দুজন কমরেড

প্রতীক

 

 

শরীরটা আজও ভাল না থাকলে ভাল হত। না যাওয়ার অজুহাতটা নিজের কাছে মজবুত হত। কাল দুপুরে যখন সুদীপকাকু ফোন করল, তখন যাচ্ছি আসছি। ঘরে এসে বসতে না বসতে আবার পেয়ে যাচ্ছে, ফের দৌড়চ্ছি। ফলে সুদীপকাকুকে বলতে অসুবিধা হয়নি, শরীরটা একদম ভাল নেই গো। জ্বর-টর হলে তাও একটা প্যারাসিটামল মেরে দিয়ে চলে যেতাম। কিন্তু পেটের এই অবস্থায় মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়া যায়, বলো? সুদীপকাকু অবশ্য বলেছিল, তুই একটা কাজ করতে পারিস। মিছিলে আসতে হবে না। শরীর ভাল থাকলে একা ট্রেনে সোজা মিটিংয়ে চলে আয়। ওখানে তো টয়লেট আছে। হঠাৎ পেয়ে গেলেও অসুবিধা হবে না। ওই কথাটাই বারবার মনে পড়ায় নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে। কাল সাত-আটবার পায়খানা হয়ে একেবারেই নেতিয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু সন্ধেবেলা দীপকে ফোন করে ওষুধ চালু করার পরে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছি। রাত বারোটার পর আর যেতে হয়নি। একটা-দেড়টা অব্দি পেটে অস্বস্তি ছিল, তারপর তো বেশ ভাল ঘুমও হল। একটু বেলা করে উঠলাম, উঠেই দেখলাম চোঁ চোঁ করে খিদে পাচ্ছে। রেখা সাবধান করেছিল— আজ বরং রুটিতরকারি খেও না। অঞ্জলিদি তো আবার মুখরোচক ছাড়া রান্না করতে পারে না। বরং চিঁড়ে ভিজিয়ে দিই, তাই খাও। আমিই জোর করে রুটি খেলাম। খেয়ে কোনও অসুবিধা হয়নি। স্নানের পর বেশ পেট ভরেই ভাত খেলাম। চারটে বাজতে চলল, অল কোয়ায়েট অন দ্য স্টমাক ফ্রন্ট। তা সত্ত্বেও বাড়িতে বসে থাকা অন্যায় হয়ে যাবে না?

অবশ্য অন্যায়ের কী আছে? কত লোক ধরে ওই হলটায়? যত লোকের যাওয়ার ইচ্ছা পার্টির এই মরা বাজারেও, তারা সবাই গিয়ে পৌঁছলে হলে জায়গাই হবে না তো। যা বুঝছি, সেরকমই দাঁড়াবে ব্যাপারটা। মিছিল তো বেশ লম্বা হবে শুনলাম। উপচে পড়বে রাজপথ। এর মধ্যে আমার মতো একজন সমর্থক না গেলেই বা কী এসে যায়? আর গিয়ে পৌঁছলেও, যদি হলে ঢুকতে না পারি, এদিকে পেটটা ফের বেগড়বাই করে, তখন? এখন শান্ত বলেই যে সন্ধে অব্দি শান্ত থাকবে তার তো কোনও মানে নেই। দীপ বলেছিল, তুই তো রেস্টুরেন্টে গেলে হাভাতের মতো খাস। বয়স হচ্ছে, হজমশক্তি কমছে, এসব খেয়াল থাকে না। যা-ই হোক, ওষুধগুলো খা। পায়খানা আজ রাতেই বন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত, তবে কালকের দিনটাও একটু হালকা খাবি। দরকার না হলে বাড়ি থেকে বেরোস না। তাহলেই ফিট হয়ে যাবি। আসলে পরশু রাতে সত্যিই একটু বেশি জমিয়ে খাওয়া হয়ে গেছে। বহুকাল পরে দুই বন্ধুর পরিবার একসঙ্গে ঘুরতে বেরোলে যা হয়। সিধু গতবছর দেশে ফেরার পর থেকে হয় ওদের ব্যস্ততা নয় আমাদের ব্যস্ততা— এই করে দেখাই হচ্ছিল না। এতদিনে আমরা চারজন— মানে আমি, রেখা, সিধু আর স্মিতা— একই দিনে ছুটি পেলাম। তাই কলকাতায় দেখা করে বাচ্চাদের নিয়ে সারাদিন ঘোরাফেরা করে, আড্ডা মেরে, বার্বিকিউ নেশনে পেট পুরে খেয়ে ফিরলাম আর কি।

