দুটি স্লোগানেই মুক্তি

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

 



রাজনৈতিক কর্মী, সমাজবিজ্ঞানে আগ্রহী

 

 

 

বর্তমানে ঘটে চলা প্রতিটি কেসের শেষেই দুটি স্লোগান খুব জোরের সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। এক, জয় শ্রীরাম; দুই, ভারত মাতা কী জয়। কেবল দেওয়া হচ্ছে নয়, প্রচারও করা হচ্ছে খুবই সুকৌশলে প্রোপাগান্ডার আকারে। মনে হচ্ছে টেপে রেকর্ড করে রাখা হয়েছে স্লোগান দুটি। প্রতিটা অন্যায় সংগঠিত হলেই রাষ্ট্র বাজিয়ে দিচ্ছে। ভাল না লাগলেও কিংবা শুনে শুনে গা জ্বললেও এই স্লোগান দুটি কেন দেওয়া হচ্ছে সবেতে?

 

জয় শ্রী রাম+ভারত মাতা কী জয়=দেশপ্রেমী। চুরি-ডাকাতি-খুন-ধর্ষণ— সাতখুন মাফ হিন্দুরাষ্ট্রের নিয়মাবলিতে; যদি তুমি হও দেশপ্রেমী। পটাপট মানুষ মেরে এক নাগাড়ে বলতে পারো— জয় শ্রী রাম! ভারত মাতা কী জয়…

কিছুদিন আগেই আমরা দেখলাম তামিল সিনেমার নায়কের মতন পুলিশ-গোয়েন্দার সমস্ত বেড়াজাল টপকে দুজন গুলি ছুড়ল জেলবন্দি আতিক আহমেদ এবং তার ভাইকে। তার ঠিক কয়েকমাস আগেই ছাড়া পেল বিলকিস বানো ধর্ষণের অভিযুক্তকারীরা। বিচারপতি বললেন— অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে বললেন— সংস্কারি। এবার ঈদের ঠিক দুইদিন আগে গণহত্যার সমস্ত কেসের দায় কাঁধ দিয়ে ঝেড়ে ফেলে মুক্ত হল তিন কুখ্যাত ভক্ত; তথা দেশপ্রেমী। গণহত্যায় অভিযুক্ত বিজেপির প্রাক্তন মন্ত্রী মায়া কোদনানি সহ ২০০২-এর নারোদাগাম গণহত্যায় জীবিত ৬৭ জন অভিযুক্তকেই বেকসুর খালাস করে দিল। যাদের মধ্যে আছে বজরং দলের নেতা বাবু বজরঙ্গী ও ভিএইচপি নেতা জয়দীপ প্যাটেল। এদের নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। হচ্ছে। চলছে প্রতিবাদও। তাই আর এদের সম্বন্ধে আমার আলাদা করে কিছু বলবার আজ আর কোনও প্রয়োজন নেই।

আমি বলতে চাই— এদের মতন কুখ্যাত ভক্তিবাদী–দেশপ্রেমীরা যে হিন্দুরাষ্ট্রে এমন বীরের মতন কাজ করে মুক্তি পাবে না তা আমি একদম ভাবিনি। বরং আমি জানতাম এরা সমস্ত কেস থেকে রেহাইও পাবে এবং আরও গণহত্যার ছক সাজাবে। কারণ এরা কুখ্যাত দেশপ্রেমী; এমন দেশপ্রেম জিন্দা রয়েইছে এদের হাত ধরে। কিন্তু আমি সাম্প্রতিককালে ঘটে চলা এই প্রতিটা কেসেই স্পষ্টভাবে লক্ষ করলাম— দেশপ্রেমের দিকনির্দেশ করা স্লোগানগুলিকে। কথায় বলে, স্লোগান যত স্পষ্ট হয়, আগামীর রাজনৈতিক লাইনটাও ততটাই মসৃণ হয়।

