বিষণ্ণ আলো

পার্থপ্রতিম রায়

 

হঠাৎই নদীর বাঁকের ওধার থেকে ঝপ ঝপ করে নৌকাগুলো বেরিয়ে এল, এক-দুই-তিন! একটু পরে আরও দুটো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। উল্টোপাল্টা চলনে, জোয়ারের স্রোতে ভেসে। এগুলো কাদের নৌকা! শুক্লপক্ষ এখনও শেষ হয়নি বটে, কিন্তু পূর্ণিমা বা চতুর্দশীর রাতের মতো আলো তো নেই, বরং আবছা অন্ধকারে ঢেকে আছে গোটা নদীটা। এলোমেলো গতিতে বয়ে যাওয়া নৌকোগুলোকে দেখে ভুতুড়ে নৌকা বলে মনে হচ্ছে। একটার সঙ্গে আর একটার ধাক্কা লেগে উলটে না যায়। মাঝিমাল্লারা সব ঘুমিয়ে আছে নাকি!

হায় আল্লা— ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল মুরগি জিন্না— সব লাশে ভরা।

একসঙ্গে সকলের শিরদাঁড়া দিয়ে বিদ্যুৎ নেমে গেল। পরের নৌকাদুটো পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করে চলছিল। চোখের সামনেই একটা নৌকা দু-তিনবার পাক খেয়ে ডুবে গেল। আবছা অন্ধকারে বোঝা গেল অনেকগুলো নারী, পুরুষ আর বাচ্চাদের মৃত শরীর মুহূর্তে নদীর জলে তলিয়ে গেল। ক্ষণিকের নৈঃশব্দ্য। সঙ্গে সঙ্গে গোপেশ্বর চাপা গলায় নির্দেশ দিল, জলিল মিয়াঁ তাড়াতাড়ি নৌকা সামনের খাড়ির মধ্যে ঢোকাও। ততক্ষণে এই নৌকার সব যাত্রীরা বুঝে গেছে সামনের নব্বই ডিগ্রি বাঁক খাওয়া নদীটার উল্টোমুখ থেকে এগিয়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু! মধুমতী নদীটা এখানে অনেকটা ইউ-র মতো আকার নিয়েছে। পশ্চিমদিকে নদী ঘেঁষে বারুড়িয়া মসজিদ, পূর্বপাড়ে একটু পিছিয়ে ভেতর দিকে বমনাপাড়া বাজার।

মোট বাইশজন যাত্রীসমেত এই মাঝারি মাপের নৌকোটা কাছারিবাজার থেকে মধুমতী নদীতে ভেসেছে। উদ্দেশ্য পদ্মা হয়ে মুর্শিদাবাদের কোথাও ঠাঁই নেওয়া। রাতের আবছা অন্ধকারকে সঙ্গী করে কোনওমতে বিশাল পদ্মার জলে আশ্রয় নিতে পারলে নজরে পড়ার সম্ভবনা কম। তাছাড়াও ওখানে ইন্ডিয়ান আর্মির তৎপরতা রয়েছে। আজ ভোরবেলায় রাজাকার আর খানসেনারা বমনাপাড়ায় ঢুকে নির্বিচারে মানুষ মেরেছে। মসজিদে মসজিদে তখন সবে ফজরের আজান শুরু হয়েছে, তাকে স্তব্ধ করে মেশিনগানের গুলির আওয়াজ আর মানুষের আর্তচিৎকার আকাশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বাজুকার আগুনে সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে ওরা। যে ক-জন পালাতে পেরেছিল এই দলটি তাদেরই অংশ। পুরুষ-মহিলা, বাচ্চা-বুড়ো— সবাই। তবে ছয়জন মানুষ এদের মধ্যে আলাদা। তাদের হাতে মারাত্মক অস্ত্র রয়েছে। ওরা মুক্তিবাহিনী।

নৌকোটা ডানদিকে সুতি খালে কেবল মুখ ঢুকিয়েছে— হৃদয় বিদীর্ণ করা মেশিনগানের ট্যা… ট্যা… আওয়াজ রাতের নৈঃশব্দ্যকে খানখান করে দিল। আওয়াজের উৎস বাঁকের ঠিক পেছনে একটু দূরে। সঙ্গে গানবোটের ডিব-ডিব শব্দে দমবন্ধ হয়ে আসে। তখন জলিল মিয়াঁর সঙ্গে প্রাণপণে লগি ঠেলছে গোপেশ্বর, শরিফুল আর বেলাদিদি। বাচ্চাদের মুখে তাদের মায়েরা কাপড় চাপা দিয়েছে। মুরগি জিন্না থ্রি নট থ্রি রাইফেলটা হাতে তুলে পাটাতনে ওপর টান-টান সোজা হয়ে দাঁড়াল। ওর হাতে এই রাইফেলের গুলি যেন বোতলের জিনের মতো কথা শোনে। রাইফেলটাকে কাঁধে ঠেকিয়ে লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে শূন্যে একটা কাল্পনিক বৃত্ত এঁকে ট্রিগার টানে। ব্যস, মুহূর্তে খেল খতম। তিন দিন আগে পদ্মার মুখের দিকে পালকপোড়া গ্রামে এমনই একটা গানবোটের তিন গানারকে পর পর তিনটি গুলিতে শেষ করে দিয়েছিল। গানবোটের আওয়াজ ক্রমশ এগিয়ে আসছিল… সঙ্গে গুলির শব্দও। পাকিস্তানি সৈন্যরা মাঝেমাঝেই এমন করে অন্ধকারে নদীর মধ্যে বা কিনারা লক্ষ করে এলোপাথারি গুলি চালায়। কিন্তু দিনের বেলা ছাড়া সচরাচর পাড়ে নামে না। আগের নৌকোগুলোকে বেশ কিছুটা দূরে কোথাও গুলি করেছিল। কে জানে অন্ধকারের সুযোগে আরও কত নৌকা এমন পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে ডুবে গেছে!

নৌকা এবার সুতি খালের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। লগি ঠেলতে সুবিধা হচ্ছে তাই। এইসব খাল একে সরু, তায় আবার চলেও এঁকেবেঁকে। সামনের বাঁকটাতে ঢুকলেই নিশ্চিন্ত।… সর্বনাশ, সামনে চড়া! বেশ খানিক জায়গা জুড়ে কেবল কাদা। আসলে এখানে নদীর মুখে ঢাল বেশি। তাই জোয়ার বড় না হলে এসব খালে বেশি দূরে জল ঢোক না। হতাশ ও ভয়ার্ত গলায় জলিল মিয়াঁ বলে, ভাই, সামনে পানি নাই। অহন কী করুম? গ্রুপ কমান্ডার গোপেশ্বর প্রমাদ গুনল। গানবোট যদি বাঁক ঘুরে এইদিকেই আসে এবং যদি খালে না-ও ঢোকে, তাহলেও খালের মুখ থেকে এই নৌকাকে স্পষ্ট দেখা যাবে। তার ফল এক নিমেষে মেশিনগানের গুলিতে সব ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।

হঠাৎ গুলির আওয়াজ থেমে গেল। তবে গানবোটের ডিব-ডিব আওয়াজ এখনও আছে। কিন্তু গোপেশ্বরের মনে হচ্ছে আওয়াজটা কেমন যেন দূরে সরে সরে যাচ্ছে। মানে বোটটা বোধহয় নদীর ওপারে চলে যাচ্ছে। উল্টোদিকে বারুড়িয়া মসজিদের আশেপাশে বহু মানুষের বাস। সেখানে এবার ব্রাশ ফায়ার হবে! অবশ্য কমান্ডারদের মেজাজ-মর্জি অন্যরকম থাকলে এলোপাথাড়ি গুলি না চালিয়ে ফুর্তির নেশায় মেতে ওঠে। সুন্দরী যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। সারারাত ধরে চলে উদ্দাম লীলা। সেনাদের বিকৃত কামনা সহ্য করতে না পেরে অনেক মেয়ে প্রাণ হারায় বা অথর্ব হয়ে যায়। কোনও কোনও মেয়ে সেনাদের হাতে ধর্ষিতা হওয়ার পর রাজাকারদের হাতে পড়ে। গোপেশ্বর সন্তর্পণে ডাঙায় নেমে দেখে গানবোট সত্যিই ওপারে চলে যাচ্ছে।  হঠাৎ দেখে ওপারে জোরালো টর্চের আলো জ্বলে উঠে নিভে গেল। পর পর তিনবার। এটা নির্ঘাৎ রাজাকারদের ইশারা। নিশ্চয় অনেকগুলো মেয়েকে ধরে নিয়ে এসেছে, এবার খানসেনাদের হাতে তুলে দেবে। তারপরে শুরু হবে ফুর্তির প্লাবন।