শুধু শুধু এই নিয়ে এত ভাবছি কেন কে জানে! আমি তো আর পার্টিসদস্য নই। সেটা হলে পার্টির কর্মসূচিতে যাওয়া আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ত। সমর্থকের যাওয়া না যাওয়া তো তার হাতে। তাছাড়া আমাকে তো পার্টির কেউ চোখ রাঙায়নি যেতেই হবে বলে, আবার পায়ে ধরে সাধাসাধিও করেনি। সুদীপকাকু ছোট থেকে চেনে, তাই আমার উপর একটা দাবি আছে। অনেক কিছুতেই যেতে বলে, এবারেও বলেছে। আমি তো এমনিতেও সেগুলোতে গিয়ে উঠতে পারি না। অফিস কামাই করে তো আর এসব করা যায় না।

অবশ্য এই ব্যাপারটা আর পাঁচটা কর্মসূচির মতো নয়। চে, আমার প্রিয় চে, ওই পুবদিকের দেওয়াল থেকে উদাস চোখে বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে থাকা চে— তার মেয়ে আর নাতনি তো রোজ রোজ আসে না আমাদের এখানে। তারা আসবে আর আমি বাড়িতে বসে থাকব? এই দিনটার জন্যে তো অনেকদিন আগে থেকে ছুটিও নিয়ে রেখেছি। তারপর বাড়িতে বসে থাকার মানে কী? ধুর, কেন যে নিতে গেলাম ছুটিটা? জানুয়ারি মাসেই সিএল নিয়ে ফেললাম। বছরের শেষ দিকে মুশকিলে পড়ব।

—কী গো! বেরিয়ে পড়েছ? স্কুল থেকে রেখার ফোন।
—না, যাব কিনা বুঝতে পারছি না।
—ও মা! কেন? আবার পায়খানা হচ্ছে?
—না, শরীর ঠিকই আছে।
—তাহলে?
—আসলে মনটা কেমন সায় দিচ্ছে না।
—কেন? হঠাৎ কী হল? কবে থেকে ছুটি নিয়ে বসে আছ এই দিনটার জন্যে!
—হ্যাঁ। আচ্ছা দেখি। এখন রাখছি।

***

 

এরকম আমার আরেকদিন হয়েছিল। সাইকেল নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলাম। সেদিন যে মনোজ মণ্ডলের শহিদ দিবস সেটা আমার জানা ছিল না। দেখি ঝিলের পাড়ে যে শহিদ বেদিটা, সেখানে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত রাস্তার ধারে স্মরণসভা হচ্ছে। গোটা পাঁচেক পাকা চুলের লোক, তার মধ্যে একজন সুদীপকাকু, আর দুটো এখানকার কলেজের ছেলে। তাদের মুখ চিনি, নাম জানি না। মনের ভুলে অথবা অভ্যাসে সাইকেলের গতি কমিয়ে ফেলেছিলাম, সুদীপকাকু দেখেই আমার দিকে দৌড়ে এল। একটু দাঁড়িয়ে যা না। তাড়া আছে? তাড়া তো ছিলই। সেদিন রবিবার, রেখা নিজে রান্না করে। আগেরদিন সন্ধেবেলা আলস্য করে খাসিটা কিনে রাখিনি। তখন কিনে নিয়ে যাব, তবে রান্না বসবে। কিন্তু একে শহিদ দিবস পালন, তার উপর সুদীপকাকু ডেকে ফেলেছে। তাড়া আছে বলে চলে যাই কী করে?

