ক্রোধের আত্মদর্শন

ক্রোধের আত্মদর্শন | দেবকুমার সোম

দেবকুমার সোম

 



কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

রাগকে বশ করা খুবই কঠিন। তার জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হয়। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ সেটা সব সময় পারে না। কিন্তু ক্রোধ সম্পূর্ণ অন্য কিসিমের জিনিস। ব্যক্তির ক্রোধ খুব উচ্চমার্গের ব্যাপার

 

মা কথায়-কথায় বলেন, ‘তোদের বাবার সবেতেই মেজাজ।’ কখনও আবার জোর দিয়ে বলেন, ‘তিরিক্ষে মেজাজ’। কথাটা শুনতে-শুনতে আর চোখের ওপর দেখতে দেখতে আমরা তিন ভাইবোন এতদিনে প্রায় লায়েক হয়ে উঠলাম; কিন্তু এখনও বুঝে উঠতে পারলাম না বাবার এই মেজাজ ব্যাপারটা ঠিক কী? নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে রোজ টানাটানির কারণেই কি আমার বাবার মেজাজ অমন ‘তিরিক্ষে’? বাবা কি নিজেকে তাঁর অন্য ভাইবোন কিংবা বন্ধুদের থেকে কম সফল এমনটা ভেবে মেজাজ হারান? নাকি অফিস-বাড়ির বিবিধ অসমতার কারণেই তিনি ভেতর থেকে বিক্ষুব্ধ, তাই এমন আচরণ? আমার মা আর বাবার প্রেম করে বিয়ে; সেই বিয়ে কি বাবাকে বিশেষ সুখ দেয়নি? যেমন তিনি ভেবেছিলেন, তেমনটা নয় তাঁর স্ত্রী-ভাগ্য এমনটাই কি তাঁর প্রত্যয়? তাই মাকে ব্যক্তিগত শত্রু ভেবে নিয়ে এমন মেজাজ দেখান? মানে বাবার কাঙ্ক্ষিত সুখ না-পাওয়াটাই ক্ষণে-ক্ষণ মেজাজ হারানোর মতো বদস্বভাবের আদল পেয়েছে?

আমরা দেখেছি বাবার এই অনায্য ব্যবহার মায়ের ক্ষেত্রেই বেশি; তারপর ঠাকুরমার ওপর। ঠাকুরমাকেও বাবা মেজাজ দেখান। তাহলে কি এটা ভালবাসার, সম্পর্কজনিত অধিকারের আর একটা রূপ? মানুষটার ধরনটাই হয়তো এমন। নাকি মেয়েরা সমাজ-সংসারে পুরুষের সমান হতে চাইলে বাবার ক্ষোভ হয়? আমার বাবা হয়তো নিজেকে তেমন ব্যর্থ মানুষ ভাবেন না, স্ত্রী কিংবা মাকেও যথেষ্ট ভালবাসেন; তবে ওই, মেয়েছেলেদের মাথায় তুলতে তাঁর ঘোর অনীহা, তাই এমন ব্যবহার? অর্থাৎ আমার বাবার মেজাজ আসলে সামাজিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ? ক্ষমতার আস্ফালন?

এদিকে আবার বাবা আমাকে পড়াতে বসলেই মেজাজ হারান। সেটা কি প্রত্যাশাজনিত অপ্রাপ্তি? নাকি সেখানেও অধিকারের প্রশ্নচিহ্নটা ঝুলে আছে? বাবার এমন অনিয়ন্ত্রিত চিৎকৃত ব্যবহার কি জন্ম থেকেই? এটা কি আমাদের বংশগত সমস্যা? দাদুকে বিশেষ রাগতে দেখি না, যদিও ঠাকুরমা বলেন এককালে নাকি দাদুরও হেবি ‘রাগ’ ছিল। কথাটা মনে পড়তেই আমার মনে একটা সন্দেহ যেন উঁকি দিল: ঠাকুরমা যাকে ‘রাগ’ বলেন, মায়ের কাছে তাই কি ‘মেজাজ’?

