ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে — পর্ব ৬ (প্রথমাংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ঘুঘুডাঙ্গা

এক.

রেখার খবর পেতে হীরকের আরও ছ-মাস লেগেছিল। দুর্গাপুরে পৌঁছাতে দেড় বছর।

ঊননব্বইয়ের আগস্টে বিজু আর মণীশ বিয়ে করে দেশ থেকে ফিরল। মণীশ ডালাসে চাকরি জয়েন করছে। বিজু পিএইচডি। কিন্তু এবার মিশিগান ছেড়ে টেক্সাস। দুজনের সংসার পাতবে।

এই কয়েকমাসে হীরক আর বিজুর কামরাডরি বেড়েছিল। যাদবপুরের সঙ্গী। চার বছর এক ক্লাসে, তার ওপর মণীশের প্রেমিকা। আড্ডার বন্ধু, কিন্তু অনেকের মধ্যে একজন। মিশিগানে এসে সেটা পিঠ চাপড়াচাপড়ি লেভেলে এসেছে। বিজু দেড় বছর আগে আসার সুবাদে হীরকের স্বঘোষিত লোকাল গার্জিয়ান। এই পদ বিজুর সঙ্গে মানায় ভাল। ওর মধ্যে একটা আগলে রাখার প্রবণতা আছে। বিশেষত হীরক আমেরিকায় এসেই এমন বড় একটা অ্যাক্সিডেন্টের শিকার হল! বিজু নিজেকে কিছুতেই এই দায় থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। তাই যেভাবে পেরেছে হীরকের পাশে থেকেছে। ওর ডিপ্রেশান বুঝতে চেয়েছে। পা ভেঙে নতুন দেশে বিছানায় পড়ে থাকার ধাক্কাটা কিছু কম নয়। বিজু সেই কষ্টটা লাঘব করার চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। তিন মাসের ক্ষতি সামলে এখানকার কলেজজীবনে ওকে সেটল করানোর জন্য যথাসাধ্য করেছে। আক্ষরিক অর্থেই এই বিদেশে হীরককে নিজের পায়ে আবার উঠে দাঁড় করিয়েছে বিজু। রেখার কথাও একটু আধটু জেনেছে। হীরক বরাবরই চাপা, প্রাণের কথা কাউকে বলতে চায় না। কিন্তু রেখার খবর না পেয়ে কেমন পাগলের মতো হয়ে গেছিল। ঠিক করেছিল কদিনের জন্য বাড়ি ঘুরে আসবে। শুনে বিজু অবাক! এই তো কদিন আগে এলি। এখুনি আবার বাড়ি যাবি কেন?

হীরক বলতে চায়নি। শুধু বলেছিল, বাড়ির জন্য মন কেমন করছে।

—মানে? এতগুলো টাকা খরচ করে এখন বাড়ি যাবি? তুই কি কচি খোকা? বিজুর রাগটা জেনুইন ছিল। কোনও ইললজিক্যাল কাজ ও কিছুতেই বুঝতে পারে না।

হীরক অবুঝের মতো রেগে গেছিল। তুই বুঝবি না। আমাকে যেতে হবে।

—দ্যাখ হীরু, আমি তোর ভালর জন্য বলছি। হত কোন আপনজনের শরীর খারাপ, বাবা-মা মরণাপন্ন। আমি মানতাম। আমার বিয়েতেও ঘুরে যেতিস না হয়। আমার তো ভালই লাগত। তাই না? বিজু উকিলি যুক্তি সাজাচ্ছিল।

হীরকের সেই গোঁ। হ্যাঁ, আছে আমার আপনজন, সে খারাপ আছে।

তখন বিজু হেসে উঠেছিল। তাই বলি, কেন এত ছটফট। আমাদের হিরো তার প্রেমিকাকে ছেড়ে আর থাকতে পারছে না। বেশ ডুবে ডুবে জল খাও তুমি শালা, কেউ গন্ধ পায়নি! এই হীরু, বল না, বল না রে।

