মানসাই: ছোট উপন্যাস, ছোট নদীটিরই মতো

বিষাণ বসু

 

এক বন্ধু সেদিন আক্ষেপ করছিলেন, কী আশ্চর্য স্বপ্নহীনতার মধ্যে এই প্রজন্ম বড় হচ্ছে! যেটুকু স্বপ্ন এদের, তা পুরোপুরি ব্যক্তিগত উন্নতিকে ঘিরে— কেরিয়ার, আর্থিক সাফল্য এসব। বৃহত্তর স্বপ্ন বলে কিছু নেই। কী দুর্ভাগ্যজনক, ভাবো তো!

মেডিকেল কলেজে সদ্য পড়াতে আসা এক তরুণ অধ্যাপক সেদিন বলছিলেন— দেখুন স্যার, আপনি হয়তো মানবেন না, কিন্তু কোনও ধান্দা না থাকলে কেউই রাজনীতিতে আসে না। বললাম— না রে। সব মানুষ ধান্দা নিয়ে আসে না। উত্তর এল— ধান্দা ছাড়া যারা রাজনীতি করতে আসে, তারা বোকা। আবারও বললাম— না, একসময় সবচাইতে উজ্জ্বল এবং মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ সক্রিয় রাজনীতি করত, নিদেনপক্ষে তাদের সবারই খুব স্পষ্ট রাজনীতিবোধ থাকত। চিরকাল পরিস্থিতি এরকম ছিল না। পরিস্থিতি বদলালেও, এখনও, সবাই স্রেফ আখের গোছাতেই রাজনীতিতে আসে, এমন নয়। আদর্শের জন্যও আসে। সবার ভাল করবে বলেও আসে। এবং, বিশ্বাস কর, তারা নির্বোধ নয়। তখন ছেলেটি বলল— ঠিক আছে, স্যার। ধান্দা শব্দটা আমি ভুল বললাম। কিন্তু আপনি যে আদর্শের কথা বলছেন, রাজনীতি করতে যারা আসে, তারা সবাই নিজেদেরটা গুছিয়ে নিতে না চাইলেও নিজের দলের দিকে লোক টানতেই তো আসে— সেটাও তো একধরনের স্বার্থচিন্তাই হল। বললাম— নিজের দলের দিকে লোক টানতে চায়, ঠিকই। কিন্তু নিজের দলের দিকে অনেক লোক এলে সমাজের অধিকাংশ মানুষের ভাল করার কাজটা সম্ভব হবে— এই আদর্শের কথা ভেবেই তো সেটা চায়। একে কি স্বার্থচিন্তা বলবি? তুই যেরকম বলছিস, সেভাবে ভাবলে তো স্বাধীনতা-সংগ্রামীরাও স্বার্থচিন্তার বেশি কিছু ভাবেননি— কিন্তু কথাটা তো ঠিক নয়, তাই না? ছেলেটি বলল— দেখুন স্যার, আমার তো মনে হয়, যারা স্বাধীনতা আনতে গিয়ে মারা গিয়েছে বা মারা যাবে জেনেও ঝাঁপিয়েছে, তারা বোকা। স্বাধীনতা যদি আসেও, তারা তা ভোগ করতে পারবে না— এটা জেনেও যারা লড়াই করেছে, তারা তো বোকা-ই।

কথোপকথন আরও অনেকখানি এগিয়েছিল, কিন্তু আমার পরবর্তী প্রজন্মের সেই ছেলেটি যে তার মত বদলেছিল, এমন নয়। আসলে, যে-সময়ে নিজের স্বার্থের গণ্ডির বাইরে কিছু ভাবা নির্বুদ্ধিতা, এমন বিচারধারা সামাজিক সহমত্য পায়— এবং যে-কোনও সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার উদ্দেশ্য বলতে ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষা, এমন সন্দেহ সমাজস্বীকৃত— সেই অদ্ভুত সময়ে তার ভাবনাটিই যাকে বলে মেইনস্ট্রিম— আমার সাধ্য কি সেই স্রোতের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার! লেখার শুরুতে বলা বন্ধুর সেই কথাটাই আবার মনে পড়ে গেল— কী আশ্চর্য স্বপ্নহীন এই সময়!