বর্তমানে ঘটে চলা প্রতিটি কেসের শেষেই দুটি স্লোগান খুব জোরের সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। এক, জয় শ্রীরাম; দুই, ভারত মাতা কী জয়। কেবল দেওয়া হচ্ছে নয়, প্রচারও করা হচ্ছে খুবই সুকৌশলে প্রোপাগান্ডার আকারে। শুধু এই কেসগুলিই নয় এমনকি সরকারের তরফ থেকে ঘর-বাড়ি-বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া কিংবা গ্রামে গ্রামে জোতদার-জমিদার টিকিধারীদের তরফ থেকে অত্যাচারিত-শোষিতের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার পরেও দেওয়া হচ্ছে এই স্লোগান দুটি। শুনলেই যেন কানে বাজছে; মনে হচ্ছে টেপে রেকর্ড করে রাখা হয়েছে স্লোগান দুটি। প্রতিটা অন্যায় সংগঠিত হলেই রাষ্ট্র বাজিয়ে দিচ্ছে। তাই নয় কি? টিভি রিয়্যালিটি শোতে ‘বাগেশ্বর বাবা’র টক শো থেকে ইউটিউবের অধিকাংশ রিলের পেছনে বাজছে এই দুটি স্লোগান। যা শুনে শুনে একঘেয়ে বোরিং হয়ে গেছে। আর শুনতে ভাল্লাগছে না মোটেও। কিন্তু ভাল না লাগলেও কিংবা শুনে শুনে গা জ্বললেও এই স্লোগান দুটি কেন দেওয়া হচ্ছে সবেতে? কেন আরএসএসের নেতারা ‘হিন্দু নারী’দের বলছে রিল বানাতে এই স্লোগান ব্যবহার করে— পাপার পরী নয় বরং পাপার শেরনি হতে; কেন? এই স্লোগান দুটি কী এমন যা লাগলেই জাদুমতন সব বদলে যাবে?

আসলে এই স্লোগান দুটিকে ব্যবহার করে আরএসএস-বিজেপি তথা হিন্দু-সেনাবাহিনি উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে দেশ জুড়ে চলা ফ্যাসিবাদী গণআন্দোলনের দপদপ করে জ্বলতে থাকা আগুনে ঘি ঢালতে চাইছে। এদিক থেকে তারা এই স্লোগান দুটির মধ্যে দিয়ে দেশের সংখ্যাগুরুর ভেতরকার ধর্মীয় চেতনা সুড়সুড়ি দিয়ে ও দেশের প্রতি ভালবাসার কৃত্রিম রস বাড়িয়ে নিজেদের ফায়দা লুটতে চাইছে। আরেকদিক থেকে সমস্ত অন্যায়ের উপরে এই দুটি স্লোগানের প্রলেপ লেপে সমাজে এক আতঙ্ক, ভয়-ভীতির সৃষ্টি করছে। এই ভয় কিসের ভয়? উগ্র দেশপ্রেমের ভয়। যাতে তাদের করা কোনও কাজেই বিন্দুমাত্র বাধা দেওয়ার কেউ না থাকে। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী গণ-আন্দোলনের পথ মসৃণ করতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি। এই পথকে মসৃণ করতেই টার্গেট (আইওয়াশ হিসেবে) কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাই রমজান মাসেই একের পর এক কাজ তারা সংগঠিত করেছে; মুসলমান বস্তিতে, রামনবমীকে উপলক্ষ রেখে সংগঠিত আক্রমণ করা থেকে ঠিক ঈদের দুইদিন আগের মুসলমান গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের মুক্তি, হত্যাকারী বাবু বজরঙ্গীদের। তারপরেই কোর্টচত্বরে এই দুটি স্লোগান। পুলিশের বিনা বাধাতেই। এসব করছে কেবল সমাজে ভয় ছড়ানোর স্বার্থে এবং সংখ্যাগুরুর ভেতরকার জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় চেতনা উগ্র করে তুলতে। মানে ফ্যাসিবাদী গণ আন্দোলনের রথের চাকার গতি বাড়াতে।