রবিজেঠু যে খুব খারাপ বক্তৃতা দেয় সে আমি ছোট থেকেই জানি। যখন প্রথম পার্টি করতে আসে, সেই তখন কয়েকটা কথা শিখে নিয়েছিল। ঘুরিয়েফিরিয়ে সেগুলোই শহিদ দিবসে, মে দিবসে, সদ্যপ্রয়াত পার্টিসদস্যের স্মরণসভায়, ছাত্র-যুবদের মিটিংয়ে, ভোটের সময়ে স্ট্রিট কর্নারে— সর্বত্র বলে যায়। সামনে পিছনে কয়েকটা লাইন জুড়ে দেয় উপলক্ষ অনুযায়ী। এই নিয়ে একসময় নাকি কমরেডরা আড়ালে হাসাহাসি করত, আজকাল বোধহয় বুদ্ধির তারিফ করে। ঠিক জানি না, কারণ পার্টির সঙ্গে আমার তার ছিঁড়ে গেছে। এখনকার পার্টিসদস্যদের অনেককেই চিনি না, তারাও আমাকে চেনে না। তাতে তাদের ক্ষতি নেই, আমারও না। আমি তো দিব্যি আছি চাকরি-বাকরি, বউ-মেয়ে নিয়ে। যা-ই হোক, রবিজেঠুর ওই ঘুমপাড়ানি বক্তৃতা মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে হল। তারপর আরেকজন বললেন, সেই ভদ্রলোককে চিনি না। মাথার উপরে চাঁদোয়া হয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটা থেকে একটা কাক একেবারে কপালে পায়খানা করে দেওয়ায় মাঝখানে একবার বক্তৃতা থামিয়ে দিতে হল। পিছনের মিষ্টির দোকান থেকে জলের জগ চেয়ে মুখটা ধুইয়ে দিল কলেজের ছেলে দুটো, উনি আবার শুরু করলেন। মনে হল বেশ পড়াশোনা করা লোক। একবার এঙ্গেলসের নাম করে কী একটা যেন বললেন। পেনশনার-টেনশনার হবেন, হয়ত অবসর নেওয়ার পর সবুজগ্রামে এসে ফ্ল্যাট কিনেছেন। নইলে এত বয়স্ক পার্টিকর্মী আমি চিনি না তা তো হয় না। লোকটার বক্তৃতা শেষ হতেই পিন্টুদা ঘোষণা করল— এবার শহিদ কমরেড মনোজকুমার মণ্ডলের বেদিতে মাল্যদান করা হবে। আমি প্রথমেই ডেকে নিচ্ছি আমাদের সবুজগ্রাম এরিয়া কমিটির সেক্রেটারি কমরেড রবি রায়কে। মিটিং শেষ বুঝে বেশ স্বস্তি বোধ করছিলাম। মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম খুব একটা সময় নষ্ট হয়নি। একে একে সবাই মালা দিচ্ছে, আমি পকেট হাতড়ে এক গোছা চাবির মধ্যে থেকে সাইকেলের চাবিটা বার করার চেষ্টা করছি, ও মা! হঠাৎ দেখি পিন্টুদা— এবার মাল্যদান করতে ডেকে নিচ্ছি— বলেই দুম করে আমার নাম বলে দিল।

আমার নামের আগে কমরেড শব্দটা শুনেই কেমন গা শিরশির করে উঠল। আমি কমরেড হলাম কবে? তখন আমার মুখের চেহারাটা তো আর আয়নায় দেখিনি, তবে আন্দাজ করতে পারি। যেদিন সকালে ভিজিটিং আওয়ারে হাসপাতালে পৌঁছে শুনেছিলাম বাবা রাতে মারা গেছে আর আমাকে নাকি ফোনে পাওয়া যায়নি, নির্ঘাত সেই দিনটার মতো দেখাচ্ছিল। সেখানে তারপর বিস্তর চেঁচামেচি করেছিলাম, কিন্তু এখানে মালা দিতে বলায় থ হয়ে গেলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, আমার এ অধিকার নেই। কিন্তু চারপাশ থেকে সকলে এমন করে বলল, আমি না করতে পারলাম না। কলেজের ছেলে দুটোর একজন মালার প্যাকেট থেকে শেষ মালাটা বের করে আমার হাতে দিল। আমিও বেদিতে দিয়ে দিলাম। কিন্তু মালা দেওয়ার পরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত মুঠো করে কাঁধের কাছে নিয়ে এসে শ্রদ্ধা জানানোর যে ভঙ্গি, সেটা আর হয়ে উঠল না। হাতটা মুঠোই করতে পারলাম না, তো তুলব কী? সেই থেকে কমরেড শব্দটা কানে আটকে আছে। জনসন’স বাডস দিয়ে অনেক খোঁচাখুঁচি করে দেখেছি। কানে কম শুনছি বলে ইএনটিও দেখিয়েছি। সদ্য পাশ করা মেয়েটি কয়েক সেকেন্ড তার যন্ত্রপাতি দিয়ে দেখেই একগাল হেসে— কিচ্ছু হয়নি, খোল জমেছে— বলে কানটা ওয়াশ করে দিয়েছে। মাথাটা হঠাৎ একবার বোঁ করে ঘুরে গেছে, কমরেড শব্দটাও ডাক্তারের ঘুপচি ঘরটার চার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বারবার আমাকে বলেছে— কমরেড, কমরেড, কমরেড, কমরেড। কোনওমতে ফিজটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এসে ভেবেছি মুক্তি পাওয়া গেল। বাইরের দখিনা বাতাস কান দিয়ে ঢুকে মাথায় পৌঁছে বুঝিয়ে দিয়েছে কানটা কতখানি ভারি হয়েছিল আর কতটা হালকা হয়ে গেছে। ফুর্তিতে বড় রাস্তায় এসে তিন ঢোঁকে একটা ছোট থামস আপ শেষ করে দিয়েছি। কিন্তু বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করেই বুঝতে পেরেছি, শব্দটা বেরোয়নি। আটকেই আছে।

