ছলাৎ ছল, বুড়িগঙ্গার স্তব্ধ জল

বর্ণালী রায়

 


চাকদায় বুড়িগঙ্গা সংস্কারের কাজ সত্যিই শুরু হয়েছে। এলাকার মানুষ স্বভাবতই খুব খুশি। কিন্তু এটা প্রথম ধাপ। রানিনগরের কাঠের সাঁকো থেকে ৩ কিলোমিটার কাজ হবে এখন। এখনও অবধি শেষ খবর বলছে— যতটুকু স্রোত ফিরে এসেছে তাতেই জোয়ারভাটা দিব্যি খেলা করছে

 

 

নদীর পিঠও দেওয়ালে ঠেকে। তখন কোনও কোনও নদী হারিয়ে যায়। আবার কোনও কোনও নদী ঘুরে দাঁড়ায়। প্রশ্ন তোলে,

….কী দিইনি তোমাদের—
জলের জীবন, ইস্টিমার,
পাল তোলা নাও,
গাভীন রাত্রির ভাটিয়ালি,
কুমারীর স্নান,
শক্ত মাটির ভিটা, ঝিল,
প্রশাখার বিস্তার

তোমরা কী না ভাসাও—
বস্তাবন্দি লাশ,
মৃত পশুর অণুজীব,
গুমখুন ক্ষুধা
ইত্যাদির দিনলিপি
ট্রাকের মূত্র, জিঞ্জিরার জঙ্গল, অ্যাসিড।….

বাংলাদেশের এই নদীটির নাম বুড়িগঙ্গা। আর আমাদের নদীয়ার চাকদার এই নদীটির নামও বুড়িগঙ্গা। সরকারি নথিতে “গঙ্গার পুরনো ধারা” বলে এর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু গত শ-বছরে সরকারি সংস্কারের মুখ দেখেনি এ নদী। বরং সুদীর্ঘ জীবন নানান বিপরীত অবস্থার কবলে পড়ে খালের চেহারা নিয়েছে। তাতে কী? এই খালই তো চাকদার প্রাণ ছিল। কিন্তু বিগত বহু বছরের উদাসীনতায় নিষ্ঠুরতায় তারই প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কিন্তু মানুষ আর নদীর সখ্যতা আদিঅন্তহীন। কিছু মানুষ তাই এগিয়ে আসেন। হাত ধরেন বুড়িগঙ্গার। চিকিৎসার দাবি তোলেন। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দাবি পেশ হয়ে চলেছে। সেই দাবি অবশেষে মান্যতা পেল। মে মাসের তীব্র দাবদাহের মধ্যেই মাটি খুঁড়ে তোলা হলুদ রঙের বিশাল মেশিন এসে হাজির। তারপর খালের বুকে জমা মাটি ঝপাঝপ কেটে তোলা। আর দেখতে না দেখতেই আবার ছলাৎ ছল। বুড়িগঙ্গার স্তব্ধ জল।

ভাগীরথী প্রবাহিণী প্রাচীন জনপদ চাকদহ। রানিনগরে যেখানে চূর্ণি নদী এই নদীপ্রবাহে এসে মিশেছে, সেই মোহনা থেকে বুড়িগঙ্গার শুরু। এভাবে ৮ কিলোমিটার বয়ে গিয়ে মুকুন্দনগরে আবার ভাগীরথীতে মিশেছে। ফলে মূল ভাগীরথীর চাপ কমেছে। কিন্তু বুড়িগঙ্গা হয়ে উঠেছে চাকদহ শহরের একমাত্র নিকাশি ব্যবস্থা। আর সংস্কারের অভাবে বুড়িগঙ্গা ভরাট হয়ে যাচ্ছিল শহরের বর্জ্য আবর্জনা, জঞ্জাল, প্লাস্টিকে। গজিয়ে উঠেছিল কচুরিপানার জঙ্গল। এভাবে একসময় ভাগিরথী থেকে ছিন্ন হয়ে গেল এই জলধারা। ফলে চাকদার আবর্জনা আর ভাগীরথীতে পড়তে পারছিল না। এভাবেই বুড়িগঙ্গা মলমূত্র, মৃত পচা প্রাণী ও অন্যান্য আবর্জনার স্তুপে ভরা এক বদ্ধ নালাতে পরিণত হয়েছিল। অথচ এই নদীই একসময় দু হাত ভরে ফসল দিয়েছে চাষিকে, মৎস্যজীবীদের নৌকো ভরে দিয়েছে কত না সব মাছ। জলজ প্রাণীদের আশ্রয় হয়েছে তার স্বচ্ছ বহমান জলধারা। একসময় এর তীরে বেশ কিছু সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। যেমন আনন্দগঞ্জ। সেখানে নদীবন্দরকে কেন্দ্র করে নৌবাণিজ্য চলত বছরভর। ছিল প্রসিদ্ধ নৌশিল্পাঞ্চলও। কত রকমের মেলা বসেছে তখন। গণেশজননীর মেলা, চড়ক মেলা, হাজরা উৎসব। গ্রামের মানুষের জীবনে তখন ছিল কত না রং। কিন্তু যার উপরে এত জীবনের ভার তার নিয়মিত সংস্কারের ব্যবস্থা হচ্ছে না। অগভীর খাতে চর জেগে উঠছে। সেই চর বিক্রিও হয়েছে। কিন্তু চাষিরা “লাঙল যার জমি তার” দাবি তুলে জমির অধিকার অর্জন করেন। রাস্তার ধারে জমা জলে পাট পচাতেন পাটচাষিরা। তাও দখল করে দোকান দাঁড়িয়ে গেল। এভাবে এখানে ওখানে ভরাট হওয়া চলতেই লাগল। তার মাঝে মাঝে জলস্রোতও থমকে গেল। জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ভগ্নাংশে নেমে গেল। মাছ সহ জলজ জীবকুল মরতে লাগল। বৃষ্টি হলেই দুকুল ছাপিয়ে বিষাক্ত জল জমিতে পড়ল। চাষিদের চাষ মাথায় উঠল। মৎস্যজীবীরা হলেন রিকশাচালক, নির্মাণশ্রমিক। বা অভিবাসী উড়ান দিলেন ভিন রাজ্যে। বিপদের উপর বিপদ। বলাগড়ে গঙ্গার চরে সিইএসসি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নিল। তা থেকে নির্গত কার্বনে ফসল ও মাছচাষ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগল। চাকদার জলে আবার আর্সেনিক প্রবণতা। ওই বিদ্যুৎপ্রকল্পের ফলে সেই জল শোধন প্রকল্পও বাধাপ্রাপ্ত হল। প্রতিবাদে সে প্রকল্প বন্ধ হল শেষমেশ। ওদিকে জল জমা শুরু হল চাকদা শহরাঞ্চলে। নাগরিকরাও সেই জল নাকানিচোবানি খেতে লাগলেন।