ওপারের চুনাখালিতে একশো ষাটজনের একটা মুক্তিবাহিনীর দল ঘাঁটি গেড়েছে বলে খবর আছে। ওই দলটা একটা বড়সড় আক্রমণ হানার জন্য তৈরি হচ্ছে। কিন্তু চুনাখালি নদীর ওপার থেকে আরও ত্রিশ কিলোমিটার পশ্চিমে। ওদের নদীর ধারেকাছে আসতে দিন কয়েক লাগবে, কারণ পাকিস্তানি আর্মির হয়ে ওই অঞ্চলে যুদ্ধ করছে রাজাকার আর আল বদর বাহিনী। জায়গায় জায়গায় তাদের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে মুক্তিসৈন্যদের। সেইসব চেলা-চামুণ্ডার দলকে নিকেশ করে ওদের একটু একটু করে এগিয়ে আসতে হচ্ছে। গোপেশ্বরের কাছে ঠিক খবর নেই ওই বাহিনী কার নেতৃত্বে রয়েছে। সরাসরি জেনারেল ওসমানি নাকি বাঘা সিদ্দিকের। ওরা মেজর জলিলের নামও শুনেছে। শুনেছে আরও কিছু সেনা অফিসারের নাম যাঁরা পাকিস্তান বাহিনী ছেড়ে এসে মুক্তিদলে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এঁদের কারও সঙ্গে গোপেশ্বরদের যোগাযোগ হয়নি। পাকিস্তানিরা নিজেরা এই নদী-অঞ্চলে খুব বেশি মাটিতে নামে না। বেশিরভাগ নদীর তীরের গ্রাম-নগর-গঞ্জে খুন, লুঠ, ধর্ষণ করে গানবোটে ফিরে আসে। মাঝেমাঝেই অনেকগুলো গানবোট একসঙ্গে হানা দিচ্ছে। ওপারের মুক্তিদের কাছে নাকি অনেক অস্ত্র রয়েছে। ভারি মেশিনগান, মর্টার ছাড়াও প্রচুর অটোমেটিক রাইফেল, কারবাইন আর গ্রেনেড রয়েছে। আর গোপেশ্বরের দলে মাত্র ছয়জন যোদ্ধা, যাদের মধ্যে পাঁচজনের কোনও ট্রেনিং নেই। অবশ্য নৌকায় এই মুহূর্তে প্রাক্তন সেনা ঘোষালবাবুকে ধরলে এটা একটা ‘সেভেন ম্যান আর্মি’। অস্ত্র যা আছে তা নিজেরা জোগাড় করে নিয়েছে। গত কুড়ি দিনে অন্তত নয়টা অ্যামবুশ করেছে এই দল। তাদের কাছে এই সময়ে সব চাইতে বড় অস্ত্র হল বিন্দুপাড়ার রাজাকার পালুই মিঁয়ার কাছ থেকে দখল করা একটা আমেরিকান কোম্পানির তৈরি পাকিস্তানি ছাপ মারা নতুন মডেলের স্টেনগান আর সাড়ে চার হাজার রাউন্ড গুলি। সঙ্গে গোটা আটেক ৩০৩ রাইফেল, মাথাপিছু কয়েকশো গুলি, আরও একটা ম্যাগাজিনবিহীন কালাশনিকভ রাইফেল। এই অকেজো কালাশনিকভটা চিনের তৈরি। ম্যাগাজিন না থাকায় কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কায়াস মেহমুদ যখন দলে এল তখন ওর হাতে ছ-খানা ম্যাগাজিন ছিল। এই ক-দিনের যুদ্ধে সব শেষ। তবে দলটা ছোট এবং সাবধানী বলে হতাহত কেউ নেই। সাধারণত রাতের দিকে অ্যামবুশ করে রাজাকার-সহ গোটা পঞ্চাশ খানসেনাকে খতম করেছে এরা। পেট্রোল বোমা মেরে দুখানা গানবোটও ছাই করে দিয়েছে। এখন তাদের লক্ষ্য একটা আস্ত গানবোট দখল করা। এই সব লড়াইয়ে এ-পক্ষে কেবল সোনা মিঁয়ার বাম কনুই ছুঁয়ে একটা গুলি বেরিয়ে গেছে।

কায়াস মেহমুদ ছেলেটা অদ্ভুত! দেখতে দেবদূতের মতো, কথা বলে ভীষণ কম। দক্ষ হাতে চিকিৎসা করে। সঙ্গে থাকা ওষুধের বাক্স থেকে ওষুধ দেয়। বন্দুক থেকে গুলি ছোড়ে। আর গ্লিসারিন, সাবান, পেট্রোল বা কিছু তুচ্ছ জিনিস মিশিয়ে মারাত্মক বিস্ফোরক তৈরি করে ফেলে! মাঝেমাঝেই সঙ্গে থাকা একটা ডয়োরিতে কীসব যেন লেখে। মুরগি জিন্না ওকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল। এক মুহূর্ত দেরি হলেই জিন্নার ৩০৩ রাইফেলের গুলি ওর মাথাটা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিত। হঠাৎ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মায়া হল দলনেতা গোপেশ্বরের। এ ছেলে কখনও খুনি হানাদার হতে পারে না। এক ধাক্কায় জিন্নাকে সরিয়ে দিয়েছিল, থাম। রাইফেল সরা। অরে মারুম না। অরে জিগাইয়া জানতে হইব আলাউদ্দিনের কোন কোন সাগরেদ খানেগো কাছে মাইয়্যা ধইরা লইয়া যায়। জিন্না ক্ষুব্ধ হয়েও রাইফেলটা সরিয়ে নেয়, কিন্তু বদলে হাওয়াই চটি পরা ওর ঢ্যাঙ্গা পা দিয়ে সপাটে একটা লাথি কষিয়েছিল কায়াসের  মুখে। ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরেছিল। গোপেশ্বর ওকে মুখ ধোয়ার জল দিয়ে শুশ্রূষা করে নিয়ামতপুরের গ্রাম থেকে নিজেদের গোপন ঘাঁটিতে নিয়ে আসে। পুরো নাম কায়াস মেহমুদ জলন্ধরী। লাহোর মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে সরাসরি আর্মি মেডিকেল কোরে। আর ক্যাপ্টেন হয়েই যশোর ক্যান্টনমেন্টে পোস্টিং। সেখান থেকে কুষ্টিয়ার রাঙাবাড়ির বেস হাসপাতালের সার্জন। বেচারার ভালো করে মগজধোলাই হয়নি। জেনেছে কিছু গোলাগুলি চালানো আর বিস্ফোরক তৈরির কৌশল। এসব অবশ্য সেনাবাহিনীর যে-কোনও সদস্যকে শিখতে হয়। সেদিন নিয়ামতপুরের হাটে যখন পাকসেনারা লুটপাট করা শুরু করে তখন সে সকলের চোখের আড়ালে হাতে কালাশনিকভ আর পিঠে ওষুধ আর সার্জারির টুলবক্স নিয়ে গানবোট থেকে নেমে সন্তর্পণে গ্রামের ভেতরে অঘোর ঘোষের গোয়ালঘরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। খানসেনাদের সেদিন লুটপাটের দিকেই নজর ছিল। সঙ্গে ছিল চোলাই মদ গেলার ধুম। এমনিতে নিয়ামতপুরে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে। এটা মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশল। এখানে তাই এখনও পর্যন্ত গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেনি ওরা। তবে হিন্দু আর গরিব চাষিদের তারা শত্রু মনে করে। এরকম বেশ কয়েকজনকে তারা ধরে নিয়ে গেছে, যাদের খোঁজ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে চোখে না দেখলেও দুজনের কথা ওরা জেনেছে, যারা বেস হাসপাতালে বেগার খাটছে। একে ওদের দলটা খুব ছোট, তার ওপর ‘জয় বাংলা’র ধারণা এখনও এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে তেমনভাবে সঞ্চারিত হয়নি। রাজাকার না হলেও জিন্না, আয়ুব খান আর পাকিস্তান সম্পর্কে কিছু মানুষ এখনও মোহাবিষ্ট হয়ে আছেন। তাই মুক্তিবাহিনীকে একপ্রকার ছদ্মবেশে চলতে হয়। লড়তে হয় গেরিলা কায়দায়। তবে গোপেশ্বর রাজাকারদের মধ্যে নিজের এক বন্ধুকে চর বানিয়ে ঢুকিয়ে রেখেছে। সে-ই জানিয়েছিল সেদিন সকালে পাকসেনাদের হাটে নামার আগাম খবর। নেতাজির ভাবশিষ্য, খুব অল্প বয়স থেকে ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মী সালাউদ্দিন আদতে কলকাতার মানুষ। এই বেজন্মা পাকিস্তানের জন্য তার ছেড়ে আসা জন্মশহরকে সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে রাজাকারদের দলে নাম লিখিয়েছে, মহাজনি কারবার থেকে জমানো এক লাখ টাকা গোপনে গোপেশ্বরের হাতে তুলে দিয়েছে।