বাবার মেজাজি স্বভাব নিয়ে বলতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি পরস্পর সংলগ্ন অথচ বৈচিত্রময় বহু কারণ ঝেঁকে এল মাথার মধ্যে।

আমার বাবা সামান্য একটা চাকরি করেন, ফলে তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা থাকলেও হয়তো আমাদের সব সাধ-আহ্লাদ পূরণ করতে পারেন না। ঠাকুরমা বলেন বাবা নাকি খুব ভাল বাঁশি বাজাতে পারতেন। সেদিন ইউটিউবে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি শুনতে শুনতে আমাকে বললেন, ‘রন্টু শোন, লোকটা কী মেজাজে বাঁশি বাজাচ্ছেন।’ এখানে ‘মেজাজ’ শব্দটা আমার কানে ধাক্কা মারে। তাই তো? সেদিন আমাদের স্কুলের গেমটিচার অধীরবাবুও বলছিলেন, ‘তোরা তো দেখিসনি, আমরা নিজেদের চোখে দেখেছি গাভাস্কারের ব্যাটিং। কী মেজাজি স্টাইল। তোদের কোহলিরা ওসব পারবে নাকি?’ আমি খানিক ধন্দে পড়ে যাই। আমার বাবার মেজাজের সঙ্গে হরিপ্রসাদ কিংবা গাভাস্কারের মেজাজের ফারাক চোখের ওপর পড়ল। তাহলে কি মেজাজ দু ধরনের? একটা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত বাড়ির পুরুষদের, আর একটা শিল্পীদের? একটা না-পাওয়া ক্ষোভের কথা, অন্যটা আত্মমগ্নতা? সাধনার দোসর?

আমার মায়ের একজন গুরুঠাকুর আছেন। মা প্রতি মঙ্গলবার তাঁর কাছে যান ধর্মকথা শুনতে। আমার একবার হাফ-ইয়ার্লির রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল; খারাপ মানে খুব খারাপ। ইংরাজিতে কুড়ি আর অঙ্কে সাতাশ। বাবার কাছে ঠ্যাঙানি খেয়েছি। মা চোখের জলে ভেসেছেন। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁর গুরুঠাকুরের কাছে ছেলেকে নিয়ে যাবেন। তাঁর আশীর্বাদে নিশ্চিত আমার পরীক্ষার সব ফাঁড়া কেটে যাবে। তা শ্রীমৎ গুরু আমাকে দেখে কিছুই বললেন না; মা কতবার ‘বাবা, বাবা’ করে গেলেন। তিনি সেই যে চোখ মুদে বসেছিলেন, একনাগাড়ে বসেই রইলেন। ফেরার সময় মা বলেছিলেন, ‘বাবার মেজাজ ঠিক নেই। দিব্য পুরুষ তো, ওঁনাদের মন-মর্জি বোঝা আমাদের মতো পাপীতাপীদের কর্ম নয়।’ তার মানে কি মেজাজ নির্ভর করে মানুষের মন-মর্জির ওপর? এতসব মেজাজ নিয়ে আমি খামোখা বেশ জটিলতার মধ্যে পড়ে গেলাম।

পরশু সকালেই একটা ঘটনা ঘটল। বুলুদি আমাদের বাড়িতে কাজ করেন। বাসন মাজা, ঘর মোছা এইসব। সকালে বাবা অফিসে যাওয়ার আগে বুলুদি না এলে মায়ের অসুবিধা হয়। তখন দিদিকে পড়া থেকে উঠে মায়ের সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে হয়। বুলুদির আসার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই— যখন যেমন মনে হল এলেন, কিংবা ডুব দিলেন। মোবাইল ফোন বেজে যাবে বুলুদি সাড়া দেবেন না। পরশু সকালে যখন বুলুদি এসেছেন, ততক্ষণে বাবা বেড়িয়ে গেছেন। বুলুদিকে আসতে দেখে মা একেবারে রণচণ্ডী। মুখের ওপর যা মনে এল বলে দিলেন। আর বুলুদিও তেমন, মায়ের মুখের ওপর কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন। পরিস্থিতি এমন যে বুলুদি তখনই হিসাব মিটিয়ে কাজ ছেড়ে দেওয়ার জন্য মাকে চাপ দিতে লাগলেন। দিদি বুঝতে পারে ব্যাপারটা হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বুলুদি কাজ ছেড়ে চলে গেলে মায়ের সব রাগ গিয়ে পড়বে আমাদের ওপর। আর ঠাকুরমার রাগ মায়ের ওপর। এই বাজারে এমনিতেই লোক পাওয়া যায় না; কাজের লোক চলে গেলে সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে না? দিদি বলল, ‘বুলুদি, তুমি রাগ করো না। তুমি তো জানো সকালে সময় মতো না এলে আমাদের কী অবস্থা হয়?’ দিদির কথাটা আমার কানে লেগে গেল। তার মানে এখন বুলুদি মেজাজ দেখাচ্ছেন না, রাগ করছেন। মনে পড়ে গেল সেই ছেলেবেলায় মা পড়িয়েছিলেন শিবঠাকুরের তিন কন্যার কথা, তার মধ্যে ছোট কন্যাটি ‘রাগ করে বাপের বাড়ি যান’। মেয়েরা যে রাগ করে বাপের বাড়ি যাওয়ার হুমকি দেন (আমার মাকেও দেখেছি), তো সেই রাগ আর এই রাগ কি এক? না ছোট কন্যাটির রাগে অভিমানের মিশেল আছে? তাহলে এমন রাগ আর অভিমান পিঠোপিঠি? তাকে কি রাগ না বলে অনুরাগ বলাটাই সমীচীন? ভাববার মতো বটে।

