সচেতন দারিদ্রে গানের স্বরাজ

কালাচাঁদ দরবেশ

সুমিত দাস

 

সাধক? নাকি গায়ক? — ক্লিশে এই আলোচনা টপকে কবেকার বাংলায় গর্বিত দারিদ্রের গল্প। লোকধর্মে যা ছিল স্বাভাবিক। সদ্যপ্রয়াত লোকশিল্পী কালাচাঁদ দরবেশের স্মরণে কলম ধরলেন সুমিত দাস।
——–

গেরস্তের তুলসীতলায় বৈষ্ণব আহ্নিকের পর গান ভাসে। ‘নবী আমার পরশমণি/নবী আমার সোনার খনি।’ তারপর কোন পথে ধরা দেন আসলি মানুষ – পথ বাতলে দেন বাঙালি এক দরবেশ। সময় পিছোতে থাকে। এই বাবরি ধ্বংসের মাসে রাজস্হানে মেরেকেটেপুড়িয়ে খুন হয়ে যাওয়া ভিডিওর পাশে দেখছিলাম সে তথ্যচিত্র। তুলসীতলায় নবী খোঁজার তরিকা আর হকিকৎ বহু যোজন দূরের। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না দরবেশ! তবু হয়, ঘৃণা-বিদ্বেষের এই সমকালে গান কতটুকুই বা পারে, কতটুকুই বা পেরেছে? নইলে শাহ জালালের এই বাংলায় চৈতন্য-লালন হয়ে আউল-বাউল-দরবেশ-সাঁইয়ে কবেই হটিয়ে দেওয়া যেত বিভাজন! কবেই বেবাক বদরক্ত ভেসে যেত গানদরিয়ায়। উত্তর বুঝে ওঠার আগে আপনি চলে গেলেন কাঁলাচাদদা। কালাচাঁদ দরবেশ।

তখন আয়ুব খানের ঘোর জমানা। পুবের বাংলায় ভেঙে যাচ্ছে নিম্নবর্ণের সঙ্গে সংখ্যাগুরুর সামাজিক জোট। নতুন করে অন্ত্যজ সংখ্যালঘু পশ্চিমমুখী। ইতিউতি রিফিউজির সংখ্যা বাড়ে। কালাচাঁদ দাসের পরিবার ধূপগুড়ির গোবিন্দপুরে নয়া সাকিন খুঁজে পায়। সময়টা ১৯৬৪। ঘোর যৌবনে নতুন ঠিকানায় রুজিরুটির খোঁজ ছাড়া কীই বা থাকতে পারে! ক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের পুরনো ঠিকানার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে। মাইল-কিলোমিটারের অংকে জুড়ে যায় পাসপোর্ট-ভিসা। তথাপি পিছনের পথে সাবলীল থেকে যায় — বাংলার আউল-বাউল-সুফি-দরবেশের যাবতীয় সুরবাতাস। শাহ জালাল ও চৈতন্যের ধরাধামে মুক্তির পথ ও পাথেয় যে গান, তা চিরকালই অস্বীকার করেছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও তার নিয়ন্ত্রকরা। তবু গানের চারায় গানের ধারা লেগে গান হয়েছে বৃক্ষ। হাওড়ের জলে লেগেছে আখড়ার ধুন। প্রতিষ্ঠান খেউড়ে সাজিয়েছে তাকে। প্রবল মনুষ্য-পরিচিতি ভোলার দিনে গান-ধরা লোককবি কতটা সাধক আর কতটা শিল্পী, মানে পার্ফরমার — সে খোঁজে একদিন ক্যামেরা শানাবে শহুরে মন। নাগরিক টিভি চ্যানেলের প্রভাতী সংগীত-প্যানেল বা পপুলার ভোজবাজির পরিচিত শটে হিসেব কষে বলে দেবে — সাধক ও গাইয়ে আসলে বিপরীত শব্দ। সাধনার সিদ্ধি শেষে মাথার পিছনে আসে সিদ্ধির জ্যোতি! আর গাইয়ে থাকেন মঞ্চে। সাধনার পথ মানে তথ্য যার জানা। শুধু সাধনায় যাননি বলে — ছোঁয়া যায়, সাত তারের স্বরাজ বাজালে চেনা যায় — “এই হলেন কালাচাঁদ দরবেশ।”

৬৮-তে ধুপগুড়ির আনন্দমোহন কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক হয়ে ৭০-এ পেলেন প্রাথমিক স্কুলে হেডমাস্টারের চাকরি। সব ঠিকঠাক চলছিল। একদিন আচমকা অজ্ঞান হলেন। কালাচাঁদের কথায় “ব্রেন শট।” ব্যাস, তাতেই বদলে গেল এতকালের চলাচল। বদলে গেলেন কালাচাঁদ দাস। গুরু পেলেন রাধাচরণ দরবেশকে। লোকধর্মের অচেনাপথে পাড়ি জমালেন স্বপত্নী। দারিদ্রের ঘোষিত পথে সচেতন প্রবেশ। আর সাততারের স্বরাজের সঙ্গে শুরু হল দোস্তি। উপমহাদেশে এর আগে বাবা আলাউদ্দীনের দাদা আখতারউদ্দীন সরোদ ও দোতারার মিশ্রণে যন্ত্রটিকে সামান্য পরিচিতি দিয়েছেন মাত্র। গুরুর কাছে পাওয়া গান আর নিজের বাঁধা গান আশ্রয় করে একসময়ের শিক্ষক হয়ে গেলেন ভিক্ষুক। গান তাঁর মাধুকরীর আশ্রয়।