এই সেফ জোন-এ কোনও এনকাউন্টার করার পরিকল্পনা ওদের ছিল না। কিন্তু সালাউদ্দিন একটা ভালো অন্তর্ঘাতের ছক বাতলেছিল। ইদানিং পাঞ্জাবি সেপাইরা ভাত দিয়ে তৈরি দেশি চোলাই মদে খুব মজেছে। এখানে রাজাকার পান্ডা সাইদুল শেখের চোলাইয়ের ভাটি থেকে এরা জ্যারিকেন ভর্তি করে মদ নিয়ে যায়। সেসব মদের জ্যারিকেনে যদি এক এক বোতল মিথাইল অ্যালকোহল ঢেলে দেওয়া যায় তাহলে আর দেখতে হবে না। গুলি-বন্দুকের আর দরকার হবে না। যুদ্ধ কিংবা বিদ্রোহের কোনও গল্প থাকবে না। কিছু হলে সেটা ওই রাজাকারের ওপর দিয়ে যাবে।  যদিও এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। নেশাড়ু সেজে সালাউদ্দিনের আগুপিছু জিন্না আর রায়হান গিয়েছিল ভাটিতে কাঁধের ঝোলা ব্যাগে মিথাইল অ্যালকোহলের বোতল ভরে, কিন্তু বিস্তর লোকজন থাকায় উদ্দেশ্য সফল হয়নি। খানেরা জ্যারিকেন ভর্তি করে  চোলাই নিয়ে গিয়েছিল আর তার আগে গলায়ও ঢেলেছিল প্রচুর। তাই তাদের মধ্যে যে একজন মানুষ গায়েব তা টের পেয়েছিল সন্ধেবেলায় গুনতির সময়। সেদিন রাতে ওরা আর ঘাঁটি থেকে অ্যামবুশের ভয়ে বের হয়নি। পরদিন সকালে সালাউদ্দিনের দোকানে একটা ছবি নিয়ে এসে তত্ত্বতালাশ শুরু করতেই সালাউদ্দিন তাদের গুমরাহ করে দেয় এই কথা বলে, ইসকো হমনে কিসিকো ইঁহা দেখে নহি। মগর বোট সে উতরনে কে বক্ত দরিয়াকে পানিমে তো গিরে নহি! কলকাতার রিপন স্ট্রিটের ছেলে সালাউদ্দিন হিন্দি উর্দুটা বেশ ভালো বলে। সবকো তৈরনা আতা থা? এই প্রশ্নে পাকিস্তানি কমান্ডাররা বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই একটু এদিক-ওদিক দেখে পাকসেনারা ওর হাতে কায়েসের একটা ছবি ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়।

পূর্ব পাকিস্তানে বদলির এই কয়েক মাসের মধ্যেই খুন, রক্ত, পৈশাচিক উল্লাস, নারীর আর্তচিৎকার, গোলাগুলির কানফাটানো শব্দে সেনাবাহিনীর এই মেডিকেল সার্জনটি নিজেই প্রায় উন্মাদগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের প্রবল ভক্ত এই তরুণ। খুবই মনে পড়ে লাহোরে বাড়িতে থাকা ছোটবোন সাগুফ্তাকে। মনে পড়ে মাকে। খুব বেশি মনে পড়ে আঞ্জুমকে। লাহোর ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। ওদের সঙ্গে মেডিকেল কলেজের ক্যান্টিনে আড্ডা দিত। কোথা থেকে কী হয়ে গেল! বাচ্চা মেয়েদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের রোজনামচা লিখে ও ক্লান্ত। কিন্তু কী আশ্চর্য, এ-দেশের মতো পৃথিবীতে খুব কম দেশেই রয়েছে যেখানে নিজেদের দেশের মানুষের ওপর হত্যালীলা চালায় স্বদেশি সেনাবাহিনী! নরপিশাচ! এদের ধরে ধরে গুলি করে মারতে ইচ্ছে করে। অন্তত এই বাহিনীতে থাকার আর ইচ্ছা নেই কায়েসের। তাই সুযোগ বুঝে এই দলত্যাগ। যদিও দিন কয়েকের মধ্যে রাজাকারেরা কায়েসের উপস্থিতি টের পেল এবং মুক্তিদের এই গ্রুপের অস্তিত্ব জানতে পারল। সব চাইতে করুণ অবস্থা হল সালাউদ্দিনের। রাজাকার নেতা আলাউদ্দিনের নির্দেশে তাকে নিয়মিতপুরের হাটে একটা গাছের ডালে ফাঁসিতে লটকানো হল। গুলি করে মারা হল তার বৃদ্ধ বাবা, মা আর ভাইকে।

ঘোষাল আর জিন্না কায়াসকে সন্দেহ করে। হালারে আমগো মইধ্যে হেন্দাইয়া দিল না তো? জিন্না বারকতক গোপেশ্বরকে কথাটা বোঝাবার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তানি আর্মির লোকরে বিশ্বাস কইরো না। আমি কাম কইরা আইছি। আমি জানি আর্মি ইন্টেলিজেন্স কারে কয়, এ-কথা ঘোষালকাকাও আসার দিন থেকেই বলে যাচ্ছে। গোপেশ্বর নির্বিকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের কৃতি ছাত্র, ছাত্র-রাজনীতি করা এই মানুষটি তার অনুভূতি দিয়ে বোঝে যে কায়াস মেহমুদ নামে এই পাকিস্তানি যুবক আসলে বিবেকরাজ্যের নাগরিক। তার কাছে দেশ, জাত, ধর্মের চাইতেও অনেক বড় হল মানবিকতা। ইতিহাস এমন বহু নজির তুলে ধরে যেখানে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে সত্যিকারের মানুষ যারা, তারা মানুষের স্বাভাবিক অধিকারকেই মান্যতা দিয়েছে। এখানে কে পাঞ্জাবি কে বাঙালি সেটা গৌণ। তবে গত দুদিনে পরিস্থিতি আরও কিছুটা বদলেছে।

ঝামাপাড়ার ঘোষালকাকুর দুই মেয়েকে রাজাকারেরা তুলে নিয়ে গেছে। ঘোষাল তখন নারায়ণপুজোর দুধ আনতে গোয়ালার বাড়ি গিয়েছিল। খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে যখন ফিরল ততক্ষণে রাজাকারেরা দুই মেয়ে, গোলার ধান, গয়নাগাটি, টাকাপয়সা-সহ লাইসেন্স করা জার্মান বন্দুকটাও সঙ্গে নিয়ে গেছে। ঘোষালের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। এই দেশের জন্য জান বাজি রেখে লড়াই করলাম! হতাশা আর ক্রোধে তার মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠল। ঘোষাল প্রাক্তন সেনানী। সবসময় সেই ধর্ম সে পালন করেছে। সেই ব্রিটিশ জমানায় সেনাবাহিনীতে ঢুকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আফ্রিকায় রোমেল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। পরে সাতচল্লিশে দেশভাগের পরে বালুচ রেজিমেন্টের হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল চাকুরিজীবনের শেষ পর্যন্ত। গোটা রেজিমেন্টে তখন তিনজন মাত্র হিন্দু। সে ছাড়া বাকি দুজন সিন্ধ্রি। পঁয়ষট্টি সনে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে খেমকরনে বীরত্ব দেখাবার জন্য সুবেদার থেকে অনারারি ক্যাপ্টেন হয়েছিল এই ইনফনট্রির সেনা। সাতচল্লিশে তার সব জমিদার আত্মীয়স্বজনেরা ইন্ডিয়াতে চলে গেলেও এইসব জল, মাঠ আর আকাশকে ছেড়ে ঘোষাল কোথাও যেতে চায়নি। তার পূর্বপুরুষেরা জমিদারি করে বহু আয়েসি জীবন কাটিয়েছে। সে বেছে নিয়েছিল সৈনিকের জীবন। ভাবতেও পারেনি দেশের হেফাজতের নাম করে তার পরিবারের ওপর এই দেশেরই কিছু মানুষ এমন বিপর্যয় নামিয়ে আনতে পারে! স্ত্রীবিয়োগের পরে এই দুই সুন্দরী মেয়েই তার শেষ আশা-ভরসা ছিল। একটু বেশি বয়সে বিয়ে করার জন্য সংসারে তার কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন বাকি ছিল। হায় ইশ্বর, তুমি এটা কী করলে! ভাবতে ভাবতেই হতাশা আর কান্না চেপে রেখে পুরনো ট্রাঙ্ক থেকে বাবার হাতি শিকার করার ৫০৫ বোরের রাইফেল আর অবশিষ্ট সত্তরটা গুলির বাক্সটা বের করে আনল। এগুলো রাজাকারদের নজরে আসেনি। প্রাক্তন আর্মিম্যান হিসেবে আশেপাশের এলাকায় ঘোষালবাবুর নাম ছড়িয়ে আছে। এমনকি কিছুদিন আগেই ঢাকায় আইয়ুব খানের উপস্থিতিতে প্রাক্তন কৃতি সেনাদের যে সম্মানজ্ঞাপন হয় তাতেও ঘোষালের নাম ছিল। খবরের কাগজেও ছাপা হয়েছিল। এই দেশে তার ও তার চোদ্দপুরুষের জন্ম। এই মাটির নুন খেয়েছি, এই দেশের হয়ে লড়াই করেছি বিদেশিদের সঙ্গে। ভারতের দুর্ধর্ষ গোলন্দাজ আব্দুল হামিদ খানের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে পঁয়ষট্টি সনে খেমকরনে প্যাটন ট্যাঙ্কের আড়াল থেকে গুলি চালিয়ে শেষবারের মতো শত্রু নিধন করেছিলাম। এবার আর একবার গুলি ছুড়ে দেশের মধ্যেই দেশের শত্রুদের নিধন করব। পরিবার গেছে যাক, নিজের জীবনই এখন বাজি। মাথায় এই আগুন নিয়ে ঘোষাল বন্দুক কাঁধে রাজাকার আলাউদ্দিনের বাড়ির দিকে রওনা দিলে রাস্তায় মেয়ের শিক্ষক সোনা মিঁয়া তাকে নিরস্ত করে গোপনে গোপেশ্বরের কাছে নিয়ে আসে। কিন্তু এই গ্রুপে এক পাঞ্জাবির উপস্থিতি লক্ষ করে বিচলিত হয় এবং তাকে সন্দেহ করা শুরু করে।