হীরু পড়েছিল ফাঁপরে। কাউকে জানাতে চায় না, এখন তো নয়ই। বাড়ি থেকে বলেছে রেখারা দুর্গাপুর থেকে হঠাৎ করে চলে গেছে। কেন গেছে, কোথায় গেছে কেউ নাকি জানে না। এত অদ্ভুত এই ব্যাপারটা, এর কোনও মাথা-মুন্ডু করতে পারেনি হীরক। এইরকম যখন অবস্থা, রেখার সঙ্গে জীবনে আর কখনও দেখা হবে কি না সেটাই জানা নেই, কোন মুখে বিজুকে বলবে হীরক? কিন্তু বিজুকে কাটিয়ে বেরোনো খুব মুশকিল। শেষে হাল ছেড়ে বলেছিল, তুই না বিজু একেবারে মনা ভটচাজের মতো। ইস্টবেঙ্গলের গোল আটকে দাঁড়িয়ে আছিস। তোকে পার করে যাওয়াই মুশকিল।

খুশির হাসি হেসে সোফায় পা গুটিয়ে বসে বিজু বলেছিল, সেটাই যখন জানো বাছাধন, তাহলে আর কেওড়ামি না করে ঝেড়ে কাশ। আমার আবার প্রেমের গপ্পো শুনতে হেব্বি লাগে।

—ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি রে বিজু। কিন্তু তোকে কথা দিতে হবে কাউকে বলবি না। মণীশকেও না। হীরকের ভয় ছিল, প্রেমিকা লেঙ্গি মেরে পালিয়েছে শুনলে সবাই প্যাঁক দেবে।
—আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। কী ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা খেললে বিশ্বাস যাবে বল, তাই করছি। আমি কাউকে বলব না। আমার ধর্মমতে স্বামী হতে যাচ্ছে তাকেও না। আর আমাকে টেনশান দিস না হীরু, মণীশ প্রপোজ করার সময়েও আমার এত প্যালপিটিশান হয়নি।

বিজু ইয়ার্কি মেরে খুব নাটক করছিল, কিন্তু হীরুর কথা শুনে গুম হয়ে গেল। দ্যাখ কেসটা একটু কেএলপিডি আছে। মেয়েটা অনেক কারণে দুর্গাপুর ছাড়তে পারে। হয়তো ওর বাবা কোনও কেসে ফেঁসেছে, কোথাও মুখ দেখাতে পারবে না। তাই রাতারাতি শহর ছেড়েছে।

—তাহলে আমাকে রেখা কেন জানাবে না?
—হয়তো ভয় পেয়েছে। কিংবা অন্য কিছু হতে পারে। সেন্টু খাস না, কিন্তু ধর রেখা প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে।

খুব রেগে গেছিল হীরক। কী যা তা বলছিস। গল্পের গরু গাছে তুলিস না বিজু। আমার সঙ্গে এরকম কিছু হয়নি ওর।

—তোর সঙ্গে হলে তো তোকেই জানাত। হয়তো অন্য কোনও প্রেমিক আছে, তুই কি জানিস? শুনতে খারাপ লাগে হীরু, কিন্তু দিজ ইজ নট ইম্পজিবল। বললি তো তোর সঙ্গে সেরকম ইন্টিমেট সম্পর্ক ছিল না গত কয়েক বছর।

হীরক কী বলবে বুঝতে পারছিল না। রেখা তো আগেও শানুর প্রেমে পড়েছিল, সুতরাং অসম্ভব কীভাবে বলে।

সোফা থেকে উঠে এসে কাঁধে হাত রেখেছিল বিজু। দ্যাখ, আমিও তো একটা মেয়ে। বিয়ের ব্যাপারে একটু হিসেবনিকেশ মেয়েরাও করে, বিশেষত যদি নিজে ডিসিশান নিতে পারে। তুই এরকম হুট বলে চলে যাস না। বরং আমি মণীশকে বলব। ও তো দুর্গাপুরের ছেলে, যদি কোনও খোঁজখবর করতে পারে।

—একদম না। আমি তোকে কাউকে বলতে বারণ করেছি। আমি না হয় এখন গেলাম না, কিন্তু তুই ওকে কিছু বলবি না।

হীরক মনে মনে ছটফট করলেও, বিজুর যুক্তি মেনেছিল। বিজু ওকে বেশি আর খোঁচায়নি, তবে মাঝেমাঝে জিজ্ঞেস করত কোনও খবর পেল কি না।

আজ সেই কথাটা মনে রেখেই হাসতে হাসতে বলল, দ্যাখ, এতদিন আর একজনের মুখ চেয়ে তোকে আগলে আগলে রেখেছিলাম। এবার মনের খুশিতে উড়তে শুরু করিস না।