৬০-৭০-এর দশক থেকেই বুড়িগঙ্গা এভাবেই ক্রমশ রুদ্ধ গতির শিকার হয়ে চলেছে। ২০০৪ সালের বন্যায় বাস্তুহারা মানুষের দুর্দশা চাকদাবাসীর চোখ খুলে দেয়। বাম আমলে সুনীল চন্দ্র দাস, অজয় নন্দী, বিপুল রঞ্জন সরকার, অভয় বিশ্বাস, নন্দদুলাল বিশ্বাস সহ আরও কিছু বুদ্ধিজীবী মানুষ বুড়িগঙ্গার সংস্কার নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তাঁদের বেশিরভাগজনই আজ প্রয়াত। কিন্তু তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে “চাকদহ বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা” বুড়িগঙ্গা বাঁচানোর লক্ষ্যে কর্মসূচি নিতে শুরু করে। স্থানীয় বহু বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষও সমবেত হলেন। কিন্তু আসলে নদীকে বাঁচাতে গেলে নদীর দুই পারের মানুষ ও যাঁরা নদীর উপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করেন তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া সে আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে না। তাই ক্রমে ক্রমে ৪০০ মৎস্যজীবী ও ১৫০০০ ব্যবসায়ীও যুক্ত হলেন। গড়ে উঠল “দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম”, “মহিলা মৎস্যজীবী ফোরাম”, “চাকদহ ব্যাবসায়ী সমিতি”, কৃষক সংগঠন ইত্যাদি। পরিবেশের সুরক্ষার দাবিতে “সবুজ মঞ্চ”ও বরাবর পাশে থেকেছে। ২০১৪-১৫-তে এই আন্দোলন তীব্র মাত্রা পায়। সেমিনার, পথসভা, পোস্টারিং, পথনাটক, পদযাত্রা, সাইকেল মিছিল চলতে থাকে। সঙ্গে বিডিও অফিস, সেচদপ্তর, জলসম্পদ দপ্তরের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে ও রাজ্যের মুখ্য সচিবের কাছে তাঁরা লিখিতভাবে তাঁদের দাবি পেশ করেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ১০০০ মানুষের সই দিয়ে সংস্কারের দাবি পেশ হয়। ২০১৭-তে চাকদায় বিদ্যুৎ চুল্লি উদ্বোধন করেন তৎকালীন মন্ত্রী মুকুল রায়। তখন এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মাননীয় বিবর্তন ভট্টাচার্য মহাশয় তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, “চুল্লি তো হল, অস্থি বিসর্জন কোথায় হবে? সেখানে যেতে তো তিন কিলোমিটার হাঁটতে হয়।” মুকুল রায় বলেন, “আমাকে তিন মাস সময় দিন।” ২০২২-এ ১০০০ লোকের সই নিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁরা জমা দেন। কিন্তু কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে চাঁদা তুলে গ্রামবাসীরা খালের মাটি কাটা শুরু করেন। ইতিমধ্যে এই সংস্কারের দাবিতে ৩০ বছর গেছে বিবর্তনবাবুর। হুমকির মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। ক্যামেরার সামনে তিনি বলেছেন, “আমার জীবন দিতে হলে দেব, কিন্তু আন্দোলন ছাড়ব না।” এই নাছোড়বান্দা আন্দোলনই তো জিতে নেওয়ার পাসওয়ার্ড। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, “চাকদা থানার চিঁড়ের কল এলাকা থেকে তিন কিলোমিটার সংস্কারের জন্য ৩২ লক্ষ টাকা অনুমোদিত হয়েছে।” সেচদপ্তরের বাস্তুকার শ্রী স্বপন বিশ্বাস মহাশয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “আগামী মে মাস থেকে কাজ শুরু হবে।” স্বভাবতই এলাকার মানুষ খুশি।