ইতিমধ্যে ছেলে-বুড়ো সকলে মিলে ঠেলে নৌকোটাকে কাদার ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। গোপেশ্বর সবাইকে নির্দেশ দিল ডাঙায় উঠে পেছনের জঙ্গলে ঢুকে বড় গাছগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকতে। সবাই সেইমতো চলে গেলেও একটা রোগা টাইপের ছেলে গেল না। ধোপাহাটির খোকা হালিম। গোপেশ্বর অবাক হয়ে দেখে ও একটা একনলা ছোট বন্দুক হাতে তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে! এটাকে বলে পাইপগান। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হানাহানিতে এই অস্ত্র খুবই কার্যকর। এই দেশের খবরের কাগজে এ খবর প্রায় প্রকাশিত হয়।

—তুই এইডা পাইলি কই?

গোপেশ্বরের প্রশ্নের জবাবে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে উত্তর দেয়, নকশাল করি।

—নকশাল! শুনে সতর্ক হয় সে। জিজ্ঞেস করে, কোন গ্রুপ?
—সিরাজ ভাই।
—তয়, কয়খান আওয়ামি মারছস?

এ প্রশ্নে মাথা নিচু করে থাকে সে।

একটু চুপ থেকে গোপেশ্বর বলে, বুছ্ছি। হোন, এইডা কিন্তু তগো মতো পাড়ার মাইরপিট না। এআ খানেগো লগে যুদ্ধ। বুছছস? যেমনে কমু হেমনে হুনবি। অহন জিন্নার লগে যা। হেয় যেমনে কয় ত্যামনে কর। গুলি আছে কয়ডা, শত খানেক হইব?

সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। জিন্না তার জামার কলারটা ধরে বড় আমগাছের পেছনে টেনে নিয়ে যায়।

গোপেশ্বর মনে মনে ভাবে কদিন আগেও দেশের নানা জায়গায় এই সিরাজ আর তোহা গ্রুপের সঙ্গে আওয়ামি লিগের কত মারপিট, খুনোখুনি হয়েছে। আর আজ পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় ‘জনযুদ্ধ’ আর ‘মুক্তিযুদ্ধ’ মিলেমিশে একাকার। জমিদারের ব্যাটা ঘোষাল, সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা কায়াস, স্কুলটিচার সোনা মিঁয়া, চাষার ছেলে রায়হান কিংবা ডাকাতি করে পেট চালানো জিন্না; আজ সব এক হয়েছে মানবতার বড় শত্রুর বিরুদ্ধে।

অপসৃয়মান গানবোটের আবছা আলোর দিকে তাকিয়ে কিছু মতলব ভাবছিল সে। গানবোট  ইতিমধ্যে প্যঁপর প্যঁপ শব্দে হর্ন বাজিয়ে রীতিমতো হর্ষ প্রকাশ করছে। এবার শুরু হবে রাতের হুল্লোড়। রাতভর ফুর্তির চোটে ভোরের দিকে চোখে ঘুম চলে আসবে। ঘড়ির দিকে তাকায় সে। এখন রাত আটটা। কিছু সময় পরে জোয়ারের স্রোত কমে আসবে। আস্তে আস্তে ভাঁটি শুরু হবে। চলবে অন্তত চার ঘন্টা। রাত দুটো নাগাদ পুরোপুরি ভাঁটা। ওই সময়ে ঠিকঠাক কায়দায় জলের টানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লগি ঠেলতে পারলে এক ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যাবে পদ্মার মুখে। তাহলে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া যায়। এখন কয়েক ঘন্টা সতর্ক থাকতে হবে। পজিশন নিতে হবে ঠিকমতো। সে সকলকে পজিশন বলে দিল। এর মধ্যেই ঘোষাল জানিয়ে গেল, কায়াসকে পাওয়া যাচ্ছে না। ও বোধহয় পালিয়েছে। গোপেশ্বর জানে সে এই অবস্থায় কী করতে পারে! সে এখন জ্যারিকেন থেকে বোতলে বোতলে পেট্রোল ভর্তি করে পেট্রোল বোমা তৈরিতে ব্যস্ত। চারিদিকে প্রায় অন্ধকারে কাদার মধ্যে বসে এই কাজ করতে হচ্ছে। আলো জ্বালানো মানে নিজেদের মৃত্যু ডেকে আনা। কায়াস তাঁর ছোট্ট টর্চলাইটটা মাটির দিকে মুখ করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ঘোষালের সন্দেহ ক্রমশ বৃদ্ধি পায়, শালা পাঞ্জাবি, আবার আর্মির লোক। হালারে পাঠাইসে আমাগো হালহকিকত জানার লাইগ্যা। আমাগো ফান্দে ফালাইয়া হালায় ভাগব। সে যে একজন প্রাক্তন আর্মিম্যান হিসাবে আর্মি ইন্টেলিজেন্সের ব্যাপার বোঝে, সেটা মাথায় আছে।

গোপেশ্বর সবাইকে নিজেদের পজিশনে সেট করিয়ে দিয়ে পইপই করে বলে দিয়েছে কেউ যেন উল্টোপাল্টা গুলি না ছোড়ে। যে যার লক্ষ্যে গুলি চলাবে কেবল তার সঙ্কেত পেলেই। ঘোষালবাবু নিজেই জানাল গানবোটের সারেংকে গুলি চালাবে। যদিও তাদের ধারণা খানেরা এখন আনন্দে মজে থাকবে। এদিকে নজর দেবে না। তবে অনেক ক-জন বাঙালি মেয়ের সর্বনাশ হতে চলেছে। ওরা এর বদলা নেবে গা। একবার এই নিরীহ মানুষগুলোকে ইন্ডিয়াতে পৌঁছে দিয়ে সেখান থেকে আরও কিছু অস্ত্র নিয়ে আসুক।

কিন্তু যা ভাবা হয় তা সবসময় ঘটে না।  হঠাৎই একটা হাউইয়ের মতো কিছু আকাশে ভেসে উঠল এবং ফেটে গিয়ে দিনের মতো আলো করে দিল গোটা অঞ্চল। আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল মেশিনগান আর মর্টারের কানফাটানো আওয়াজ। নদীটা বাঁকের অংশটা বেশ চওড়া। কিন্তু এপার থেকে স্পষ্ট দেখা গেল একটা গানবোট গোলার আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল, কতগুলো জ্বলন্ত শরীর নদীর জলে ঝাপিয়ে পড়ল। এপারের যোদ্ধারা তখন প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল। মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উঠল। যাদের কথা শোনা যাচ্ছিল সেই শক্তিশালী মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা রাজাকারদের পরাস্ত করে নদীর ধারে চলে এসেছে এবং তারাই যুদ্ধবন্দি রাজাকারদের দিয়ে ফাঁদ ফেলে সেনাদের ওপরে আক্রমণ শানিয়েছে। এবার এগুলোকে ধ্বংস করে এপারের এই ছোট্ট যোদ্ধাদলটির সঙ্গে যোগাযোগ হলেই আর চিন্তা নেই।