পরমে পৌঁছতে — অহংকারের ভ্রান্তি ত্যাগ করে, বেছে নেওয়া দারিদ্র আর সেবার পথে নম্রতা আসলে পাথেয়। জেনে নিতে হয়, — আউলে অবস্হান করেন ফকির রূপে আল্লা। শেষমেষ আউল-বাউল-দরবেশ-সাঁই একই পথের পথিক। সাধু-গুরু-বৈষ্ণব হয়ে মানুষে বিলীন থাকা পরম ছু্ঁয়ে বাঁচা। বহিরঙ্গের সে বিশ্বাসে হাঁটতে থাকা দরবেশ যত না তুরস্ক বা ইরানের উপমা, তারও বেশি উত্তর বাংলার শব্দ আর তালের নির্যাস। সহজিয়া সুরের প্রবাহিত ধারায় মাধুকর দরবেশ গানের মোকামে রাখলেন নিজস্ব সুরছন্দ। “দেরেনা দেরে দেরেনা, দেরে দেরেনা দেরেনা।”

পরের গল্পটা লোকশিল্পী কালাচাঁদ দরবেশের। বোলপুরের পৌষমেলায় বাউল-ফকিরের আখড়ার মাঝে থাকে হিন্দু-মুসলমানের পর্দা। চেনা গানে গলা মেলানো লালন-নীলকণ্ঠের উত্তরসূরীরা সেই নাগরিক পর্দা তোলার ডাক দিয়েছেন বলে শুনিনি। ফলে শিল্পী দরবেশের ঠাঁই হয়েছিল ফকিরদের আখরায়। পরে ‘কালাচাঁদ’কে নিয়ে এসেছিলেন দুই বাউল। তাৎক্ষণিক এই গল্পটাই এই সময়ের, এই দেশের। ৮৮-তে বোলপুরের মেলায় শান্তনু ফুকন জানিয়ে গেলেন — বিদেশে ডাক আসবে। সে পথে অমিতাভ বচ্চনের আলিঙ্গন, জাকির হোসেনের সঙ্গতে মাধুকর শিল্পীর পসার বাড়ে। অনুষ্ঠান করেন প্যারিস, গ্লাসগো, মরক্কো সহ অন্যত্র।

বাউল-ফকিরের বৃত্তে দরবেশ কালাচাঁদের পরিবেশনের নিজস্বতা রীতিমত আলোচনার বিষয়। নাগরিক গাইয়ের দল তাঁর খোঁজ রাখতেন বৈকি।পরিশীলিত ও পারফরমেন্সে বিশ্বাসী শিল্পীর কাছে সাধনা স্রেফ তথ্য। গানটাই মুখ্য। বহুজনই কালচাঁদ দরবেশকে ধূপগুড়ির ট্রেনে আবিষ্কার করার দাবিদার। তবু একদল অন্যরকম হয় চিরকালই। ২০১৪-র জুনে এমনই একদল বাংলা অ্যাকাডেমির সামনে গান গেয়ে দরবেশের চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহ করেছে। কেউ কেউ নিয়মিত খোঁজও রাখতেন। এসময় গুলিয়ে দেবার। জাতপাত-বর্ণের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শাসনে বন্দি নিরালাচারী পথ খুঁজেছে মিলনের, বাঁচার। গগনবিহারী ঈশ্বর-আল্লাকে মানুষে আরোপ করে সহজ করেছেন জীবনবোধ। এসময় হিংস্র। বহুত্বের পথ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেকে পুনরায় বিলিয়ে দিচ্ছে। বাউল-ফকির যত না বিবাগী, বাহিরানায় মুক্ত হওয়ার ডাক, তারও বেশি গেরুয়া, রামগেরুয়া।

নাগরিক বিনোদনের বাজারে প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন করা আউল-বাউল-দরবেশ-সাঁইরা কে কোথায় কতটা নকল আর কতটা খাঁটি — সে বিতর্কও চলবে। সাধক না গায়ক, সে বিতর্ক টপকে গানগুলি থেকে যায়। থেকে যাবে। থেকে যাবে — ‘দেরেনা দেরে দেরেনা।’ হয়ত নাগরিক পার্ফমার বহুকালের বিশ্বাস — ভায়া কালাচাঁদ দরবেশ — মঞ্চে গানের ফাঁকে বলবেন — “শরীর হল বৃক্ষ, শরিয়ত হল শিকড়, তরিকৎ হল কাণ্ড, হকিকৎ মানে শ্বাসপ্রশ্বাস, আর মারফৎ হল ফুল-ফল।’ আর একদিন সেসব প্যাঁচপয়জার ডিঙিয়ে, নামের পরিচিতি ডিঙিয়ে গেয়ে উঠবেন — সিন্ধুপারের বন্ধু যেজন/তোমার পার করিবে দরিয়ায়/যাননি সে বন্ধুর বাড়ি কোন জাগায়।” আসলে এ লেখায় ‘কোন জায়গা’ মানে — কোন সময়, কোন সময়কাল। তাঁর সময়ে অচেনা ব্যতিক্রমী ছিলেন স্বজ্ঞানে দরিদ্র দরবেশ।

কৃতজ্ঞতা : তথ্যচিত্র — ইন সার্চ অব দরবেশ

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4645 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...