একথা আজ সত্যি স্বীকার করবার আছে— নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার সাম্রাজ্যবাদী আইন-নীতি-প্রণালী তেমনভাবে তাঁদের আমলে বাস্তবে কার্যকর করে উঠতে পারেনি। সংসদে যেভাবে হোক পাশ করালেও। যেমনটা কংগ্রেস জমানায় চুপিসারে টুকটুক করে করেছিল মনমোহন সরকার। শুধু বিজেপিকে আমাদের কংগ্রেসের থেকে বাড়তি ভয়ঙ্কর লাগবার কারণ, ওদের গরু নিয়ে খুনোখুনির রাজনীতি আর আরএসএস-এর সংগঠিত হিন্দুত্ববাদী ইডিওলজি। যা ধরেই বিজেপি সরকার টিকে থাকবার চেষ্টা করছে এখনও। তবুও আরএসএসের কট্টর হিন্দুত্ববাদী আদর্শ দিয়েও পেরে উঠছে না এদেশের সংখ্যাগুরু ’হিন্দু‘দের এক সুতোয় বেঁধে সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ম-নীতি পুরোপুরি কার্যকর করতে।

আরএসএসের ‘হিন্দু’রাষ্ট্র হল পুরনো বাইকে নতুন সিটকভার লাগানোর মতন; যে বাইকের পার্টস সবটাই পুরনো কেবল পুরনো পার্টসের দিকে নজর এড়াতে উপরে সিটকভারটি নতুন। ঝা চকচকে একেবারে। সেই কভারে সংখ্যাগুরু ভেতরকার ধর্মীয় চেতনায় জিগির দিতে রাম কিংবা হনুমানের ছবি। যে রাম কিংবা হনুমান সাম্রাজ্যবাদী-ভোগবাদী সংস্কৃতিতে মত্ত। যাদের নিজস্ব কোনও সত্তা নেই। সে এখন ডিজে গানে কোমর দোলায়। এই হিন্দুরাষ্ট্রের একটাই লক্ষ্য এদেশের বুকে যেভাবে হোক শিক্ষার বেসরকারিকরণ করা, শ্রমিক-কর্মীদের কাজের সময় বাড়ানো এবং দৈনিক মজুরি কমানো, কৃষকদের চাষের জমি উন্নয়নের নামে কেড়ে নেওয়া, আদিবাসীদের হাত থেকে যেভাবেই হোক জল-জঙ্গল-জমিন কেড়ে নেওয়া। তথা, ব্যবসার একচেটিয়া আধিপত্য— অধিক মুনাফার স্বার্থে— ‘এক দেশ এক আইন‘, ‘এক দেশ এক ভাষা’, ‘এক দেশ এক ধর্ম‘ কার্যকর করা। সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা পরিচালিত এদেশের অতি ধনীদের স্বার্থ যেভাবে হোক রক্ষা করা। বিশ্ব নয়া উদারবাদী অর্থনীতি টালমাটাল পরিস্থিতিতে। সুতরাং, এই ‘হিন্দু’রাষ্ট্র কেবল বড়লোকদের। রাম থেকে হনুমান সব তাদের হাতের এক একটা অস্ত্র মাত্র। যেখানে গরিবের কোনও স্থান নেই; গরিবের জন্যে কোনও রাষ্ট্রসুরক্ষা নেই। আর ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রধান অস্ত্র হল সমাজে সবসময় ভয়-ভীতি, আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখা। যাতে মানুষ ভয়ের বাইরে কিছু ভাবতে না পারে কখনও। তাই, এমতাবস্থায় আমাদের প্রথম কাজই হল এসবের ফলে ভয় না পাওয়া। আবার অতিরিক্ত স্বতঃস্ফূর্ততার বশেও কোন হঠকারী সিদ্ধান্তপূর্ণ কাজ না করে বসা। প্রতিটা সময় সচেতন থাকা এবং অন্যকে সচেতন রাখা। ফ্যাসিবাদীদের প্রধান ওষুধ হল ওদের মনে পাল্টা ভয় ধরানো।

তবুও এতকিছুর পরেও চিন্তা একটা জায়গাতেই। আজ আমাদের দেশের আইন-বিচারব্যবস্থা-সংসদ-সংবাদমাধ্যম যেভাবে কুখ্যাত দেশপ্রেমী বাবু বজরঙ্গী’দের বাঁচাতে ব্যস্ত তা তো একথায় প্রশংসনীয়। কিন্তু তাহলেও এরপরে কী হবে! ৯০ শতাংশ সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী জনগণের দেশে ফ্যাসিস্টদের সমস্ত দিক থেকেই পালানোর পথ একে একে হচ্ছে বন্ধ। তখন এই সমাজব্যবস্থাকে বাঁচাবে কে?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...