তাও দলনেতা গোপেশ্বরের মনে সংশয়। ব্যাপারটা এত সহজে মেটার নয়। সে চিৎকার করে সবাইকে চুপ করতে বলে, এই খাড়াইবা না। ওইপাড় থিক্কা মেশিনগানের গুলি আইয়া লাগতে পারে। খানেগো আরও বোট আইতে পারে। সব চুপ কইরা থাহ। বলতে বলতেই গোলাগুলি চালাতে চালাতে আরও তিনটে গানবোট বাঁকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ওপারের দিকে চলল। আলোহীন এইসব ভুতুড়ে মৃত্যুযানগুলি থেকে শুধু লাল আগুনের সিসের গুলি ছিটকে ছিটকে বেরোতে লাগল। এখন এটা পুরোদমে যুদ্ধ। আদমজি আর ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠীর বেশ কটি বাণিজ্য জলযান পাকবাহিনী হাতে পেয়েছে। সেগুলোতে মাঝারি পাল্লার কামান লাগিয়ে একটু অদলবদল করে যুদ্ধজাহাজে পরিণত করেছে। তেমন একটিকে এইবার দেখা গেল এসে হাজির। অন্ধকারে যেন এক ভাসমান দৈত্য। একটা ছোটখাটো ডেস্ট্রয়ার! এটা এসেই ওপারের লোকালয়ের ওপর বড় বড় গোলা ফেলতে লাগল। গোলার আগুনে ঘরবাড়ি, মানুষ, পশু, গাছপালা সব ছারখার হতে লাগল। ওপারের মানুষদের আর্তচিৎকার এপার থেকে শোনা যাচ্ছে। ছোট গানবোটগুলিও মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়ে এগোতে লাগল, কিন্তু এবার ওরা খুব সাবধানী। বড় জাহাজের আড়ালে খুব ধীরগতিতে চলতে লাগল। উল্টোদিকের যোদ্ধারা যেন বেশ খানিকটা ম্রিয়মান হয়ে গেল এই প্রতিআক্রমণে। পাল্টা কিছু বিক্ষিপ্ত মর্টারের সেল এসে পড়ছে বটে, কিন্তু বড় কামানের গোলায় ওরা বোধহয় দূরে সরে গেল। বেশ খানিকক্ষণ ধরে প্রতিআক্রমণের লক্ষণ নেই।

সব আশা বোধহয় শেষ। এরপর সকাল হতেই মাটিতে নেমে পাকবাহিনী যে নৃশংস হত্যায় মেতে উঠবে সেটা ভেবে গোপেশ্বর বিচলিত হল। নিজের জীবনের চাইতেও সঙ্গে থাকা অসহায় অসামরিক নাগরিকদের জন্য তার মন শঙ্কিত হয়ে উঠল। স্টেনগান সামনে রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে ঘটে যাওয়া মৃত্যুদৃশ্য দেখতে দেখতে এই শান্ত সুন্দর বাংলার মাটিতে তার নিজের জীবনের নানা সুখস্মৃতি মনে পড়তে লাগল। মৃত্যু বোধহয় খুব সামনে, তাই অতীতের যাবতীয় ভালোলাগার কথা মনে এসে জড়ো হয়। হামাগুড়ি দিয়ে কখন যে কায়াস এসে পাশে হাজির তা টের পায়নি সে।

—ঘাবড়াইয়ে মত। মুক্তিলোগ ফির সে অ্যাটাক করেগা।

কায়েসের স্বরে আত্মবিশ্বাস। তার গোটা শরীরে নদীর কাদা লেপটে আছে। কিন্তু তার কথার যুক্তিটা কী সেটা বোঝা মুশকিল। কায়াস তো আসলে ডাক্তার। সরাসরি কমিশন পেয়ে ক্যাপ্টেন হয়েছে। এরা নাকি ভালো করে স্যালুট মারতে না শিখেই কাজে লেগে যায়। তবুও সে আর্মিম্যান। গুলি চালানো, বিস্ফোরক বানানো ইত্যাদি কাজের ট্রেনিং নিয়েছে। তাছাড়া বেশ কিছুদিন বাংলায় রয়েছে। যুদ্ধ দেখছে। মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে সহকর্মীদের মতামত শুনেছে। তাই মুক্তিবাহিনী  মানে অন্তত যারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত, তাদের সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ তো করতেই পারে। গোপেশ্বর তাই চুপ করে থাকে।

ইতিমধ্যে আরও কিছু সময় অতিবাহিত হল। বড় জাহাজের কভারিংয়ের মধ্যে ছোট গানবোট ব্রাশফায়ার করতে করতে আরও খানিকটা পাড়ের দিকে এগিয়ে গেছে। জাহাজের গোলায় বারুড়িয়া মসজিদ ও তার আশপাশের বিস্তীর্ণ জায়গায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে তো জ্বলছেই। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ এই মুহূর্তে প্রায় নেই বললেই চলে। দু-একবার এক-আধটা শেল ফাটার আওয়াজ কানে আসছে ওদের দিক থেকে। তাহলে ওরা বোধহয় পিছু হটছে। নতুবা কামানের গোলায় ওদের অনেক হতাহত হয়েছে। এক নিরাশ ভাবনা গোপেশ্বরের মাথাকে আচ্ছন্ন করল, তাই সে দেখতে পেল না গুচ্ছের কচুরিপানার ঝাড়িতে মাথা গুঁজে শুশুকের মতো সাঁতার দিয়ে বাংলার একদল দামাল ছেলে কোমরে গ্রেনেডের মালা বেঁধে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে সেই ঘাতক জলযানের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। একসঙ্গে আট-দশটা বিস্ফোরণ হল জাহাজের ডেকে। সেখানে যেসব গোলন্দাজরা ছিল সবাই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মুহূর্তে। এরপরেই বিস্ফোরণ হল ইঞ্জিন রুমে। সেই বিস্ফোরণে তেলের ট্যাঙ্কে আগুন লেগে আরও বড় বিস্ফোরণে গোটা জাহাজে আগুন ধরে গেল। জাহাজে অন্ততপক্ষে একশোজন সৈন্য সবাই এই আচমকা আক্রমণে গ্রেনেডের আঘাতে বা আগুনে পুড়ে মারা গেল। বাংলার সাঁতারপটু ছেলেরা যেভাবে এই অ্যামবুশটি করল তা বিশ্বখ্যাত পাকিস্তানি আর্মি ভাবতেই পারেনি।

এবার আবার শুরু হল আকাশে সেই হাউইবাজির খেলা, সঙ্গে ওপার থেকে মেশিনগান আর মর্টারের গোলাগুলি। পাকিস্তানি গানবোটগুলোর তখন মরণ-বাঁচন অবস্থা। একটি তীব্রগতিতে পালাতে লাগল পদ্মার দিকে। কিন্তু বিপত্তি ঘটাল বাকি দুটি বোট। দিশা না পেয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল এপারের সুতিখালের মধ্যে। এপারের যোদ্ধাদের মধ্যে তখন প্রবল উত্তেজনা, কেউ কেউ নিজের পজিশন থেকে সরে এসেছে। নদীর ওপারের মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু তারা অনেকেই তেমন ট্রেনিংপ্রাপ্ত যোদ্ধা নয়। নানান বাধ্যবাধকতা আজ তাদের যোদ্ধা বানিয়েছে। কথা ছিল গ্রুপলিডার গোপেশ্বরের নির্দেশ না পেলে কেউই গুলি চালাবে না। কিন্তু সদ্য নিজের মেয়েদের হারানো প্রাক্তন আর্মিম্যান ঘোষালবাবু ধৈর্য রাখতে পারল না। তার হাতি মারার বন্দুক গর্জে উঠল। তবে কথা অনুসারে সে বোটের সারেংকে গুলি করেছিল কিনা বোঝা গেল না। কারণ তার গায়ে গুলি লাগেনি। সে বোটটাকে আরও ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে এল। সেইসঙ্গে শুরু হল ব্রাশফায়ারিং। এক অসম যুদ্ধ শুরু হল: একদিকে দুটি গানবোটে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত অন্তত ত্রিশজন পাকসৈন্য। আর উলটোদিকে সাত আর এক আটজনের এক বাহিনী যাদের হাতে অস্ত্রভাণ্ডার খুবই ছোট্ট। তবু রক্ষা, ওপারের মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের চাপে এরা গানবোটর সব আলো নিভিয়ে রেখেছে। নাহলে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে থাকা গোপেশ্বরকে ওরা দেখতে পেত নির্ঘাৎ! ওদের চালানো এলোপাথাড়ি মেশিনগানের গুলি তার মাথার দুই-চার ফুট ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। সে মুহূর্তে ভেবে নেয় একেই বলে যুদ্ধ। এক মুহূর্তে সাফল্য বদলে যায় পরাজয়ে। হর্ষ বদলে যায় বিভীষিকায়! এই মুহূর্তে ঠিক কী করবে, কীভাবে করবে, ভেবে পায় না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হওয়া গোপেশ্বর দাশগুপ্ত। এ-সময় যদি নদীর ওপারের মুক্তিযোদ্ধাদেরও একটা গানবোট থাকত তাহলে কত ভালো হত। পাক বোটগুলোকে তাড়া করে পদ্মার দিকে নিয়ে যেতে পারত। তাতে তাদের অন্তত এই কঠিন অবস্থায় পড়তে হত না। নিজেরা মরে গেলে যুদ্ধের নিয়মেই মারা যাবে, কিন্তু পেছনের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা সে-সব সহজ, সরল অসামরিক মানুষগুলোর কী হবে! ওদের কথা ভেবে সে শিউরে উঠল। যেসব মুক্তিযোদ্ধারা নদীতে সাঁতরে এসে অত বড় পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজটাকে ধ্বংস করে দিল তারাই বা কোথায়! তারাও কি পাকিস্তানিদের মারতে গিয়ে নিজেরাও শহিদ হয়ে গেল! কিছুক্ষণের মধ্যে এতগুলা ভাবনার শেষে সে বুঝতে পারল দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পালটা ব্রাশফায়ার শুরু করতে হবে। ওদের সংখ্যা অনেকটা কমিয়ে দিতে হবে।

