ঘুমপাড়ানিয়া গান, মেঘালয় এবং এক তরুণীর গল্প

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

শুরুতেই এক বইয়ের কথা। গত বছর ২৬ নভেম্বর দিল্লিতে টাটা স্টিল ফাউন্ডেশনের ‘সংবাদ’ শীর্ষক বার্ষিক অনুষ্ঠানে লেখিকাকে ফাউন্ডেশন ফেলোশিপে ‘চেঞ্জমেকার’ আখ্যা দিয়ে তাঁর বই ‘হা ইউপিয়াম কা বেই’ বা ‘On Mother’s Lap’ প্রকাশ পেল। লেখিকা মেঘালয়ের তরুণী আমাবেল সুস্নগি। ২৮ বছরের আমাবেলের এটিই প্রথম বই। সঙ্গীতশিক্ষিকা আমাবেল লোকগীতি নিয়ে গবেষক। বিষয়টি এই পর্যন্ত এসে পৌঁছে যাচ্ছে অন্য দিকে। কোন দিকে? সেখানেই তাৎপর্য, ‘চেঞ্জমেকার’…

খাসি পাহাড়ে হারিয়ে যাওয়া লুলাবাই বা ঘুমপাড়ানি গান নিয়ে গবেষণা করছেন আমাবেল। তাঁর দীর্ঘ গবেষণায় প্রকাশিত বইটিতে জায়গা পেয়েছে মূল ভাষায় এবং পাশাপাশি ইংরিজিতে অনূদিত ২৫টি ঘুমপাড়ানি গান, প্রতিটি গানের শেষে স্বরলিপি এবং একটি কিউআর কোড। কী আছে ওই কোডে? স্ক্যান করলে যে-কোনও পাঠক, শ্রোতার মোবাইলে উঠে আসবে ওই গানটির ইউটিউব ভিডিও। কী আশ্চর্য এই বই!

 

মেঘালয়ের পশ্চিম জয়ন্তিয়া পাহাড়ের মেয়ে আমাবেল তাঁর মাতৃভাষা খাসি-র লোকসঙ্গীত নিয়ে পিএইচডি করছিলেন বেশ কয়েক বছর ধরে। কিন্তু শুধুমাত্র গবেষণার ওপরে উঠে গিয়ে এমন একটা কাজ! আমাবেল ইতিহাসটা জানেন। স্থানীয় পাঁর আদিবাসীদের সঙ্গে মিশে হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় উঠে আসে বিদ্যুৎঝলক। ঘুরে ঘুরে তুলে আনেন কুড়িটি খাসি গ্রামের একশোর বেশি মানুষকে এবং তাঁদের কণ্ঠের সঙ্গীতকে। নিজের মা-ঠাকুমার থেকে শোনা এই ঘুমপাড়ানি গানের প্রতি মুগ্ধতা বরাবর রেখে এসেছিলেন আমাবেল। ২০১২ থেকে গান শেখানোকেই পেশা হিসেবে বাছেন। শিলং-এর মার্টিন লুথার ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটিতে লোকসঙ্গীত নিয়ে গবেষণা করছেন ২০২০ সাল থেকে। এইসমস্ত পেশা-নেশার ভেতর উঠে আসছে মেঘালয়-ঐতিহ্য। গ্রামে গ্রামে ঘুরে কথা বলেন বয়স্ক নাগরিক, তরুণ-তরুণী, সঙ্গীত গবেষক এবং সবচেয়ে বড় কথা বদলে যাওয়া পৃথিবীতে এই ঘুমপাড়ানি গান নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা প্রজন্মের সঙ্গেও। এই নতুন প্রজন্মের মধ্যে অনেকেই ভুলে গেলেও কেউ কেউ এখনও মনে রেখে দিয়েছেন সেইসব গান। ঠিক করলেন, সংরক্ষণ করতে হবে এইসব গানের, এইসব স্মৃতির। পপ মিউজিক-ইউটিউব চ্যানেলের দৌলতে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনেন এই ইউটিউবের মধ্যে দিয়েই। গ্রামের মানুষদের কণ্ঠে তাঁদের গানের ভিডিও তুলে আপলোড করতে থাকেন একের পর এক। নিজের জন্য, সবার জন্য।

আমাবেল জানেন, মেঘালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে, লোকসঙ্গীতের ইতিহাসে ঘুমপাড়ানি গানের একটা অনন্য জায়গা আছে। খাসি, জয়ন্তিয়ার বেশ কিছু গ্রামে এই সঙ্গীত মানুষের পরিচয়। যেমন ইস্ট খাসি জেলার ৭০০ মানুষ অধ্যুষিত ছোট্ট গ্রাম কংথং-এ সমস্ত গ্রামবাসীর কাজের প্রয়োজনে থাকা একটি নামের পাশাপাশি ছোট একটি নাম থাকে, যা আসলে নাম নয়, সুর। তাঁর জন্মের আগে তাঁর মা-র তৈরি করা ঘুমপাড়ানিয়া গানের টিউন। বড় হলে বন্ধুরা, বাড়ির লোকেরা তাঁকে ডাকলে ওই সুরে ডাকেন। তিনি চিনতে পারেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ওয়ার্ল্ড  ট্যুরিজম অর্গানাইজেশনে ভারত থেকে বেস্ট ভিলেজ বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছে এই কংথং। এই আশ্চর্য সঙ্গীতমুখর পাহাড় থেকে, রাজ্য থেকে উঠে আসা আমাবেলের এই কাজ খুব অনন্য হলেও মেঘালয়ের সাংস্কৃতিক ট্র্যাডিশনের সঙ্গে খুব বেমানান না হয়তো।

এবং তাই, আমাবেল যখন তাঁর ভাষায় শোনেন, ‘খোন ওয়া মাইয়া, আ খোন ইয়ং গা…’ তখন তাঁর মনে হয় ইংরিজিতে এর অর্থ ‘Beloved child, my beloved child’ পৌঁছে যাক গোটা পৃথিবীতে। অথবা যখন শোনেন ‘লাম থিয়া ফি খোন ইনি ওয়ারো…’ তখন ইচ্ছে করে সবাইকে ডেকে ইংরিজিতে বলেন ‘If sleep you dismiss, the world’s beauty you will miss.’

আমাবেল সুস্নগির মেঘালয় পাহাড়ের ঘুমপাড়ানিয়া গানের গল্প যেন কেউ না মিস করে…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...