আমাকে অবশ্য পরে আর কেউ কমরেড বলে ডাকেনি। নিশ্চিন্তেই ছিলাম তারপর থেকে। কিন্তু আজ আবার সেই মালা দেওয়ার আগের অবস্থা হয়েছে। সেদিন সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল, যে জেনেবুঝেও অনধিকার চর্চা করে ফেলেছিলাম। আজ আশপাশে সেরকম কেউ নেই, বাড়িও খালি। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়াই ভাল।

কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছি কই? এমনিতে আজকের ব্যাপারটা অত শক্ত কিছু নয়। আমি তো পার্টির নেতা-টেতা নই, যে আমাকে মঞ্চে উঠে আলেইদা আর এস্তেফানিয়াকে ফুলের তোড়া দিতে বলবে। ফলে অনধিকার চর্চার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ব্যাপারটা কি ঠিক হবে? কার জন্যে যাচ্ছি? চে তো আমার ঘরেই আছে, চে-কে দেখতে তো যাচ্ছি না। চে-র মেয়ে আর নাতনিকে দেখতে যাব? তা যাওয়াই যায়। আমার স্বপ্নের মানুষটাকে দেখিনি, তার সন্তানকে দেখতে চাওয়া কি নেহাত হ্যাংলামি? নাঃ! জামাকাপড় বদলে নিই। মিছিল এতক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। সোজা পাবলিক মিটিংটাতেই চলে যাই ট্রেন ধরে।

***

 

“I dream in my dream all the dreams of the other dreamers, And I become the other dreamers.”

কথাটা কে শিখিয়েছিল আমাকে? ওই পশ্চিমের দেওয়ালের লোকটা। দুজনের ছবি একেবারে মুখোমুখি— চে আর বাবা। ছবি দুটো যে একেবারে মুখোমুখি, আগে খেয়াল করিনি তো! মুখোমুখি কী কথা হয় দুজনের, যখন আমি থাকি অফিসে, রেখা আর টুপাই থাকে স্কুলে? নিশ্চয়ই এতদিনে চে বাবাকে বলে দিয়েছে। ফাঁস করে দিয়েছে যে ওই কবিতার মতো শব্দগুলো আসলে কবিতাই, আর ওগুলো চে-র নিজের শব্দ নয়। ওগুলো ওয়াল্ট হুইটম্যানের লেখা। আমি তো জেনেছি অনেকদিন, তবু বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কখনও মনে মনেও উচ্চারণ করিনি সেকথা। কে জানে কোথা থেকে বাবা জেনেছিল কথাগুলো চে-র, আর ওই শব্দগুলো দিয়েই আমাকে চে চিনিয়েছিল। আমার গেঁয়ো বাবা, আমার বোকা বাবা, আমার কমিউনিস্ট বাবা। কোনওদিন হুইটম্যান না-পড়া বাবা।

তখন বাবা হাঁটু গেড়ে বসলেও আমার চেয়ে লম্বা। একদিন বাড়ি ফিরে অকারণেই ওভাবে বসে পড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলেছিল— I dream in my dream all the dreams of the other dreamers, And I become the other dreamers. কোনও তারে টান পড়েছিল কি শুনে? মনে পড়ে না। তখন ইংরেজি বুঝি মনে আছে, তবু খটকা ছিল— কী বলল বাবা? কদিন বারবার আপন মনে, নাকি আমাকে শুনিয়েই, বাবা আউড়েছিল, I dream in my dream all the dreams of the other dreamers, And I become the other dreamers. কে বলেছে বল তো? বলেছে চে গুয়েভারা। তারপর বলত চে গুয়েভারার গল্প।