শিবঠাকুরের কথাটাই যখন উঠল তখন তেনাকে নিয়ে একবার ভাবা যাক। চণ্ডীমঙ্গলে দেখা যাচ্ছে কৈলাশে শিবানীর সঙ্গে তাঁর নিত্যদিনের অশান্তি। ভোলানাথ সামান্য ভিক্ষা করে এনেছেন। সেই ভিক্ষায় পেট পুরে খাবার জোটার কথা নয়, এদিকে চণ্ডীকে তিনি আদেশ দিলেন পাঁচ পদ রেঁধে খাওয়াতে। এমন আবদারে চণ্ডী তো রেগে কাঁই। রাগের মাথায় দু-চারটে ভালমন্দ শুনিয়ে দিলেন স্বামীকে, এর মধ্যে নিজের ভাগ্যকেও বারকয়েক দুষলেন। বউয়ের অপমান মুখ বুজে সহ্য করবেন তেমন বান্দা কি আর আমাদের মহেশ্বর? তিনি রাগ করে কৈলাশ ছেড়ে চলে গেলেন। এক রাগ থেকে আর এক রাগ, যাকে এক্ষুনি প্রতিহিংসা হয়তো বলা যাচ্ছে না, তবে সংসারে নিত্যদিন এমন রাগ-অনুরাগ চলে, মিটেও তো যায় রাগ পড়ে গেলে। আমার বাবার সঙ্গে আমার ঠাকুরদার এমন মারকাটারি অনেকবার হয়েছে, আবার মিটেও গেছে। কিন্তু, মায়ের ওপর ঠাকুরমার রাগ? আমার মামারবাড়ি বেজায় গরিব। শুনেছি বিয়ের সময় মামারা বিশেষ দিতেথুতে পারেননি, সেই কারণে ঠাকুরমার রাগ মায়ের ওপর। আমার দিদির মুখেই শোনা। তবে ঠাকুরমার রাগটা কৈলাশের মতো নয়, নিয়ন্ত্রিত। মাপা। শকুনির যেমন নিয়ন্ত্রিত রাগ ছিল কুরুবংশ ধ্বংস করার, খানিকটা তেমন। আমার কুশলী ঠাকুরমা তার নিয়ন্ত্রিত রাগকে কাজে লাগিয়ে বাবাকে উসকে দেন, এটা আমারও নিজের চোখে দেখা। ফলে ঠাকুরমার রাগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আমার বাবার হঠাৎ মেজাজ— মা আর বউ দুজনের ওপরই।

