‘এক দেশ এক ভোট’— বহুদিন ধরে শান দেওয়া অস্ত্রের প্রয়োগ, নাকি নির্বাচন জেতার মরিয়া চাল

তানিয়া লস্কর

 


অতি-সরলীকরণের নানা মন্ত্রগুলোর মাধ্যমে বিজেপি যে বৃহৎ ক্ষতিটি করতে চাইছে সেটি হল ভারতীয়তার যে ধারণা বা 'idea of India'-র যে রূপ ভারতীয় সংবিধানের মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছে তাকে পুরোপুরি মুছে দিয়ে একটি নতুন ভারতীয়তার ধারণা প্রণয়ন করা। এরই অঙ্গ হিসেবে ভারতীয় সংবিধান-প্রণীত যুক্তরাজ্যের ধারণাটিকে নিশানায় নেওয়া হয়েছে

 

বিজেপির ‘এক দেশ এক ভোট’ একীকরণ রাজনীতির নতুন ট্যাগলাইন। এক দেশ এক ট্যাক্স, এক দেশ এক শিক্ষাব্যবস্থা, এক দেশ এক রেশন কার্ড ইত্যাদির পর এক দেশ এক ভোট। এর পিছনে আপাত-গ্রহণযোগ্য একটি যুক্তিও দেওয়া হয়েছে। সেটি হল এতে নির্বাচনের সময়ে হওয়া খরচ কমবে, ফলে ভারতীয় অর্থনীতি লাভবান হবে। এই ধরনের স্লোগান-কেন্দ্রিক অতি সরলীকরণ বিজেপির মতো ডানপন্থী দলগুলোর ইউএসপি। যেহেতু তাদের ভোটারদের বেশিরভাগই মনের মধ্যে বুদ্ধিজীবী এবং গভীর রাজনৈতিক আলোচনা— এই দুইয়ের প্রতি প্রচ্ছন্ন বিতৃষ্ণা লালন করেন কিংবা তাঁদেরকে সেটা করতে প্রশিক্ষিত করা হয়, তাই তাঁদের কাছে এ-ধরনের চমকগুলো খুব গ্রহণযোগ্যতা পায়। সুতরাং বিজেপি বারবার এই খেলাটি খেলে আসছে। কিন্তু ‘এক দেশ এক দেওয়ানি বিধি’-র নামে তাদের গত দানটি তেমন সফলতা পায়নি। সুতরাং আবার নতুন চাল। এবার একেবারে ভারতীয় গণতন্ত্রের যে মূল বৈশিষ্ট্য সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় পন্থায় আঘাত করতে নেমেছে তারা। গত ২ সেপ্টেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তবে এই চাল কতটা সফল হয় সেটা এখনও স্পষ্ট হচ্ছে না। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে সংসদের যে বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে সেখানে স্পষ্ট হবে বলে অনেকের ধারণা। তার আগে, যেমন ভাবা হয়েছিল তেমন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, যা গোদি মিডিয়া নামে বিশ্ববিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত) হয়ে উঠছে তার মাধ্যমে এই স্লোগানটি পৌঁছে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। এছাড়াও আইটি সেল তো আছেই। নির্বাচনের প্রাক্কালে এই প্রচার নির্বাচনে বিজেপি কীভাবে কাজে লাগাবে সেটা সময় জানাবে। কিন্তু আপাতত যে বিষয়টি ভারতের নাগরিক সমাজকে চিন্তায় ফেলেছে সেটি হল ভারতীয় সংবিধানের উপর এ-ধরনের একীকরণের রাজনীতির প্রভাব।

অতি-সরলীকরণের এই নানা মন্ত্রগুলোর মাধ্যমে বিজেপি যে বৃহৎ ক্ষতিটি করতে চাইছে সেটি হল ভারতীয়তার যে ধারণা বা ‘idea of India’-র যে রূপ ভারতীয় সংবিধানের মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছে তাকে পুরোপুরি মুছে দিয়ে একটি নতুন ভারতীয়তার ধারণা প্রণয়ন করা। এরই অঙ্গ হিসেবে ভারতীয় সংবিধান-প্রণীত যুক্তরাজ্যের ধারণাটিকে নিশানায় নেওয়া হয়েছে।