কত যে গল্প বলত তখন! শুধু অতীতের গল্প নয়, ভবিষ্যতের গল্পও। স্বপ্নের গল্প। বলত সব একদিন সত্যি হবে। প্রায় কোনওটাই সত্যি হয়নি। আমি সেসব কথা বাবাকে কখনও মনে করাই না। বাবাও নিশ্চয়ই চে-কে ওসব বলে না। তোমার স্বপ্ন সত্যি হয়নি— একথা কাউকে জানিয়ে কী লাভ? সে তো আর ফিরে আসতে পারবে না নতুন করে লড়াই করতে। তাছাড়া বাবা তো বলত, আমরা শুধু বর্তমানের জন্যে লড়ি না। ভবিষ্যতের জন্যেও লড়ি। তাহলে স্বপ্নগুলো যে কোনওদিন সত্যি হবে না তাও তো বলা যায় না। স্বপ্ন দেখার সময় তো ফুরিয়ে যায়নি। থাক না। বাবার কাছে ওই শব্দগুলো চে-রই থাক, চে ওভাবেই সামান্য ভুরু কুঁচকে স্বপ্নগুলোর দিকে তাকিয়ে থাক।

কখন থেকে জামাকাপড় পরে, ডিও লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুতেই দরজা খুলে ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে পারছি না। বেরোতে গিয়ে বাবার ছবিতে চোখ পড়ার পর সেই যে দাঁড়িয়ে পড়েছি হুইটম্যানের লাইনগুলো মনে পড়ে যাওয়ায়, আর এক পা-ও এগোতে পারছি না। কী করব আলেইদা আর স্তেফানিয়াকে দেখে? তাদের সঙ্গে আমার তো কোনও সংলাপ হবে না। আমার ঘরে যে চে আছে, তার সঙ্গে এখনও, এই ধেড়েবয়সেও আমার তো সংলাপ চলে। এই কি ভাল নয়? আজ বড় সাধ হচ্ছে সারাদিন কান পেতে বসে থাকি, যদি শুনতে পাই বাবার সঙ্গে চে-র কী কথা হয়। আমি নিশ্চিত কথা হয়। দুজন কমরেড মুখোমুখি বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা, অথচ কোনও কথা হয় না— তা তো সম্ভব নয়। বাবা কিউবার জন্যে কৌটো হাতে সবুজগ্রাম স্টেশনে দাঁড়িয়েছে, আমি স্কুলে যেতে যেতে দেখেছি। আমার বন্ধুরা বাবাকে চিনত। ইচ্ছে করে আমাকে শুনিয়ে হাসাহাসি করেছে— দ্যাখ, শালা ভিখারি পার্টি। সেসব বাবা জানে না, কিন্তু বাবা কিউবার খবর খুঁজে খুঁজে পড়ত। এখন একেবারে ঘোড়ার মুখ থেকে, চে-র মুখ থেকে, বাবা নিশ্চয়ই শোনে কিউবার লড়াইয়ের গল্প? বাবার কখনও না শোনা গল্প, বাবা আরও বিশ বছর বাঁচলেও জানতে পারত না— এমন সব গল্প? বাবার মতো চে-ও তো ভবিষ্যতের জন্যে লড়ত। তাহলে চে-ও নিশ্চয়ই শুনতে চায় বাবার লড়ে যাওয়ার গল্প, হেরে যাওয়ার গল্প? দুজন কমরেড মুখোমুখি বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আর কী নিয়ে কথা বলতে পারে?

কমরেড!

বাবা আর চে যেমন কমরেড, আমার তো তেমন কোনও কমরেড নেই কোথাও। একদিন হঠাৎ অনুষ্ঠানের আতিশয্যে আমাকে কমরেড বলে ফেলেছিল একজন। কিন্তু কথাটা তো সত্যি নয়। আজ যদি ওই মিটিংয়ে গিয়ে পৌঁছই, সেখানে যদি কেউ আমাকে কমরেড বলে ডাকে, আরেকবার ঘোর অন্যায় হবে। আমার কানগুলো হয়ত চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে! বদ্ধ কালা হয়ে যাব! আমি কারও কমরেড নই বলে কেউ আমার কমরেড নয়। আলেইদা, স্তেফানিয়াও নয়। কেন যাব? ওরা কি সিনেমার নায়িকা? নাকি কলেজ স্কোয়ারের দুর্গাপ্রতিমা? পুব আর পশ্চিমের দেয়ালের ছবিদুটোর মাঝখানে বাবু হয়ে বসি। মনে পড়ে, বাবা বলত, কাউকে ঠাকুর বানাবি না। বাবা-মাকেও নয়। আর আমি সেজেগুজে অষ্টমীর দিন কলকাতার ঠাকুর দেখতে যাওয়ার মত চলেছি চে-র মেয়ে আর নাতনিকে দেখতে?