আমার ছোট ভাই সন্টুরও রাগ কিছু কম নয়। সেদিন নুডলস্ খাবে বলে মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিল। মা মুড়ি দিয়েছিলেন। ছেলের কী রাগ? খাবে না! মুড়ির বাটি ছুড়ে ফেলে কাঁদতে শুরু করল। তারপর আর কী? মা ভিজে হাত আঁচল মুছে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এলেন; পিঠে ঘা-কতক পড়ল— বাবু তারপর ঠান্ডা হলেন। আমি বুঝতে পারলাম মেজাজ ব্যাপারটা মানুষের স্বভাবগত; খানিকটা মর্জিমাফিকও বটে। জিনিসটা সকলের মধ্যেই হয়তো কমবেশি থাকে। তবে শিক্ষক, শিল্পী আর বাবা-মায়েদের বেশি থাকে। ওটা খারাপ, তবে বোধহয় তেমন দোষের নয়। মনে হয় রাগ অমনটা নয়। রাগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। রাগের মাথায় বুলুদি যেটা করেছিলেন, আর শিবঠাকুর যে আচরণ করেন, সেটা এক রকম আত্মহত্যার শামিল। এটা আমার সঙ্গেই তো ঘটেছে। বছর কয়েক আগে এক ছুটির দিন বাবা পড়তে বসিয়ে ছিলেন; যথারীতি আমি ইংলিশ ট্রানস্লেশনে ধেড়িয়েছি। বাবার হাতের সামনে ছিল প্লাস্টিকের স্কেল, সেটাই আমার পিঠে ভাঙলেন। আমিও তেমন, রাগ করে ঠিক করলাম রাতে খাব না। খাওয়ার সময়ে মা অনেকবার সাধাসাধি করলেন, বাবা বললেন, ‘ছেড়ে দাও, খিদে পেলে আপনি খাবে।’ হলও তাই। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়তে আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না, তখন কোথায় আমার রাগ? পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। বাবা আলো জ্বেলে মাকে ডেকে তুললেন, তারপর আদর করে বসিয়ে আমাকে খাওয়ালেন। আমার মাথায় হাত বোলানোর সময় বাবার গলা কেমন ভিজে ভিজে ঠেকে আমার। ঠাকুরমা বাথরুমে যেতে যেতে বলেছিলেন, ‘ঢং, অমন মারারই বা কী দরকার, আর আদরেরই বা কাজ কী? ছেলে মানুষ কি আমরা করিনি?’ আমার ঠাকুরমার এই এক দোষ, তিনি মনে করেন তাঁর নাতি নাতনিদের তিনি ছাড়া কেউ শাসন করতে পারবেন না; আদর করলে অবশ্য ক্ষতি নেই। মানে শাসন করার সময় মানুষের ছদ্মরাগ হতে পারে, কিংবা শাসনজনিত রাগ থিতিয়ে গেলে মানুষের অনুশোচনাও হয়। এই রাগ যেন মেজাজের এক্সটেনশন।

রাগের প্রসঙ্গ এলে মনে পড়ল ‘রাগে চণ্ডাল’ এমন একটা বাগধারা আমাদের বাংলার স্যার আমাদের শিখিয়েছেন। যদিও চণ্ডাল মাত্রই ভয়ঙ্কর রাগী, তেমনটা নয়। বহু মানুষকে রাগের মাথায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হতে শুনেছি। খবরের কাগজে প্রতিদিন যেসব খুনের কথা পড়ে সকলে চমকে ওঠে, সেগুলো তো রাগের মাথায় ঘটে? রাগের মাথায় কাটারি দিয়ে স্বামী স্ত্রীর গলা কেটে দিল, কিংবা বন্ধুদের মধ্যে সামান্য কথাকাটাকাটি খুনোখুনিতে পৌঁছে গেল— এ তো সকলেরই জানা। এসব রাগ থিতিয়ে গেলে মানুষ অপরাধ গোপন করতে চায়, পারে না; শেষে শাস্তি হলে অনুশোচনাও হয় হয়তো। শিবঠাকুরের ঘটনাটাই দেখুন না। শ্বশুর জামাইকে যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করেননি; মেয়ে যেচে বাপের বাড়ি গেছেন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। সেখানে ভরা রাজসভায় দক্ষরাজ জামাই মহেশ্বরের নামে অপমানজনক কথা বলতে সতী প্রাণ দিলেন। খবর গেল কৈলাশে, মহাদেবের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল, সেই অনয়িন্ত্রত রাগ আর শোকে স্ত্রীর মৃতদেহ নিয়ে শুরু হল তাঁর তাণ্ডব নৃত্য।