—হীরুর আরেকজনটা আবার কে? তু নে তো ছুপা রুস্তম নিকলা হীরু।
—সেসব বলা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের বারণ আছে। তাই না হীরু? চোখ টিপে বলল বিজু।
—শালা, আমি ল্যাংটিয়া ইয়ার, আমাকে বলবি না?
—স্কুলে তোরা ল্যাঙট পরে যেতিস নাকি? চোখ কপালে তুলল বিজু। না কি বাথরুমে গিয়ে নুঙ্কু নুঙ্কু খেলতিস?
—বিজু, তোর মুখে কোনও ফিল্টার নেই একদম। বিয়ে করেছিস, অন্তত এখন একটু সাধ্বী নারীর মতো কথা বলবি, এখনও বখাটে মেয়ের মতো কথা।
—তোদের জন্যেই বিশ্ববখাটে হয়েছি। কোনদিন শাশুড়ির সামনে খিস্তি ঝেড়ে দেব, বুড়ি অজ্ঞান হয়ে যাবে।

মণীশ কথাটা ঘোরাতে চাইল, ওই হল, স্কুলের বন্ধু তো বটেই। আমাকে ডিঙিয়ে তোকে বলল কেন?

—বিশ্বাসযোগ্য বলে। তোকে মেয়েদের ব্যাপারে আমিই বিশ্বাস করতে পারি না, হীরু তো কোন ছাড়। ছদ্ম দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে বলল বিজু।

মণীশ আর বেশি জোর করল না। হাত নেড়ে বলল, তবে আর কি, বিজুর হেডমাস্টারি থেকে ছাড়া পেয়েছিস, তুই এখন চিত্রগ্রীব। ওড় আর খুঁটে খা। নতুন বিয়ের পর সবার মধ্যে এক বোলে বাজার প্রবণতা থাকে, চেপে না রাখা উচ্ছ্বলতা। একজন আরেকজনকে বল পাস করতে করতে অপোনেন্টের গোলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মতো। মণীশও তার ব্যতিক্রম না।

হীরক এই নিয়ে আর কিছু না বলে মিটমিট করে হাসছিল। খুব সুন্দর লাগছে আজ বিজুকে। সারাক্ষণ জিনস আর টি-শার্টে থাকে মেয়েটা। কলকাতায় কলেজে পড়তেও খুব কম দিন ওকে সালোয়ার কুর্তায় দেখেছে। সংস্কৃতির দিনগুলোতে সবার জোরজারে একদিন হয়তো শাড়ি পরল। কিন্তু সে সাদামাটা রোজকার। আজ পরনে বেগুনি রঙের বেনারসি, হলুদ রঙের জরির ভরাট কাজের ব্লাউজ। গলায় হীরের পেন্ড্যান্ট চমকাচ্ছে। এমনকি হীরের নাকফুল। বড্ড অন্যরকম লাগছে বিজুকে। রোজকার চেনা মেয়েটা নয়। বাঙালি সাজে ওর কমনীয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে, সঙ্গে নতুন বিয়ের চিহ্ন নিয়ে কপালে সিঁদুরের টিপ আর হাতে শাঁখা পলা। ঢুকতেই বলেছিল সেই কথা। তোকে একদম বউ বউ লাগছে আজ বিজু।

—বিয়ে করেছি বউ বউ তো লাগবই। কিন্তু মণীশটাকে কীভাবে বর বর লাগানো যায় বল তো? চেয়ারে বসে থাকা মণীশের মাথাটা নিজের বুকের মাঝখানে নিয়ে দাঁড়াল বিজু। মুখের হাসিতে পরিতৃপ্তি। পূর্ণতা। নেভি ব্লু স্যুট আর লাল সিল্কের টাইতে মণীশকেও খুব ভাল লাগছে। এমনিতেই ওর নাম লেডি কিলার হিসাবে। একটু ড্রেস আপ করলেই উত্তমকুমার, বাঙালি হ্যান্ডসামনেসের সেরা উপমা।
—কেন এখন কি বর্বর লাগছে? মাথা ঘুরিয়ে বিজুর চোখে চোখ রাখল মণীশ।

বিজু মাথা ঝুঁকিয়ে মণীশকে চুমু খেল। না, সে তো লাগছ না। কিন্তু আমার শাঁখা পলা আর সিঁদুরের মতো তোমার জন্যেও একটা নো এন্ট্রি সিগন্যাল লাগানো দরকার। কী বল হীরু, তাই না?