গোপেশ্বর নদীর পাড়ে জমির ওপরে নেমে আসে। আশপাশে ঝোপঝাড় থাকায় তাকে এমনিতে দেখা যাচ্ছে না,  কিন্তু এখান থেকে গুলি চালালে বা সামান্য নড়াচড়া করলে তার অস্তিত্ব ধরা পড়বে। তার ফল মেশিনগানের গুলির মুখে পড়া। কয়েক ফুট দূরে নদীর ঢাল, সেখানে নেমে যেতে পারলে দারুণ সুবিধাজনক অবস্থান পাওয়া  যাবে। ঢালের আড়াল থেকে স্টেনগানের গুলিতে ওদের গোটা দলটিকে সাবাড় করে দেওয়া যায়। অন্তত ভলো লড়াই দেওয়া যায়। গানবোটগুলো সরু খাল থেকে মুখ ঘুরিয়ে আর নদীতে ফিরে আসতে পারবে না। ওরা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের চোখের সামনে একই জায়গায়, আর মুক্তিদের আটজন আট জায়গায় ওদের চোখের আড়ালে। পজিশন বদলে বদলে ওদের ওপর আক্রমণ হানলে জয়লাভ অসম্ভব না। একটা প্রাচীন মোটা শিরীশগাছের আড়াল থেকে ঘোষালবাবু ক্ষণে ক্ষণে গুলি চালানোতে খানসেনাদের যাবতীয় মনোযোগ এখন সেদিকে। দু-দুটো মেশিনগানের মুখ এখন সেদিকে ঘুরে গেছে। কিন্তু অত মোটা ডালপালা সহ এই মহীরুহ একটা দুর্গের মতো ঘোষালকে আগলে রেখেছে। ওদিকে খালের ওপারে শরিফুল তার থ্রিনটথ্রি রাইফেলটা নিয়ে এমনই একটি গাছের আড়ালে অপেক্ষা করছে। একটা মেশিনগানের বেল্টে চারশোর মতো গুলি থাকে। একটা বেল্ট শেষ হলে দু-তিন মিনিট সময় লাগে নতুন বেল্ট লাগাতে। গোপেশ্বর অপেক্ষা করে আছে সেই সুযোগের জন্য। অন্ধকারের মধ্যেও পাকসেনাদের উপস্থিতি ছায়ামূর্তির মতো বোঝা যায়। ডেকের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, মাঝেমাঝে আন্দাজে গুলি চালাচ্ছে, কিন্তু নজর রাখছে তীক্ষ্ণ, একটু নড়াচড়া মানে ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। অন্ধকারের মধ্যে পাঁকালমাছের ঘাই মারার মতো একটা শরীর লাফিয়ে উঠল, আর একটি গুলিতে প্রথম বোটের গানারটাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিল। সেই ছেলেটা যে কিছুক্ষণ আগেই ওর পাইপগানটা হাতে নিয়ে দলে যোগ দিয়েছিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাকি সৈন্যদের অত্যাধুনিক অটোমেটিক রাইফেলের গুলি ওকে ঝাঁঝরা করে দিল। এই গ্রুপের প্রথম শহিদ। গোপেশ্বর অবশ্য শুনতে পেল না, মৃত্যুমুহূর্তে সে কোন শব্দ উচ্চারণ করল— ‘জয় বাংলা’ না ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। দ্বিতীয় গানার মেশিনগানের দখল নিতে না নিতেই আমগাছের পেছন থেকে ছুটে আসা জিন্নাহর রাইফেলের গুলি ওকে খতম করে দিল। এরপর বিভিন্ন দিক থেকে ছুটে আসা মুক্তিসেনাদের গুলি পাকসেনাদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। এই সুযোগে নিজের অবস্থান বদলে দ্রুত নদীর ঢালে নেমে গেল সে। এবার পাকিস্তানিরা তার সহজ টার্গেট। ওর শরীরে আটকানো আছে ন-খানা ম্যাগাজিন। স্টেনগানে একটা। আর ম্যাগাজিনভর্তি ব্যাগটা ডাঙায় পড়ে আছে। কিন্তু একটা লম্বা দড়ি দিয়ে সেটা তার কোমরের সঙ্গে বাঁধা। দরকারে দড়ি টেনে ওটা সে নিজের কাছে নিতে পারবে। অ্যাকশনের সময় সে এভাবেই রসদ নিজের কাছে রাখার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। একেবারে পালাতে গেলে ছুরি দিয়ে দড়িটা কেটে দিলেই হল। ড্রিম ড্রিম ড্রিম এক রাউন্ড গুলি ছুড়তেই পাকসৈন্যদলে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। ওরা ভাবতেই পারেনি ওইরকম জায়গা থেকে কেউ তাদের আক্রমণ করবে। গোপেশ্বর যেখান থেকে ওদের আক্রমণ করেছে সেখানে পালটা আক্রমণ সম্ভব না। এমনকি যে দূরত্বে তার অবস্থান, সেখানে একটা গ্রেনেড ছুড়তে গেলে উঠে দাঁড়িয়ে হাত পেছন থেকে টেনে আনতে হবে যা আত্মহত্যার সামিল। তাই গোপেশ্বর ঠান্ডা মাথায় হিসাব কষে সেদিকে গুলি চালাতে লাগল। দ্বিতীয় বোটের মেশিনগানের গানার এবার শেষ। ওদের বেশ কিছু হতাহত হয়েছে, কয়েকজন কাতরাচ্ছে ডেকের ওপর, বাকিরা নিচে পালিয়েছে। এই  মুহূর্তে মেশিনগান দুটো মুক! কিন্তু কায়াস মেহমুদ কোথায়, তার হাতে থাকা সেইসব আগুনে বোমা! ভাবতে ভাবতেই অন্ধকারে কয়েকটা আগুনের বুদবুদ, আর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ করে আগুনের একটি বিশাল দলা এসে গ্রাস করল পেছনের বোটটাকে।  অনেকগুলো জ্বলন্ত শরীর মরিয়া হয়ে ডাঙায় লাফিয়ে পড়ল। এদের বেশিরভাগই মুক্তিবাহিনীর গুলি খেয়ে মরল আর যাদের গুলি লাগেনি তারা কিছুক্ষণ গড়াগড়ি দিয়ে আগুন নেভানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে একসময় নিথর হয়ে গেল। বোটের খোলের ভেতরের সৈন্যরা পাগলের মতো অন্ধকারে হোলের মুখে নল ঠেকিয়ে গুলি ছুড়তে লাগল। পালটা গুলি ছুড়ে জবাব দিতে লাগল মুক্তিযোদ্ধারা। শোনা গেল ‘জয়বাংলা’ ধ্বনিও। উত্তেজিত হয়ে কেউ-কেউ নিজের পজিশন ছেড়ে বেরিয়ে এল। গোলাগুলিবিনিময়ে অবস্থা সাংঘাতিক আকারে পৌঁছে গেছে। তখনই কায়েসের ছোড়া দ্বিতীয় বোমাটা, যেটা আরও বড়, জ্বালিয়ে দিল সম্পূর্ণ গানবোটটা। প্রবল তাপে দগ্ধ সৈন্যরা তখন পালাতে গিয়ে গোপেশ্বরের স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল। সোনা মিঁয়ারও বোধহয় গুলি লেগেছে, গোঙানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এবার প্রথম গানবোটাকে জ্বালিয়ে দিলে এই যুদ্ধ শেষ। সে এবার চিৎকার করে কায়াসকে জানান দিল সেটা, কিন্তু কায়েসের থেকে উত্তর পাওয়া গেল না। প্রথম গানবোটের খোলের ভেতর থেকে পাকবাহিনী তখনও থেকে থেকে গুলি ছুড়ে চলেছে। মাত্র একটি বা দুটি মালোটভ ককটেলের অপেক্ষা, কিন্তু কায়াস মেহমুদ কীসের অপেক্ষা করছে! উৎকন্ঠা বাড়ে গোপেশ্বরের। বেশি দেরি হলে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে পারে। সে আবারও চিৎকার করে কায়াসকে ডাকে। এবারেও সাড়া পাওয়া যায় না। এবার সে তার বাকি সঙ্গীদের নাম ধরে ডাকা শুরু করল। রায়হান আর জিন্নার সাড়া পাওয়া গেল। ঘোষাল একটা গুলি ছুড়ে অস্তিত্বের জানান দিল। তার গুলিতে গানবোটের সার্চলাইটটা ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। বোঝা গেল এরা এখনও বেঁচে। কিন্তু কায়াস উত্তর দিচ্ছে না কেন! ওর কিছু হয়নি তো!