আমি তো আমার ঠাকুরমার কথা বলছিলাম, বুড়ির রাগ নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু কেউ-কেউ আবার রাগ জমিয়ে রাখে। যেমন আমার ছোটকাকা। তিনি বড় চাকরি করেন। আমাদের পৈতৃক বাড়ি ভাগবাঁটোয়ারা করে দাদুর কাছ থেকে জমি নিয়ে তিনতলা বাড়ি হাঁকিয়েছেন; কিন্তু মন শান্ত হয়নি। বাবা বসতবাড়িটা পেয়েছেন এটা সহ্য হয় না কাকার। ঠাকুরদা আমার সামনেই একদিন ছোটকাকাকে মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন, ‘লেখাপড়া শিখেছ, বড় চাকরি করো। এদিকে বুড়ো বাবা-মাকে দেখার মুরোদ তোমার নেই। কোন মুখে আসো সম্পত্তির হিসাব চাইতে?’ আমার দাদুর মত তাঁর বড়ছেলে তাঁদের দেখভাল করেন, তাঁর সংসারে টানাটানি থাকলেও মা-বাপকে ঝেড়ে ফেলেননি, ফলে তিনি বড়কেই টানবেন। দাদুর এমন বিচার কাকা মানবেন কেন? তাঁর আরও সম্পত্তি দরকার; ফলে দুই বাড়ির মধ্যে সীমানা-পাঁচিল নিয়ে নিত্যদিন ঝামেলা। কাকিমা মাকে খুব খারাপ কথা বলেন, ঠাকুরমাকে অভিশাপ দেন। বাবা বাড়ি ফিরে সেসব শুনে ছোটকাকাকে শাসাতে যান। মাঝে-মাঝে থানা-পুলিসও হয়। এমন আশান্তিতে আমি খুব ঘাবড়ে যাই, দিদিকে কাছ-ছাড়া করি না। আমার দিদি তো পড়াশুনায় ব্রিলিয়ান্ট, কলেজে পড়ে। সেদিন আমাকে বলল, ‘জানিস ব্যাপারটা হল দেশভাগের মতো।’ আমি বুঝলাম না, হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। তখন দিদি বলল, ‘বুঝলি না হাঁদারাম? ভারত-পাকিস্তান আর কি।’ আমি তখনও বুঝিনি। দেশ তো কবেই স্বাধীন হয়েছে, তাহলে ভারত-পাকিস্তানের কথা আসছে কেন? ‘দুই ভাই মিলে একসঙ্গে ছিল। বাবা ইংরেজ যাওয়ার সময় তিনটে টুকরো করে দিয়ে গেল। তারপর কাশ্মির নিয়ে শুরু হল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সুযোগ পেল পাকিস্তানকে টুকরো করে দেওয়ার। ব্যস সেই রাগ থেকে এখনও খুচখাচ দু-দিকেই চলছে। অথচ দেখ সকলেই একদিন ছিল একই মায়ের পেটের সন্তান।’ দিদি বুঝিয়ে দিতে আমি বুঝলাম না-পাওয়ার গ্লানি কিংবা বেশি চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও মানুষের, সমাজের, রাষ্ট্রের রাগ হয়, আর সেই রাগ নিয়ে কাশ্মিরকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়া যায়। এভাবে কথাটা মনে পড়তে আমার পল্টুর কথা মনে পড়ে গেল। স্কুল থেকে ফেরার সময় হয় ল্যাম্পপোস্টের লাইটগুলো ঢিল ছুড়ে ভেঙে দেয়, নয়তো খামোখা কুকুরকে ঢিল মেরে আনন্দ পায়। একদিন একটা কুকুর আর একটু হলেই ওকে ঘ্যাঁ করে কামড়ে দিচ্ছিল। কুকুরটার আক্রমণ প্রতিহিংসাজনিত, পরিকল্পিত রাগেরই প্রকাশ দিদির কথায় সেটা বুঝতে পারলাম।