প্রতিভা সরকার-এর ‘মানসাই’ পড়তে পড়তে কথাগুলো বারবারই মনে পড়ে যাচ্ছিল।

স্বল্পায়তন উপন্যাস। উত্তরবঙ্গের নদীর নামে উপন্যাসের নাম। নদীর তীরে ছোট গঞ্জ শহর এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। সময়কাল— গত শতকের ছয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পরের দশকের প্রথমার্ধ। লেখক কিছু স্বপ্নের কথা বলেছেন— বৃহত্তর আদর্শের স্বপ্ন— স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার গল্পও— স্বপ্ন ঘিরে হানাহানির গল্প-ও এসেছে, অনিবার্যভাবেই। পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, তবে কি স্বপ্নকে তাড়া করে দৌড়ানো এবং সে দৌড়ের ব্যর্থতার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল পরবর্তী প্রজন্মের এমন স্বপ্নহীনতার বীজ? ব্যর্থতা কি ততখানিই অবশ্যম্ভাবী ছিল, যাতে স্বপ্নহীনতাও অনিবার্য হয়ে ওঠে? প্রশ্নগুলো সহজ নয়, আর উত্তর তো একেবারেই অজানা। লেখক অবশ্য উত্তর দিতে যাননি। তিনি স্রেফ নদীর তীরে থাকা একটি ছোট্ট জনপদের গল্প শুনিয়েছেন।

উপন্যাস শুরু হয় প্রীতিলতার দুঃস্বপ্নের বিবরণ দিয়ে। বিজয়া দশমীর সকালে ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে প্রীতিলতার পা যেন মেঝেয় পিছলে যায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার শোওয়ার ঘরের মেঝে৷ সত্যিসত্যি না, স্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন। যদিও সেই দিনটির বাস্তব তার সকালের দুঃস্বপ্নের চাইতেও ঢের নির্মম হয়ে উঠবে। সময়টা গোলমেলে। একবার যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হল— রাষ্ট্রপতি শাসন চলল— আবার যুক্তফ্রন্টের সরকার— সে-ও যে কবে ভেঙে দেওয়া হবে, কেউ জানে না!

প্রীতিলতার স্বামী রমণীমোহন, পেশায় স্কুলমাস্টার, খুন হয়ে যায় ওই দশমীর সন্ধেতেই। তার লালপার্টির কমরেডকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল— সেই হত্যার প্রতিবাদে মিছিল— ওই মিছিলেই খুন হয় রমণীমোহন। মিছিলে বেরোনোর ঠিক আগে রমণীমোহন বৃদ্ধা মায়ের ঘরে দেখা করতে ঢোকেন, মায়ের সঙ্গে কথা বলেন— মায়ের স্মৃতিভ্রংশ, ছেলেকে সবসময় চিনতে পারেন এমন নয়— বেরোনোর আগে রমণীমোহন মাকে প্রণামটা করতে পারেননি, ঠাকুর ভাসান হয়নি যে! দিনটা বিজয়া দশমী।

বিপ্লব। বিপ্লবের স্বপ্ন। লালপার্টিরা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সেই বিপ্লবের দেখা যে কোন পথ ধরে এগোলে পাওয়া যাবে, সে নিয়ে বিস্তর মতভেদ। সবাই লালপার্টি যদিও। মতভেদ স্রেফ তত্ত্বকথায় সীমাবদ্ধ থাকে না, গড়ায় আরও অনেক দূর। সে বিবাদ এতই গভীর, যে, বিমলাপ্রসাদ শুক্ল, গাই-বাছুর-এর একান্ত অনুগত ও দাপুটে নেতা, তিনি প্রীতিলতাকে মনে করিয়ে দেন— “রমণী মরে গিয়ে তার ছেলে নকশালি করতে শুরু করল। সে বেঁচে থাকলে কি এটা সম্ভব ছিল? আপনাদের পার্টির সঙ্গে নকশালদের যে আদায় কাঁচকলায় এটা জানে না কে, বলুন!”