এই মুহূর্তে চরম নৈঃশব্দ্য। পেছনের বোটের সবাই মৃত, সামনের বোটের ডেকের ওপর কয়েকটা লাশ, বাকিরা খোলের ভিতরে। এ-পক্ষে শরিফুল্লা, সোনা মিঁয়া আর ওই নকশাল ছেলেটা তাহলে শহিদ হয়েছে। কতই বা বয়স হবে নকশাল ছেলেটার, বড়জোর সতেরো! ওরা ভেবেছিল দেশের শ্রমিক-কৃষকের অর্থনৈতিক মুক্তি আনবে। দেশে সাম্য প্রতিষ্ঠা করবে! কিন্তু তার চাইতেও বড় শত্রু এই উপমহাদেশে জাঁকিয়ে বসে আছে, তারা হল জাতি, ভাষা ও বর্ণবিদ্বেষ! ওরা বোধহয় এটা উপলব্ধি করতে পারেনি। তাই আগের যুদ্ধ না লড়ে পরের যুদ্ধ লড়তে নেমেছিল। কিংবা তাদের শ্রেণিযুদ্ধকে এই যুদ্ধের সঙ্গে মেলাতে পারেনি। আজকের লড়াইয়ে শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার জন্য তার প্রাণটা গেল। যদিও সে তার বিপ্লবী সাহস দিয়ে নিজে মরে এই যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে! তার ছোড়া একট গুলিই মুক্তিযোদ্ধাদের এই মুহূর্তে অনুকূল পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে! গোপেশ্বর মনে মনে ভাবে, অন্তত এসব শহিদদের রক্তঋণ শোধ করতেও তাদের এই যুদ্ধে জিততেই হবে। সে শরীরের নিচের হাফপ্যান্ট ছাড়া সব পোশাক খুলে ফেলে সারা শরীরে নদীর কাদা মেখে নিল। হাতের অস্ত্রটিকে বাগিয়ে ইঞ্চি মেপে মেপে এগোতে লাগল। এবার চুপিচুপি প্রথম গানবোটের হোলে নল ঠেকিয়ে ভেতরে ব্রাশফায়ার করার পরিকল্পনা। হামাগুড়ি দিয়ে খালের মুখে পৌঁছতেই অন্ধকারে আবার আগুনের বুদবুদ ও বিস্ফোরণ। এক-দুই-তিন বার। কিন্তু কোনওটাই বোটের ওপরে না, সব আশেপাশে! গোপেশ্বর কায়েসের উপস্থিতিতে উৎফুল্ল হয়ে চিৎকার করে বোটের ওপর বোমা ফেলতে নির্দেশ দেয়। ইতিমধ্যে সে দ্বিতীয় গানবোটের পেছনে চলে গেছে এবং সেখান থেকেই গুলি চালিয়ে প্রথম বোটের ওপরদিকের অবশিষ্ট কাচগুলো ভেঙে ফেলল। আবারও দুটো বোমা পাশের জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দিল। সে এবার শুধু অবাক নয়, বেশ বিরক্ত হয়। এবার হঠাৎই কায়েসের গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজ শোনা গেল, পাকিস্তানি ফৌজিলোগোঁ, বে আভিতক জিন্দা হ্যাঁয়, সারেন্ডর কর যাইয়ে। হাতিয়ার ডাল কর বোট সে নিকল আইয়ে। আপকে কমান্ডার লোগোঁ সব আপকো ছোড় কর ফরার হো গয়ে। হামারি ফৌজ চারোঁ তরফ সে আপকো ঘের লিয়া। আগর আপ হাতিয়ার ডালেঙ্গে তো আপকে সাথ বহি সুলুক কিয়া জায়েগা জো জেনিভা কনভেনশন কে মুতাবেক এক ফৌজি দুসরে ফৌজি সে করতে হ্যাঁয়। আপলোগ নিকল আইয়ে। হম দশ তক গিনেঙ্গে। উসকে বাদ ইস বোটকো ভি জ্বালা দিয়া জায়েগা। স্টেনগানের গুলি আর মলোটভ-ককটেল পাকিস্তানিদের বেশ চাপে ফেলে দিলেও আত্মসমর্পণ এত সহজে হত না। কিন্তু কায়াসের গুরুগম্ভীর বাচনভঙ্গি ওদের মনোবল শেষ করে দিল। চারোঁ তরফ সে ঘের লিয়া— কথাটি যুদ্ধের কৌশল হলেও বাস্তবে তা ঘটেও গেল। কেউই টের পায়নি, ক্যাপ্টেন সাজিদ হোসেনের নেতৃত্বে অনেক অস্ত্র নিয়ে কয়েকটা লম্বা নৌকোতে চেপে জনাচল্লিশ মুক্তিযোদ্ধা এপারে এসে হাজির। ওদের হাতে তিনব্যাটারি চারব্যাটারির লাইটগুলো সব জ্বলে উঠতেই পরিবেশ একদম বদলে গেল। কায়াস এক দুই করে গুনতে শুরু করতেই বোট থেকে সাদা পতাকা উড়ল, একে একে নয়জন পাকসৈন্য হাতিয়ার ছুড়ে দিয়ে নিচে নেমে এল।

—অন্দর মে ওর কোই হ্যাঁয় ক্যা?

কায়াসের প্রশ্নে মৃদুস্বরে একজন উত্তর দেয়, জী, দো বঙ্গালি বন্দে হ্যাঁয়।

পাকিস্তানির কথা শেষ হতে না হতে ভেতর থেকে আলাউদ্দিনের কণ্ঠ ভেসে এল—

—আমি আর দানু মিঁয়া আছি এইহানে। আমগো ছাড়ান দেওন লাগব। আমার লগে মশকরা কইরো না। তোমাগো আমানত আমার কাছে আছে।

বোটের ভেতর থেকে মহিলার চিৎকার শোনা গেল! সর্বনাশ, এ তো ঘোষালকাকুর বড় মেয়ের গলা! মানে মেয়েদুটোকে নিজের হেফাজতে রেখেছে শয়তানটা! এখন দরকষাকষি করে পালাতে চাইছে। গোপেশ্বরের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সালাউদ্দিনের কথাও মনে পড়ল। চিৎকার করে বলল,

—এই হারামজাদা, বেশি চালাক হইসস! পেচাল পারিস না। ভালোয় ভালোয় সারেন্ডার কর।

একটু চুপচাপ থেকে আলাউদ্দিন উত্তর দিল,

—আমি কোনও মালাউনের কাছে সাইরেন্ডার করুম না। তোর কিছু করার নাই রে, হালা। আমি মরলে এই মাল দুইটাও জাহান্নামে যাইব। ভালোয় ভালোয় যাইতে দে আমারে। নাইলে যা করার এই বোটের মইধ্যেই কইরা দিমু। অগোরে এহনো কিন্তু কেউ ছোয় নায়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিরিগেডিয়ার সাহেবের জইন্য রাহা আছে।

আলাউদ্দিনের কথা শেষ হওয়া মাত্র প্রায় একই সময়ে মুরগি জিন্না আর রফতান গর্জে উঠল প্রায় একইরকম ভাষায়—

—এই শুয়োরের বাচ্চা, বড় মুরুব্বি হইছস! মাইয়া মানুষেরে আটকাইয়া রাইখা আমাগো চ্যালেঞ্জ দেস! যদি মুসলমানের বাচ্চা হস, আর তোর যদি হিম্মত থাহে খালি হাতে লড়, দেহি আল্লা তোরে রাহে না আমাগো।

কথা বলতে বলতে দুজনেই হাতিয়ার ছুড়ে দিয়ে এগিয়ে গেল বোটের দিকে, আর পরপর দুটি মাত্র গুলি ওদের দুজনকেই শহিদ বানিয়ে দিল।