—তার দরকার হবে না। তুই ওর পাশে শাখা সিঁদুর পরে পুলিশ-ওম্যানের মত ঘুরে বেড়াবি। টিপটা শুধু আর একটু গোল্লামতো করে দে। সিঁদুরের টিপ রেড সিগন্যাল হয়ে সবাইকে আটকে দেবে।
—ব্যস ব্যস ওকে আর উসকে দিস না হীরু। আমি তো জেলখানায় হাসতে হাসতে ঢুকে গেছি। এখন আগেকার দিনের কয়েদিদের মতো চামড়ায় দেগে দেওয়ার ব্যবস্থা করিস না প্লিজ।

বিজু এখানকার বন্ধুদের জন্য একটা পার্টি রেখেছে আজ। বেশি কেউ নয়, তবে জনা পঞ্চাশ তো হবেই। ছাত্রছাত্রীরাই বেশি, তার মধ্যে ইন্ডিয়ান সিংহভাগ। কয়েকজন প্রফেসর। স্যাঙ্গি, রনধীর ওরাও আসবে। স্যাঙ্গি চাকরি জয়েন করেছে, নিউ জার্সি চলে গেছে। কিন্তু আসবে বলেছে। ইনফ্যাক্ট মিশিগানে এসে গেছে কাল রাতে। আরও সবার সঙ্গে দেখা করতে ব্যস্ত। রণধীর চলেছে চিকাগো। সেপ্টেম্বরে জয়েন করবে।

বিজুর খুব ইচ্ছা ছিল বাঙালি খাবারের আয়োজন করে। কিন্তু সেটা করা মুশকিল, অন্তত ইন্ডিয়ান খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে। রাজা রানি এখানকার একমাত্র ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ। তার একদিকটা বিজুদের জন্য রিজার্ভ। বিজুর হয়ে হীরক তদারক করে এদিকটা ফুল দিয়ে সাজানোর ব্যবস্থা করেছিল। খাবারের ব্যাপারটা পুরো এদের। ওদের আর কিছু ব্যবস্থা করার নেই। শুধু লোকজন আসার যা অপেক্ষা। তিনজনে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। বিজু অন্যদিনের চাইতে একটু বেশি উচ্ছ্বল। সেই আমেজ নিয়েই বলছিল, নিজের আনন্দে ওড়ার জন্য পুরো মিশিগান পড়ে রইল তোর জন্য। খুঁটে খা, ঘেঁটে খা। এ-দেশের মেয়েদের বাপেদের সবার কাছে বন্দুক থাকে, অনেক মেয়ের কাছেও। তাই নেড়েঘেঁটে দেখতে চাইলে একটু সাবধানে।

—বুঝতে পারছি, এতদিন তুই ছিলি বলে হীরু এদেশি মেয়েদের পটাতে পারছিল না। ভয় খাইয়ে রেখেছিলি।
—একদম। সাদা চামড়ার মেয়ে দেখলেই ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টদের কেন যে এমন ছোঁকছোঁক বেড়ে যায়! ভাবে ফ্রিতে শুতে পারবে।
—দ্যাটস আনফেয়ার বিজু। আমিও ইন্ডিয়ান ছেলে। তার মানে আমি কি ছোঁকছোঁক করে বেড়াতাম?
—একা থাকতিস, কাকে ধরলি, কাকে ছাড়লি আমি তার কী জানি। দেখলাম তো তোকে। অ্যাকসিডেন্ট হল, দেখতেও এলি না। তখনই বুঝেছি, কিছু একটা চলছে, আর একা থাকতে দেওয়া যায় না।
—ভেরি আনফেয়ার। আমি শুনেই চলে আসতে চেয়েছিলাম। তুই না করলি। বললি, কদিন বাদে সংসার পাততে হবে টাকা নয়ছয় করলে চলবে না।
—আমি তো বলবই। কিন্তু ভালবাসলে লোকে এইসব কথা শোনে না।
—উফ হীরু। দ্যাখ বিয়ে করলে কী অবস্থা হয়। কোন কথাটা শুনব আর কোনটা না-শোনা করতে হবে তার বিচার কেমনভাবে করবি তুই বল? হাসিটা এখনও লেগে আছে মণীশের মুখে, কিন্তু বেচারার মধ্যে একটা কাঁচুমাচু ভাব।