***

 

বাবার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। দেখামাত্রই মানুষের বয়স বলে দিতে পারত। আমি একেবারেই পারি না। মাথাভর্তি পাকাচুলের লোকের দেখেছি চল্লিশের নিচে বয়স। আবার যাকে দীর্ঘদিন যুবতী ভেবে এসেছি, জানতে পেরেছি সে পঞ্চাশ ছুঁতে চলল। ফলে ওই লোকটার বয়স কত বলতে পারব না। শরীরটা খুব শক্তসমর্থ। চওড়া কবজি, চওড়া কাঁধ, মেদ নেই একফোঁটা। নইলে কি আর আলুর বস্তাগুলো ম্যাটাডোর থেকে নামিয়ে বাজারের মধ্যে এনে ফেলতে পারে? কিন্তু মুখটা ভেঙে চুরমার, মাথার সব চুলও সাদা। হঠাৎ মনে হয় গণেশের দেহে হাতির মাথা বসানোর মতো একজন সুঠাম যুবকের শরীরে একটা বুড়োর মুণ্ডু বসিয়ে দিয়েছে কেউ। লোকটাকে কখনও একটা বেঢপ হাফপ্যান্ট আর বেরং গোলগলা গেঞ্জি ছাড়া কিছু পরতে দেখিনি। মানে যখন থেকে তাকে দেখেছি। সে অবশ্য আমাকে বরাবর দেখেছে।

—চুপ কর, চুপ কর। তোদের মুখের কোনও আগল নেই রে? কার সামনে কী কতা বলতে হয় জানিস না? জানিস এ কে?

আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে ওরকম চেহারার একজন এসব বলছে দেখে অবাক হয়েছিলাম। তখন আমি আফসারদার দোকান থেকে পছন্দসই একখানা লাউ ব্যাগে ভরে কুচোচিংড়ির খোঁজে যাচ্ছি। পটল, ঝিঙে, কুমড়ো, সজনেডাঁটা, চিচিঙ্গা, ঢ্যাঁড়শ, লাউ পছন্দ করতে করতেই দেখছিলাম, লোকটার আর বিয়ে হল না বলে পিছনে লাগছে সবজিবিক্রেতারা সবাই। আমাকে না চিনলেও, আমার জামাকাপড় আর পকেট থেকে বেরিয়ে থাকা মোবাইলটাকে সম্মান করে একেবারে কাঁচা শব্দগুলো ওরা উচ্চারণ করছিল না। কিন্তু চোখ টেপাটেপি করে সকলে মোটামুটি একই সন্দেহ প্রকাশ করছিল— লোকটার দাঁড়ায় না, তাই বিয়ে হয়নি। চিরকালীন নিয়ম মেনে সে যত চটছিল, ওরা তত উৎসাহ পাচ্ছিল। চটে গিয়ে নিজের মুখের আগল কিন্তু রাখছিল না। তবে যত খিস্তি দিচ্ছিল সবই হাসিমুখে। কিন্তু আফসারদা যেই বাকিদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলল, যাঃ, তোরা সব বাজে কথা বলছিস। ওর মাথার স্ক্রু ঢিলে আছে তাই বিয়ে হয়নি, অমনি সে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। রীতিমত তেড়ে এল আফসারদার দিকে। আমি মাঝে না থাকলে হয়তো লাগিয়েই দিত দু ঘা। কিন্তু আমার দিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াল, তারপর ওই কথা।