ভেতরে আবার মেয়েদের আর্তচিৎকার শোনা যায়, আবার আলাউদ্দিনের কন্ঠ শোনা যায়,

—অহনো কই, আমাগো ছাড়ান দে। মাইয়া দুইডা বাঁচব।

ঘটনাটা সাময়িকভাবে সবাইকে নিথর করে দিয়েছিল। এরপরেই গোপেশ্বর যেন পাগল হয়ে গেল। স্টেনগানটি তুলে নিয়ে পাগলের মতো বোটের ওপর সমানে গুলি ছুড়তে লাগলো। গুলিগুলো সবই বোটের লোহার শরীরে প্রতিহত হয়ে ছিটকে ছিটকে যেতে লাগল। ক্যাপ্টেন সাজিদ তাকে কোনওক্রমে নিরস্ত করল, কারণ এতে বিনা কারণে গুলিখরচ এবং মেয়েদের শরীরেও গুলি লাগার সম্ভাবনা! আবেগ দিয়ে যুদ্ধ হয় না। সে বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দিল বোটটাকে ঘিরে নিতে, যাতে কেউ পালাতে না পারে। ইতিমধ্যে আত্মসমর্পণকারী পাকসেনাদের নৌকায় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও অনেকেই খেয়াল করল না, কায়াস মেহমুদ হামাগুড়ি দিয়ে বোটের পেছনে গিয়ে চুপচাপ বোটে উঠে সেঁদিয়ে গেল নিচে। ভেতর থেকে প্রবল ধস্তাধস্তি, চিৎকার, গোঙানির আওয়াজ ও মহিলা কণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে এল। ধস্তাধস্তির প্রবল অভিঘাত বোঝা গেল বোটের দুলুনি দেখে! পরপর দুটি গুলির আওয়াজ, তারপর এক অনন্ত নৈঃশব্দ্য। কয়েকটি মিনিট যেন কতটা সময় ধরে অতিবাহিত হল। আসলে যুদ্ধের মধ্যে যখন জীবন আর মৃত্যু পাশাপাশি দৌড়োতে থাকে, তখন সব ঘটনাই যেমন আকস্মিক মনে হয়, তেমনি প্রতিটি মুহূর্তকেই এক-একটা যুগ বলে মনে হয়।

এই মুহূর্তে গোপেশ্বরের দলে তাকে ছাড়া বেঁচে আছে শুধু কায়াস আর ঘোষালকাকু। এই কয়েক মিনিট আগেই তার চোখের সামনে অত্যন্ত বিশ্বস্ত দুই সঙ্গীর মৃত্যু দেখতে হয়েছে। এই বোটের ভেতরে শেষ পর্যন্ত কী হল, কারা মারা গেল তা সে বুঝতে পারে না। মেয়েদুটোর কী হল! তাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখায়। কিন্তু ঘটনা তার নিজের মতোই ঘটে যায়। একটার চেয়ে আরেকটি যেন বেশি আকস্মিক, অনভিপ্রেত! মুক্তিবাহিনীর লোকজন ইতিমধ্যে আরও একটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে। নানান সুরক্ষিত জায়গা থেকে তারা আলো ফেলতে লাগল। ক্যাপ্টেন সাজিদ তাকে মাটিতে শুইয়ে চেপে ধরে রেখেছে। এক দমবন্ধ করা পরিবেশ। হঠাৎ দেখা গেল রক্তমাখা শরীর নিয়ে কায়াস মেহমুদ নিচের খোল থেকে বোটের ডেকে উঠে আসছে, মুখে স্মিত হাসি। আর তার পরেই ঘটে গেল এই ঘটনাপরম্পরার সবচাইতে বেদনাবিধুর, আফশোসপূর্ণ বিয়োগান্তক অধ্যায়টি। সেই মোটা শিরীশগাছের আড়াল থেকে একটা মোটা ব্যারেলের গুলি এসে কায়েসের কলিজাটাকে স্রেফ দু-ভাগ করে দিল। পেছনেই ঘোষালের বড় মেয়ে উঠে আসছিল। কায়েসের নিথর শরীরটা তার ওপরে ঢলে পড়ল। উলটোদিক থেকে— শালা পাকিস্তানি, বেইমানের বাচ্চা— বলতে বলতে ঘোষালকে দেখা গেল ছুটে আসতে। এতক্ষণ এই যুদ্ধে তার ছোড়া গুলিতে ঠিক কতজন পাকিস্তানি হানাদার মারা গিয়েছিল তা তো বোঝা যায়নি, কিন্তু নির্ভুল নিশানায় কায়াস মাহমুদের হৃদয় দু-ফাঁক করে দিয়ে সে প্রবল উল্লসিত। তবে তার এই উল্লাস দীর্ঘস্থায়ী হল না। তার ছোটমেয়ে বড়টির পেছনেই ছিল, দৌড়ে এসে পাগলের মতো তার বাবার বুকে কিল মারা শুরু করল, মুখে বিলাপ। বাবাগো তুমি এইটা কী করলা! এই মানুষটাই তো শয়তান দুইটারে মাইরা আমাগো ইজ্জত বাঁচাইল। বিহ্বল ঘোষালের শরীরটা কেমন যেন মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল। হাত থেকে বন্দুকটা পড়ে গেল। সে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আর তার মেয়ে তার বুকে কিল মেরেই যেতে লাগল।

সাইকেলভ্যানটা খুব আস্তে আস্তে চলছিল। ইন্ডিয়ার করিমপুরের সীমানা এখনও বেশ কিছু কিলোমিটার দূরে। ঘোষাল এই দুটো দিন প্রায় কিছুই মুখে দেয়নি। মেয়েদের অবস্থাও একইরকম। শেষে প্রায় জোর করেই ক্যাম্প ইনচার্জ শফিউদ্দিন ওদের কিছু খাওয়াতে পেরেছিল। মেয়েদুটো সেই থেকে কেঁদেই চলছে। গোপেশ্বর এই দুদিনে কায়েসের রোজনামচাটি পড়ে নিয়েছে। কিছুটা ইংরেজি, কিছুটা উর্দু। ইংরেজি অংশ থেকে জানা গেল তার ঠাকুরদাদা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে শহিদ হয়েছিলেন, তার বাবাও ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, জেল খেটেছিলেন, ছিলেন ভগৎ সিং-এর অনুগামী। দেশভাগের দাঙ্গায় ওদের সব হারিয়ে জলন্ধর ছেড়ে লাহোরে চলে যেতে হয়েছিল। কী অদ্ভুত মানুষের সমাজ! গোপেশ্বর মনে মনে ভাবে দেশ স্বাধীন করেও স্বাধীনতার সৈনিকরা দেশে থাকতে পারে না! বিদেশি শাসক ছেড়ে গেলেও দেশ ভেঙে যায় নিজেদের জাতি বর্ণ বিবাদে!

দেশ কি আবার ভাঙতে চলেছে! সে জানে না জয় বাংলা হবে কিনা, পাকিস্তানি মিলিটারিরা আরও কতদিন এখানে তাণ্ডব চালাবে, তাও সে জানে না। এই যুদ্ধে শেষপর্যন্ত বাংলার মানুষের জয় হবে কিনা তাও পরিষ্কার নয়। কিন্তু সে জানে এ দেশ তার নিজের দেশ। এ দেশের জল, বায়ু, রং, গন্ধ সব মিশে আছে তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে। তার চোদ্দপুরুষের ঠিকানা এ দেশ। এই ঠিকানা কি হারিয়ে যাবে চিরতরে! যে-সব বন্ধুরা তার পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করে জীবন দিল, তাদের আত্মা কি খুঁজে বেড়াবে তাকে এ-দেশের খাল, বিল, মাঠ ময়দানে! ঘোষালকাকুর মেয়েরা ইঙ্গিতে জানিয়েছে তারা এ-দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে চিরতরে। ইন্ডিয়াতে ওদের আত্মীয়রা রয়েছে বরানগর আর ঢাকুরিয়াতে। সম্ভবত সেখানেই যাবে প্রথমে। গোপেশ্বরের বুকপকেটে ক্যাপ্টেন সাজিদের লেখা চিঠিটা খানিকটা বেরিয়ে আছে। কোচবিহারে জেনকিং স্কুলের সহপাঠী চঞ্চল মুখার্জিকে লেখা। তিনি এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার, ফোর্ট উইলিয়ামে ইস্টার্ন কমান্ডে কর্মরত। গোপেশ্বরকে সাহায্য করবেন কলকাতায় সেটেল্ড হতে, ভারতীয় ক্যাম্পে ওর বিধবা মা আর ছোটবোনকে খুঁজে পেতে— এমনটাই অনুরোধ চিঠিতে। সে পকেট থেকে চিঠিটা বের করে ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিল, এক লাফে ভ্যান থেকে নেমে জোরকদমে উলটোদিকে হাঁটতে লাগল…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...