হীরু লেগপুল করায় বেশি পাত্তা দিচ্ছিল না। কথাটার নল এবার মণীশের দিকে ঘুরে যাওয়ায় এক চোট হেসে নিল। সেমসাইড হয়ে গেল বিজু। এখন মণীশের গোলটাও তোকেই বাঁচাতে হবে।

—সেটাই তো বাঁচাচ্ছি এতদিন। আমি কি চিনি না এই লোকটাকে। যাদবপুরে থাকতেই মেয়েরা পঙ্গপালের মতো ছেয়ে থাকত। আমার চোখের সামনে।
—মানে বুকে বসে দাড়ি উপড়ানো যাকে বলে। হীরক খুশিমনে ইন্ধন জোগাচ্ছিল। বিদেশে বসে বাঙালিমতে ঝগড়াটা বেশ উপভোগ করছিল।
—নেহাত দাড়ি নেই, তাই আমার জন্য ভেবে ভেবে ওর মাথার চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে দেখছিস না। মণীশ উষ্মার সঙ্গে কৌতুক মিশালেও অস্বস্তি চাপতে পারছিল না।
—একদম। এই দুবছর আমার আড়ালে কী গুল খিলিয়েছ তার কি কোনও ঠিকঠিকানা আছে। আমি তো সেই জন্যেই বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেললাম। না হলে এখানে পিএইচডি করলে কত সুবিধা হত আমার।

এই সময় হইহই করতে করতে স্যাঙ্গি এসে গেল। সঙ্গে রনধীর। স্যাঙ্গি নিউ ইয়র্কে আছে, রণধীর যাচ্ছে চিকাগো। মিশিগান ছেড়ে বড় বড় শহরে পাড়ি দেওয়ার এক্সাইটমেন্ট দুজনেরই। স্যাঙ্গি তো এসেই নিউ ইয়র্কের গুনগান করতে বসে গেল। মিশিগান আর ইন্ডিয়ার একটা ছোট শহরের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। শহর হল নিউ ইয়র্ক। স্যাঙ্গির অবস্থা হয়েছে হাতে ললিপপ পাওয়া বাচ্চার মতন। তেমনি অপরচুনিটি। আমি তো ভাবছি, কদিন বাদেই আর একটা চাকরি ধরব।

স্যাঙ্গি খুব কাজের ছেলে। নিজেরটা ভাল গুছিয়ে নিতে পারে। আর খুব ফোকাসড।

রনধীর ওর মতো করে খুশি। চিকাগোতে ইসকনের মন্দির রজার্স পার্কে। ওটা ডেট্রয়েটের থেকেও বড়। আজকাল ও কপালে তিলক কেটে ঘোরে। শুধু পাকাপাকি একজন বোষ্টমী নেওয়াটাই যা বাকি।

এক-এক করে সবাই আসছিল। অ্যালান আর সু, ওদের ওয়েডিং এই সামারেই। দুজনে গলা জড়াজড়ি করে এসে কংগ্রাচুলেট করল। আয়ো এল ঠিক ওদের পরেই। আয়োর সঙ্গে হীরুর এখন খুব দোস্তি। সামারে ও আর আয়ো দুজনেই ওয়ালমার্টে কাজ করছে, কিন্তু আলাদা শিফটে। হীরক করে নাইট শিফটে। দিনের বেলায় স্টারবাকসে কাজ নিয়েছে। তাই সেরকম দেখা হচ্ছিল না। আসতেই ওকে লং লস্ট ফ্রেন্ডের মতো জড়িয়ে ধরল হীরক। ও ম্যান, অলমোস্ট আফটার টু উইকস। হয়ার হাভ ইউ বিন?

চিরপরিচিত দাঁত বের করা হাসি ছড়াল আয়োর মুখে। আই ওয়াজ আউট রক। আমার মেডিক্যাল টেস্ট ছিল।

—কেন, কী হয়েছে?

