ইসলামফোবিয়া রুখতে রমজান মাসে “দোস্তি কি ইফতারি”

সুমনা গায়েন

 


২০২২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ১৫ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক ইসলামফোবিয়া প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই বিশেষ দিনটির উদযাপনে এবং ইসলামফোবিয়া দূরীকরণের উদ্দেশ্যে শহর কোলকাতায় ‘নো ইয়োর নেবার’ ও ‘মাইনরিটি কাউন্সিল অব বেঙ্গলে’র যৌথ উদ্যোগে ২৩ মার্চ শনিবার আয়োজন করা হয় ইসলামোফোবিয়া নিয়ে আলোচনাসভা এবং "দোস্তি কি ইফতারি"। এমন সদর্থক পদক্ষেপ আরও হওয়া প্রয়োজন

 

কবি লিখেছিলেন ‘রং যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে’, আর আজ স্বাধীন ভারতবর্ষে সেই রঙেই বিদ্বেষের বীজ বপন করা হচ্ছে। দিন দুয়েক আগে উত্তরপ্রদেশে বাইক-আরোহী এক মুসলিম ব্যক্তির সঙ্গে তার স্ত্রী এবং মেয়েকে কয়েকটি যুবক জোর করে হোলির রং মাখায়। উৎসবের নামে ওই পরিবারকে রীতিমতো হেনস্থার শিকার হতে হয়। কবি বেঁচে থাকলে হয়তো ভিরমি খেতেন। আবার ট্রেনে টুপি-পোশাক পরা পরিবার-সহ এক প্রৌঢ় ভদ্রলোককে শুধুমাত্র তার ধর্মীয় পরিধানের কারণে বেশ কয়েকজন যাত্রী বাংলাদেশি তকমা দিয়ে সমস্ত রাস্তা জুড়ে কটূক্তি করতে থাকে। এই ধরনের ঘটনা এখন আমাদের চারপাশে আকছার ঘটছে, আর বিচ্ছিন্ন বলে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে। এর ব্যাপকতাকে পরিসংখ্যানে আটকে ফেলা যাবে না। ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক একটি গোষ্ঠী ইন্ডিয়া হেট ল্যাব ২০২৩ সালে মুসলমানদের প্রতি ৬৬৮টি নথিভুক্ত ঘৃণাত্মক বক্তৃতার ঘটনা রেকর্ড করে ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্যের নথিপত্র প্রকাশ করেছে। ‘ভারতে ঘৃণাত্মক বক্তব্যের ঘটনা’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে এমন ২৫৫টি ঘটনা ঘটেছে, বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এই সংখ্যাটি ৪১৩-তে দাঁড়িয়েছে, ৬২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলাম-বিরোধিতা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।

কাজী নজরুলের “মোরা এক বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু মুসলমান” বর্তমানে শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ের কবিতা হিসেবেই রয়ে গেছে। নিজ ধর্ম-স্বাধীনতা বা অপর ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব প্রায় নেই বললেই চলে।

ইসলামফোবিয়াই হল এর মূল কারণ। এই ইসলামফোবিয়া বা মুসলমান-ভীতি আসলে কী? ইসলামোফোবিয়া হল মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি ভয়, কুসংস্কার এবং ঘৃণা। যার ফলে সমাজে এবং সামাজিক মাধ্যমে উভয় জগতেই মুসলিমদের হুমকি, হয়রানি, অপব্যবহারের শিকার হতে হয়। যা অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শত্রুতা অসহিষ্ণুতা তৈরি করে। ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে নূর মসজিদ এবং লিনউড ইসলামিক সেন্টারে গুলিবর্ষণের ঘটনাকে স্মরণ করে যেখানে শুক্রবারের নামাজের সময় ৫১ জন নিহত হয়। ২০২২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক ইসলামফোবিয়া প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এই বিশেষ দিনটির উদযাপনে এবং ইসলামফোবিয়া দূরীকরণের উদ্দেশ্যে শহর কোলকাতায় ‘নো ইয়োর নেবার’ ও ‘মাইনরিটি কাউন্সিল অব বেঙ্গলে’র যৌথ উদ্যোগে ২৩ মার্চ শনিবার আয়োজন করা হয় ইসলামোফোবিয়া নিয়ে আলোচনাসভা এবং “দোস্তি কি ইফতারি”। এরা বুনিয়াদি স্তরে বিশেষত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিভাজনের বিরুদ্ধে সতর্কতা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছে।

 

বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতি ও অংশগ্ৰহণ অনুষ্ঠানটিকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছিল। যেমন সাংবাদিক শুভজিৎ বাগচী কেন্দ্রীয় সরকারের বিতর্কিত এনআরসি, সিএএ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন। বস্তুতপক্ষে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যেভাবে দেশে ধর্মীয় অশান্তি তৈরি করছে বা করতে চাইছে এনআরসি-সিএএ তার বহিঃপ্রকাশ। এর ফল হিন্দু-মুসলিম উভয়ের জন্যই সুখকর নয়। অকারণ মুসলমানভীতির কারণে দেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো আজ ধ্বংসের মুখে। সভায় আমন্ত্রিত বক্তা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষিকা ঈপ্সিতা হালদার বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির ইস্যুর কথা তুলে ধরেন। এমন চলতে থাকলে একে একে সব ইসলামি স্থাপত্যগুলোই আক্রমণের শিকার হবে এমনটাই আশঙ্কা রয়েছে। নিজেদের স্বার্থে কিছু লোক হিন্দু মাইথোলজিকে ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন সংখ্যালঘুদের যেন একপ্রকার দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ফলে তারা হীনম্মন্যতায় ভুগছে। তাদের মনের মধ্যে এই ধারণা গেঁথে দেওয়া হচ্ছে যে মুসলমান ও মুসলমান সংস্কৃতি ভারতবর্ষের অংশ নয়। সিএএ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আরও একটি অবাককরা বিষয়— সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষজনের মধ্যেও ইসলামফোবিয়া দানা বাধছে, সামাজিক মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যে-কোনও সেকুলার মানুষ ইসলামিক আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেই তাদেরকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হচ্ছে। আবার কিছু কিছু মানুষ নিজেদেরকে সেকুলার হিসেবে পরিচয় দিলেও ইসলামিক অনুষ্ঠানের প্রতি তাদের প্রবল অনীহা। গবেষক সাবির আহমেদ তেমনই একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। বর্তমানে ইসলামোফোবিয়া নিয়ে চর্চা হলেও এই রোগ যে শতশত বছর পুরনো, পুরনো বাংলা সাহিত্য তা প্রমাণ করে। উদাহরণস্বরূপ লেখক বিশ্বেন্দু নন্দ ‘রামচরিত’, ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’র উদ্ধৃতি টেনে আনেন।

 

পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান আহমদ হাসান ইমরান দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে যেভাবে ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষ-হিংসা বেড়ে চলেছে এবং এর ফল যে মারাত্মক যা দেশের জন্যে মোটেও হিতকর নয় বরং ক্ষতিকর সে-কথা বলতে শোনা যায় তাঁকে। সম্প্রতি গুজরাতের বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন বিদেশি মুসলমান পড়ুয়াদেরকে নামাজ পড়ার অপরাধে মারধর করা হয়। এই ইসলামবিরোধিতা যে ভবিষ্যতের অশনিসঙ্কেত বয়ে আনছে তা এখন থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে।

 

ছোটরাও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত একটি ঘটনায় দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়। হায়দ্রাবাদের একটি বেসরকারি স্কুলে মুসলমান সহপাঠীর কাছ থেকে জন্মদিনের চকলেট নিতে অস্বীকার করে হিন্দু (মাড়ওয়ারি) সহপাঠীরা। কারণ হিসেবে তাদের হালাল চিহ্নিত করা খাবার খেতে নিষেধ এমনটাই দাবি করে। অর্থাৎ বড়রা যে নিজেদের অজান্তেই বা জেনেশুনে অতি সন্তর্পণে ছোটদের মনে ইসলামবিদ্বেষী ধারণা ঢুকিয়ে দিচ্ছে তা সমাজেরই বিফলতা বলতে হয়। চারপাশে এত এত সব ঘটনার পরেও সমাজের-দেশের শুভাকাঙ্ক্ষীরা আওয়াজ না তুললে বিরাট ক্ষতি আটকানো যাবে না। “দোস্তি কি ইফতারি” এই ভেদাভেদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। পবিত্র রমজান মাসে রোজা ভাঙার পর সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে আহার যেন কিছুটা হলেও স্বস্তির বাতাস বয়ে আনে। এমন সদর্থক পদক্ষেপ প্রচারমুখী হওয়া খুবই প্রয়োজনীয়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. খুব সুন্দর উদ‍্যোগ। ভবিষ্যতে এই ধরণের কাজে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। বেশি সংখ্যক শিক্ষিত মানুষকে এই দায়িত্ব নিতে হবে তবেই সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ কিছুটা হলেও দুর করা যাবে বলে মনে হয়।

আপনার মতামত...