টিভি দেখতে দেখতে বাবা আর দাদু সেদিন আলোচনা করছিলেন। বাবা বলছিলেন, ‘লোকটা দল বদলে কেমন পালটে গেলেন’। আমি বড়দের কথায় কান পেতে বুঝতে পারলাম যাঁর কথা বলা হচ্ছে, তিনি আগে ছিলেন সরকারপক্ষের লোক, এখন তিনি বিরোধী হয়েছেন। সেই রাগে সরকারপক্ষের লোকেরা যেমন তাঁকে নিত্যদিন গালিগালাজ করে চলেছে, তিনিও তেমন সরকারকে তেড়ে গালাগাল করেন। মানে এই রাগের সঙ্গে ক্ষমতার একটা যোগাযোগ রয়েছে। যারা ক্ষমতায় রয়েছে তাদের রাগ লোকটা আজ ঘরের শত্রু বিভীষণ বনে গেছেন, উলটোদিকে তিনি তাঁর আগের দলে যে ক্ষমতা চেয়েছিলেন, তা না পাওয়ায় এখনও রেগে টং। এই রাগারাগি আপাতত নিষ্ফল, কেননা দুপক্ষই জমি মাপছে, জমি আগলাচ্ছে। কিন্তু আইপিএল-এ তেমনটা হয় না। যারাই কেকেআর থেকে অন্য দলে চলে গেছে, তাদের দেখি কেকেআর সামনে পড়লে কেমন ফুঁসে ওঠে। হয় চার-ছয়ের বন্যা, নইলে আমাদের ধ্যাড়াদ্ধাড় উইকেট দখল এবং ম্যান অফ দ্য ম্যাচ। মানে রাগ থেকেই দেখিয়ে দেওয়া যে আমিও কিছু কম নই। এই প্লেয়ারগুলো অন্য টিমের বিরুদ্ধে তেমন সফল নয়, যেমন কেকেআর সামনে পড়লে হয়। মানে রাগ উগরে দেওয়ার মঞ্চ পেলে তারা সফল হবে। ব্যাপারটা এমন: অবিচার>রাগ>প্রতিশোধ।

আমার পিসেমশাই খুব ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। পণ্ডিত, মার্জিত— বাড়তি কথা বলেন না। সেদিন ঠাকুরমার কী একটা কথায় পিসেমশাই ভীষণ রেগে গেলেন। মা আর পিসি মিলে ঠান্ডা করতে হিমশিম অবস্থা। পিসেমশাইকে আমরা কোনওদিন রাগ করতে দেখিনি। পিসি তো ঠাকুরমাকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিলেন। মা নিজে কিছু বললেন না বটে, তবে দাদুর কাছে ঘটনাটা বেশ বিস্তারে পরিবেশন করলেন, ফলে দাদুর কাছেও ঠাকুরমা ঝাড় খেয়ে কারও কাছে মুখ লুকাতে পারেন না। আমার মায়ের সেদিনের আচরণে আমি একটু অবাকই হয়েছি। ঠাকুরমা যখন বাবা কিংবা দাদুর কাছে মায়ের নামে রাগ দেখান তখন মা আড়ালে কাঁদেন। আর আজ সুযোগ পেয়ে ঠাকুরমাকে কাঁদিয়ে ছাড়লেন। তাহলে কি নিষ্ফলা রাগ থেকেই নালিশ ব্যাপারটা আসে? আমরা যার সঙ্গে লড়াই করে পেড়ে উঠব না, তার ওপর জমে থাকা রাগই আমাদের নালিশকুটি বানিয়ে দেয়?

