পদ্মক্ষেতে ঘাসফুলের বীজে রহস্য উত্তরবঙ্গে

গৌতম সরকার

 


ভাঙড়, ক্যানিং, সন্দেশখালির উত্তাপের নিরিখে উত্তরবঙ্গ কিন্তু এখনও অনেক পিছিয়ে। তবে উত্তেজনা নেই বলা যাবে না, বরং অনেক বেশি চাপা উত্তাপ। কেন? সোজা কথায় বাংলায় এমন সহজ মধুভাণ্ডের (পঞ্চায়েত) নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কামড়াকামড়ি স্বাভাবিক। এখানকার জেলাগুলিতে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যালট বাক্স যে হারে লুঠ হয়েছে, ভাঙচুর হয়েছে, তাতে স্পষ্ট তৃণমূলের অন্দরেও মধুভাণ্ড দখলে রাখার প্রতিযোগিতাটা তীব্র

 

বৃহস্পতিবার মাঝরাত। ভোটগ্রহণের আর দেড়দিন বাকি। এই প্রতিবেদনটা লিখব বসে সবে বসেছি। হঠাৎ খবর এল, গভীর রাতে গুলি চলেছে দিনহাটায়। লাশ পড়েনি। তবে গুরুতর জখম চারজন হাসপাতালে ভর্তি। তাঁরা সবাই বিজেপি দলের। ৪৮ ঘণ্টা আগের শেষ প্রচার সেরে গল্পগুজব করছিলেন নিজেরা। কারও বাড়ির সামনে বসে। হঠাৎ রে রে করে হাজির একদল দুষ্কৃতী। পরপর গুলি চালিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে।

দিনহাটা তাই আবার খবরের শিরোনামে। সেই দিনহাটা। উত্তরবঙ্গের যে শহরটি বছরের পর বছর চর্চায় থাকে। বাম আমলেও থাকত। ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটে ছিল তৃণমূলের যুব শাখা ও মূল তৃণমূলের মধ্যে নিত্য অশান্তি, মারপিট। উদয়ন গুহ শাসকদলে যোগ দেওয়া ইস্তক বিরোধী পক্ষের সঙ্গে যেমন, তেমন তৃণমূলে ঘরোয়া বিবাদের শেষ নেই। এসব সবাই জানে। এই প্রতিবেদন লেখার ভাবনাটাই উল্টে গেল মাঝরাতে।

উত্তরবঙ্গ কতটা উত্তপ্ত? কলকাতা থেকে একজন দীর্ঘদিনের বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন, উত্তরবঙ্গ এরকম সংবাদ-শিরোনামে কেন? আমার পালটা প্রশ্ন ছিল, সত্যিই কি শিরোনামে? সাধারণত খুনোখুনি, সন্ত্রাসের গল্পে অভিযুক্ত হয় শাসক শিবির। লাশ পড়ে যাওয়াকে যদি চরম সন্ত্রাসের প্রতিফলন ধরি, তাহলে উত্তরবঙ্গে এবার নির্যাতিত তৃণমূলই। পঞ্চায়েত ভোটের দুদিন আগে পর্যন্ত উত্তরের ৮ জেলায় হিংসার বলি হয়েছেন ৫ জন। তাঁদের ৩ জনই ঘাসফুল শিবিরের।

এর মধ্যে কালিযাচক এলাকার ২ জন। দিনহাটার ১ জন। দিনহাটায় আরেকজন নিহত হয়েছেন। তিনি বিজেপির। এঁদের সকলের খুনির পরিচয় নিয়ে অবশ্য কিছু যদি, কিন্তু আছে। একমাত্র চোপড়ায় সিপিএম কর্মীর খুনে কোনও সংশয নেই। মিছিলে গুলি করে তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছিল। তৃণমূল বিধায়ক হামিদুল রহমানের ইঙ্গিত ছাড়া চোপড়ায় গাছের পাতাও পড়ে না। ফলে এই খুনের রহস্য উন্মোচনে খুব বেশি গোয়েন্দা হওযার দরকার পড়ে না।

ভাঙড়, ক্যানিং, সন্দেশখালির উত্তাপের নিরিখে উত্তরবঙ্গ কিন্তু এখনও অনেক পিছিয়ে। তবে উত্তেজনা নেই বলা যাবে না, বরং অনেক বেশি চাপা উত্তাপ। কেন? সোজা কথায় বাংলায় এমন সহজ মধুভাণ্ডের (পঞ্চায়েত) নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কামড়াকামড়ি স্বাভাবিক। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নবজোয়ার শুরু হয়েছিল উত্তরবঙ্গে। এখানকার জেলাগুলিতে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যালট বাক্স যে হারে লুঠ হয়েছে, ভাঙচুর হয়েছে, তাতে স্পষ্ট তৃণমূলের অন্দরেও মধুভাণ্ড দখলে রাখার প্রতিযোগিতাটা তীব্র।

