবে। শিথিল, স্খলিত উপাদানসমূহের অবপতনের দরুণ যে সমস্ত গভীর ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোকে যুদ্ধকালীন দ্রুততার সঙ্গে ভরাট করে দিতে হবে না হলে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা বাড়বে।
  • ঢালের ওপর কৃষিকাজ ও পশুপালন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যথাসম্ভব।
  • গাছ কাটা চলবে না। স্থানীয় মানুষজনের জ্বালানির সঙ্কট মেটানোর জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের বিকল্প জ্বালানির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে।
  • বৃষ্টির জল বা অন্যতর উৎস থেকে নিঃসারিত জল যাতে পৃষ্ঠপ্রবাহের আকারে পরিবাহিত না হয়, তার জন্য বাঁধানো খাতের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে এই জল চুঁইয়ে মাটির গভীরে ঢুকে বড় রকমের বিপদ ঘটাতে পারে।

মিশ্র কমিটির সুপারিশগুলো যে খুব দূরদর্শী ছিল, সে বিষয়ে কারওই সামান্যতম সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকারের উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড ও তার ইতিবাচক সার্থক রূপায়ণ কতদূর বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে কিছু সন্দেহ থেকেই যায়। উত্তরাখণ্ডে উন্নয়নের মোচ্ছব পালিত হচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরে। বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর আবহিক ভারসাম্য বিলকুল বদলে গেছে, বাড়ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পৌণপুনিকতা ও তীব্রতা। এমন প্রেক্ষাপটেই জোশিমঠের সাম্প্রতিক উন্নয়নযজ্ঞ নিয়ে দু-চার কথা বলা দরকার।

 

উন্নয়নের ভূতের দাপট

এই মুহূর্তে জোশিমঠ ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে তিনটি বড়মাপের নির্মাণকাণ্ড চলছে। বিশেষজ্ঞদের অকপট অভিমত— আজকের জোশিমঠ বিপর্যয় সেইসব নির্বিকার নির্মাণের ফল। বিশিষ্ট পরিবেশবিদ সুনীতা নারায়ণ এই বিপর্যয়কে অভিহিত করেছেন a well-engineered calamity হিসেবে। অর্থাৎ এই বিপর্যয়ের পেছনে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নির্মাণবিদ ও তাদের মদতদাতা প্রশাসনের কর্তারাই দায়ী। তপোবন-বিষ্ণুগড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কথাই ধরা যাক। মাটির নিচ দিয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ধৌলিগঙ্গা নদীর জলকে বয়ে নিয়ে এসে ৫২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০০২ সালে এই প্রকল্প রূপায়ণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এনটিপিসি-র তরফ থেকে লারসেন টুব্রো এবং একটি অস্ট্রিয়ান কোম্পানিকে টানেল নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এই অঞ্চলের জটিল ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণে সুড়ঙ্গ খননের কাজ বিলম্বিত হওয়ায় ২০১৪ সালে এই দুই সংস্থাকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং ২০১৬ সালে হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি নামের একটি নির্মাণসংস্থাকে টানেল নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই খোঁড়াখুঁড়ির দরুন এই অঞ্চলে প্রধান জলধারক শিলাস্তরটি ফেটে যাওয়ায় জোশিমঠ ও সংলগ্ন গ্রামগুলির অধিবাসীরা তীব্র জলসঙ্কটের সম্মুখীন। শুকিয়ে গিয়েছে অসংখ্য পাহাড়ি ঝোরা। তাহলে উন্নয়নের নামে এই অঞ্চলের মানুষেরা পেলেন কী? সমস্ত মহলের পক্ষ থেকে এই জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টিকেই প্রধানত দায়ী করা হয়েছে। এই মুহূর্তে তপোবন-বিষ্ণুগড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সবরকম কাজ বন্ধ আছে। বিপুল শ্রম, অর্থ, সময়ের এমন অপচয় আর কতদিন চলবে?