মানসাই
প্রতিভা সরকার
ছাপাখানা
মুদ্রিত মূল্য – ৩০০ টাকা
পৃষ্ঠাসংখ্যা – ১৪১

 

‘মানসাই’-এর গুণ এই, যে, উপন্যাস পড়তে পড়তে বারবারই আপনি অন্যমনস্ক হতে থাকবেন। সমকালীন বাস্তবতার কথা মনে পড়ে যেতে থাকবে। মনে পড়বে, জীবন গিয়াছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার— পড়ুন পার হয়ে গিয়েছে অর্ধশতাব্দীর অধিক কাল— দেশ তথা বিশ্বের রাজনীতির বদল ঘটে গিয়েছে প্রায় একশো আশি ডিগ্রি, কিন্তু এই ‘আদায় কাঁচকলায়’-এর রেশ এখনও কাটিয়ে ওঠা গেল না। রমণীমোহনদের পার্টি বিমলাপ্রসাদদের দলের সঙ্গে নির্বাচনে হাত মেলায় আর রমণীমোহনের ছেলের দল, ‘নকশালি’-রা, বিমলাপ্রসাদদের দাদাগিরি ও উপন্যাসে বর্ণিত সময়ের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের যাঁরা যথার্থ উত্তরসূরি, তেমন দলকে সমর্থন করতে থাকেন। কিন্তু মূলগত আদর্শে ঢের মিল থাকা সত্ত্বেও, এমনকি এই ঘোর দুঃসময়েও, রমণীমোহন ও তাঁর ভাস্করের দল এখনও পরস্পরের হাত ধরে চলতে পারে না। অথচ নান্টু যেমন বলেছিল— “একই মায়ের প্যাটত জন্মিয়া দুই ভাই দুই ভাইয়ের মুখ দেখে না। কিন্তু দোনো ভাই হাতে হাত রাখিয়া কাম করির পাইলে কী হইত, আমরা কি তা বুঝির পাই না?” ঠিকই, এই সময়েও, এই এত বছর বাদেও, ‘’হাতে হাত রাখিয়া কাম করার পাইলে”, আর কিছু না হোক, আমজনতা বামপন্থার প্রতি আরেকটু আস্থাশীল হতে পারত। কিন্তু সেসব কথা থাক। উপন্যাসে ফিরি।

আদতে মানসাই, নদীটির মতোই, এক প্রবহমান স্বপ্নের গল্প। নদীতে বয়ে চলা খড়কুটো বা কচুরিপানার গল্পও বটে। মুক্তিযুদ্ধে ভেসে আসা কুসুম আশ্রয় পায় প্রীতিলতার সংসারে। তার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। এই কাহিনির অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র ভাস্করের প্রতি তার অব্যক্ত প্রেমের স্বপন। ভাস্করের সত্যেনের আরও কত কত মানুষের চোখে দিনবদলের স্বপ্ন। বিপ্লবের স্বপ্ন।

কী হলে কী হতে পারত, এমন অবান্তর স্বপ্নও বটে। যেমন “যুক্তিবাদী সত্যেনেরও বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে হয়, রমণীদা বেঁচে থাকলে এ শহর এরকম হয়ে যেত না। তখন তার মাথা থেকে বেরিয়ে যায় বামপন্থার অনুগামীদের ভাগ হয়ে যাওয়ার কথা, একদা একই পথের যাত্রীদের রাতারাতি পরস্পরের চরম শত্রু বনে যাওয়া, দু-দুবারের রাষ্ট্রপতি শাসনের শেষে ব্যাপক কারচুপি করে মুক্তিসূর্যের ক্ষমতায় ফেরা। সে ভুলে যায়, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, ঘরের পাশে নতুন রাষ্ট্রের জন্মগ্রহণ, সেই ঢেউয়ে টালমাটাল হয়ে যাওয়া কোটি কোটি মানুষের জীবন! ইতিহাসের জঠরে সমুদ্র মন্থনের মতো অসংখ্য নাড়ির পাকে উঠে এসেছে এই জটিল সময়। এত সমস্যা সমাধানের জন্য কোনও সহজ অঙ্ক নেই এটা বুঝেও সত্যেন যেন কোনও অলৌকিকের প্রত্যাশী হয়ে পড়ে।” অথচ, অলৌকিক কিছু ঘটে না, ঘটা অসম্ভব বলেই। যা ঘটে, তা বাস্তব, স্রেফ নিষ্ঠুর ক্রূর বাস্তব, প্রীতিলতার দুঃস্বপ্নের মতো।