কাজ সত্যিই শুরু হয়েছে। এলাকার মানুষ স্বভাবতই খুব খুশি। কিন্তু এটা প্রথম ধাপ। রানিনগরের কাঠের সাঁকো থেকে ৩ কিলোমিটার কাজ হবে এখন। এখনও অবধি শেষ খবর বলছে— যতটুকু স্রোত ফিরে এসেছে তাতেই জোয়ারভাটা দিব্যি খেলা করছে। কিন্তু কয়েকটি জিনিস মাথায় রাখতে বলছেন এই আন্দোলনের নেতৃত্বরা। চাকদা শহরের আবর্জনা যেন কোনওভাবেই এই স্রোতে এসে না পড়ে। তার জন্য তাঁরা চারটি ড্রেনকে নির্দিষ্ট করেছেন। এদের মুখে নেট বসানো যেতে পারে। সবচেয়ে ভাল চাকদার পৃথক নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যে মাটি দিয়ে এখন পাড় উঁচু করা চলছে সেখানে তাঁরা ১০০০ গাছ লাগিয়ে মাটি ক্ষয় রোধ করবেন। মূলত নারকেল সুপুরি আম ইত্যাদি ফলের গাছ ও বজ্রনিরোধক গাছ হিসাবে কদমগাছ রোপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এই গাছ যার বাড়ির কাছে হবে সেই তার অধিকার পাবে।

বুড়িগঙ্গার সংস্কার হলে এলাকার ছবিটাই বদলে যাবে। মৎস্যজীবীরা তো এই বর্ষাতেই এলাকার তাজা মাছ নাগরিকের পাতে তুলে দিতে পারবেন বলে বেজায় খুশি। পাটচাষিদের সঙ্গে জল নিয়ে বিবাদ। ঠিক হয়েছে বর্ষার দুই মাস চাষিরা এই জলে পাট পচাতে পারবেন। তাঁরাও খুশি। সংস্কার সম্পূর্ণ হলে চাকদা শহরে এক ফোঁটা জলও জমবে না, বলছেন সংগঠকরা। শ্মশানঘাটেই অস্থি বিসর্জন দেওয়া যাবে। প্রবল বৃষ্টি বা জোয়ারের ফলে ভাঙন ও বন্যা রোধ হবে। মৎস্যজীবী, চাষি ও পাটচাষি সহ দেড় লক্ষ মানুষের জীবন বেঁচে যাবে। নেমে যাওয়া জলস্তর উঠে আসবে। বলাগড়ে নৌশিল্পে আসবে জোয়ার। জলপথে পর্যটন বৃদ্ধি পাবে। দুই তীরে পার্ক ও মেরিন ওয়াকিং-এর ব্যবস্থা হলে যা আরও বিকশিত হবে। বুড়িগঙ্গার জীববৈচিত্র্য উন্নত হলে সন্নিহিত এলাকাগুলির জীববৈচিত্র্যও উন্নত হবে। সব মিলিয়ে চাকদার এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে আবারও রং ছড়াবে। এই ঘনঘোর রাজনৈতিক সামাজিক দূর্যোগে বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে এক স্বপ্ন সত্য হয়ে নেমে এসেছে মাটির পৃথিবীতে।

এই মুহূর্তে রাজ্যের আরও অনেক নদীরই এমন মুমূর্ষু অবস্থা। গঙ্গাকে মাঝখানে রেখে তার যাবতীয় শাখানদীগুলিরই এই দশা। যেমন, চূর্ণি, ভৈরব, জলঙ্গী, মাথাভাঙা, ইছামতী ইত্যাদি। আর হারিয়ে যাওয়া নদীর সংখ্যা ২০ থেকে ৩০টি। যেমন, সরস্বতী, বিদ্যাধরী, আদিগঙ্গা, সূতী, গাঙুড়, বেহুলা, বাঁকা, মারালী, অঞ্জনা ইত্যাদি। আসলে নদীমাতৃক ভারতীয় সংস্কৃতিকে গিলে খাচ্ছে প্রোমোটার তথা করপোরেট রাজ। জলাজমি ভরাট, বৃক্ষ ছেদন, জলের অতি ও অপব্যবহার, দূষিতকরণ চলছে দেশজুড়ে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কঠিনতম চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম। কিন্তু অসম্ভব নয়। তা প্রমাণ করল বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর ধারাবাহিক লড়াই। যা আরও একবার প্রমাণ করল আন্দোলনের কোনও বিকল্প নেই।

 

*কৃতজ্ঞতা স্বীকার: শ্রী বিবর্তন ভট্টাচার্য। কবিতা: বুড়িগঙ্গার চোখে জল। কবি: ইকবাল হোসেন বাল্মিকী

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...