আমি পাগল আর মাতাল— দুটোকেই বেজায় ভয় পাই ছোটবেলা থেকে। এই লোকটি বদ্ধ পাগল না হলেও স্ক্রু যে সত্যিই ঢিলা, তা নিয়ে আমার সন্দেহ রইল না। নইলে জম্মে যাকে দেখেনি তার সঙ্গে পরিচয়ের দাবি করে? কী করে কেটে পড়া যায় ভাবছিলাম। বড়সড় চেহারার লোকটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াও আমার মতো সোয়া পাঁচ ফুটিয়ার অসাধ্য। সে হঠাৎ গলাটা একেবারে খাদে নামিয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল— বাবু, ভাল আছিস? এ প্রশ্নের উত্তরে কে-ই বা খারাপ থাকার কথা স্বীকার করে, আর আমি তো সত্যিই দিব্যি আছি। তাই মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তামাশা এরকম মাঝপথে থেমে যাওয়া আফসারদার না-পসন্দ। সে বলল, এই বাবু কে তুই জানিস? খুব তো আমাদের ধমকে দিলি। সে আমাকে অনেকদিনের চেনা লোকের মতো বুকে টেনে নিয়ে বলল, অনেক বড়মানুষের ছেলে। অনেককাল চিনি। তোদের তখন জম্ম হয়নি। কাজ কর, কাজ কর। বাজে বকিস না। বলে কারও কোনও প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে হনহনিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।

সেদিন সকালেই আমাদের পুরনো বাড়ির খাঁ খাঁ ঘর থেকে চে-কে ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে পুবদিকের দেওয়ালে বসিয়েছি। বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরে রেখা আর টুপাইকে মজার অভিজ্ঞতা হিসাবেই ঘটনাটা বলেছিলাম। কিন্তু রেখা বলল— পাগল ভাবছ কেন? হয়ত সত্যিই তোমার বাবাকে চিনত। কদিন আগে বাবার মৃত্যুদিন গেছে, রজনীগন্ধার বাসি মালাটা তখনও ফেলা হয়নি। সেটা খুলে ফেলতে ফেলতে রেখার কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারলাম না। লোকটা খ্যাপাটে বলেই না বাজারের সবাই ওর পিছনে লাগছিল? বাবা নেই আজ চোদ্দ বছর। ওই লোক যদি বাবাকে চিনেও থাকে, এতদিন মনে রাখতে পারবে? তাছাড়া বাবাকে চিনলেও আমাকে তাঁরই ছেলে বলে চেনার কোনও সম্ভাবনা নেই। বাবার সাইকেলের রডে পা ঝুলিয়ে বসে পার্টির মিটিংয়ে গেছি সেই কোন ছোটবেলায়। বড় হয়ে তো আর বাবার কমরেড হইনি। আজকের ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওলা, পদোন্নতি-সচেতন এই লোকটার মুখে সেদিনের হাঁ করে বক্তৃতা শোনা এবং অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করা ছেলেটাকে সুদীপকাকুর মতো যারা ছোট থেকে দেখে আসছে তারাই খুঁজে পায় না। ওই অপরিচিত মানুষটা পাবে কী করে?

আমাদের দেখা কিন্তু হতেই থাকল। বোধহয় আগেও দেখা হত। সে আমাকে দেখত, কিন্তু আমি তাকে দেখতে পেতাম না। কত মানুষকেই তো দেখতে পাই না। হয়তো তারা অনেক প্রত্যাশায়, বা নেহাত দৃষ্টিপথে এসে যাই বলেই, আমাকে দ্যাখে। এখন বাজারে গেলে আমিও তাকে দেখতে পাই। সে কোনওদিন ভারি বস্তা পিঠে যেতে যেতে ঘাড় তুলে আমাকে বলে— বাবু, ভাল তো?, কোনওদিন ব্যাগভর্তি বাজার সাইকেলের সামনের বাস্কেটে কাত হয়ে আছে দেখে মাথায় খড়খড়ে হাত বুলিয়ে বলে— সাবধানে। আমি শুধু মাথা নেড়ে যাই। বাবা, মা চলে যাওয়ার পরেও ইহজগতে এই সামান্য কারণে আমাকে “সাবধানে” বলার মতো কেউ যে আছে— এত বড় প্রাপ্তিস্বীকারে আর কী-ই বা করার আছে আমার? না হয় মানুষটা আধপাগলই হল, হয়তো আগে আমরা অপরিচিতই ছিলাম। এখন তো আর তা নয়। তাছাড়া আমার দিক থেকে না হোক, তার দিক থেকে কোনও এক অদৃশ্য বন্ধন নিশ্চয়ই আছে। নইলে এত অনায়াসে কী করে আমাকে স্নেহে ভিজিয়ে দিতে পারে কখনও একটা শব্দে, কখনও কর্কশ মৃদু স্পর্শে?