চারধাম সড়ক যোজনা প্রকল্পটিও জোশিমঠের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। দুই লেনের সড়ক নির্মাণের জন্য এই অঞ্চলের বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করা হয়েছে যা অপূরণীয়। শান্ত সমাহিত বনশ্রীকে নির্বাসিত করে আবাহন করা হয়েছে উন্নয়নের উৎপাতকে। অনন্তলালেরা কি এমন উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন? তীর্থযাত্রীদের হটিয়ে আজ পিচবাঁধানো রাস্তার দখল নিতে চলেছে দর্পিত টুরিস্টবাবুরা। তাদের থাকা, খাওয়া, আবাসিক স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে চলছে নির্বিচার নির্মাণ। ফল— আজকের বিপন্ন জোশিমঠ সহ আরও আরও অনেক শৈল জনপদ।

এর শেষ কোথায়? কেউ জানে না। পূর্ববঙ্গের একটি বহুচলতি প্রবচন ঠাকুমার মুখ থেকে বহুবার শুনেছি, আজ প্রসঙ্গক্রমে আলোচনার একেবারে অন্তিম পর্বে এসে তা উল্লেখ করার ইচ্ছেটাকে সামলাতে পারছি না। কথা কটি এরকম— খড়কুটায় আগুন দিয়া পেত্নি নাচে আলগোছে। আজ সত্যি সত্যিই এমনটা ঘটল না তো? পাহাড়তলির গ্রাম থেকে উন্নয়নের পেত্নিকে তাড়াবে কে? অনন্তলালদের যে বয়স হয়ে গেছে!

 

শেষ হইয়াও হইল না শেষ…

অনন্তলালদের সঙ্গে সমব্যথী হয়ে বেশ খানিকটা রাগ আর হতাশা নিয়ে কলম বন্ধ করেছিলাম। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম হযবরল উন্নয়নের কথা— ছিল পাহাড়, হয়ে গেল ধ্বস্ত জনপদ! গুটিকয়েক ব্যবসায়ী ভাবনায় ভরপুর মস্তিষ্ক কেবলমাত্র উন্নয়নের ধুয়ো তুলে স্থল, জল, অন্তরীক্ষকে তছনছ করার খেলায় মেতে উঠেছে। আমরা আর কত বিপর্যয়সূত্রে উপলব্ধি করব যে হিমালয়ের অস্তিত্ব, তার সুস্থিতির ওপর আপামর ভারতবাসীর অস্তিত্ব, সুস্থিতি ও উন্নয়ন নিবিড়তমভাবে সম্পৃক্ত? আজ হিমালয়কে অস্থিত করার অর্থই হল ১৪১ কোটি ভারতবাসীর চিরায়ত জীবন ও যাপনকে বড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। হিমালয় তো কেবল বস্তুবাদী যাপনের অবলম্বন মাত্র নয়, আমাদের অধ্যাত্মবাদী আত্মারও পরম আশ্রয়। সেই আশ্রয় থেকে মানুষকে বিচ্ছিন করার অধিকার কে দিল? ধর্ম আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার শিখণ্ডী খাড়া করে আর কতকাল এই সংহারলীলা চলবে? কবে বুঝব যে উন্নয়ন মানে কতগুলো সড়ক নির্মাণ নয়, উন্নয়ন মানে বড় বড় হোটেল, রিসর্ট, রোপওয়ে শপিং মল, অ্যারোস্পেস নির্মাণ নয়— উন্নয়ন মানে মানুষের যাপনকে সুস্থিত সাবলীল করা, তাদের আশা আকাঙ্খা উদ্দীপনাকে সংহত করে নদীর স্বচ্ছন্দ গতির মতো বহমান করা। তেমনটা না হলে দেবতাত্মার অভিশাপ বারংবার নেমে আসবে সভ্যতার ওপর। পরম উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তা নিয়ে ধুকপুক করব আমরা যতদিন না সব কীর্তি (?) সব মহিমা (?) পরম অচিনের মধ্যে মিশে যায়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. একটু খটকা লাগল। জোশিমঠের সাথে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই। এটি শংকরাচার্য প্রতিষ্ঠিত চতুর্মঠের অন্যতম।

  2. খুব জরুরি লেখা।

    এই বিপর্যয় হয়ত অনায়াসেই রুখে দেওয়া যেত যদি ১৯৭৬ এর ভূতাত্ত্বিক সুপারিশগুলি উপেক্ষা না করা হত। ছবির মত ছোট জনপদটি ইচ্ছাকৃত ভাবে নষ্ট করা হল।
    ছিঃ
    হীরক সেনগুপ্ত

  3. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রচনা। লেখার মূল সুরটিই ধরা পড়েছে অতীতের তীর্থযাত্রীদের ‘বিনম্র পদচারণা’ আর আধুনিক ট্যুরিস্টদের ‘দর্পিত দাপাদাপি’র মর্মান্তিক বৈপরীত্যে। হিমালয়ের শান্ত সমাহিত বনানী হাজার হাজার বছর ধরে সর্বত্যাগী সাধকদের পবিত্র তপস্যাভূমি। সেই হিমালয়ের নিজস্ব প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে তথাকথিত উন্নয়ন কখনই কাম্য হতে পারে না।

Leave a Reply to Dipankar Dasgupta Cancel reply