দিদি সেদিন আমাদের দুই ভাইকে দুর্বাসা মুনির গল্প বলছিল। খুব কোপন স্বভাবের ঋষি তিনি। ‘কোপন কী দিদি?’ সন্টু জানতে চাইল। দিদি বলল, ‘যার খুব কোপ, সেই কোপন।’ তাও আমরা বুঝতে পারলাম না। দিদি বলল, ‘গাছের ডালে কাটারি দিয়ে কোপ দিতে দেখেছিস?’ আমরা দুজনেই ঘাড় কাত করলাম। দিদি বলল, ‘মানুষ যখন গাছের ডালে কোপ বসায়, তখন তার শরীর আর মন এক সঙ্গে রেগে ওঠে, তাকে বলে ক্রোধ।’ ক্রোধ শব্দটা আমি জানি; রাগ যাকে বলে সেটাই তো ক্রোধ? দিদি ঘাড় নাড়ল, ‘না না, ক্রোধ আর রাগ এক নয়। আমি রেগে গিয়ে তোকে দু-চারটে খারাপ কথা বলতে পারি; কিন্তু ক্রুদ্ধ হলে তোকে অভিশাপ দেব, ঝাড়ে-বংশে এক করে দেব। আমাদের পু্রাণে দুর্বাসা ছিলেন এমন এক কোপন স্বভাবের মুনি ঋষি।’ এরপর দিদি আমাদের শকুন্তলার গল্পটা মনে করাল। বেচারা শকুন্তলা কোনও অপরাধ না করেই কেমন অভিশাপের ভাগী হলেন। দিদি তারপর ভেঙে বলল জাত-ক্রোধ আর এমনি ক্রোধের মধ্যে পার্থক্য বেজায়। এমনি ক্রোধ মানুষ হয়তো জন্মগতভাবে পায় তার সামাজিক অবস্থানের কারণে। যেমন রাজরাজড়াদের ক্রোধ। আর একটা হল অর্জিত ক্ষমতার ফলে ক্রোধ। দুর্বাসার মতো মুনিঋষিরা দীর্ঘকাল তপস্যা করে মানুষকে অভিশাপ দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন, কিংবা আমাদের স্কুলের হেডস্যার, বাবার অফিসের বড়বাবু। এঁরা রাগেন না, ক্রুদ্ধ হন। ফলে সেই ক্রোধের প্রতিক্রিয়া হয় সুদূরপ্রসারী।

‘জাত-ক্রোধ একটু অন্য ধরনের’ দিদি বলল। মানুষের সঙ্গে সাপের সম্পর্ক যেমন। একমাত্র বেদেরা ছাড়া কেউ সাপকে বশ মানাতে পারে না। ভীতি কিংবা ভুল ধারণা থেকেই সাপের ওপর মানুষের জাত-ক্রোধ। অথচ সাপ খুবই নিরীহ আর কমজোরি প্রাণী। আমার মনে হল দিদি বোধহয় সম্পর্কটাকে চোর-পুলিসের মতো বলতে চাইছে। চোর দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই পুলিস হাতের সুখ করে নেয়। আগেকার দিনের বিপ্লবীদেরও পুলিস এমনটা করত। ‘আগেকার দিন শুধু নয় রে, এখনও তাই হয়ে। যেই তুই সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলবি, অমনিই তুই আরবান নকশাল, ফলে তোর ল্যাপটপ, মোবাইল হ্যাক হবে, ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে প্রমাণ করবে তুই দেশের পক্ষে কতটা খতরনাক। তারপর বিনা বিচারে, বিনা চিকিৎসায় তোকে মেরে ফেলবে। সকলেই দেখবে, বুঝবে, তবু টুঁ শব্দটা পর্যন্ত কেউ করবে না।’

‘মানে বে-পাড়ার কুকুর দেখলে আমাদের লালিটা যেমন দাঁত বের করে গর্ গর্ করে তেমন?’

‘ঠিক বলেছিস। যাঁরা রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকে তাঁরা অমনটা করে। তবে আরও নমুনা আছে। সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যচার, মাংস খাওয়া নিয়ে খুনখারাপি, এমনকি দাঙ্গাও জাত-ক্রোধ থেকে হয়। যে-কারণে এ-দেশে মসজিদ ভাঙলে বাংলাদেশে মন্দির ভাঙা হয়। এক রাজ্যের দাঙ্গা অন্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। জাত-ক্রোধের আরও উদাহরণ আদিবাসী সমাজের প্রতি আমাদের অপমান; উদাসীনতা। যার অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে আমাদের সাহিত্যে।’

‘যেমন ইংরেজরা আমাদের সঙ্গে করত, দিদি?’ আমার মুখে প্রশ্ন চলে আসে নিশ্চিত হওয়ার জন্য।

‘শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা দুনিয়ায় সবর্ত্রই দেখা যায়। নাৎসিবাহিনি ইহুদিদের সঙ্গে জাত-ক্রোধ মেটাতেই গ্যাস চেম্বার বানিয়েছিল। তারপর ধর স্পেনের কথা, রানি ইসাবেলা আর রাজা ফার্দিনান্দ মিলে কীভাবে মুসলমান আর ইহুদিদের দেশছাড়া করতে বাধ্য করেছিলেন।’

দিদি বলল, ‘রাগ থেকে প্রতিরাগের জন্ম হয়। আর সেই প্রতিরাগ খুব সাংঘাতিক হয়ে ওঠে।’

আমি বুঝলাম না দিদি ঠিক কী বলছে।

‘ভোটের সময়, আগে কিংবা পরে যে মারামারি চলে সেটা রাগ থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিরাগ। পাড়ার সমাজবিরোধীদের মধ্যেও খুনোখুনি শুধু এলাকা দখলের জন্য নয়, জান্তব রাগ থেকে— যেমন জঙ্গলে হয়।’

‘??’