এমন চলতে চলতে একদিন বাজার থেকে বেরোবার সময়ে বৃষ্টি নামল। সঙ্গে ছাতা নেই বলে দাঁড়িয়ে পড়তে হল শিবুজেঠুর মশলার দোকানের টিনের শেডের নিচে। অঝোর বৃষ্টি, বাজার করতে আসা লোকেরা সকলেই দাঁড়িয়ে পড়েছে একটু ছাউনি খুঁজে নিয়ে। সে দেখি গটগটিয়ে ভিজতে ভিজতে হেঁটে আসছে। যেতে যেতে আমায় দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল— বাবু, তোর বোনের বিয়ে কোতায় হল? উত্তর দিতে আমার একটু দেরিই হল, কারণ নিজের কাছে স্বীকার করতে সময় লাগল যে লোকটা আধপাগল নয় এবং আমি তার চিরপরিচিতই বটে। উত্তর পেয়ে অবশ্য সে এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। আমার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক সেসব নিয়ে আমি ভেবে চলেছি প্রায় এক বছর ধরে, কিন্তু তার কোনও সংশয় নেই বোঝা যায়। সে জানে আমি তার আত্মীয়। আমি মানি কি না মানি তা নিয়ে ভাবনা নেই।

সম্পর্কটা জানতে পারলাম আরও কিছুদিন পরে। সেদিন নভেম্বরের সাত তারিখ। গত চোদ্দ বছর এই দিনটায় সকালবেলা সবুজগ্রাম স্টেশন আমাকে টানে, আবার সাইকেলে চাপলেই পা দুটো যেন পাথরের মতো ভারি হয়ে আসে। চোদ্দটা বছর কেটে গেছে মনেই হয় না। ভাবি, স্টেশন চত্বরে গেলেই দেখব, বাবা বরাবরের মতো দাঁড়িয়ে কাগজ বিক্রি করছে। কিন্তু প্যাডেলে চাপ দিতেই বুদ্ধিসুদ্ধি ফিরে আসে, তখন আর ওদিকটায় যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু উপায় কী? বাজারটা যে রেললাইনের গায়েই।

অন্যমনস্ক ছিলাম। সাইকেলটা স্ট্যান্ডে রেখে মাথা নিচু করে বাজারে ঢুকছি, সে এসে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর কানের কাছে মুখ এনে বলল— নভেম্বর বিপ্লবের শুভেচ্ছা, কমরেড। বলেই, তার যেমন ধারা, আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে চালের বস্তা আনতে ছুটে গিয়েছিল। সেই প্রথম আমাকে কেউ কমরেড বলে ডেকেছিল। আমি তাকে কমরেড বলে ডাকতে পারিনি। পেটে এসেছে, মুখে আসেনি।

***

 

এখনও আমাদের দেখা হয়। প্রতিবারই ভাবি কমরেড বলে ডাকব, শেষপর্যন্ত ডাকি না। কারণ ডাকার অধিকার নিজের ভিতরে খুঁজে পাই না। কী করে যে সে অধিকার অর্জন করা যায় তাও ভেবে পাই না। এমন কাউকে খুঁজে পাই না, যে আমায় বলে দিতে পারে কোনও সোজা রাস্তা। আজ আলেইদা আর এস্তেফানিয়ার উপস্থিতিতে অনেকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বললেই কি আমার ওই কমরেডকে কমরেড বলে ডাকার অধিকার পাব? সে ভরসা তো পাচ্ছি না। তাহলে কেন যাব?

পুবের দেওয়ালে চে আর পশ্চিমের দেওয়ালে বাবা— দুজনকেই প্রশ্ন করি। উত্তরের অপেক্ষায় থাকি। জানি না কত দীর্ঘ এ অপেক্ষা। শুধু জানি আমাকে অপেক্ষায় থাকতেই হবে, নইলে যখন উত্তর এসে পৌঁছবে, আমি শুনতে পাব না।

দুই কমরেডের মাঝে বসে জানলা দিয়ে দেখতে পাই বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়, চাঁদ ওঠে। প্রশ্ন করা ছাড়া আর তো কিছু করতে পারি না এই দুজনের জন্যে। না, পারি বোধহয়। গান ধরি—

যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে—

এই নিরালায় রব আপন কোণে।
যাব না এই মাতাল সমীরণে॥

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...