আবার একগাল হাসল আয়ো। নাথিং। আমি মিলিটারি জয়েন করছি।

—মানে? ভীষণ অবাক হল হীরক। তোমার না পিএইচডি করার কথা।
—না, পরে করব। আগে তো এই দেশের সিটিজেন হয়ে নিই।
—মানে, মিলিটারিতে গেলে তোমাকে সিটিজেন করে নেবে।
—ইয়া, দ্যাটস দ বারগেন।
—যুদ্ধে যেতে হবে?
—রাইট নাউ, আই অ্যাম ইন রিজার্ভ। ইরাকে ডিপ্লয় করতে পারে যে-কোনও সময়ে। কিন্তু এই সব জাস্ট দুই বছরের জন্যে। তারপর আমি পিএইচডি করতে ফিরে আসব। যদি অন্য কোনও দেশ ইউএসে অ্যাটাক করে, তাহলে শুধু ফ্রন্টে যেতে হবে, তা না হলে আমি সেফ।

আবার দাঁত বের করে হাসল আয়ো। হীরক ভেবে অবাক হচ্ছিল। এই দেশের সিটিজেনশিপ নেওয়ার জন্য লোকে নিজের জীবনটাও বাজি রাখতে পারে!

—আর ইউ সিওর আয়ো? ইজ দিস দ্য রাইট থিং টু ডু?
—আরও অনেক নাইজিরিয়ান এরকম করেছে। দিজ ইস নাথিং নিউ ইন আওয়ার কমিউনিটি। তাছাড়া আমি বন্ড সাইন করে দিয়েছি। নো ওরি ম্যান, ইউ হ্যাভ টু টেক চান্সেস ইন লাইফ।

সবাই মোটামুটি এসে গেছে। বিজু এখন তাদের সামলাতে ব্যাস্ত। মণীশ অবশ্যই কাউকে চেনে না। হাত-টাত মিলিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসেছিল। ওকে একা দেখে হীরক পাশে এসে বসল। বিয়ে করে কেমন লাগছে রে মণীশ?

—যাসশালা, বিয়ে করে আবার নতুন কী লাগবে? বিজু তো আর নতুন না।
—তোদের বিয়ে তো কলকাতায় হল, দুর্গাপুরে গেছিলি?
—অবশ্যই, আমাদের বৌভাত হল তো রিকল পার্কেই। অনেকের সঙ্গেই দেখা হল। প্রায় ভুলে গেছিলাম তেমন অনেকেও এসেছিল। বাই দ্য ওয়ে, তোর রেখা বলে মেয়েটাকে মনে আছে তো? ও তো তোদের ওদিকেই থাকত, চিনতিস ভাল করে।

রেখার নাম শুনেই অ্যান্টেনা খাড়া হয়ে গেল হীরকের। হ্যাঁ, হ্যাঁ চিনি তো। রেখা এসেছিল তোর রিসেপশানে?

—না রে, স্যাড কেস। আসলে ল অ্যান্ড অর্ডার দিনদিন খারাপ হচ্ছে।
—কেন, কী হয়েছে রেখার? গলাটা নিজের কানেই খসখসে শোনাল হীরকের। কী শুনেছিস তুই?
—মাস ছয়েক আগের ব্যাপার। বন্ধুর বিয়েফেরত রাত্রে রিক্সা করে আসছিল। ওর মুখে অ্যাসিড ছুড়েছে।

হীরকের মুখের সব আলো যেন কেউ শুষে নিল ব্লটিং পেপারের মতো। খামচ ধরল মণীশের হাত। কী যা তা বলছিস মণীশ? তুই ঠিক শুনেছিস? হীরক কথাটা মুখে বলল না মনে মনে নিজেই বুঝতে পারল না।

—কেন তুই কিছু শুনিসনি? তোদের বাড়ির কাছেই থাকত। আমি তো যা শুনলাম বীরেন বলে এক যুবনেতার হাত আছে। ওদের এত তাণ্ডব, ফুল ফ্যামিলিকে দুর্গাপুর-ছাড়া করেছে। মেয়েটা আর বাড়িই ফেরেনি। ওর বাবা বোধহয় বাড়ি বিক্রি করে শহর ছেড়েছে।

হীরকের হাত পা কাঁপছিল। এসব কী শুনছে? বাবা মাকে জিজ্ঞেস করেছে একটু আধটু। ওরা তো কিছু বলেনি একবারও?

চারদিকে এখন গল্পগুজব চলছে। এদের অনেকেই মিশিগান ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সবার মধ্যে খুব বনোহমি। শুধু হীরক একা বসে রইল। এখুনি কেক কাটা হবে, তারপর লাঞ্চ। বিজুর এই রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে হঠাৎ করে কোথাও চলে যেতে পারে না হীরক। শুধু ওর শরীরটাই পরে রইল, প্রাণপাখি ছটফট করছিল অন্য কোথাও। অন্য এক দেশে।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4760 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে — পর্ব ৬ (দ্বিতীয়াংশ) – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...