বাইরের স্রোত আছড়ে পড়ে ঘরে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় রোজকার জীবন। বিপ্লব ঘটাতে চাওয়ার স্বপ্ন দেখে হারিয়ে যাওয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়া মুখগুলো লিঙ্গপরিচয়ে, অধিকাংশত, পুরুষ। আর সেই স্বপ্নের বাকি অর্ধেক অংশীদার? অর্থাৎ সর্বার্থেই ভুক্তভোগী যাঁরা? অর্থাৎ মেয়েরা? স্রেফ কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবে দেখব তাঁদের?? কিন্তু প্রীতিলতার চোখে দেখলে? হৈম বা কুসুমের চোখে দেখলে? ভাস্কর বা সত্যেন বা রমণীমোহনের পরিণতি যতখানি সাধারণের শ্রদ্ধা বা সহানুভূতি পায়, প্রীতিলতা-হৈম-কুসুম কি তার ভগ্নাংশও পান? ‘মানসাই’-এর সার্থকতার অন্যতম কারণ, এ উপন্যাস যতখানি না ভাস্করের, তার চাইতে আরও অনেক বেশি করে প্রীতিলতার বয়ান।

ভাস্করের স্বপ্ন যখন শেষ— অবশ্য স্বপ্ন কি কখনও শেষ হয়! তা প্রবাহিত হয়ে চলে এক প্রজন্ম হতে অন্য প্রজন্মে, এমনকি এই স্বপ্নহীন প্রজন্মেও— তখনই, সেই ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে প্রীতিলতার স্বপ্নের শুরু।

প্রীতি জেগে জেগে স্বপন দেখে নতুন লেডিজ সাইকেলে চড়ে মানসাইয়ের ধারে ধারে সবুজ গ্রামগুলোতে সে চলেছে আসন্ন প্রসবাদের কাছে। তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে রাখা নিরাপদ জন্মের সহায়ক যন্ত্রপাতি। সাইকেলের পেছন পেছন ছুটে চলেছে অজস্র শিশু, মুহূর্তে মুহূর্তে সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছে তারা, তাদের ক্যালোর ব্যালোরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মানসাইয়ের ঢেউয়ের শব্দ। আগামীর সৈনিক, সাম্যের দূতেরা টলোমলো পায়ে এগিয়ে আসছে জরুরি অবস্থার অন্ধকারের মধ্য দিয়েই। তার ভাস্কর, তার কুসুম, তার নিহত জীবনসঙ্গী সবাই মিশে আছে ঐ ভিড়েই!

উপন্যাস শেষ হয়ে আসে এইভাবেই। প্রতিভা সরকারের অনবদ্য গদ্যশৈলীর এমনই টান, যে, এ উপন্যাস কখন যে সমাপ্তিতে পৌঁছে যায়, বুঝতে পারা মুশকিল। হয়তো উপন্যাস নয়, এ বড় আকারে ছোটগল্প। কেননা, এ উপন্যাস শেষ করে অতৃপ্তি অবশ্যম্ভাবী। পাঠকমাত্রেরই মনে হবে, “শেষ হয়ে হইল না শেষ!” দুই অর্থেই। অর্থাৎ বই শেষ করার পরেও অনেক অনেএএক দিন এ উপন্যাস পাঠকের মনে রয়ে যাবে। আবার, শেষ করে উঠেই পাঠকের মনে হতে বাধ্য, ইশ্, লেখক আরেকটু লিখলেন না কেন! এই শেষের আক্ষেপটা প্রকৃত প্রস্তাবে সমালোচনা-ই— কিন্তু এমন সমালোচনা লেখকের সাফল্যের চিহ্নও কি নয়!

পুনঃ, চমৎকার ছাপা, বাঁধাই। ছাপার ভুল খুবই কম। দিবাকর চন্দ নির্মিত প্রচ্ছদটি অনবদ্য। দেবব্রত হোড়-এর তোলা কিছু ছবি বইয়ে মধ্যে মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে— যদিও এ উপন্যাসকে কোনও নির্দিষ্ট ভূগোল দিয়ে বাঁধা মুশকিল, তবু ওই ছবিগুলোর মাধ্যমে আপনিও মানসাইয়ের জলে হাত ভেজাতে পারেন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...