আমরা জানি ডঃ আম্বেদকরের নেতৃত্বে ভারতীয় সংবিধান সভা প্রথাগত যুক্তরাষ্ট্রের যে ধারণা তার থেকে অল্প সরে গিয়ে, ‘একটি শক্তিশালী কেন্দ্র-সরকার থাকা যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা’-কে সংবিধানে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা চেয়েছিলেন যে একটি শক্তিশালী কেন্দ্র সরকার ভারতকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শক্তি জোগাবে। সেইসঙ্গে রাজ্য সরকারগুলো ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিবিধতা বজায় রেখে তাদের ঐতিহাসিক-ভাষিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতি টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। এই ধারণা সাধারণভাবেই বিজেপির হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের ধারণার পরিপন্থী। সুতরাং তারা বহুদিন থেকেই এই ধারণায় আঘাত করার পথ হিসেবে এই ‘এক দেশ এক ভোট’-এর পক্ষে জনমত গড়ার চেষ্টা করছিল। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে বিজেপির প্রবক্তা বিশিষ্ট উকিল গৌরব ভাটিয়া দুজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়ে একটি ওয়েবিনার করে বিষয়টি জনসমক্ষে উত্থাপন করেন। তারও আগে ২০১৭ সালে বিজেপির সমর্থক অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায় এবং কিশোর দেশাই এই ধারণাটির সমর্থনে একটি পেপার ছাপিয়েছিলেন। তাতেই নির্বাচনের ব্যয় লাঘবের যুক্তিটি উপস্থাপন করা হয়েছিল। ভারতীয় রাজনীতিবিদ তথা কংগ্রেসের এমপি শশী থারুর এবং প্রবীণ চক্রবর্তী গত ৫ সেপ্টেম্বর ‘দি হিন্দু’ প্রত্রিকায় একটি কলামে হিসেব কষে দেখিয়ে দিয়েছেন যে এই ‘এক দেশ এক ভোট’ প্রণালী চালু হলে নির্বাচনী ব্যয় যেটুকু কমবে তাতে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ কোনও প্রভাব তো পড়বেই না, উলটো এতে দেশে সরকারের স্থায়িত্ব নষ্ট হতে পারে। তাছাড়া এই ধারণাটি প্রয়োগ করতে হলে বিজেপিকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। লোকসভাতে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্যসভায় গিয়ে বিলটি আটকে যাবে বলে তাঁদের ধারণা।  কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে কজন এই হিন্দু পত্রিকা পড়েন। সুতরাং গোদি মিডিয়া এবং আইটি সেলের দেওয়া অতি-সরলীকৃত ব্যাখ্যাই তাঁদের কাছে পৌঁছবে। হয়তো-বা বিজেপি এটাই চাইছে। তাই জেনেবুঝেই এই কমজোর ঘুঁটিটা এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে দুটি লাভের সম্ভাবনা আছে। প্রথমত, বিপক্ষকে কদিন বিভ্রান্ত করে রাখা যাবে। দ্বিতীয়ত, বিপক্ষ এবং জোটে থাকা অন্য দলগুলো ভাল কাজে বাধা দেয় এই ছুতোয়, নির্বাচনের সময়ে জনতার কাছে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার আবেদন করা যাবে। এ-যাত্রায় উতরে গেলে পরেরবার সুপ্রিম কোর্টসহ গণতন্ত্রের অন্যান্য স্তম্ভগুলোকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে আরও কয়েক বছরের জন্য রাজত্ব নিশ্চিত করা যাবে।

তবে বিষয়টির আরেকটি দিক আছে। আমরা জানি ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধানরা বাইরে থেকে ভীষণ শক্তি প্রদর্শন করলেও ভিতরে ভিতরে তারা ভীষণ ভীতু বা প্যারানয়েড হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে গৌহাটিতে কংগ্রেস কর্মীদের একটি কর্মশালায় প্রাক্তন মন্ত্রী পি চিদাম্বরম বোধহয় সেরকম একটি প্যারানোইয়ার দিকে ইশারা করে বলেছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভগবানের চেয়েও নির্বাচনকে বেশি ভয় পান। তারও আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও অনুরূপ একটি কথা বলেছিলেন যে মোদি হারাতঙ্কে ভোগেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপক্ষের নেতাদের এই মন্তব্যগুলো আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। ভয় পেয়ে একটি মরিয়া সিদ্ধান্ত, নাকি বহু বছর ধারে শান দেওয়া অস্ত্রের সুচতুর প্রয়োগ সেটা সময় বলবে। আপাতত ভারতীয় গণতন্ত্রের বারবার মার খেয়েও টিকে থাকার ইতিহাসকে সম্বল করে আমরা নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকি।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...