তৃণমূলের গোষ্ঠীবিবাদের মূল সূত্র লুকিয়ে এখানেই। শাসক-বিরোধীদের হিংসার কারণও এটা। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার পিছনের রহস্যও সেই মধুভাণ্ড। ততটা প্রহসন এবার হতে দিতে দোলাচল আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ভাইপোর। তাঁরা জানেন, পঞ্চায়েত ভোটে মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার সন্ত্রাসের ফল ভুগতে হতে পারে লোকসভা নির্বাচনে। যেমন হয়েছিল ২০১৮-র পর ২০১৯ ও ২০২১-এ। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ প্রায় সমূলে উৎখাত করেছিল ঘাসফুলের বীজকে।

সেজন্য অভিষেক প্রচার করেছেন, ভোট দিতে বাধা দিলে বা বিরোধীদের মনোনয়নপত্র পেশ করতে না দিলে, সে যিনিই হোন না কেন, তৃণমূলের সেই নেতা বা কর্মীকে বহিষ্কার করা হবে। দলীয় শৃঙ্খলা কতটা ঠুনকো বোঝা যায়, রাজ্য জুড়ে মনোনয়নপত্র পেশে বাধার বহু ঘটনা ঘটলেও সেজন্য কারও বিরুদ্ধে পদক্ষেপের একটি দৃষ্টান্তও দেখা যায়নি। মধুভাণ্ডের লোভে তৃণমূলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে নির্দল প্রার্থী হওয়ার হিড়িক কম নয়।

বহিষ্কারের হুমকি সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে কমজনই মনোনয়নপত্র তুলে নিয়ে দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এই কারণে তৃণমূলের ভোট ভাগ হওয়ার বাস্তবতা চরমে। এই পরিস্থিতিতে আরও হাওয়া লাগছে মুখে ভাষণ দিয়ে বেড়ালেও পিছনে কাঠি দিয়ে দলকে টেনে ধরার নেতা কম নেই বলে। কোচবিহার থেকে মালদা, তৃণমূলের চাপের বড় কারণ সেটা। তার ওপর উত্তরবঙ্গ তো পদ্মশিবিরের খাসতালুক।

এসব বললে মনে হবে, তৃণমূলের বোধহয় কোনও ভবিষ্যৎ নেই উত্তরবঙ্গে। হারানো জমি ফেরানো বোধহয় শিবেরও অসাধ্যি। চমৎকৃত হওয়ার মতো তথ্য হল, বিজেপি তেড়েফুঁড়ে ময়দানে নেই কার্যত। কোচবিহারে চারদিন পড়ে থাকলেন তৃণমূলের অরূপ বিশ্বাস। বাবুল সুপ্রিয়ের মতো শৌখিন মন্ত্রীকেও একের পর এক সভা করতে হয়েছে কোচবিহারে। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় মনোনয়নপর্বের সময় থেকে ছুটে বেড়াচ্ছেন কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িতে।

ফিরহাদ হাকিমকে দেখা যাচ্ছে মালদহে। শান্তনু সেন পড়ে ছিলেন উত্তর দিনাজপুরে। বিজেপির উত্তরের জেলায় তেমন মুখ নেই। যে দু-একজন আছেন, তাঁরা ডুমুরের ফুল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক পঞ্চায়েত ভোট ছেড়ে আজ দক্ষিণ আফ্রিকা কাল বেঙ্গালুরু ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রাজ্য সভাপতির দাযিত্ব থাকায় সুকান্ত মজুমদার বালুরঘাটেই সময় কম দিতে পারেন। শুভেন্দু অধিকারী দুদিনে আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়িতে ও একদিন মালদায় কার্যত বুড়ি ছুঁয়ে গেলেন। দিলীপ ঘোষের ভাষণের সফর শেষ হল দুদিনে।

মনে হতেই পারে, হয় দক্ষ নেতার অভাব, নাহয় হাল ছেড়ে বসে আছে পদ্ম শিবির। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে যা মুখে আসে, তাই বলে কড়া সমালোচনা করেছেন রাজ্যপাল। যদিও রাজীব সিনহাকে ওই পদে নিয়োগে রাজ্য সরকারের সুপারিশ অনেকদিন চেপে রাখার পর কী কারণে হঠাৎ সন্তুষ্ট হয়ে তিনি ফাইলে সই করলেন, সেই রহস্যটার উত্তর লুকিযে আছে বোধহয় সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে। তিনি উত্তরবঙ্গে এলেন, দিনহাটা ছাড়া কোথাও গেলেন না। তাঁর উপস্থিতিতেই দিনহাটায় অশান্তি হল।

সাংবিধানিক পদে থাকার সুবাদে রিপোর্ট পাঠানো যাঁর কাজ, তিনি আর প্রতিকার করবেন কীভাবে? প্রশ্নটা থেকেই যায়, রাজভবনে পিসরুম তৈরি বা রাজনৈতিক নেতাদের মতো জেলায় জেলায় ঘুরে শুধুই আশ্বাস দেওয়ার পিছনেও কি কোনও অঙ্ক আছে? উত্তরবঙ্গের মাটিতে আবার পদ্মই ফুটবে না ঘাসফুলের অঙ্কুরোদ্গম হবে নতুন করে— প্রশ্নটির উত্তর লুকিয়ে আছে ওই অঙ্কেই।


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...