‘সাপ আর নেউলের কথা ভাব। সাপ কি নেউলকে খায়? নাকি নেউল সাপকে। তবু মুখোমুখি হলেই একে অন্যের জান নিকেশ না করলে শান্তি নেই।’ দিদি বলল।

‘কিন্তু দিদি, সেটা তো শত্রুতা। ক্রোধ কেন বলছ?’ আমার চটপট প্রশ্ন।

‘শত্রুতার প্রকাশে ষড়যন্ত্র যেমন থাকে, তেমন থাকে ক্রোধ। মহাভারতের কথা মনে করে দেখ।’

আমি বুঝতে পারলাম ক্রোধ রাগের মতো নিরীহ বিষয় নয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে রাগ জমে ক্রোধ হয়ে যেতে পারে। যেমন আমার বাবা একদিন ছোটকাকাকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, ‘তোমরা দেখবে একদিন ও আমার হাতে খুন হয়ে যাবে।’ দীর্ঘদিন ধরে মানুষ কিংবা সমাজ অত্যাচার কিংবা অপশাসন সহ্য করতে করতে একদিন হঠাৎ প্রতিশোধের জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিতে পারে। তখন সেই সহজাত ক্রোধ কিন্তু প্রচণ্ড ধারালো, ভীষণ তার অভিঘাত। সেই অস্ত্র হিংসা হতে পারে, আবার অহিংসা— অসহযোগ অথবা শান্তিপূর্ণ ভোটদানের মধ্যে দিয়ে।

দিদির সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি বুঝতে পারলাম বাবার মেজাজ আর মায়ের গুরুঠাকুরের মেজাজ ভিন্ন হলেও ব্যক্তিগত; সামাজিক নয়। মেজাজের থেকে রাগ একটু কড়া। ব্যক্তিগত পরিসরের বাইরে তার সামাজিক প্রভাবও থাকে। রাগকে বশ করা খুবই কঠিন। তার জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হয়। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ সেটা সব সময় পারে না। তবে এটা আমি নিশ্চিত, যে ব্যক্তিগত রাগ কিংবা মেজাজ সবল দুর্বলের ওপর প্রয়োগ করে। সামাজিক রাগের বহিঃপ্রকাশ তেমনটা নয়। যারা দুর্বল, তারাও সমবেতভাবে প্রতিরাগে (যাকে আমরা প্রতিবাদ নামে চিহ্নিত করি) গর্জে উঠতে পারে। ক্রোধ সম্পূর্ণ অন্য কিসিমের জিনিস। ব্যক্তির ক্রোধ খুব উচ্চমার্গের ব্যাপার। হিটলারের মধ্যে ইহুদিদের ওপর যে ক্রোধ ছিল তাই তাঁকে খলনায়কের ভূমিকায় ঠেলে দিয়েছে; কিন্তু যখন ইউক্রেনের সমবেত মানুষ লেনিনের মূর্তি ভাঙে কিংবা একনায়ককে পরাজিত করে তখন সেই ক্রোধ হয়ে ওঠে একটা আন্দোলন। তাই প্রতিবাদ আর ক্রোধ এক জিনিস নয়। প্রতিবাদের স্ফূলিঙ্গ দিয়ে ক্রোধকে মাপা যায় না। আমাদের মধ্যে যে অনিয়ন্ত্রিত রাগ জমা থাকে, তাই সামাজিক আন্দোলন কিংবা বিপ্লবে পরিণত হয়; সে জিনিস সচরাচর ঘটে না।

তাই যাবতীয় অন্যায় আর রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের সমবেত ক্রোধ থাকুক; যে ক্রোধকে ভয় পাবে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিস, প্রশাসন, ব্যবসায়ী কিংবা রাজনেতারা। সেই ক্রোধ অনিয়ন্ত্রিত হলেও সমাজের কোনও ক্ষতি নেই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...