আয়না গড়ার হাতুড়ি: ব্রেশট ১২৫, হাবিব ১০০— সপ্তম বর্ষ, সপ্তম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলাম

 

আর্টের উদ্দেশ্য হল বাস্তবতাকে তৈরি করা, তার আয়নায় বাস্তবের চেহারা দেখিয়ে ক্ষান্ত হওয়া নয়— এই কথাটি বলেছিলেন ব্রেশট। সুতরাং, এই বাস্তবকে আমরা মেনে নেব না। আমরা চাইব এই বাস্তব বদলে যাক, আর নাটকের হাত ধরেই নাটকের সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত হোক। এই আয়না তৈরির কথাটা মাথায় রেখে আমাদের এবারের মেল ট্রেন ‘আয়না গড়ার হাতুড়ি’।

 

গত বছর দুই ধরে আমরা বাংলা নাটকের কয়েকটি ল্যান্ডমার্ক পার করলাম। ২০২২ ছিল ন্যাশনাল থিয়েটারের দেড়শো বছর, এবং চেতনা ও পিপলস লিটল থিয়েটারের পঞ্চাশ বছর। ২০২৩ সালে আবার বাংলা নাটকের স্নেহশীলা জননী শোভা দে-র শতবর্ষপূর্তি। এরই মধ্যে নবনাটকের জনক বের্টল্ট ব্রেশট পড়লেন ১২৫-এ, আর ছত্তিশগড়ের আদিবাসীদের দিয়ে লোক-আঙ্গিকে নাটক করিয়ে বিখ্যাত হওয়া হাবিব তনবির স্পর্শ করলেন তাঁর শতবর্ষ।

 

যেকোনও সংস্কৃতি-সচেতন জাতির কাছেই এই ল্যান্ডমার্কগুলি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। কারণ নাটকে লোকশিক্ষার কথা বলে গেছেন পরমহংসদেব স্বয়ং। বিদেশের অভিনেত্রী, টম ক্রুজের মিশন ইম্পসিবল এক-খ্যাত ভানেসা রেডগ্রেভ বলেছেন একটি সভ্যতার জন্য থিয়েটার নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের মতোই অবশ্য প্রয়োজনীয়। এই রাজ্যের মাননীয় মন্ত্রী ও অধুনা বাংলা থিয়েটারের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব আচার্য ব্রাত্য বসুও বলেছেন নাটক ও সিনেমা জীবনের কথা বলে। যদিও বাংলার মানুষ যে ক্রমশ থিয়েটারবিমুখ হয়ে পড়ছেন এ নিয়ে খেদ ‘প্রকট’ করতেও তিনি ভোলেননি।

আমরা, যারা মোটামুটি কুৎসার উপর নির্ভর করে জীবন অতিবাহিত করছি, তাদের ধারণা, বাংলা থিয়েটারের অবস্থা খুব একটা জোর গলায় ধন্য ধন্য করার মতো কিছু নয়, যদি না সেই ব্যক্তি কোনও স্নেহাতুরা তস্করমাতা না হয়ে থাকেন। এখানকার থিয়েটার ক্রমশ সিরিয়ালধর্মী হয়ে উঠছে, যদিও তার প্রগতিশীল হয়ে ওঠার বাতিক সে এখনও সম্পূর্ণ বর্জন করে ফেলেনি। মঞ্চের কলাকুশলীদের প্রধান উদ্দেশ্য গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন করা তো নয়ই, এমনকি অভিনেতা হয়ে ওঠাও নয়। যেনতেনপ্রকারেণ সিরিয়ালের অভিনেতা হয়ে উঠতে পারাই অধিকাংশের জীবনের একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা। জীবিকা অর্জনের কষ্টসাধ্যতা এইসব ছেলেমেয়েদের অহরহ একটা মিশ্রণযন্ত্রের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, যেখান থেকে স্ব-শরীরে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। এদের দেখার কেউ নেই। এদের লালনপালন করার কেউ নেই। এ তো গেল অভিনেতাদের কথা। থিয়েটারের কর্মী, অর্থাৎ অভিনয় ছাড়া থিয়েটারের অন্যান্য বিষয়ে যাঁরা হাল ধরে থাকেন— আলোকশিল্পী, মঞ্চশিল্পী, রূপসজ্জাশিল্পী— এদের অবস্থাও শোচনীয়। আক্ষরিক অর্থেই, এদের কথা ভাবার কেউ নেই। বাজারের অবস্থাও এখন ওই কিল মারার গোঁসাইয়ের মতো। অর্থাৎ তার আর ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই। তার মুরোদ আছে শুধু শিল্পসংস্কৃতিমনুষ্যত্বরক্তমাংসজীবনজীবিকা খেয়ে চলার। আর সঙ্গে আমোদের পূতিগন্ধময় উদ্গার তোলার।

আর্টের উদ্দেশ্য হল বাস্তবতাকে তৈরি করা, তার আয়নায় বাস্তবের চেহারা দেখিয়ে ক্ষান্ত হওয়া নয়— এই কথাটি বলেছিলেন ব্রেশট। সুতরাং, এই বাস্তবকে আমরা মেনে নেব না। আমরা চাইব এই বাস্তব বদলে যাক, আর নাটকের হাত ধরেই নাটকের সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত হোক। এই আয়না তৈরির কথাটা মাথায় রেখে আমাদের এবারের মেল ট্রেন ‘আয়না গড়ার হাতুড়ি’। এই যাত্রায় আমরা প্রকাশ করেছি হাবিব তনভীরের নিজের কথায় ব্রেশটের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার গল্প। আছে শিল্পী হিরণ মিত্রের ব্রেশটের মৃত্যুমুখোশ প্রোজেক্টের কথা। অ্যারিস্টটলীয় এবং ব্রেশটীয় নাট্যতত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন দত্তাত্রেয় দত্ত। জনপ্রিয় অভিনেতা চন্দন সেন শুনিয়েছেন বাংলা থিয়েটারে ব্রেশট-হাবিবের দর্শনের এখন-তখনের কাহিনি। পরিশেষে হাবিবের নাট্যদল ছত্তিশগড় নয়া থিয়েটারের বর্তমান নির্দেশক রামচন্দ্র সিং আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন হাবিবের সঙ্গ করার কথা।

শীতকালে পালং ও কড়াইশুঁটির মতো বাজারে নাটক ও নাট্যোৎসবও অঢেল বিকোচ্ছে। পারিবারিক ও দমফাটা হাসির নাটকের সঙ্গে অসম লড়াই লড়ছে কিছু সৎ নাট্যপ্রচেষ্টা। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর এবারের প্রচ্ছদ নিবন্ধগুলি এই প্রচেষ্টার হাত ধরুক, এটুকুই আমাদের ঐকান্তিক চাওয়া।

ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছান্তে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...